পর্বঃ৩১
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
…
রাইদার ঘুম ভাঙে ফোনের ভাইব্রেশনে। চোখ বন্ধ করে বালিশের পাশে ফোনটা খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়। শেষে চোখ জোড়াকে জোর করে ঘুমের রাজ্য থেকে বের করে ফোন খুঁজতে থাকে। ডান পাশে ঘুরে দেখে ফোনটা সায়নের শোয়া বালিশ আর তার শোয়া বালিশের মাঝে। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা নিয়ে দেখে অর্ক কল দিয়েছে। কল রিসিভ করার পূর্বেই কলটা কেটে যায়। বিরক্ত হয়ে অর্ককে কল দেয় কিন্তু দেখে ফোনের ব্যালেন্স শেষ।
শোয়া থেকে উঠে বসতে নিলে রাইদার পরিহিত টি-শার্ট টান লাগে। চোখের পলক কয়েকবার ফেলে রাইদা তাকিয়ে দেখে সায়ন তার টি-শার্টর একটা অংশ খামচে ধরে ঘুমাচ্ছে। সায়নের মুখের দিকে তাকিয়ে রাইদা সায়নকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
ঘুমানো অবস্থায় সায়নকে একদম ছোট বাচ্চার মতো লাগছে। এক হাত দিয়ে কোল বালিশ জড়িয়ে রেখেছে অপর হাত দিয়ে রাইদার টি-শার্ট খামচে ধরে রেখেছে। সায়নের ঘুমন্ত মুখ দেখে রাইদার মনে সুপ্ত ইচ্ছে জাগে।সায়নের হাত নিজের টি-শার্ট থেকে ছাড়িয়ে বিছানায় রাখে এরপর সায়নের দিকে ঝুঁকে সায়নের নাকের ডগায় আলতো করে দাঁত বসায়। ঘুমের মধ্যে সায়নের চোখ মুখ বিরক্তে কুঁচকে আসে। রাইদা এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে বোঝার চেষ্টা করে সায়নের ঘুম ভেঙেছে কিনা। বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমন্ত সায়নের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দেয় রাইদা। মিনিট পাঁচেক পর বুঝতে পারে সায়ন গভীর ঘুমে তাই নিশ্চিন্তে চলে মুখ ধুতে।
বাথরুম থেকে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রাইদা বের হয়। বারান্দায় তোয়ালে রেখে বিছানার দিকে তাকালে দেখে সায়ন এখনো আগের মতো ঘুমাচ্ছে তবে বালিশে মুখ গুঁজে আছে আর সে যেখানে শুয়ে ছিলো সেখানে হাত বাড়িয়ে তার গায়ে দেওয়ার চাদর মুঠো করে রেখেছে, রাইদা বুঝতে পারে তার টি-শার্ট ভেবে চাদর মুঠো করে রেখেছে সায়ন। রাইদার কেনো জানি হাসি পায় সায়নের এমন কাজে।
‘এখনো ঠিক সেই স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের মতো কাজ করে। আট বছর আগে যেমন ছিলো এখনো ঠিক তেমনই পাগলামি করে। এই পাগলামি শেষে আপনার কষ্টের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সাবধান ইমতিয়াজ সায়ন। সরি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না কিন্তু কি করবো বলেন আপনি যা করেছেন তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।’
এতক্ষণ ঘুমন্ত সায়নের কাজগুলো রাইদাকে হাসালেও হুট করে পূর্বের কথা মনে পড়ায় রাইদার হাসিমুখ মিলিয়ে যায়।
আলমারি খুলে নিজের জামা বের করে বাথরুমে গিয়ে পাল্টে বের হয়। দশ মিনিটে রেডি হয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। সায়ন ঘুমে থাকায় দরজা তালা না মেরে শুধু লক করে চলে যায় রাইদা।
ভার্সিটিতে এসে অর্ককে কল দেয় কিন্তু অর্ক কল রিসিভ করে না। ক্যান্টিনে গেলে দেখে বাপ্পি বসা। রাইদা গিয়ে বাপ্পির পাশে বসে।
‘কিরে অর্ককে দেখছিস?’,বাপ্পিকে জিজ্ঞেস করে রাইদা।
‘সকাল সকাল আমাকে কল দিয়ে বললো আজকে নাকি ওর বাসায় আমাদের দাওয়াত সেই জন্যই আসলাম সকালের ক্লাসটা করে ওর বাসায় চলে যাবো।’, বাপ্পি ফোনের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়।
‘বাকিরা কই?’,রাইদা আবারো প্রশ্ন করে।
‘জানি না ভাই আমাকে অর্ক কল দিছে আমিও চলে আসছি।’
‘দূর তোর কথার কোনো কূল কিনারা পাই না। রুহিকে কল দেই ও ভালো বলতে পারবে।’
রাইদা রুহিকে কল দেওয়ার পূর্বেই অর্কের কল আসে। কল রিসিভ করে রাইদা ফোন কানে দেয়।
‘কই তুই?’, রাইদা প্রশ্ন করে।
‘তুই কই সেটা বলে আগে। কল দিয়ে তোরে পাওয়া যায় না। ভাবছিলাম কাজটা শেষ করে তোর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখবো কই হারাইছিস।’,অর্ক কর্কশ স্বরে বলে।
‘আমি তো ভার্সিটিতে আসলাম। বাপ্পি আছে কিন্তু ও কি বলছে কিছুই বুঝতেছি না তুই বলতো কি কাহিনী। ‘
‘ভাইয়ার সেই কলিগ আজকে বাসায় দাওয়াত খেতে আসবে তাই তোদেরও দাওয়াত বুঝেছিস? আমি এসেছি ভাইয়ার সাথে বাজারে তুই বাপ্পি আর পায়েলকে নিয়ে চলে আয়।’
‘রুহিকে আনবো না? নাকি ওরে আলাদা বলছিস?’
‘শাটাপ রাই ফলতু কথা বলবিনা একদম আর শোন ওরে নিষেধ করবি শাড়ি পরে আসতে।’
অর্কের কথা শুনে রাইদার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
‘ঠিক আছে না করে দিবো লাল রঙের শাড়ি পরতে।’
‘উহু কালো রঙের শাড়ি পরতে না করবি।’
‘ইশ এভাবে কেউ বললো না এই জন্যই আজও আমার প্রেমটা হলো না।’
রাইদা বলা কথাটা শুনে অর্ক শব্দ করে হেঁসে দেয়।
‘প্রেম হয়নি তাই বিয়ে করে বসে আছিস আর প্রেম হলে তো এতোদিন আমাকে মামা বানিয়ে দিতি।’
‘চুপ বেয়াদব ছেলে আমি ফোন রাখলাম এখন যাবো ফাহিমের বাসায় এরপর সোজা তোর বাসা।’
কল কেটে রাইদা পায়েলকে কল দেয়।
‘বল কি খবর।’,খাবার মুখে পায়েল বলে।
‘শোন এখনই রুহির মেসে গিয়ে ওরে কালো শাড়ী পরিয়ে একদম কালো পরী সাজিয়ে আনবি। আমি আর বাপ্পি ফাহিমের বাসায় যাচ্ছি সেখানেই আসবি।’, দ্রুত কথাগুলো বলে রাইদা।
‘কিন্তু সকাল সকাল কি হলো?’
‘আরে বুঝিস না এটা একজন চাচ্ছে তাই।’
রাইদার কথা শুনে পায়েল বুঝে যায়।
‘নিজের মুখে বলছে? ওকে তুই চিন্তা করিস না আমি ওরে এমন সাজিয়ে আনবো আজকেই সব মনের সব কথা বলতে বাধ্য হবে।’
‘ঠিক আছে লেট করিস না দুপুরের আগে অর্কের বাসায় যেতে হবে।’
‘আচ্ছা আমি বের হচ্ছি।’
পায়েল কল কেটে বাসা থেকে বের হয়। কল কেটে রাইদা দেখে ফোনে চার্জ নেই বিষয়টা সে আমলে নেয় না।
রাইদা বাপ্পিকে নিয়ে চলে যায় ফাহিমের বাসায়। ফাহিমের মা সকালবেলা রাইদাকে দেখে অনেক খুশি হয়। ফাহিমের জন্য বানানো নাশতা রাইদাকে খেতে দেয়।
বেলা বারোটা বাজতেই রাইদা,ফাহিম,বাপ্পি পৌঁছে যায় অর্কের বাসায়। রাইদাকে দেখে অর্কের মা ডাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতে বেচারি কাজ না পারা রাইদা সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে রান্নাঘরে যায়। মিনিট বিশেক পর বাসার কলিং বেল বেজে উঠলে অর্ক গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খুলে অর্ক কয়েক মিনিটের জন্য ভুলে যায় সে কোথায় আছে।
দরজার সামনে কালো শাড়ী পরিহিত রুহিকে দেখে অর্কের গলা শুকিয়ে আসে। ঠোঁট নেড়ে অর্ক কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু গলা দিয়ে কোনো কথা বের হয় না।
‘রুহি ভেতরে চল অর্কতো আমাদের ঢুকতেই দিচ্ছি না কোন দুনিয়াতে যে হারালো কে জানে!’, জোরে জোরে কাশি দিয়ে পায়েল বলে।
অর্ক লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে সরে দাঁড়ায়। রুহি অর্কের দিকে তাকিয়ে বোঝার লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে।
রুহি চলে আসায় রাইদা রুহিকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে রুমে এসে অর্কের বোনের পাশে বসে। অর্কের বোন অনু শাড়ী পরে মন খারাপ করে বসে আছে। পায়েল আর রাইদা তাকে আশ্বাস দিচ্ছে নিশ্চিন্তে থাকতে।
বাসার কলিং বেল আবারো বেজে উঠলে অর্কের বড় ভাই গিয়ে দরজা খুলে। অর্ক,ফাহিম,বাপ্পি বসার ঘরে চলে যায় আর পায়েল,রুহি বসে থাকে অনুর সাথে।
‘এই রাই মা তোরে ডাকছে।’,বসার ঘর থেকে অর্ক বলে।
‘হ্যা আসছি এখনই।’,রাইদা জবাব দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
বসার ঘরের পাশেই রান্নাঘর হওয়ায় রাইদার চোখ সোফার দিকে যায়। সোফায় বাপ্পির পাশে বসা মানুষটাকে দেখে রাইদা চোখ বড়বড় করে ফেলে। হাঁটা থামিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে চোখের চশমা ঠিক বোঝার চেষ্টা করে সে ঠিক দেখেছে নাকি।
সোফায় বসে সকলের সাথে হেঁসে কথা বলছিলে আরাফ কিন্তু যখনই অর্কের মুখে রাইয়ের নাম শুনে আরাফ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিলো রাইকে দেখার আশায়। রাইদা হাঁটা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিষয়টা বুঝতে পেরে আরাফ আর রাইদার দিকে তাকায় না।
রাইদাও রান্নাঘরে চলে যায়। খাবারের টেবিলে সকলে খেতে বসেছে অনু আর অর্কের মা বাদে,তারা দু’জন সকলের পাতে খাবার দিচ্ছে। রাইদা অস্বস্তিতে খেতে পারছে না আর আরাফও চোখ তুলে কোথাও তাকাতে পারছে না। আরাফ এখনো বুঝতে পারছে না তার সাথে হচ্ছে টা কি।
অনু আরাফের প্লেটে বেগুন ভাজা দিতে নিলে সেটা রাইদার চোখে পরে।
‘আপু ওনাকে বেগুন দিয়েন না।’,হুট করে রাইদা অনুকে বলে।
রাইদার কথা শুনে সকলে তাকায়।
‘আসলে আমি যতটুকু জানি অনেকের বেগুনে এর্লাজি থাকে তাই বললাম ওনাকে বেগুন না দিতে।’,আমতাআমতা করে রাইদা বলে।
‘হ্যা আমার বেগুনে এলার্জি।’,আরাফ বলে।
বিষয়টা রাইদার বন্ধুদের চোখ এড়ায় না সকলে কিছুটা আচঁ করতে পারে। খাওয়া শেষ হলে অর্কের বড় ভাইয়ের কথা মতো আরাফকে নিয়ে ছাদে যায় অর্ক। অর্কের বড় ভাই চাচ্ছিলো অনুর সাথে আরাফ আলাদা কথা বলুক তখন আরাফের যদি অনুকে ভালো লাগে তারপর সে বিয়ের কথা আরাফকে বলবে তাই ছাদে পাঠিয়েছে আলাদা কথা বলতে।
রাইদা অনুকে নিয়ে ছাদের দিকে যায়। ছাদের সিঁড়িতে গিয়ে দেখে অর্ক দাঁড়িয়ে আছে একা।
‘এটা সেই আরাফ ভাই না? তুই গিয়ে কথা বল আমি আর আপু এখানে আছি। আর শোন বলিস যাতে সে ভাইয়াকে বুঝায়।’,অর্ক রাইদাকে কথাগুলো বলে।
অর্কের কথায় মাথা নেড়ে রাইদা ছাদে যায়। ছাদের রেলিং ধরে আরাফ দাঁড়িয়ে ছিলো। কারো পায়ের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়। রাইদাকে আসতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই পকেটে হাত রাখে।
‘আমি তো ভেবেছি আজও কথা না বলে তুমি পালাবে।’,আরাফ হাসি দিয়ে রাইদাকে বলে।
‘আসলে আমি এসেছি অনু আপুর বিষয়ে কথা বলতে। ভাইয়া তো উঠে পরে লেগেছে অনু আপুর বিয়ে দিতে।’
‘আমাকে যখন রাসেল ভাই দাওয়াত দেয় আমি বিষয়টা সাধারণ ভাবেই গ্রহণ করি। আসার পর বুঝলাম সে তার বোনের সাথে আমার দেখা করাতে চাচ্ছে কিন্তু বিয়ের কথা ভাবছে এটা আমি জানতাম না। এই যে তুমি এলে আমি তো ভেবেছিলাম রাসেল ভাইয়ের বোন এসেছে।’
‘অনু আপুর অন্য জায়গায় সম্পর্ক আছে কিন্তু ভাইয়া মানছে না কিছুতেই। আপনি তাকে বলবেন আপনি এখন বিয়ে করবেন না। ছাদ থেকে আপনি নামলেই ভাইয়া আপনার সাথে অনু আপুর বিয়ের বিষয়ে কথা বলবে।’
‘তুমি চিন্তা করো না আমি এমনিতেও এখন অন্য কারো প্রতি আগ্রহী নই। আমি না করলেও রাসেল ভাই কিন্তু অন্য ছেলে আনবে তোমরা রাসেল ভাইকে ঠান্ডা মাথায় বুঝাও ছেলে ভালো হলে ভাই রাজি হবে।’
আরাফের এমন কথায় রাইদা কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারে না।
‘আমরা সেই চেষ্টাই করবো। আমি তো প্রথমে আপনাকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম।’
‘অর্ককে দেখে আমারো মনে হচ্ছিলো কোথাও দেখেছি পরেই তোমাকে দেখলাম। তোমাদের সকলের বন্ধুত্বের প্রশংসা করতেই হয়। বিপদে যেভাবে বন্ধুর পাশে আছো দেখে ভালো লাগলো।’
আরাফের কথা শুনে রাইদা হাসি দেয়। এরপর দু’জনেই চুপ করে থাকে।
‘আপানাকে কিছু কথা বলার আছে। আমার মনে হয় কথাগুলো না বলতে পারলে আমি শান্তি পাবো না।’,অনেকক্ষণ পর রাইদা বলে।
‘হ্যা বলো আমি শুনছি।’
অর্ক দৌড়ে এসে রাইদার হাত ধরে টান দেয়।
‘আরে ভাইয়া উপরে আসতেছে জলদি চল এখানে থেকে।’,ব্যাস্ত গলায় অর্ক বলে।
‘আপনাকে পরে কল দিয়ে এ বিষয়ে কথা বলবো।’
আরাফকে কথাটা বলে রাইদা ছাদ থেকে নেমে সিঁড়িতে গিয়ে অনুকে নিয়ে বাসায় চলে যায়।
রাসেল এসে আরাফের সাথে কথা বলে তখন আরাফ রাসেলকে বুঝিয়ে বিষয়টা বলে। রাসেলের সাথে কথা বলে আরাফ চলে যায়।
বিকাল পর্যন্ত অর্কের বাসায় সকলে ছিলো। অর্কের বাসা থেকে নেমে সকলে চলে যায় টিএসসিতে। রুহি আর অর্ককে টিএসসি রেখে সুযোগ বুঝে রাইদা,পায়েল,বাপ্পি,ফাহিম পালায়।
..
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রাইদা দেখে ফোন বন্ধ। তার মনে পড়ে রাতে ফোন চার্জ দিতে ভুলে গিয়েছিলো সকালে দেখেছিলো দশ পারসেন্ট চার্জ আছে, ভেবেছিলো অর্কের বাসায় গিয়ে চার্জ দিবে কিন্তু সেটাও ভুলে গেছে।
রাইদা যখন ফ্ল্যাটের সামনে আসে তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। চাবি দিয়ে দরজার লক খুলতে নিলে বুঝে ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি লাগানো। সে বুঝে যায় সায়ন বাসায় আছে। দরজায় কয়েকবার নক করে কিন্তু দরজা খুলে না। বিরক্ত হয়ে রাইদা অনবরত দরজা নক করতে থাকে, একসময় দরজা খুলে সায়ন। রুমের দরজা খোলার পর রাইদার নাকে সিগারেটের বাজে গন্ধ আসে। চোখ মুখ খিঁচে রাইদা বিরক্তি প্রকাশ করে অন্ধকার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। সায়ন দরজা খুলে দিয়ে শোবার ঘরে চলে গেছে। দরজা লাগিয়ে রাইদা দ্রুত কদম ফেলে শোবার ঘরে আসে। শোবার ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে দেখে রুমের জানালা লাগানো বারান্দার দরজাও লাগানো আর রুমের মধ্যে থেকে সিগারেটের বাজে গন্ধ। ফ্লোরে পরে আছে অনেকগুলো সিগারেটের টুকরা।
‘এ কি অবস্থা করেছেন বাসার?’,রাইদা সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে।
বিছানায় বসে মাথা নিচে করে দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো সায়ন। রাইদার এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না সে।
‘আপনাকে না বলেছি এভাবে সিগারেট খাবেন না। আমার বমি আসে সিগারেটের গন্ধে। একদম সহ্য করতে পারি না এই বাজে গন্ধ।’,রুমের দরজা জানালা খুলে বলে রাইদা।
‘কোথায় ছিলে তুমি সারাদিন?’,ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে সায়ন।
‘কোথায় আবার ভার্সিটিতে ছিলাম। এখন কি আপনাকে বলে সব জায়গায় আমাকে যেতে হবে নাকি?’
সায়নের প্রশ্ন থেকে পালাতে রুম থেকে বের হতে নেয় রাইদা তখনই সায়ন এসে পথ আঁটকায়। সায়নের চেখের দিকে তাকিয়ে রাইদা আতংকে উঠে। রাগে সায়নের চোখ লাল হয়ে আছে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না রাইদার। ঢোক গিলে ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করে রাইদা।
‘তোমার ফোন সকাল থেকে বন্ধ কেনো?’
‘চার্জ শেষ এখন চার্জে দিবো।’
হাতের ফোনটা দেখিয়ে রাইদা বলে। রাইদার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সায়ন ছুঁড়ে ফেলে বিছানার উপর। চোখ বন্ধ করে সায়ন রাগ কমানোর চেষ্টা করতে থাকে।
‘আমাকে একটা কল দিয়ে যদি জানাতে কোথায় আছো তাহলে কি খুব সমস্যা হতো?’,চোখ বন্ধ রেখেই ঠান্ডা গলায় বলে সায়ন।
সায়নের রাগ সম্পর্কে রাইদার অজানা না তাই সে চুপ করে থাকে যাতে এমন কিছু না বলে যা শুনে সায়ন রেগে হিতে বিপরীত আচরণ না করে।
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো? এন্সার মি রি।’,রাইদার বাহু ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে সায়ন।
‘আপনি আগে এখানে বসুন রাগ কমুক আপনার তারপর না হয় সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। আসুন এখানে।’,সায়নের হাত টেনে বিছানার দিকে ইশারা করে রাইদা বলে।
সায়ন রাইদার হাত টেনে রাইদাকে নিজের দিকে নিয়ে আসে। রাইদার চশমাটা চোখ থেকে খুলে সেটাও বিছানায় ছুঁড়ে দেয় সায়ন। রাইদা কিছু বলতে চাইছিলো সেই সুযোগটা আর দেয় না সায়ন। নিজের ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে রাইদার ওষ্ঠে রাখে। গভীর চুম্বন দিয়ে সকল রাগ ঢেলে দেয় রাইদার ওষ্ঠে। দু’হাতে দিয়ে সায়নকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে রাইদা কিন্তু সায়ন শক্ত করে রাইদার হাত জোড়া চেপে ধরে।
রাইদার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে পুরো মুখমন্ডলে একের পর এক চুম্বন দিতে থাকে সায়ন। রাইদা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সায়নের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। রাইদার মাথাটা এনে বুকের বাম পাশে রাখে সায়ন। সায়নের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায় রাইদা।
‘তুমি কি চাইছো আমি তোমার ভালোবাসায় পুড়ে ম*রি? এমন কেনো করো তুমি একটু মায়া হয় না আমার প্রতি তোমার? এমনিতেই আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য কতটা বদলেছি দেখতে পাচ্ছো না তুমি? সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখে কতটা চিন্তায় ছিলাম সেটা কি বুঝো না? সারাটা দিন রাস্তায় ঘুরে খুঁজেছি তোমায়। ভেবেছি হয়তো আমার উপর রাগ করে আবারো আমাকে একা ফেলে চলে গেছো। চিন্তায়,ভয়ে নিজেকে পুরো পাগল লাগছিলো। এই কয় ঘন্টা আমার কীভাবে কেটেছে বলে বুঝাতে পারবো না। আমি আজই এই ফ্ল্যাট থেকে চলে যাচ্ছি তারপরও তুমি এমন করে আমার কষ্ট দিও না রি সহ্য হয় না আমার।’,অসহায়ের ন্যায় কথাগুলো বলে সায়ন।
সায়নের কথা শুনে মাথা তুলে সায়নের মুখের দিকে তাকায় রাইদা। সায়নের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে আসে। হাত বাড়িয়ে সায়নের অশ্রু মুছে দেয় রাইদা। চোখ নামিয়ে রাইদার দিকে তাকায় সায়ন। রাইদার চোখ মুখে অপরাধের ছাপ স্পষ্ট।
‘আমাকে ক্ষমা করুন সায়ন আর এমন হবে না কথা দিচ্ছি। আপনি প্লিজ কাঁদবেন না আপনি কাঁদলে আমার খারাপ লাগে। আমি চলে গেলে আপনাকে বলেই যাবো এভাবে লুকিয়ে কিংবা আপনাকে কষ্ট দিয়ে যাবো না।’,রাইদা আপরাধীর ন্যায় বলে।
রাইদার কথা শুনে সায়ন শক্ত করে রাইদাকে জড়িয়ে ধরে। রাইদা সায়নের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
‘সারাদিন কিছু খাইনি রি আমার খিদে পেয়েছে।’,রাইদাকে ছেড়ে সায়ন বলে।
‘আমারো তেমন খাওয়া হয়নি চলুন বাহিরে গিয়ে খেয়ে আসি।’
‘উহু বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরে চলো কিছু একটা রেঁধে দুজনে খেয়ে নেই।’
‘আমি রান্না করতে পারি না তো।’
‘সমস্যা নেই ভালোবেসে তুমি যা দিবা খেয়ে নিবো।’
সায়নের কথা শুনে রাইদা হেঁসে দেয়। হুট করে সায়নকে দেখে রাইদার বড্ড মায়া হয়।
সায়নের হাত টেনে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। ফ্রিজ থেকে ডিম, কাঁচামরিচ বের করে সাথে নেয় পেঁয়াজ।
রাইদাকে সরিয়ে চপিং বোর্ডে ছুরি দিয়ে সায়ন পেঁয়াজ মরিচ কাটতে থাকে। রাইদা পাশে দাঁড়িয়ে সায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন সায়নকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছেলে এতক্ষণ রেগে ছিলো।
পেঁয়াজ মরিচ কেটে তাতে লবন ডিম আর একটু শুকনো মরিচ দিয়ে ভালো করে ডিমটা ফেটিয়ে নেয় সায়ন, পাশে দাঁড়িয়ে রাইদা বলে দেয় কীভাবে করবে। ডিমের মিশ্রণ হয়ে গেলে হলে পাউরুটি বের করে ডিমে চুবায়ে গরম তেলে ছেড়ে দেয় সায়ন। রাইদাকে দূরে সরিয়ে সবগুলো পাউরুটি সায়ন ভেজে নেয়।
‘এই না বললে রান্না পারো না তাহলে এই রেসিপি কীভাবে জানো?’,রাইদাকে প্রশ্ন করে সায়ন।
‘রুহিকে সবসময় ঝটপট নাশতা বানাতে দেখি সেখান থেকে রেসিপি শিখেছি কিন্তু নিজে কখনো রান্না করে দেখিনি।’,রাইদা উত্তর দেয়।
রাইদা বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে নেয় এদিকে সায়ন খেতে থাকে। গোসল সেরে রাইদা বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। রাতের বেলায় চারিদিকে এতো আলোতে শহরের সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। এক ধ্যানে রাস্তার গাড়ি গুলো দেখতে থাকে রাইদা।
‘যেই রাগ এতো বছরেও আমি নিজের আয়ত্তে আনতে পারিনি তা তুমি এই কয়দিনেই পেরেছো। আজকে যেই পরিমাণ রেগে ছিলাম বাসায় থাকলে তো জিনিসপত্র সব এতক্ষণে ভেঙে চুরমার করলেও আমার রাগ কমতো না। সেবার যখন আমায় ফেলে চলে গিয়েছিলে রাগে ইটের উপর নিজের হাতে কয়েকবার বারি দিয়েছিলাম।’
বারান্দার গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে সায়নের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় রাইদা।
‘আপনি যা শুরু করছেন আর কয়েকদিন গেলে তো আমি আপনাতে বাঁধা পরে যাবো মিস্টার ইমতিয়াজ সায়ন। এতো পাগলামি করলে যে কেউ নিজেকে সঁপে দিতে চাইবে কিন্তু আমি পারছি না। আপনার প্রতি জন্মানো ঘৃণা আমায় বাঁধা দেয় সবসময়।’
সায়ন এগিয়ে এসে রাইদার দুই পাশের গ্রিলে হাত রেখে বন্দী করে ফেলে রাইদাকে।
‘তুমি এভাবেই থাকো একটুও বদলে যেয়ো না। আমার তো এই জেদী রি কে পছন্দ। প্রথমবার তোমার হাসি দেখে পছন্দ হয়েছিলো তোমাকে। দ্বিতীয়বার তোমার দুষ্টুমি দেখে প্রেমে পড়েছি আর শেষে তোমার এই জেদ দেখেই ভালোবেসেছি। আমি তো চাই তুমি শুধু আমার কাছে থাকো যেভাবে আছো ঠিক সেভাবে।’
‘আপনি সামনে আসলেই আমার চোখের সামনে অনেক কিছু ভেসে উঠে। আপনি বর্তমানে যেমনই হন আপনাকে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না।’
‘ক্ষমা করোনা রি আমায় শুধু স্বামী হিসেবে আমার নামটা রেখে দাও তাতেই আমি খুশি।’
সায়নের কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে পাশে তাকায় রাইদা। রাইদার ভেজা চুল সরিয়ে ঘাড়ে নাক নিয়ে আলতো স্পর্শ করে সায়ন। সায়নের স্পর্শে রাইদা মৃদু কেঁপে উঠে। ধাক্কা দিয়ে সায়নকে সরিয়ে রুমে চলে যায়।
রাত দু’টো বাজে সায়ন গভীর ঘুমে। রাইদা এপাশ ওপাশ করে বারবার শুয়ে চোখ বন্ধ করছে কিন্তু চোখে ঘুম নেই। শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। পাশে শোয়া ঘুমন্ত সায়নের দিকে তাকায়। রুমের লাইট বন্ধ তবুও বাহির থেকে আসা আলোতে সায়নের মুখ স্পষ্ট।
এই মূহুর্তে সে দোটানায় পড়ে গেছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সায়নের থেকে দূরে যেতে চাইলেও বিয়ে নামক সম্পর্কটা বারবার বাঁধা দিচ্ছে। দিনদিন তার প্রতি সায়নের পাগলামি বেড়েই চলেছে এটা যে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে সেটাও বেশ বুঝতে পারছে রাইদা। যতবারই ভাবছে সম্পর্কটা নিয়ে ভাববে ততবারই সায়ন এমন কিছু করছে যাতে রাইদা গলে যাচ্ছে। সায়নের দিকে ফিরে বালিশে শোয় রাইদা। সে চাইছে সায়নের করা ভুলের জন্য তাকে শাস্তি দিতে কিন্তু সায়নের অসহায়ত্ব মুখটা দেখলে রাইদার ভেতরটা কেমন করে উঠে নিজেও বুঝে না।
‘আজকে যখন আমায় স্পর্শ করলো কেনো আমি আটঁকাতে পারলাম না? তবে কি আমি সায়নের প্রতি দূর্বল হচ্ছি?’,বিরবির করে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে থাকে রাইদা। অন্ধকার ঘরে রাইদার কানে একটা কথাই বাজতে থাকে।
‘তবে কি আমি সায়নের প্রতি দূর্বল হচ্ছি?’
…
চলবে..
(দুপুর থেকে লিখছি এখন লেখা শেষ করে রিচেক করেই পোস্ট করলাম আশা করি সকলের ভালো লাগবে।
গল্পটা ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইলো, একজন মেয়ে হিসেবে বলতে পারি কারো প্রতি অনুভূতি জন্মাতে অনেকটা সময় লাগে তাই তাড়াহুড়ো করে রাইদার মনে সায়নের জন্য অনুভূতি হোক এমনটা দেখিয়ে গল্প পড়ার আনন্দ নষ্ট করতে চাই না।)