#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৪
রিক্সা থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে পুনরায় পেছনে ফিরে সদাহাস্যজ্বল মুখশ্রীতে চেয়ে বলল,
“ভেতরে আসুন।”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“আজ নয় পরশু একেবারে বর বেশে ঢুকবো।”
“কিন্তু মা যদি জানতে পারে তার আদরের জামাই কে আমি দোরগোড়া থেকে বিদায় করে দিয়েছি তবে আমার কপালে শনি আছে।”
“জামাই বলে মেনে নিচ্ছো তবে?”
“আমি না মানলেই কি পিছপা হবেন আপনি?”
আবরার মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইশারা করল।
ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
“তবে? মেনে নেওয়াই কি উত্তম নয়?”
“সর্বোত্তম।” কালবিলম্ব না করে বলল আবরার।
পুনরায় ভেতরে যাওয়ার জন্য পা চালাতে শুরু করল ইভানা। সহসা কিছু মনে পড়তেই তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরল। কিন্তু ততক্ষণে আবরারের রিক্সা ঘুরিয়ে চলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দ্রুত এগিয়ে আসতে আসতে ইভানা ডাকল।
“শুনুন।”
” শুনছেন, আবরার?”
আবরার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“তুমি আমাকে ডাকলে?”
ইভানা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“আপনার ফোন। রয়ে গেছিলো তো আমার কাছে।”
আবরার মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে নিল ফোনটা।
মাথা নিচু করে ঘন হাস্কি গলায় বলল,
“এভাবে ডাক শোনার জন্য আমি হাজার বার ফোন ফেলে যেতে রাজি।”
ইভানা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
“প্রথম বার তাই ভদ্রতার খাতিরে দিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় বার সোজা ভাঙারির দোকানে কেজি দরে বিক্রি করে ফেলব। মাইন্ড ইট।”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“তুমি চাইলে আমি নিজেও কেজি দরে বিক্রি হতে পারি প্রেয়সী।”
ইভানা ভেংচি কেটে ঘুরে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল নিজ গন্তব্যে। মাত্র কয়েক গজ দূরেই তার আলয়। অথচ মনে হচ্ছে শতশত ক্রোশ দূরে।
আবরার নিজের পরিচিত ফোনটাই উল্টে পাল্টে দেখছে। নাহ, ফোন বদল হওয়ার চিন্তায় নয়। প্রেয়সীর হাতের ছোঁয়ার আবেশ খুঁজতে।
রিক্সায় বসতে অসুবিধা হওয়ার দরুন ইভানার হ্যান্ডব্যাগে ফোনটা রাখতে বলেছিল আবরার। সেটাই পরে নিতে ভুলে যাওয়ায় ইভানা মধুর সুরে পিছু ডেকেছে তার।
চলতে চলতে আনমনে আওড়াল,
“দুদিন এত দীর্ঘস্থায়ী কেন কাঁচাগোল্লা? সময় কি আমার সাথে বেঈমানী করছে? আটচল্লিশ ঘন্টা কি পরিবর্তিত হয়ে শত শত ঘন্টায় পরিণত হচ্ছে? আমার যে খানিকটা কালবিলম্বও সহনীয়তার পর্যায়ে নেই। আট বছর কম সময় নয়। আট বছর সহ্য করে নিয়েছি। দুদিন কেন পারছি না?”
“এত দেরি হলো কেন তোর?”
মায়ের কথা শুনে ইভানা থেমে গেল। নিজের রুমে যেতে যেতেও পা থামিয়ে বসে পড়ল ড্রয়িং রুমের সুসজ্জিত সোফায়। গলা বাড়িয়ে বলল,
“ইভান এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে যা না ভাই।”
ইভান নিজের ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“নিজে নিয়ে খা। নয়তো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর।”
ইভানা ফোঁত করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুই মর বেয়াদব ছেলে। মরার সময় পানি পাবি না দেখিস। মা তুমি দেবে প্লিজ।”
মাকসুদা খানম কটমট করে একবার তাকিয়ে পানি নিয়ে এলেন। ইভানা ধীরে সুস্থে পানি পান করে আয়েশ করে বসে বলল,
“এখন বলো কি বলবে? সময় পাঁচ মিনিট। গোসল করতে হবে। এমনিতেই বেলা ফুরাতে বসেছে। সর্দি-জ্বরে পড়লে আবার সমস্যা। দেখা যাবে বিয়ের দিন বিয়ের কনেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ব্যাপারটা খুব বাজে দেখাবে। তাই না মা?”
মাকসুদা খানম হা করে চেয়ে রইল ইভানার দিকে। তা দেখে ইভানা মৃদু হেসে বলল,
“আমাকে পরেও দেখতে পারবে। এখন বলো কি বলবে?”
“এত দেরি হলো কেন? সেই কখন বেরিয়েছিস। এত দেরি তো সচরাচর হয় না তোর।”
“আবরারের সাথে দেখা করতে গিয়ে সময় চলে গেছে। তারপর আবার পার্লারে গিয়েছিলাম। আগে তো আর বিয়ে করিনি। বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করিনি। তাই এত সময় লাগে নি। এখন বিয়ে করছি। সময় তো লাগবেই তাই না?”
“আবরার? ওর সাথে আজ আবার দেখা করার কি হলো? কালই না দেখা করলি। কিছু আকাম করিসনি তো?” সন্দিহান গলায় বলল মাকসুদা খানম।
ইভানা মুচকি হেসে বলল,
” তোমার মেয়ে কাজ না করলেও আকাম কুকাম করে না মা। যা করার সোজাসুজিই করে। ভয় পেও না। বিয়ে ভাঙার মত কিছু করিনি আমি। তার সাথে বোঝাপড়া ছিল। সেজন্যই দেখা করেছি। আর কিছু না। সে কিন্তু আমাকে পৌঁছেও দিয়ে গেছে বাসার বাইরে পর্যন্ত। এই যে হাতে ব্যান্ডেজ সেটাও সেই করে দিয়েছে। তাই বিয়ে ভাঙা নিয়ে অযথা ভয় পেও না মা।”
মাকসুদা খানম ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“একি হাতে এই অবস্থা কি করে করলি তুই? অনেকখানি কেটেছে?”
ইভানা নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“ভাগ্যিস দেখলে।”
“ওমা কিছু খেতে দেবে? ক্ষুধা পেয়েছে তো।”
আবরারের চিৎকার করে বলা কথাগুলো শুনে ফাহিমা করিম ছুটে এসে বললেন,
“এই তুই কোথায় টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলি সারাদিন? সেই সকালে বের হইছিস। এখন বিকেল গড়িয়ে এলো। কোথায় কি করিস তুই? তুই কতদিন একা একা বাইরে যাস না মনে আছে? কাল বাদে পরশু বিয়ে খেয়াল আছে?কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেললে কি হবে ভেবে দেখেছিস? এটা কিন্তু তোর ইতালি নয়। এটা ঢাকা। আজকের ঢাকা ছয় বছর আগের ঢাকা শহর নেই। তাই একা একা বের হবি না।”
আবরার মুচকি হেসে মা’কে টেনে পাশে বসিয়ে বলল,
“তুমি এত চিন্তা করো না তো মা। একা বের হইনি। সাথে একজন ছিল। তার পেছনেই সারাদিন চলে গেছে। আবার তাকে পৌঁছেও দিতে হয়েছে। সেজন্য ফিরতে একটুখানি দেরি হয়ে গেছে। এখন কিছু খেতে দাও না মা।”
ফাহিমা করিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“সত্যি করে বল কাকে পৌঁছাতে গিয়েছিলি? পরশু কিন্তু বিয়ে ভুলে যাস না। একটা মেয়ে তার সবকিছু ছেড়ে শুধুমাত্র একটা মানুষের উপর বিশ্বাস করে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় চলে আসে। সে কিন্তু জানে না সেই নতুন পরিবেশের মানুষগুলো কেমন। আদৌ তার সাথে মানিয়ে চলতে পারবে কি-না। তবুও কিন্তু সে চলে আসে। কেবলমাত্র একজন মানুষের বিশ্বাসে, ভরসায়।সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা কখনো করিস না বাবা। এটা তোর মায়ের আর্জি তোর কাছে। যদি আমাকে ভালবেসে থাকিস তবে তাকে আগলে রাখিস সারাজীবন। ভুলে যাস না সেও কিন্তু মায়েরই জাত। ভবিষ্যতে তোর সন্তানেরই মা হবে সে।”
আবরার হা করে মায়ের বলা কতগুলো গিলে নিল। হজম করতে বেগ পেতে হলো না খুব একটা। বরং ভালোই লাগল তার। কিন্তু মা যে সন্দীহান নজরে দেখছে তাকে।
সদাহাস্যজ্বল মুখে বলল,
“আমি তাকেই পৌঁছাতে গিয়েছিলাম আম্মাজান। সে-ই তলব করেছিলেন এই অধম বান্দাকে। বিশ্বাস করেন আম্মাজান সে ছাড়া আমার ত্রিভুবনে আর কোনো প্রেম ভালবাসা করার মানুষ নেই। সেখানেই শুরু আর সেখানটাতেই শেষ। এটা শুধু কথার কথা নয় আম্মাজান। এটা আমার অলিখিত দলিল। আপনি চাইলে আমি লিখিত দলিলও দিতে পারি।”
ফাহিমা করিম ছেলের কান টেনে বলল,
“মায়ের সাথে মজা করছিস তুই? বেয়াদব ছেলে। আগে বললেই তো হতো। শুধু শুধু এতগুলো কথা খরচ করালি আমার।”
আবরার কান ধরে রাখা হাতটা এনে চুমু খেয়ে বলল,
“আমার সবটা তো আমার মায়ের সাথে। আমার মা তো আমার বান্ধবী লাগে। একটু মজা করব না?”
ফাহিমা করিম হেসে বলল,
“আচ্ছা, বান্ধবী। বিয়ে করছিস সে উপলক্ষে বান্ধবীকে ট্রিট দিয়েছিস? শুধু মুখে বান্ধবী কিন্তু আমি মানি না।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি এতো দুষ্টু কেন মা? নানু যে তোমাকে কিভাবে সামলেছে আল্লাহ জানেন। আমার বাবা-ই বা এতগুলো বছর কিভাবে কাটালো? নিশ্চয়ই তুমি জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে পাগল করে ফেলেছো।”
ফাহিমা করিম মুচকি হাসলেন। কিছু বললেন না। আবরার মায়ের হাত ধরে বলল,
“সরি মা।”
ফাহিমা করিম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোর বাবার কথা মনে করলে আমার কষ্ট হয় না রে। তাই সরি বলিস না। তার সাথে আমার কেবল উজ্জ্বল মূহুর্ত গুলোই মাথায় গেঁথে আছে। চোখ বন্ধ করে ভাবলে মনে হয় এখনো জীবন্ত সবকিছু। মানুষটা না থাকলে কি হবে? তার স্মৃতিগুলো তো আছে। সেগুলো মরে যায় নি। সেগুলোই আমাকে এতগুলো বছর বাঁচিয়ে রেখেছে। দিব্যি ভাল আছি তোকে নিয়ে। তুই আছিস, নোভা আছে। আর কি চাই? তোদের রেখে গেছে তো সে। একা তো নই তাই না। যখন তোরা থাকিস না তখন তার স্মৃতিগুলো আমাকে সঙ্গ দেয়। এভাবেই কেটে যায় প্রহর। আর একা লাগে না রে। সময় সব বদলে দেয়। বদলাতে বাধ্য করে। ”
খানিকটা দম নিয়ে বললেন,
“তুই খাবি বলছিলি তাই না? নোভা, নোভা ভাইকে খেতে দাও। ভাইয়ের খিদে পেয়েছে।”
বলেই আবরারের মাথায় আদুরে স্পর্শ ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এখন তার স্মৃতি হাতড়ানোর সময়। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলাতে হবে তো।
“পানি খেয়েছিস? নাকি এনে দেব?”
ইভানের কথা শুনে ইভানা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। দুমিনিট ভেবে বলল,
“তোর পাঁচ মিনিটের অভ্যাস কি কখনো যাবে না ইভান? এটা নিয়ে কিন্তু তুই বিপদে পড়বি। সাংঘাতিক বিপদ। দেখা গেল তোর বিয়ের সময় কাজী তোকে কবুল বলতে বলল কিন্তু তুই পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বললি। এদিকে তোর বউ পাঁচ মিনিটের বিরহ সইতে না পেরে চলে গেল আরেক জনের হাত ধরে। আবার ধর তুই তো বড় হয়ে ডাক্তার হবি তাই না? দেখা গেল তোর একটা সিজারের রোগী এলো। ইমার্জেন্সি অপারেশন। কিন্তু তখন তো তুই তোর পাঁচ মিনিটের মিশনে। অপারেশন টেবিলে রোগী ছটফট করছে। তুই মগ্ন তোর ধ্যানে। ব্যস হয়ে গেল নর্মাল ডেলিভারি। মাঝখান থেকে তোর টাকাগুলো গায়েব। অপারেশন না করে তো আর টাকা নিতে পারবি না। আবার উল্টোটাও হতে পারে রোগী অক্কা পেলে তোকে চৌদ্দ শিকের শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিল। আরামসে কাটিয়ে দিবি জীবনের বাকি দিনগুলো। ভালো হবে না? নির্ভেজাল জীবন। কোনো প্যারা নেই।”
ইভান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল শুধু। বাকরুদ্ধ সে। চিন্তারা সব ফার্মগেটের জ্যামে আঁটকে আছে। শব্দ ভান্ডারও বাড়ন্ত।
চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৫
“তুই কি বিয়েটা সত্যি সত্যি করতে চাস না ইভা?”
সায়মার কথা শুনে ইভানা মৃদু হেসে বলল,
“ব্যাপারটা আর আমার চাওয়া না চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই রে। এটা এখন আমার নিয়তিতে গিয়ে ঠেকেছে।”
“ছেলেটা কি ভালো নয়? তুই তো দেখা করেছিস। কি বুঝলি?”
ইভানা চুপ করে গেল। কি বলবে? আবরার কে ছেলে হিসেবে তো খারাপ লাগে নি তার।বরং ভালোই লেগেছে। সভ্য, শান্ত, মিশুক একজন মানুষ। ইভানার সমস্যা তার পেশা। তার কর্মস্থল। কিন্তু সেটা তো কেউ বুঝতে পারছে না। হয়তো সে বুঝাতেই পারছে না।
“কিরে কিছু বল।”
“ছেলেটা ভাল। শ্যামল ভাইয়ার ফ্রেন্ড। আজ রেস্টুরেন্টে শ্যামল ভাইয়াও এসেছিল। তখনই জানলাম।”
সায়মা ইভানার মুখোমুখি বসে নরম গলায় বলল,
“বিয়ে জীবনে একবারই হয় ইভা। সময়টাকে কমপ্লিকেটেড করে ফেলিস না। নিজের জেদের জন্য বাকি মানুষগুলোর আনন্দটুকু নষ্ট করে দিস না। মেনে নে। মানিয়ে নে নিজেকে। সবকিছু এক প্লেটে পাওয়া যায় না ইভা। একটা পেতে হলে একটা ছাড়তেই হবে। ধর তুই দেশেই থাকলি। কিন্তু তোর যার সাথে বিয়ে হলো সে লোকটা মাতাল, নেশাগ্রস্ত হলো। দিনের পর দিন তোর উপর অত্যাচার করল। সেটা ভালো হবে? নাকি বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকেও মানুষটা তোকে রানী করে রাখল সেটা ভালো হবে? দেশের বাইরে থাকলেই কেউ দেশপ্রেম করতে পারবে না এমনটা তো নয় তাই না? তুই বাইরে থেকেও দেশের ঋণের প্রতিদান দিতে পারবি।”
ইভানা শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আর বাবা মায়ের? তাদের প্রতিদান কিভাবে দেব?”
“আমাদের প্রতিদান চাই না মা। আমরা শুধু চাই তুই ভালো থাক।সুখে থাক।”
বাবার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিল মূহুর্তেই।
অভিমানী গলায় বলল,
“তোমরা আমাকে ভালো থাকা দেখতে চাও নি বাবা। তোমরা চেয়েছো তোমার মেয়ে যেন আরামে থাকে। যেমনটা সব বাবা মায়েরা চায়। আমি তো বিলাসিতা চাই নি বাবা। আমি সবাই কে নিয়ে একসাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। হোক সেটা দু’বেলা দুমুঠো খেয়ে।ভালবাসার মানুষগুলোকে নিয়ে একসাথে ভালো থাকতে চেয়েছিলাম।”
“দারিদ্রতা দুয়ারে হানা দিলে ভালবাসা জানালা দিয়ে পালায় জানিস তো?” ইয়াসিন মোন্তাজের পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন মাকসুদা খানম।
“জানি তবে সেটা ভুল জানি মা। যদি সেটাই হতো তবে তোমরা আজ এভাবে একসাথে আমার সামনে বসে থাকতে না। বাবার চাকরি চলে যাওয়ার পর ঠিক কি অবস্থায় তোমার দিন কেটেছে ভুলে গেলে মা? তখন তো তোমাদের ভালবাসা জানালা দিয়ে পালায় নি। তবে আমার বেলায় কেন?”
“আমি তর্কে যেতে চাই না ইভা। আবরার ছেলেটা ভালো। তুমি ভালো থাকবে। শুধু বিলাসিতা নয়। ওর সংস্পর্শে তুমি জীবনের মানে খুঁজে পাবে। সময় গড়ালে তুমি নিজে এই বিয়ের জন্য আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। মিলিয়ে নিও আমার কথা।”
বাবার কথা শুনে ইভানা মলিন হেসে বারান্দায় চলে গেল। একাকিত্বই তার সুখ দুঃখের সাথী এখন।
মুখে ঝাল টক একটা ফুচকা পুরতেই স্বশব্দে গর্জন করে উঠল সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ। তীরে এসে আছড়ে পড়ছে একের পর এক ঢেউগুলো। শব্দটা এমনই। শব্দগুলোর উৎপত্তিস্থল ইভানার ফোন । তার ফোনের রিংটোন এটা। সমুদ্র প্রীতি থেকেই এই শব্দ ব্যবহার করে সে।
ফোন হাতে নিয়ে আনসেভড নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সচরাচর অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে না তার। ভাবতে ভাবতে একবার বেজে কেটে গেল।
পুনরায় বাজতেই সবুজ রঙের বৃত্তে স্পর্শ করে কানে তুলে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“আমার নাম্বার সেভ করো নি তুমি?”
ইভানা বুঝতে পারল না কে ইনি। কিন্তু সালামের উত্তর না দেওয়ায় রাগ হলো তার। ঈষৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব।”
অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি থতমত খেয়ে বলল,
“ওয়ালাইকুম সালাম।”
“কে বলছেন প্লিজ?”
“আমি আবরার। আবরার ফাইয়াজ। যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে ফোন সামনে এনে নাম্বারে নজর বুলিয়ে পুনরায় কর্ণে স্পর্শ করে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
“আমাকে বোকা বানিয়ে আপনার লাভ?”
পুনরায় থতমত করা কণ্ঠ কানে এলো ইভানার। সঙ্গে কিছু মানুষের চাপা আওয়াজও।
মিনিট দুয়েক চুপচাপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনার পাশে আবরার আছে। তাকে ফোনটা দিন।”
“হ্যালো।” মিনমিনে কণ্ঠে বলল আবরার।
“আমার সাথে মজা করছেন আপনি? কে ছিল ফোনে? কি ভেবেছেন, আপনার কণ্ঠ চিনতে পারব না আমি? না চিনেই যার তার সাথে পিরিতের আলাপ শুরু করে দেব?” একনাগাড়ে বলে হাঁপ ছাড়ল ইভানা।
আবরার দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠে শুধালো,
“আমার কণ্ঠস্বর তুমি চেনো? আর যার তার পিরিতের আলাপ করবে না কেন? ওটা কি কেবল আমার জন্য প্রযোজ্য? কিন্তু সামনে এলে তো পিরিত ঝরে না। ঝরে কেবল ধানিলংকার ঝাঁঝালো বীজ।”
ইভানা খানিকটা সামলে নিল নিজেকে। তার বুঝা উচিৎ ছিল কথা তো সে যার তার সাথে বলছে না। ফোনের ওপাশে তো আছে দ্যা গ্রেড হারামি আবরার ফাইয়াজ।
আবরার পুনরায় শুধালো,
“কিছু বলো।”
“ফোন কার কাছে ছিল? কে কথা বলছিল আগে?”
“রিফাত। শ্যামলের সাথে রেস্টুরেন্টে ছিল । মনে নেই? তোমার সাথে পরিচয় করিয়েছিলাম তো।”
ইভানা চোখ বন্ধ করে পুনরায় খুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনি এতক্ষণ পাশে বসে মজা নিচ্ছিলেন?”
আবরার নীরব রইল।
ইভানা পুনরায় বলল,
“আমাকে বোকা বানানো এত সহজ নয়। না আপনার বন্ধু পেরেছে আর না আপনি। এরপর কাউকে বোকা বানাতে হলে পাশে বসে হাহা হিহি করবেন না। এতে খুব সহজে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাইহোক কল দেয়ার কারণটা জানতে পারি?”
“আমার ফোন থেকে কল দেই?” নমনীয় গলায় বলল আবরার।
ইভানা সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“শিওর।”
“কি করছিলে?”
“পিন্ডি চটকাচ্ছিলাম।” ইভানার ভাবলেশহীন উত্তর।
আবরার ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমার?”
“উঁহু। আমার।”
“সেকি কেন? আমার পিন্ডিও কি তোমার পছন্দ নয়? আমি না-হয় নাই-বা পছন্দনীয় হলাম।” অভিমানী গলায় বলল আবরার।
ইভানা বোধহয় সেটা বুঝতে পারল। পাশে বসে থাকা সায়মার দিকে তাকিয়ে সোফা থেকে উঠে বারান্দায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সায়মা হাত টেনে মৃদুস্বরে বলল,
“ফুচকাগুলো নিয়ে যা। নেতিয়ে গেলে খেতে পারবি না। আমি আন্টির সাথে আড্ডা মেরে আসি।”
ইভানা প্লেট হাতে নিয়ে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে ধীর গলায় বলল,
“আবরার আপনি আসলে আমাকে ঠিক বুঝতে পারছেন না।”
আবরার ঘন হয়ে আসা গলায় বলল,
“বোঝাও। আমি তো বুঝতেই চাই।”
ইভানা চেয়ারের হাতল খুঁটতে খুঁটতে বলল,
” কিভাবে কি বলবো আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। আপনাকে কি বোঝাবো? আপনি এইযে বার বার বলছেন আপনাকে পছন্দ নয় হ্যানত্যান, হাবিজাবি। এগুলো আসলে কোনো কথা নয়। আপনি ব্যক্তিত্বশালী একজন মানুষ। আমার মনে হয়েছে এটা। আপনাকে যে কারোরই পছন্দ হয়ে যাবে। আমার সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। আপনার প্রফেশন। আমি নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না। কোনো মতেই না। না নিজে শান্তি পাচ্ছি। আর না কাউকে শান্তিতে রাখতে পারছি। জীবনটা ম্যাথমেটিক্যাল টার্মের জটিল সমীকরণের মত মনে হচ্ছে।”
আবরার কিছুক্ষণ মৌণ থেকে কাটকাট গলায় বলল,
“ঠিক আছে। আমি আংকেল কে ফোন করে বলে দিচ্ছি এই বিয়ে হচ্ছে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ভালো থেকো।”
বলা শেষ হতেই টুট টুট শব্দ করে কেটে গেল কল।
ইভানা আকষ্মিক কান্ডে তব্দা খেয়ে বসে রইল। বলতে চাইল কি আর ছেলেটা বুঝল কি। জ্ঞানে আসতেই ঝটপট কল দিল আবরারের ফোনে। কিন্তু রিং হয়ে কেটে গেলেও অপর পাশ থেকে সাড়া পেল না। পরপর তিনবার কল দিয়েও ব্যর্থ হয়ে উঠে দৌড় লাগালো বাবার রুমে।
ইয়াসিন মোন্তাজ কারো সাথে কথা বলছিলেন ফোনে। ইভানা আমতা আমতা করে বলল,
“বাবা জরুরি ফোন নাহলে রেখে দাও। আমার ফোন লাগবে।”
ইয়াসিন মোন্তাজ ইশারায় বললেন,
“কি করবে?”
ইভানা ফিসফিস করে বলল,
“জরুরি দরকার বাবা। তুমি আবার পরে কথা বলে নিও। এখন দিয়ে দাও প্লিজ ।”
অগ্যতা ফোন রেখে মেয়ের হাতে দিয়ে দিলেন। টেবিলের উপর মায়ের ফোন পড়ে থাকতে দেখে সেটাও হাতে তুলে ছুটল ইভানের রুমে। তার ফোনটাও হাতাতে হবে যে।
ইয়াসিন মোন্তাজ মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললেন,
“এদের যে কখন কিসে ধরে কেবল আল্লাহ মাবুদ জানেন।”
ইভান ঝগড়া বিবাদ করেও ফোন হাতছাড়া করল না। শখের গেইম খেলার সময় পৃথিবী উল্টে গেলেও মোবাইল হাত ছাড়া করতে নারাজ সে। বাধ্য হয়ে ইভানা চিন্তিত মুখে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পেছনে ঘুরে হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আবরার ফোন দিলে খবরদার ধরবি না। যদি ধরিস তবে মাকে বলে দেব তুই স্কুলে যাওয়ার পথে মিথিদের বারান্দায় ফুল ছুঁড়িস প্রতিদিন। তাও আবার আমার গাছ থেকে চুরি করে।”
ইভান চেঁচিয়ে বলল,
“তোর মত বোন যেন আল্লাহ শত্রুকেও না দেয়। মীর জাফরও তোর থেকে ভালো ছিল। বেঈমানও তোর চেয়ে ঈমানদার।”
চলবে…