সিঙ্গেল মাদার পর্ব ১১

#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব:১১

ভোর ভোর সবাই উঠে পড়লো , নাস্তা করেই বেড়িয়ে পড়লো সৌমিকের বাড়ির উদ্দেশ্যে ।
ইরিন এক মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে যেন সে বাড়ি গিয়ে সৌমিক কে দেখতে পায় ।
একটু অভিমান সে ও জমিয়ে রেখেছে খুব সহজে একদম মন গলাতে পারবে না অভিমানের পসরা সাজিয়ে চলেছে , ইরিন ভেবেই নিয়েছে সে‌ সৌমিকের দেখা পাবে ।

ঘন্টাখানেক পর ওরা গিয়ে দাঁড়ালো একটা খয়েরী রঙের গেটের সামনে , গেটের মাথার উপর বেশ কিছু মাধবীলতা ফুল ঝুলে আছে । কেমন যেন একটা প্রশান্তি ভাব ।
ইরিন ভয়ে ভয়ে কলিং বেলে হাত দিল ।
কলিং বেল বাজাতেই এক অর্ধবয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এলেন চোখে‌ মুখে গাম্ভীর্যতা ফুটে উঠেছে ।

– কাকে চাই ?

আতিক বলে উঠলো
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি এটা কি সৌমিকের বাসা ??
– হুম কিন্তু কেন ?
– আন্টি আমরা সৌমিকের বন্ধু, আমরা একটু ভেতরে আসতে পারি
– আচ্ছা আসো ।
বলেই ওদের বসার ঘরে নিয়ে এলো ।
আলো এতোক্ষণে বলে উঠলো “কেমন আছেন আন্টি ?

– ভালো তুমি কেমন আছো ? আর তোমাদের পরিচয় দাও , আমি তো কাউকেই চিনতে পারছি না ।

ইরিন বসে থেকেও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে , সৌমিককে দেখতে না পেয়ে আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না জিজ্ঞেস করল
-“আন্টি সৌমিক আছে ? কোথায় ও একটু ডেকে দিন প্লিজ” !

এতোক্ষণে আরিফা বেগম খেয়াল করলো ছিপছিপে গড়নের এক মেয়ে চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ ।

ইরিনের এমন‌ কথায় একটু অবাক হলেন, আরিফা বেগম জিজ্ঞেস করল
– সৌমিক কে কেন খুঁজছো ?
– আমার ‌খুব প্রয়োজন আন্টি আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না ।
– কিসের ধৈর্য্য ?
ইরিন কান্না করে বললো
– ওকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না আন্টি !
– বলছো টা কি , আমার ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে ! কোথায় আমার ছেলে ??

আতিক বলে উঠলো

– আন্টি সৌমিক এখানে আসে নি ?

– না আসে নি তো , কি হয়েছে আমার ছেলেটার ।
আরিফা বেগম উতলা হয়ে উঠলেন , সৌমিকের বাবা ছুটে বেরিয়ে এলেন আরিফা বেগমের এমন উতলা অবস্থা দেখে ।

– কি হয়েছে আরিফা তুমি এমন করছো কেন ?
– ওগো শুনছো আমার ছেলেটাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওরা সৌমিকের ভার্সিটি থেকে এসেছে । বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন ।

– আহা আরিফা থামো আমাকে শুনতে দাও ওদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ টা ।

– সৌমিকের কি হয়েছে বলো তো ? কবে থেকে পাওয়া যাচ্ছে না ?

– আলো বললো “আঙ্কেল সৌমিক ভাইয়া আজ প্রায় এক সপ্তাহ যাবত নিখোঁজ , আমরা ভেবেছিলাম কোথাও কোনো কাজে আটকে আছে হয়তো বা বাড়ি এসেছে , আমরা সবাই খুঁজেছি সব জায়গায় কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না” ।

– তোমরা আমাদের জানাও নি কেন ?

– আঙ্কেল এমন যে পাওয়া যাবে না আমরা তো ভাবিই নি , যখন সব জায়গায় খুঁজে আর কোথাও পেলাম না তখন এখানে শেষ ভরসা করে এসেছিলাম ।

– “আলো আমার সৌমিক কে কোথায় পাবো আমি আমি যে আর পারছি না রে ” ।

হঠাৎ ইরিনের এই কথায় আরিফা বেগম একটু থামলেন ।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন
– সৌমিকের সাথে তোমার কিসের ‌সম্পর্ক ?

– সৌমিক আমার আমার স্বামী আমি সৌমিকের সন্তানের মা হতে চলেছি ।

আরিফা বেগম যেন একটু কঠোর রূপ নিলো – “তোমার সাহস তো কম নয় আমার ছেলের সম্পর্কে যা নয় তা বলে যাচ্ছো” !
এবার সৌমিকের বাবা কথা বলে উঠলেন-
– এই মেয়ে কে তুমি ??

ইরিন দাঁড়িয়ে পড়লো আশরাফ আলীর সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে বললো –

– আঙ্কেল বিশ্বাস করুন আমি সৌমিকের বিবাহিতা স্ত্রী ।

– তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে আমার ছেলে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করবে , সৌমিক ভদ্র পরিবারের সন্তান । ওর অনুপস্থিতিতে যা নয় তা বলে যাচ্ছো ।

আলো উনার ধমকানি শুনে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
– আঙ্কেল ইরিন সত্যি বলছে ওর আর সৌমিক ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে ।
আরিফা বেগম ধমকে উঠলো আলো কে
– “এই মেয়ে তুমি থামো এখন তো দেখছি তোমরা সবাই এক পথের পথিক , আমি মা হয়ে জানতে পারলাম না আমার ছেলে বিয়ে করেছে ।
আতিক আর চুপ থাকতে পারলো না ইরিন আর আলো কে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করছে সৌমিকের বাবা-মা”।

– আঙ্কেল আন্টি আপনারা দয়া করে থামুন , কোনো মেয়ে যতোবড় মিথ্যে কথাই বলুক না কেন তার সতীত্ব আর সম্মান নিয়ে মিথ্যে কোনো মেয়েই বলার সাহস রাখে না ।

আরিফা বেগম ধমক দিয়ে বললো “তুমি থামো বাপু কোথায় থেকে না কোথায় থেকে পেট বানিয়ে নিয়ে এসে আমার ছেলের দোষ দিচ্ছে খারাপ মেয়ে একটা ।
আর তুমি কে হও ঐ মেয়ের ?

– আমি ওর বন্ধু ।

– মেয়ে মানুষের আবার ছেলে বন্ধু কিসের ,মেয়ে বন্ধু কি ছিল না যে তোমাকে আসা লেগেছে সব বুঝি খারাপ মেয়ে একটা ।
শোনো মেয়ে আমার ছেলেকে যদি না পাই না তবে থানায় তোমার নামে মামলা করবো ।

– আশ্চর্য আপনি কি পাগল হয়েছেন নাকি আমাকে আর ইরিন কে জড়িয়ে খারাপ কথা বলছেন , আমরা সৌমিক কে খুঁজতে এসেছি আর আপনি কি না এসব শোনাচ্ছেন ।

ইরিনের সব কথা শুনে মনে হলো যেন পায়ের নিচের মাটি একদম সরে গেল আকাশটাই তার মাথায় ভেঙ্গে পড়লো । মাথা টা একটু ঘুরে গেল পড়ে যেতে গেলে আলো আর আতিক ধরে ফেলল ।
– অপরিচিতা আপনার শরীর খারাপ করছে ! আপনি বসুন ।
– না নিউরোলজিস্ট বাবু ।

কান্না করতে করতে বললো ইরিন-
– “আমি আপনার ছেলের বিবাহিতা স্ত্রী , আর আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে আপনার ছেলের রক্ত ।
অন্য কারোর সাথে যদি রাত কাটিয়ে বেড়ানোর হতো আন্টি আজ অন্তত এই সন্তান গর্ভে জায়গা পেত না , আমাকে এই সন্তান বাঁচানোর জন্য নিজের বাড়ি থেকে পালাতে হতো না ।
আজ আপনি আমার গায়ে যে কলঙ্কের দাগ দিচ্ছেন আপনার ছেলে এসে তা প্রমাণ করে দেবে” ।

“নিউরোলজিস্ট বাবু এখানে আর এক মুহূর্ত ও না আমার সৌমিক কে আমি খুঁজে এনেই তাদের সামনে দাড়াবো তার আগে আর না”।

ইরিন কান্না করতে করতে আতিক আর আলো কে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলো ।
চট্টগ্রামের বাসে উঠে পড়লো সারা পথে ইরিন আর চোখ বন্ধ করতে পারলো না কান্নার ফোয়ারা নেমেছে চোখ জুড়ে ।

মাঝে কেটে গেল বেশ কিছু দিন অথচ সৌমিকের কোনো খোঁজ নেই থানায় গিয়ে এফ আই আর করে এসেছে পুলিশের বারান্দায় নিয়ম করে ঘুরে যাচ্ছে ইরিন ।
পুলিশ খুঁজছে তবুও কোনো রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছে না ।
এর মাঝে সৌমিকের বাবা মা এসে অযাথা কারণে ইরিন কে শাশিয়ে গেছে ।

আস্তে আস্তে চার মাসে পা দিয়েছে ইরিনের গঠনের পরিবর্তন হচ্ছে ক্লাস মিস যাচ্ছে , পড়া লেখায় মন নেই ।
বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে ।
ক্যাম্পাসে যাওয়া লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কেউ দেখলে এখন টিটকারি দিতে ছাড়ছে না , ইরিন বুঝতে পারছে বাইরের পৃথিবীটা ঠিক কতোটা কঠিন আর নির্মম একটা সিঙ্গেল মাদার এর জন্য এই পৃথিবীটা বড্ড ভয়ঙ্কর ।

“একটা মেয়ে যখন মা হয় আল্লাহ পাক হয়তো তার মধ্যে অসাধারণ কিছু গুণ আর ধৈর্য্য ক্ষমতা দিয়ে দেন” ।
চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here