সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -০৬+৭

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৬

“অসভ্য , ইতর , বদমাশ লোক একটা।”
হবু শ্বশুরের ফোনে কল দিয়ে এহেন অশোভনীয় বাক্য শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো আবরারের।
বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
“ইভানা! তুমি এগুলো বলতেও জানো?আর বাবার ফোন তোমার কাছে কেন?”
ইভানা ফোঁত করে নিশ্বাস ছাড়ল।
কিঞ্চিৎ খোঁচা মেরে বলল,
“আমি কি কি পারি তার সিকিভাগও আপনি আন্দাজ করতে পারছেন না। আর বাবার ফোন নয় মায়ের ফোনটাও এখন আমার কাছে। আপনি সত্যি সত্যি বাবাকে ফোন দিয়ে বিয়ে ভাঙার কথা বলতে যাচ্ছিলেন? এই একটু আগে পর্যন্তও তো বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এত দয়া উগলে উঠল কেন আমার জন্য? আপনি জানেন বিয়ের আগের দিন বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরিণাম কি হয়? আমি বললাম আর অমনি সাধু পুরুষ সেজে তথাস্তু বলে দিলেন। অসভ্য লোক। এতদিন কি করছিলেন? আমি তো সেই শুরু থেকেই বিয়ে করতে চাইছিলাম না।”
আবরার চোখ বড় বড় করে ইভানার কথাগুলো শ্রবণ করল। মৃদুস্বরে বলল,
“আমি তোমার ফোন পেয়ে কলব্যাক করেছিলাম তোমার ফোনে দেখো। তুমি তো ধরলে না। তাই ভাবলাম কোনো সমস্যা হয়েছে কি-না। তুুমি কল দিচ্ছিলে তখন আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। এনিওয়ে তুমি কি আমার কথা বলা আটকাতে বাবা মায়ের ফোন কিডন্যাপ করেছো?”
ইভানা মৃদু হেসে বলল,
“হুম। কল দিয়ে আমার গুনগান গাইলে মা আবার ঝাঁটা নিয়ে আসতো। এখন আমার মোটেই ঝাঁটার বাড়ি খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আপনার জন্য তো নয়ই।”
“আমার জন্য ঝাঁটার বাড়ি খাওয়ার দরকার নেই। আমার জন্য তুমি রোজ রোজ কেবল চুমু খাবে। তিনবেলা নিয়ম করে।”
ইভানা কপাল কুঁচকে বলল,
“আপনি নির্লজ্জ?”
“সারাদিনেও বুঝতে পারো নি?”
ইভানা হাহুতাশ করে বলল,
“আমি বাবাকে ফোন দিয়ে আসছি। আপনার যা ইচ্ছে আপনি বলে দিন। বলে দিন আপনি বিয়ে করতে চান না।”
“কিন্তু আমি তো বিয়ে করতে চাই।
ইভানা অবাক হয়ে বলল,
” একটু আগেই তো বললেন বাবাকে বলবেন বিয়ে করতে চান না।এখন পাল্টি খাচ্ছেন কেন?”
“টাইম আউট হয়ে গেছে। যখন বলছিলাম তখন তো দিওয়ানা হচ্ছিলে। এখন তুমি পাল্টি খাচ্ছো কেন?”
ইভানা বিস্মিত হয়ে বলল,
“আমি কখন দিওয়ানা হচ্ছিলাম? সেটাও আবার আপনার জন্য। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন?”
“এভাবে বলে না সোনা। দিলে লাগে তো। একেবারে ধরাস ধরাস, ধরাস ধরাস করে বুকের ভেতর। হার্ট অ্যাটাক করে মরে টরে গেলে কিন্তু অকালে বৈধব্য বরণ করতে হবে। তার জন্য দায়ী থাকবে তুমি। শুধু তুমি। মেনে নিতে পারবে তো?”
অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারী হয়ে উঠল ইভানার। কথা খুঁজে না পেয়ে নীরবতাই শ্রেয় মনে হলো তার।
পরিস্থিতি গম্ভীর হওয়ার আবরার হেসে বলল,
“আমি মজা করেছি তো। সিরিয়াস কেন হচ্ছো?”
ইভানা তবুও কিছু বলল না। আবরার পুনরায় গভীর গলায় বলল,
“যদি হাজার বার মরার সুযোগ থাকত তবে আমি তোমার জন্য হাজার বার মরতে প্রস্তুত। কিন্তু আফসোস উপরওয়ালা সেই সুযোগটা একবারই দিয়েছেন। কিন্তু আমার এই হাজার বার মৃত্যুর পেছনে একবারের জন্যও আমি তোমাকে দায়ী করতাম না। আর না পৃথিবী কে করতে দিতাম। তুমি জানো না তুমি আমার কাছে কত বড় প্রাপ্তি। তুমি জানো না তোমার জায়গাটা ঠিক কোথায়। কত গভীরে। যদি জানতে…”
“যদি জানতাম?”
“কিছু না। তুমি কি বুঝতে পারছো তোমার মনেও অনুভূতির জন্ম হচ্ছে? নতুন কিছু অনুভব করতে পারছো?”
ইভানা সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনার প্রেমে পড়ছি?”
“হুম। তুমি বুঝতে পারছো না। তোমার হৃদয় বুঝতে পারছে। তোমার হৃদয়ের সেই অনূভুতি আমার প্রেমিক হৃদয় ঠিকই চিনে নিয়েছে। এর নামই প্রেম ইভানা। এর নামই প্রণয়।”
ইভানা হেসে বলল,
“ইউরস ড্রিমস। ইভানা প্রেমে পড়ে না। পড়বে না। আপনার তো নয়ই।”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“পড়বে। পড়ছো। একটু একটু করে।”

সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া তরুণী নোভা। নোভালী ফারহানা। ফর্সা গায়ের রঙ ও বিড়াল চোখের অধিকারিনী নোভা কে প্রথম দেখায় বিদেশিনী ভেবে ভুল করে প্রায় সকলে। হালকা বাদামী বর্ণের চুলে ব্যাপারটা আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন করেছে। যদিও নোভা এই বিদেশিনী ব্যাপারটাতে বেশ মজা পায়। শপিংমলে যখন বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই কৌতুহলী নজরে তার দিকে তাকায় তখন মুখ টিপে হাসে সে। তাই তো ঘনকালো চুলগুলোকে কৃত্রিম বাদামী রঙে রাঙিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। এতেই যেন তার আনন্দ।

দুপুরের পর পর, বিকেলের সূচনালগ্ন।
নোভা আবরারের রুমের বাইরে এসে গলা বাড়িয়ে ডাকল।
“দাদাভাই, ভেতরে আসব?”
আবরার শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল,
“আয়। অনুমতি নিতে হচ্ছে কেন? বড় হয়ে গেছিস?”
নোভা মিষ্টি করে হেসে বলল,
“বড় হই নি তো দাদাভাই। তুমি একা থাকলে অনুমতি লাগতো না। তোমার রুমে আরও দুটো মুখ পোড়া হনুমান আছে তো। তাই অনুমতি নিতেই হতো। কখন কোথায় লাফিয়ে বেড়াবে বলা তো যায় না।”
শ্যামল অভিমানী গলায় বলল,
“আজ আমরা কালা বলে তুমি আমাদের মুখ পোড়া হনুমান বললে তো সুইটহার্ট। দিলে চোট পেলাম।”
নোভা এগিয়ে এসে ব্যথিত হওয়ার সুরে বলল,
“তুমি কালো নয় শ্যামদা। তুমি হচ্ছো শ্যাম তরুণ। শ্যামা মেয়েদের মায়াবী বলা হয় জানো তো। তুমি তাদের মেল ভার্সন। তারা মায়াবী হলে তুমি মায়াবী পুরুষ। বুঝলে?”
শ্যামল মুচকি হাসল। কিছু বলবে তার আগেই রিফাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“তোকে হনুমান বলে নি শ্যাম। হনুমান তো আমি। দেখিস না হনুমানের পোড়া মুখের মত কালো গায়ের রঙ। আমার সাথে হনুমানই যায়। নোভা ঠিকই বলেছে। থ্যাংস নোভা। মুখের উপর সত্যি বলার সাহস কিন্তু সবার থাকে না। এজন্য তোমার জন্য একটা পুরস্কার তোলা রইল। সময় করে নিয়ে নিও।”
নোভা বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে রইল। রিফাত সবসময় তাকে তুই বলেই সম্বোধন করে। আজ হঠাৎ তুমি বলল। তার উপর এত গভীর গভীর কথা। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“গায়ের রঙ কালো হলেই কেউ অসুন্দর হয় নাকি? এটা তোমাকে কোন মনিষী বলেছে রিফাত ভাই?”
রিফাত গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বলতে হয় না। এগুলো সবাই জানে।”
“ভুল জানে। একসময় তোমার ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেব।”
রিফাত আর কিছু বলল না।
আবরার রিফাতের কাঁধে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল,
“কিছু মনে করিস না দোস্ত। তোকে হার্ট করে কথাগুলো কিন্তু ও বলে নি। আমি তো আমার বোন কে চিনি। আমি জানি তোরাও চিনিস। তাই কিছু মনে করিস না দোস্ত।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমি তোকে কিছু বলেছি? তুই পকপক করছিস কেন ডাফার? তোর বোন আমাদের কেউ হয় না? আমি ওকে বলেছি। ও আমাকে বলেছে কি বলে নি সেটা আমাদের ব্যাপার। থার্ড পার্সন হয়ে তুই নাক গলাচ্ছিস কেন? বন্ধুর বোনের পেছনে একটু লাগাই যায়। তুই ভাই হয়ে বাম হাত ঢুকাবি?”
আবরার হেসে ফেলল রিফাতের কথা শুনে। বুঝতে পারল কথাগুলো সে মজার ছলেই বলেছে।
রিফাত নোভার দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
“আমাকে কালা বলার দাম তো আপনাকে চুকাইতে হবে বিদেশিনী।”

নোভা কথা ঘুরাতে শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“শ্যামদা তোমরা কি করছো বলো তো। বিকেল হয়ে গেছে। এখনো নিজেরা রেডি হচ্ছো না। দাদাভাই কেও রেডি করাচ্ছো না। ও বাড়ি থেকে লোকজন চলে আসবে তো। তাড়াতাড়ি করো।”
শ্যামল চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“বিদেশী ম্যাম কি আজ শাড়ি পরবে সুইটহার্ট। লোকে কিন্তু ভীমড়ি খাবে। সাবধান।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৭

বাসন্তি রঙা শাড়ির সাথে সবুজ রঙা দোপাট্টা মাথায়। চন্দমল্লুিকার সতেজতায় হলুদে সজ্জিত নব বধুর রূপ যেন ঠিকরেে পড়ছে। হলুদ গাদায় আবৃত স্টেজে ঠায় বসে আছে ইভানা। জনে জনে এসে হলুদ ছুঁয়ে ফল মিষ্টি খাওয়াচ্ছে তাকে। কলের পুতুলের মত মুখে মৃদু হাসি লেপ্টে সকলের মন রক্ষার্থে মুখে পুরে নিচ্ছে একের পর এক গ্রাস।
অপছন্দের মিষ্টি পেটের ভেতরে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ইভানার। কিন্তু ধারে কাছে কাউকে বলার মত পেল না। গলা বাড়িয়ে ডাকারও জো নেই। সকলের দৃষ্টি তার উপরই নিবদ্ধ।
ইভানার অসহায়তা মুখে ফুটে উঠতেই নোভার নজরে এলো। নিজের আসন ছেড়ে ইভানার পাশে বসে বলল,
“ভাবী অসুবিধা হচ্ছে? এখানে ভালো লাগছে না? কোনো সমস্যা?”
ইভানা করুণ দৃষ্টিতে নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বোধহয় আর কিছুক্ষণেই বমি করে দেব। মিষ্টিগুলো পেটের ভেতরে ঘূর্ণিঝড় শুরু করে দিয়েছে।”
নোভা চাপা সুরে বলল,
“আগে বলবে না? রুমে চলে এক্ষুনি।”
ইভানা নোভার হাত আঁকড়ে বলল,
“সবাই আছে এখনো। আমি চলে গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে।”
“সবার সামনে বমি করে দিলে সেটা আরও খারাপ দেখাবে। সারাজীবন এজন্য তোমাকে খোঁচা শুনতে হবে। মজা করবে তোমাকে নিয়ে। লোকের কথা ভেবো না। আমি ম্যানেজ করছি।”
নোভা স্টেজ থেকে নেমে গলা বাড়িয়ে বলল,
“আর দেরি করা যাবে না এখানে। দাদাভাই ফোন করেছিল। রাস্তায় ঝামেলা হয়েছে। আর একটু দেরি হলে রাস্তা ব্লক হয়ে যাবে। দশটার পর নাকি একটা মাছিও গলতে দেবে না। তাই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো। আর কেউ হলুদ দেবে?”
শ্যামল এগিয়ে এসে বলল,
“আবরার ফোন করেছিল? আমি তো কিছু জানিনা। কোথায় ঝামেলা হয়েছে?”
নোভা চাপা গলায় বলল,
“চাপ নিও না শ্যামদা। দাদাভাই ফোন করে নি। আমি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলেছি। আসলে ভাবী আর নিতে পারছে না। বমি পাচ্ছে। অথচ কিছু বলতেও পারছে না। বেচারীর বা কি দোষ। ষাট জন মানুষ যদি এক চিমটি করেও খাওয়ায় ষাট বার নিতে হবে মুখে। বমি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ দেখো এদের থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। মাকেও বলিহারি, যাদের জীবনে পা মাড়াতে দেখিনি আমাদের দোরগোড়ায়। তাদেরও নিমন্ত্রণ করেছে। বুঝতে পারে না এরা কেবল সুখের সঙ্গী। বিপদে এদের টিকিটিও দেখা যায় না।”
শ্যামল আশেপাশে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“চেপে যাও সুইটহার্ট। এসব এভাবে বলতে নেই। কেউ শুনে নিলে আন্টির অসম্মান হবে। এখন যাও ইভানাকে ঘরে দিয়ে এসো।”
নোভা চোখ পিটপিট করে বলল,
“ভাবী বলো। বন্ধুর বউকে ভাবী বলতে হয়।”
শ্যামল হেসে বলল,
“ওটা আমার ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড।”
“হ্যা ভাইয়ার সামনে বলো। ভাইয়া তোমাকে ক্যালাবে।”

ঘরে পৌঁছে ইভানা নোভা কে হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মনে হচ্ছে আমি শ্বশুরবাড়ির প্রকৃত অনুভূতি পাব না।”
নোভা ভ্রুকুটি করে বলল,
“কেন ভাবী? আমাকে পছন্দ হয় নি?”
ইভানা মৃদু হাসল। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বলল,
“ননদিনী হয় রায়বাঘিনী। তোমাকে দেখে তো বোন বোন ফিলিংস হচ্ছে। প্রথম দেখার দিনও মনে হয়েছিল। আজও। আন্টিও শ্বাশুড়ি মেটেরিয়াল নয়। তাহলে কিভাবে হবে? নব্বই দশক বা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের সিনেমাগুলোতে দেখো নি শ্বাশুড়িরা কেমন ভয়ংকর হয়। এখনো কিছু কিছু পরিবারে বউদের অত্যাচার করা হয় নির্মমভাবে। যুগের পর যুগ এভাবেই চলছে। সেই হিসেবে আমি ফিলিংস টা পাচ্ছি না।”
নোভা মুচকি হেসে বলল,
“আমার দাদাভাই হাসবেন্ড মেটেরিয়াল তো?”
ইভানা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
“শুরু হয়ে গেল ননদিনীর মত ব্যবহার?”

নোভা ও তার মা ফাহিমা করিম মাস তিনেক আগে এক বিকেলে এসেছিল ইভানাকে দেখতে। মূলত রাস্তায় দেখা হয়েছিল ইভানার সাথে। ইভানা ইভান কে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিল। তখনই ফাহিমা করিম রিক্সা করে যাচ্ছিলেন সেই পথে। ইভান ইভানা খুনসুটি করতে করতে রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি চলে আসে। ফাহিমা করিমও পিছু পিছু এসে চিনে নেন ইভানার ঠিকানা। পরে ঘটক লাগিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে নিজে স্বয়ং পৌঁছে যান। তারপরই দেখাশোনার পর বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর দুই বার দেখা হয়েছে ইভানার ফাহিমা করিমের সাথে। আর নোভার সাথে একবার।
যেদিন বিয়ে ঠিক হলো তারপর দিন নিজে হাতে করে একজোড়া চুড়ি এনেছিলেন। যা ছিল নিজের স্বামীর রেখে যাওয়া স্মৃতি। ছেলে অন্ত প্রাণ এক বাবা রেখে গিয়েছেন তার আশীর্বাদ স্বরূপ। ছেলের বউকে দেওয়ার জন্য। হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার সমাপ্তি রেখা অতি নিকটে।
ফাহিমা করিমের সঙ্গে এসেছিল নোভা। ইভানা হ্যাংলার মত তাকিয়ে ছিল নোভার দিকে। মোহাবিষ্ট হয়ে বলেছিল,
“তুমি কি ইউরোপের কোনো দেশে থাকো?”
নোভা একগাল হেসে বলেছিল,
“না ভাবী। আমি তোমার শ্বশুর বাড়ির পাঁচটা রুমের একদম পশ্চিম কর্ণারের রুমে থাকি। রুমটা অতটাও বিলাসবহুল আর বড় নয়। যার সাথে তুমি ইউরোপের তুলনা করতে পারো।”
ইভানা থতমত খেয়ে বলেছিল,
” তোমাকে দেখতে একদম তাদের মত। আন্টি তো এমন নয়। তুমি কার মত দেখতে?”
“আমি আমার মতোই। এরকম কেউ আমাদের বংশেও নেই। তবে দাদাভাইয়ের চুলগুলো আমার মত ঘন কালো। আমার চুলগুলো কিন্তু রং করা। আসল বাদামী ভেবে ভুল করো না যেন। দাদাভাইয়ের নাকটাও আমার মতোই। শুধু আমি একটু বেশি ফর্সা আর চোখের মণি সাদাটে। তবে দাদাভাইও কিন্তু অন্যরকম। তুমি দেখলে বুঝতে পারবে। আর বিদেশি ভাব না থাকলেও তুমি তো বিদেশিনীই হয়ে যাবে।”
ইভানা বুঝতে না পেরে বলল,
“মানে?”
“দাদাভাই এলে তোমাদের বিয়ে হবে। আর বিয়ের কয়েক মাস পরই তো তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবে। তখন তুমিও বিদেশিনী হয়ে যাবে।”
সেদিন থেকেই ইভানার বিয়েতে ঘোর আপত্তি। ঠিক বিয়েতে নয়, এই পাত্রতে পাত্রস্থ হতে তার আপত্তি।কেবল একজন মানুষের জন্য দেশ ছেড়ে যেতে নারাজ সে। হোক সে স্বামী। এমন বিয়ে তার চাই না। যে বিয়েতে আপনজন, আপনদেশ ছাড়তে হবে।

নোভার ফোনের স্কিনে স্লাইড করে একের পর ছবি দেখছে আবরার। হলদে পাখির ছবি। মাত্র কিছুক্ষন আগে তার জন্য নিজেকে সাজানো, তার নামের হলুদ নিজের অঙ্গে ছোঁয়ানো হলদে পাখিটাকে দেখছে সে নয়ন ভরে। কিন্তু এই কৃত্রিমতার যুগে কৃত্রিম অভয়ব দেখে চোখ, হৃদয় কিছুই ভরল না তার। বরং আরও প্রখর তৃষ্ণার উন্মোচন হলো। ধূ-ধূ মরুর খরার মত চৌচির হলো হৃদয় জমিন।
রিফাত এসে পাশে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষণ। আবরারের হেলদোল না পেয়ে গলা খাঁকারি দিল। তবুও আবরার নির্বিকার। বাধ্য হয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ওই তোকে ডাকছি আমি। কিসের ধ্যান করছিস? মোবাইলে কি দেখছিস তুই? নীল নীল নীলাঞ্জনা?”
আবরার আকষ্কিক ধাক্কায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“নীল নীল নীলাঞ্জনা মানে কি? আমি যা ভাবছি তাই? তোর মনে হচ্ছে আমি ওসব দেখি?”
রিফাত চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“এহ আসছে আমার সাধু পুরুষ। কলেজে পড়ার সময় তিনজনে একসাথে দেখতাম ভুলে গেছিস?”
আবরার মাথা চুলকে হেসে বলল,
“তখন বয়স কম ছিল। কৌতূহল বেশি ছিল। এখন আমরা বড় হয়েছি না। এখন ওসব দেখতে নেই মনা। বউ জানলে ঠ্যাঙাবে।”
রিফাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে পরক্ষণেই ফিক করে হেসে ফেলল। আবরার তাকিয়ে দেখল কালো গায়ের রঙের ছেলেটা হাসলে কতটা প্রাণোচ্ছল মনে হয়। কে বলে সৌন্দর্য কেবল সাদা চামড়ায় নিহিত?

“কোথায় ঝামেলা হয়েছিল রে? এত জরুরী তলব করলি। আসার সময় তো তেমন কিছু দেখলাম না রাস্তায়।”
রিফাতের কথা শুনে আবরার কিছু বুঝতে পারল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি কোথায় কাকে তলব করলাম? কিসের ঝামেলার কথা বলছিস?”
রিফাত কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে সবটা বলতেই আবরার নোভা কে ডেকে পাঠাল।

“মিথ্যে কেন বলেছো নোভা? আমি তো তোমাকে ফোন করিনি।”
নোভা আবরারের পাশে বসে হাতের চুড়ি গুলো এক এক করে খুলতে খুলতে বলল,
“ভাবীর বমি পাচ্ছিল। আবার সবার সামনে থেকে যেতে ইতস্তত করছিল। কারো ফেরার কোনো তাড়াও চিল না। একটা মেয়ে আর কতক্ষণ ওভাবে সং সেজে বসে থাকবে বলতে পারো? শুধু বসে থাকা নয়। আবার একের পর এক মিষ্টিও গেলানো হলো। তাই আমি মিথ্যে বলে সবাই কে নিয়ে এসেছি।”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“ভালো করেছিস। তবে মিথ্যে না বললেও হতো।”
“তোমার বউ শুনেছিল না দাদাভাই। সোজাসুজি বললে যাচ্ছিল না। সে লোকজনের পরোয়া করছিল।”
রিফাত মিনমিন করে বলল,
“হ্যা। তুই তো আবার বেপরোয়া। তাই সবাই কে বেপরোয়াই হতে বলিস।”
নোভা রেগে আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েও ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। চুড়িগুলো মুঠোয় পুরে লেহেঙ্গার একপাশ উঁচু করে ধুপধাপ পা ফেলে কক্ষ ত্যাগ করল। রিফাত সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ালো।

শ্যামল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সায়মার সাথে ফোনে কথা বলছে। আবরার ওয়াশরুমে ঢুকেছে। রিফাত কাজ না থাকায় পায়চারি করছে রুমের ভেতরে। টেবিলের উপর একটা চাবি নজরে এলে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। আলমারির চাবি বলে ধারণা হলো তার। তবে কার আলমারির সেটা জানতে হলে আবরার কে লাগবে। তাই ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল,
“আবরার টেবিলের উপর চাবি তোর আলমারির?”
আবরার হঠাৎ মনে পড়ার মত বলল,
“শিট! ভুলেই গেছি আমি। ওটা নোভার আলমারির চাবি। সাথে সাথে দিয়ে আসতে বলেছিল। তুই একটু দিয়ে আসবি? বাড়িতে এত লোকজন। চাবি ফেলে রাখলে হারিয়ে যেতে পারে। একটু যা না।”
অগ্যতা রিফাত রওয়ানা হলো নোভার রুমে।
নোভা দু’হাত ভর্তি মেহেদী লাগিয়ে সোফার হাতলে বসে আছে। নজর হাতের দিকে নিপতিত।
রিফাত দরজায় কড়া নেড়ে বলল,
“নোভা ভেতরে আছিস?”
নোভা সাড়া দিল না। উঠে এগিয়ে গেল। ভেজিয়ে রাখা দরজা পা দিয়ে খুলে বলল,
“কি হয়েছে রিফাত ভাই? তুমি হঠাৎ?”
“কেন তোর ঘরে আসতে হলে কি অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে আসতে হবে?”
নোভা দমে গেল। একটা কথাও সোজা উত্তর না দেওয়া মানুষটার উপর বিতৃষ্ণা জন্মাল মনের কোণে।
স্থির দৃষ্টি মেলে বলল,
“কি বলবে, বলো।”
রিফাত চাবি উঁচিয়ে বলল,
“এটা তোর?”
নোভা ভাবলেশহীন ভাবেই বলল,
“হ্যা। দাদাভাই নিয়েছিল।”
রিফাত হাত বাড়িয়ে বলল,
“নে, ধর।”
নোভা হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু হাত ভর্তি মেহেদী তে।
কিঞ্চিৎ সময় ভাবার পর মুখ বাড়িয়ে দিল হাতের দিকে। রিফাত লাফিয়ে দূরে সরে গেল।
অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“কি করতে যাচ্ছিলি তুই?”
নোভা আহাম্মকের মত তাকিয়ে থেকে বলল,
“চাবি আনতে যাচ্ছিলাম।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল কেবল।
নোভা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি ভেবেছো? তোমাকে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম?”
রিফাত হাত ঝাড়া দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
“আমার ভাবনা এত খারাপ না। ভাবনা গুলোও যার তার চুমু নেয় না।”
নোভা আর বিতর্কে না গিয়ে বলল,
“দাও চাবিটা।”
রিফাত চাবি উঁচিয়ে ধরলে নোভা মুখ এগিয়ে চাবি নিয়ে রুমের ভেতরে চলে গেল। রেখে দরজার কাছে আসতেই দেখল রিফাত ভাবুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নোভা ইশারায় বোঝালো,
“কি?”
রিফাত মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।
নোভা এবার মুখে বলল,
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন?”
“এমনি। তোর হাতটা দেখা।”
“হাত, কোন হাত ভাই?”
“বাম হাত।”
নোভা বাম হাত এগিয়ে দিলে রিফাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। অবশেষে এক কোণে “R” অক্ষর দেখে মৃদু স্বরে বলল,
“হাতে আর লিখেছিস কেন? তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীতে আর নামে কেউ নেই আমি জানি। এখন বলে দে আর কে?”
নোভা হঠাৎ আক্রমণে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রিফাত পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কিছু বলতে বলেছি আমি নোভা।”
নোভা হকচকিয়ে বলল,
“আর মিনস রাহাত। রাহাত।”
রিফাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কে রাহাত?”
নোভা এবারেও হকচকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আমার ব্যাচমেট।”
রিফাত পুনরায় ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিন্তু তুই তো মহিলা কলেজে পড়িস।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here