সিঙ্গেল মাদার পর্ব ১০

#সিঙ্গেল_মাদার
ফাবিহা ফারিন প্রিয়ন্তী
পর্ব: ১০

দিনটা ব্যাস্ততার মাঝে কাটলো ইরিনের সৌমিকের ঠিকানা জোগাড় করতে বেশ কাঠ খড় পোড়ানো লাগলো ।
সম্পূর্ণটা সময় রাহাত ওকে সাপোর্ট দিয়ে গেছে ।

ইরিন করুন ভাবে রাহাত কে জিজ্ঞেস করলো-

– ভাইয়া ঠিকানা তো পেলাম এখন ওখানে গিয়ে ওকে পাবো তো ??

ইরিন যেন একটা আশ্বাসের বাণী শুনতে চাইছে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে ।
ইরিনের প্রশ্নে রাহাতের যেন বুকটার মধ্যে একটা হাহাকার করে উঠলো মনে হলো হয়তো চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসবে কিন্তু পুরুষ মানুষের তো কাঁদতে মানা , নিজেকে সামলে বললো
– বোন আমার এতো টেনশন কেন করছিস বল তো‌ , সৌমিককে আমরা ঠিক পেয়ে যাবো ।
হয়তো শালা বাড়ি গিয়ে বসে আছে আর আমাদের এতো টেনশন দিচ্ছে ।

ইরিনের চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো মুছে নিয়ে বললো- “ভাইয়া তোমার কথাটা যেন সত্যি হয়” ।

ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট ক্রস করছিল হঠাৎ ইরিনের গা গুলিয়ে এলো বুঝতে পারলো বমি করবে- “ভাইয়া আমার পানি লাগবে বমি পাচ্ছে খুব”

-“ইরিন তুই এখানে একটু বস আমি যাবো আর আসবো” বলেই রাহাত দৌড় দিয়ে ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেল ।

ইরিন গাছের ছায়ায় বসে বসে ভাবছিল- রাহাত যেন ঠিক তার নিজের ভাইয়ের মতো দায়িত্ব পালন করছে ।
সবসময় কেমন যেন একটা স্নেহের পরশে আগলে রেখেছে । একটু সময়ের জন্য ও বিরক্ত প্রকাশ করে নি ।

” ক্যাম্পাস গুলো বড্ড অদ্ভুত জাদুকরী মঞ্চ , কিছু দিতে পারুক আর না পারুক কিছু রক্তহীন সম্পর্কের আত্মিক বন্ধনের জন্ম দেয়” ।

কিছুক্ষণ পরেই এক বোতল পানি নিয়ে হাজির হলো রাহাত ।

রাহাত ইরিন কে প্রীতিলতা হলে পৌঁছে দিয়ে ওর হলে ফিরে গেল ।
রাহাত আনমনে ভাবছিল আদৌ কি সৌমিককে ওখানে পাওয়া যাবে ইরিন কে মিথ্যে সান্তনা দিয়ে এলাম, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “কোথায় হারিয়ে গেলি সৌমিক” !

ইরিন হলে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো । আলো আর মিথি ক্লাসে গেছে ওরা ফিরবে ২টার দিকে ।

– ইরিন তোর শরীর টা এখন কেমন আছে ?
– “আশা আপু বসো , আর শরীর জীবনটাই তো ফিকে হয়ে গেল, কি দোষ করেছিলাম যে সেই ভুলের সাজা পাচ্ছি আমি আপু ! ” ইরিন আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো ।

– ইরিন শান্ত হ বোন এভাবে ভেঙে পড়লে হবে বলে তো ?? তোর মাঝে যে এখন একটা নতুন অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে তার জন্য হলেও তোকে ধৈর্য্য ধরতে হবে ।

– আমি শুধু বাচ্চার কথা ভেবেই বাড়ি ছেড়েছি আপু আজ কতোটা দিন হলো সৌমিককে দেখি না , জানিনা কোথায় , কেমন , কি অবস্থায় আছে কিছুই জানি না কিভাবে আর আমি ধৈর্য্য ধরে থাকবো ।

– ইরিন জানিস না আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের বড় বড় বিপদের মাধ্যে দিয়েই ঈমানের পরীক্ষা নেই তোর ও পরীক্ষা নিচ্ছে আল্লাহ একটু ধৈর্য্য ধারণ কর বোন , সব ঠিক হয়ে যাবে ‌।

ইরিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে যাচ্ছে ‌।

– তোর তো বরিশাল যাওয়ার কথা সৌমিকের বাসায় তার কিছু হলো ?

– হুম আপু ঠিকানা এনেছি কাল ভোর ভোর বেড়িয়ে যাবো আমি আলো আর মিথি ।

– আচ্ছা আমার কোনো সাহায্য লাগলে বলিস , আর এখন একটু রেস্ট নে আমি এখন যায় একটু বাইরে যাবো ‌।

ফোনটা বেজে উঠলো ইরিনের সকাল থেকে বাড়ি থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছে করেই ফোন উঠাচ্ছে না ইরিন ।
এবার রিসিভ করলো

– হ্যালো
– ইরিন তুই আমাদের একটু ও ভালোবাসিস না , একটু ও গন্য করিস না পারলি কিভাবে আমাদের এভাবে না বলে চলে যেতে ? আমাদের কি একটুও চিন্তা হয় না তোর জন্য বল তো ?

– মা তুমি তোমার মেয়ের কথা ভেবেছো আর আমি আমার বাচ্চার কথা ভেবেছি , কোথায় ভুল করেছি মা ??

– শাহানা বেগম চেঁচিয়ে বলে উঠলো তুই কার সন্তান আকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছিস ইরিন যে ছেলেটা তোকে ব্যাবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে !

– মা এভাবে বলবে না প্লিজ সৌমিক খারাপ ছেলে না ও আমাকে ব্যাবহার করতে চাইলে বিয়ে না করেই ব্যবহার করতে পারতো কিন্তু তেমন টা তো করেনি মা , কেন অযাথা ভুল বুঝছো ??

– ওসব ফর্ড ছেলেরা একটা কেন চারটা বিয়ে ও করতে পারে , ইরিন তুই কি নিজের ভালোটা বোঝার চেষ্টা করবি না , কি হবে তোর ভবিষ্যত ?

– না মা আমি ভাবছি না , সৌমিক যদি না ও ফেরে আমি আমার সন্তানকে আকড়ে ধরে বাঁচবো , তবুও আমি ওকে নষ্ট করার কথা ভাবতে পারি না ।

– তুই বাড়ি ফিরে আই ইরিন !

– না মা আমি আমার বাচ্চাটা কে হারাতে চাই না , ভালো থেকো বাবা কে বলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে অনেক বড় অন্যায় করেছি বাবার সাথে , তোমাদের বাড়ি হয়তো আর ফিরবো না ‌আমার বাড়ি টা হারিয়ে ফেলেছি ।
বলেই ইরিন ফোন টা কেটে দিল ।

নিজেকে এখন শক্ত করতে হবে , সবার সামনে প্রমাণ করতে হবে আমার সৌমিক খারাপ ছেলে না ওকে খুঁজে বের করতেই হবে ।
ইরিন পেটে হাত রেখে বললো- “পুচকু তোর বাবা কে আমি খারাপ হতে দেব না কারোর কাছে” ‌।

রাহাত কে দিয়ে তিনটা টিকিট কাটিয়ে আনলো ইরিন , সকাল ১০ টাই বাস ।

– বের হওয়ার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ করে মিথি অসুস্থ হয়ে পড়লো ।
ভিষণ পেটে ব্যাথা উঠতে পারছে না , মিথির অসুস্থতায় ইরিন একটু ঘাবড়ে গেল ।
মিথি আর আলো সাথে থাকলে ইরিন ভয় পায় না কোনো কিছু করতে কিন্তু অপরিচিত একটা জায়গায় ও আর আলো একা যাবে এটা ভাবতেই একটু মন খারাপ হয়ে গেল কিন্তু সাহস নিয়ে বললো
– এভাবে তো তোকে নিয়ে যেতে পারবো না তুই বরং থাক আমি আর আলো বের হয়ে যায় ।

মিথি ব্যাথায় কাতরাচ্ছে তবু বললো- “তোরা রাহাত কে নিয়ে যা ও গেলে তোর বেশ উপকার হবে ” ।
– না রে তুই এখানে একা রাহাত ভাই থাক আমি আর আলো বের হচ্ছি ।

ইরিনের ফোন টা বেজে উঠলো ফোন বের করে দেখলো আতিক ফোন দিয়েছে ।
– আসসালামু আলাইকুম নিউরোলজিস্ট বাবু বলুন !

– ওয়ালাইকুমুস সালাম , কেমন আছেন আপনি ?

– এইতো এখন বের হচ্ছি বরিশাল যাওয়ার জন্য ।

– কে কে যাচ্ছেন ?
– আমি আর আলো ।
– মিথি ?
– না ও যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু হঠাৎ ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই ওকে আর নিয়ে যেতে পারছি না ।
– মিথির টিকিট কি কেটেছিলেন ?
– হুম ।
– আচ্ছা আমি যেতে চাই আপনাদের সাথে যদি কোনো সমস্যা না থাকে ।

– ইরিন একটু ইতস্তত বোধ করে বললো “আপনি সত্যি যাবেন” ??
– আমি তো বলেছিলাম আমি সৌমিককে খুঁজতে আপনাকে সাহায্য করবো তাহলে সত্যি মিথ্যের কি আছে ।

ইরিন আর কথা বাড়ালো না মনে মনে ভাবলো‌ নিউরোলজিস্ট বাবু সাথে থাকলে ভালোই হবে রাহাত ভাইয়া আর মিথি কেউই তো যেতে পারছে না ।

– “আচ্ছা তবে আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন বাস স্ট্যান্ডে” ।
বলেই ফোন রেখে ওরা ফাইনালি বের হয়ে পড়লো ।

পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেকটা রাত হয়ে গেল , সারাদিনের জার্নিতে ইরিন একদম ক্লান্ত ।
– নিউরোলজিস্ট বাবু আমার আর ভালো লাগছে না বড্ড ক্লান্ত লাগছে ।
– আপনার এখন এতোটা জার্নি করা একদমই ঠিক হয় নি কিন্তু শুনলেন কোথায় ।
– আচ্ছা আতিক ভাইয়া আমরা বরং এখন কোনো হোটেলে উঠি রাত হয়ে গেছে কাল সকালে না হয় নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছানো যাবে ।
– আচ্ছা তবে সেটাই ভালো হবে ।
ইরিন আর না করলো না ।
একটা হোটেলে দুই রুম নিয়ে নিলো। খাওয়া দাওয়া করে ইরিন আর আলো এক রুমে চলে গেল আর আতিক অন্য রুমে চলে গেল ।
সারাদিনের ক্লান্তিতে আলো খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো ।
ইরিন লাইট টা অফ করে জানালার পাশে মোড়া নিয়ে বসলো বাইরে চাঁদের আলো ইরিনের মুখে এসে পড়ছে।
একটা ঠান্ডা শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেল , পরম আবেশে ইরিন চোখ বন্ধ করে ফেলল হঠাৎ মনে পড়ে গেল –

সৌমিকের বাহুডোরে শুয়ে ইরিন বললো
– সৌমিক আমাকে সাতলা গ্ৰামে শাপলা বিলে নিয়ে যাবে ?
– হঠাৎ আমার বউ টার শহর ছেড়ে বিলে যেতে ইচ্ছে হলো যে ?
– বা রে আমি কি অন্য কোথাও যেতে চাইছি নাকি আমি তো তোমার শহরে যাবো ‌।
– উঁহু ওটা তোমার ও শহর হবে ।
– আচ্ছা বলো না নিয়ে যাবে তো ?
– আমার বউ বাইনা করেছে আর আমি পূর্ণ করবো না !
– আচ্ছা শোনো আমারা পূর্ণিমার রাতে যাবো ।
– তাই হবে আমরা পূর্ণিমার রাতেই ওখানে নৌকায় করে ক্যাম্পে যাবো । কিন্তু বউ ওখানেই কেন যেতে ইচ্ছে হলো ?
– আমার শাপলার বিল দেখার অনেক শখ আর সেটা যদি হয় প্রিয় মানুষের প্রিয় শহরে তবে তো কথাই নেই ।

– চুল গুলো তো বিলি কেটে দিতে দিতে বললো সৌমিক “আচ্ছা তবে তোমাকে শাড়ি পরে যেতে হবে একটা লাল রঙা শাড়ি , চাঁদের আলোয় শাপলার মাঝে আমার লাল টুকটুকে বউ টা কে দেখতে চাই” ।
– ইরিন সৌমিকের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে বললো “পাগল একটা ” ।
হঠাৎ বাতাসে জানালা বন্ধের শব্দে ইরিনের চোখ খুলে গেল ।
ইরিন চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো “সৌমিক আজ আমি তোমার শহরে পূর্ণিমার রাতে প্রবেশ করেছি কিন্তু কোথায় তুমি ! এই শহর টা বড্ড ফাঁকা তুমি ছাড়া , আমার যে এখনো একটা পূর্ণিমার রাতে শাপলার বিলে লাল শাড়ি পড়ে ক্যাম্পিং করা বাদ আছে , ফিরে এসো সৌমিক আমি তোমার অপেক্ষায় ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here