সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -০৮+৯

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৮

“হলুদ বাটো মেন্দি বাটো
বাটো ফুলের মৌ
ফুল কুমারীর বিয়ে হবে
সাজবে হলুদ বউ।”

“সায়মা চড় না খাইতে চাইলে মুখে আঙুল দে।”
ইভানার কথা শুনে সায়মা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“কেন ইভু বেবি? বিয়ে অথচ গান হবে না, এটা কোনো কথার কথা হলো?”
ইভানা হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“তাই বলে এটা? অন্য কিছু গা না।”
সায়মা কিঞ্চিৎ ভাবার ভঙ্গিমা করে বলল,
“আচ্ছা, হিন্দি শুনতে চাস? মেহেন্দি লাগাকে রাখনা?”
ইভা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
“উঁহু।”
“তাহলে?”
ইভানা কনফিউজড হয়ে বলল,
“কোনটা শুনতে চাইছি সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ”
সায়মা হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“পেয়েছি।”
“কি?” উৎসাহী কণ্ঠে বলল ইভানা।
সায়মা মুখ টিপে হেসে বলল,
“তোর মনের মত গান। এখন প্যাকপ্যাক না করে শোন।”
ইভানা মনোযোগী হতেই সায়মা মৃদুসুর তুলে গাইল,

“সানাইটা আজ বলছে কি
আমি জানি সেই কথা
রাত জেগে কেউ শুনছে কি
আমি শুধু শুনছি তা
কি করে বলি এ প্রাণ চায় যা
আজ মধু রাত আমার ফুলসজ্জা।”

ইভানা বাম হাতে সায়মার মুখ চেপে ধরে বলল,
“আর একটা আওয়াজ বের হলে মেহেদী লাগানো হাত গোর গালে মাখিয়ে দেব বেয়াদব মহিলা।”
সায়মা হাত সরিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল।
ইভানা চোখ পাকিয়ে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আর একটা উল্টাপাল্টা কাজ করলে তোর ফুলসজ্জার ব্যবস্থা করব আমি। বিয়ে ছাড়াই। তখন দেখব কত গান গাইতে পারিস।”
সায়মা হাসতে হাসতেই বলল,
“আচ্ছা! কে করবে বিয়ে ছাড়া বাসর? তুই?”
ইভানা নাক ছিটকে দূরে সরে বসে বলল,
“ছি!”
সায়মা আবার হেসে উঠল। খানিক পরেই মুখে সুখীভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,
“শ্যামল বিয়ের আগে আমাকে ছুঁয়ে দেখবে না ইভা। ছোঁয়ার অনেক সুযোগ তার কাছে ছিল।”
ইভানা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল সায়মার সুখী চেহারা। ভালবাসায় কত বিশ্বাস! ভালবাসার মানুষে কত ভরসা! সে কি পারবে এভাবে ভালবাসতে? বিশ্বাস করতে? আবরার কি দেবে তাকে ভালবাসার জন্য পর্যাপ্ত সময়? নাকি তার আগেই বিয়ে নামক অধিকারে হাসিল করবে তাকে?
গায়ে কাটা দিয়ে উঠে ইভানার। সায়মার মেহেদী টিউব ধরে রাখা হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার ভয় করছে সায়মা। ভীষণ ভয়।”
ইভার মুখ দেখে সায়মা আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ধুর বোকা মেয়ে। এত ভয়ের কি আছে? আবরার ভাইয়া কি তোর অপরিচিত?”
ইভানা হতাশ চাহনিতে তাকিয়ে বলল,
“দুদিনের পরিচিত। এটাকে পরিচয় বলে?”
“সেটা তোর ভুল ইভা। তিন মাস আগে বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুই পরিচিত হতে না চাইলে তার কি দোষ? তুই তো চাসনি সম্পর্কটা সহজ করতে।”
“আমি তো বিয়েটাই চাইনি। এখনো চাই না। যদি একটা মিরাকল হতো। যদি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে যেতে পারতাম এই পরিস্থিতি থেকে। কিন্তু আফসোস! সেই ক্ষমতা আমার নেই।”
সায়মা চোখ পাকিয়ে বলল,
“তুই এখনো এসব ভাবছিস? এটা অন্যায় ইভা। তুই এত মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলতে পারিস না। আবরার ভাইয়ার তো নয়ই।”
ইভানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সেজন্যই হাতে মেহেন্দি পড়ছি। নয়তো এই হাতেই সুটকেস চেপে পালাতাম। নে এখন তাড়াতাড়ি কর। সকলের খাওয়া শেষ হওয়ার আগে কমপ্লিট করবি। নয়তো এসে পরলে ক্যাচক্যাচ করে মাথা খারাপ করে দেবে।”

“কথা হবে দেখা হবে প্রেমে প্রেমে মেলা হবে
কাছে আসা আসি আর হবেনা
চোখে চোখে কথা হবে ঠোটে ঠোটে নাড়া দেবে
ভালো বাসা বাসি আর হবেনা
শত রাত জাগা হবে থালে ভাত জমা রবে
খাওয়া দাওয়া কিছু মজা হবে না
হুট করে ফিরে এসে লুট করে নিয়ে যাবে
এই মন ভেঙ্গে যাবে জানো না
আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না
আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না।”

ছাদের মেজেতে বসে গিটারে সুর তুলে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে গাইছে তিন বন্ধু। গিটারে সুর তুলছে রিফাত। মূলত গাইছেও সে। সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে আবরার ও শ্যামল। তিনটি সুখী মুখ মনের সবটুকু আনন্দ দিয়ে গেয়ে চলেছে যেন।
স্বল্প পরিমাণ দূরত্বে বসে বিদেশী ধাঁচের মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চোখ বন্ধ করে থাকা গিটারিস্ট পুরুষটির দিকে।

“যদি তুমি ভালোবাসো ভালো করে ভেবে এসো
খেলে ধরা কোনো খানে রবে না
আমি ছুয়ে দিলে পরে অকালেই যাবে ঝরে
গলে যাবে যে বরফ গলে না
আমি গলা বেঁচে খাবো কানের আসে পাশে রব
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কথা হবে না
কারো একদিন হবো কারো একরাত হবো
এর বেশি কারো রুচি হবে না
আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না
আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না”

রিফাত চোখ মেলে নোভার দিকে তাকাতেই নোভা অপ্রস্তুত হয়ে অন্য দিকে তাকাল। মনে মনে নিজেকে শত সহস্র গালি দিল হাভাতের মত তাকিয়ে থাকার জন্য।

“আর একটা গা না দোস্ত। এবার তুই একা গাইবি। আমাদের কাক চিলের কণ্ঠে আর না।”
শ্যামলের কথা শুনে আবরার হেসে তাল মেলালো। নোভাও পুনরায় সেদিকে নজর দিল। ততক্ষণে শ্যাম পুরুষটি নজর সরিয়ে নিয়েছে তার উপর থেকে।

রিফাত মুচকি হেসে পুনরায় গিটারে সুর তুলল।

“তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় ডেকেছ
আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছ।
আমি ময়ূরপঙ্খী নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি।
আগুন ঝরা ফাগুন যখন ছিল পলাশ বনে
তোমার কথাই ভেবেছিলেম আমি মনে মনে
তোমার চোখে তাই তো খুশির পরাগ মেখেছি
ওগো তোমার চোখে তাই তো খুশির পরাগ মেখেছি
আমি ময়ূরপঙ্খী নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি।”

নোভা মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। গাল দুটোতে বোধহয় জ্বর এসেছে তার। মাত্রারিক্ত গরম হয়ে গেছে। কান দিয়েও ধোঁয়া বের হচ্ছে। রিফাতের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকায় তার অষ্টাদশী মনটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। দুবার সাহস করে তাকাতেই শ্যাম পুরুষটির নজরে নজর বন্দী হয়েছে।
আর বসে থাকতে না পেরে ইভানা উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। ধাপে ধাপে পা ফেলে নিচে চলে যেতে গিয়েও পুনরায় সেই মনোলোভা সুর কানে আসতেই থমকে দাঁড়াল। নিজের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

“শুক্লা চাঁদের পঞ্চমীতে সাগর যখন দোলে,
তোমার আশায় বসেছিলেম বাতায়ন খুলে
দখিন হাওয়ায় তাই তো তোমায় চিঠি লিখেছি
আমি দখিন হাওয়ায় তাই তো তোমায় চিঠি লিখেছি
তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় ডেকেছ
আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছ।
আমি ময়ূরপঙ্খী নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি।”

চোখের আড়াল হয়েও নোভার মনে হচ্ছে এখনো বোধহয় চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তার কল্প পুরুষ। না চাইতেও নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। অষ্টাদশী মন শরীর কোনোটাই তার বাঁধা মানছে না। দেয়ালে হেলেই চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল সে।

রিফাত গান শেষ করে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি একটু আসছি। তোরা এনজয় কর। জাস্ট পাঁচ মিনিট। শ্যাম ওর সাথে থাক।”
শ্যামল হেসে ফেলল রিফাতের কথা শুনে। বুঝতে পারছে তার বন্ধুর মতিগতি। আবরারের দিকে তাকিয়ে পুনরায় রিফাতের দিকে মুচকি হেসে বলল,
“ঠিক আছে, যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস।”

সতর্কের সহিত সিঁড়ির তিনটি ধাপ অতিক্রম করল রিফাত। চতুর্থ ধাপে দেয়ালে হেলে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে নোভা। দু’হাত পকেটে পুরে সামনে দাঁড়িয়ে মুখের উপর ফু দিল রিফাত। নোভা কেঁপে উঠে চোখ খুলল। অতি নিকটে রিফাত কে দেখে হকচকিয়ে গেল।
আমতা আমতা করে বলল,
“রিফাত ভাই, তুমি?”
রিফাত মৃদু হেসে বলল,
“হুম। চোর ধরতে এলাম।”
নোভা মাথা নিচু করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বেহায়া হৃদপিণ্ডের চলন তো থামার নামই নেই।
রিফাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“ম্যারাথন জিতে এলি?”
নোভা অবুঝের মত বলল,
“মানে?”
“এভাবে হাপাচ্ছিস কেন? মনে হচ্ছে সাত ক্রোশ পথ দৌড়ে এসেছিস। নয়তো… ”
নোভা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“নয়তো কি রিফাত ভাই?”
রিফাত অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“ওসব তোকে বলা যাবে না। তুই ছোট মানুষ।”
নোভা অসহায় মুখ করে বলল,
“আমি বড় হয়ে গেছি রিফাত ভাই। আমার দিকে একবার ভাল করে তাকাও। বুঝতে পারবে।”
রিফাত নোভার দিকে বিস্ময়ের সহিত তাকিয়ে বলল,
“তুই কি বোকা নোভা? একটা তাগড়া জোয়ান ছেলেকে বলছিস ভাল করে তাকাতে। তুই জানিস তুই যেভাবে তাকাতে বলছিস সেভাবে তাকালে তোর কোথায় কোথায় নজর চলে যাবে?”
নোভা ফ্রিজড হয়ে তাকিয়ে রইল। এভাবে বলেছে নাকি সে।
রিফাত পুনরায় বলল,
“এভাবে আর বলিস না যেন। আমি কিন্তু সাধু পুরুষ নই। আর একবার বললে সত্যি সত্যি এদিক সেদিক নজর দেব। তখন আমায় খারাপ বলিস না যেন।”
নোভার গাল গরম হয়ে উঠছে। লালাভ আভায় ছেয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে এভাবে রিফাতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। পাশ কেটে চলে যেতে চাইলে রিফাত পকেটে গোঁজা হাত বের করে দেয়ালে ঠেকালো।
যাওয়ার পথে বাঁধা দেওয়ায় নোভা ভ্রুকুটি করে তাকাল।
রিফাত গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার বয়স কত জানিস নোভা?”
নোভা মাথা নিচু করে ফেলল। সে জানে পরের কথাগুলো কোন দিকে যাবে।
রিফাত পুনরায় বলল,
“উনত্রিশ প্লাস। দু’মাস পরেই ত্রিশে পড়বে। আর তোর সবে আঠারো। তোর বয়সটা আমি পেরিয়ে এসেছি বহু আগেই। তোর এই চোখের ভাষা, বুকের ধুকপুকানি এসব আমার পরিচিত নোভা। একসময় আমারও হতো। আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। নিজের গায়ের রঙের জন্য ভয়ে কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকাইনি। পাছে অপমান করে বসে। কিন্তু আমারও ইচ্ছে হতো। কেউ একজন আমার কথা ভাবুক। একান্ত আমার থাকুক। কিন্তু সময় গড়াতেই সেসব খুব হাস্যকর মনে হতো। তুইও নিজেকে সামলে নে নোভা। সামনে তোর সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তোর দাদাভাই তোর জন্য রাজপুত্র খুঁজে এনে দেবে। অপাত্রে নিজের অনুভূতি দান করিস না বোকা।”
নোভা চুপচাপ সবটা হজম করলেও শেষের দুটো বাক্য হজম করতে পারল না।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি অপাত্রে কিছু দান করছি না। আপনার কেন মনে হলো আমার মনে আপনার আঠারো বছর বয়সের সেই অনুভূতি হচ্ছে? সেরকম কিচ্ছুটি হচ্ছে না। আপনার জন্য তো নয়ই। আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছিলাম, ব্যস।”
রিফাত হেসে বলল,
“আচ্ছা?”
নোভা চোখ পিটপিট করে তাকাল।
“তোকে যদি একটুখানি ছুঁয়ে দেই তুই গলে যাবি। মিশে যাবি আমার এই কালচে দেহের সাথে। এই পোড়া ঠোঁটের স্পর্শ তোর চিবুকে ছোঁয়ালে তুই কেঁপে কেঁপে উঠবি। শক্ত হাতটা তোর নরম দেহের ভাজে হাতরে বেড়ালে পারবি তো সহ্য করতে? তোর রাঙা অধরে… ”
নোভা রিফাতের মুখে হাত রেখে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আর না রিফাত ভাই। আমি মরে যাব।”
রিফাত মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল,
“তবুও অস্বীকার করবি?”

নোভা মাথা নিচু করে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে ধপাধপ পা ফেলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়ল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল সে।

রিফাত নোভার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
“তুই থাকলেও জ্বালা না থাকলেও জ্বালা। চোখের সামনে থাকলেও পোড়াস না থাকলেও পোড়াস। কেন এত ছোট হলি নোভা? কেনই বা এত রূপ নিয়ে জন্মালি? তোর পাশে যে আমি বড্ড বেমানান।”

চলবে….#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৯

অগ্রহায়ণের শেষ তিথি। অর্থাৎ হেমন্তের বিদায় লগ্ন আর শীতের সূচনালগ্ন। প্রকৃতি সেজে উঠছে নতুন রূপে। সবুজ গাদার পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে অসংখ্য ছোট ছোট কলি। কিছুদিনেই আগুন ঝরা রূপে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় অপেক্ষমান তারা। নিজেদের ভুবনমোহিনী রূপে মাতোয়ারা করতে ক্ষণে ক্ষণে প্রস্তুতি নিচ্ছে । ঠিক যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে ইভানাকে। নিজের সারাজীবনের গচ্ছিত সৌন্দর্যকে সবদিক থেকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে।
আবরারের দেয়া লাল রঙা বেনারসি গায়ে জড়িয়ে ভারী গহনা অঙ্গে ধারণ করে আয়নায় মুগ্ধ হয়ে নিজেকেই দেখছে ইভানা।
আনমনে বিরবির করে বলল- ইভানা তোকে বউ বউ লাগছে। বউ হওয়ার জন্য প্রস্তুত তুই?
কোনো উত্তর আসে না আরশির ভেতর থেকে। কেবল দেখা যায় বিদ্রুপাত্মক হাসি।

সাজ শেষ করে পার্লারের মেয়েরা চলে যেতেই ইভানার ঘর লোকে লোকারন্য হয়ে গেল। এতক্ষণের বাঁধা নিষেধ শেষে সবার আগমন দেখে ইভানার মনে হলো কয়েক বছর পর যেন লকডাউন শিথিল হলো। হাজার বছর পর যেন তারা বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পেল।
সায়মা ইভানার কানের কাছে মৃদুস্বরে বলল,
“সহ্য করে নে সোনা। আগামী কয়েকদিন এসবই চলবে।”
ইভানা অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলল,
“কখন শেষ হবে এত গ্যাঞ্জাম?”
“বাসর ঘরে পৌঁছার পর।”
ইভানার শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। অজানা ভয়ে পুনরায় শিহরিত হলো গোটা শরীর।

“দাদাভাই, হলো তোমার?”
বলতে বলতে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল নোভা।
আবরার লাল পাজামার সাথে সোনালী শেরোয়ানী পড়ে বসে আছে। রিফাত আবরারের মাথায় পাগড়ী পরানোর চেষ্টা করছে।
নোভা মৃদুস্বরে বলল,
“পাগড়ী এখনই পড়ার কি দরকার রিফাত ভাই? পরেও তো পরা যাবে।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“এখন তুই বলে দিবি আমাদের কি করতে হবে? পাকা বুড়ি হয়েছিস? ভুলে যাস না আমরা তোর বার বছরের বড়। এমনিতে সম্মান না দিস। বয়সের সম্মানটা অন্তত দে।”
নোভা কিছু বলার আগেই শ্যামল আয়নার সামনে থেকে এসে দাঁড়াল নোভার সামনে। আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আমার তো মাথা ঘুরে যাবে আজ। সুইটহার্ট কি করেছো তুমি! এত মাঞ্জা মেরেছো কেন? আমি তো বোধহয় অন্ধই হয়ে যাব আজ। হে পৃথিবী দ্বিধা হও। এক অষ্টাদশী তরুণী আমাকে অন্ধত্ব বরণ করার দিকে চালনা করছে।”

নোভা মাথা নিচু করে হেসে ফেলল। রিফাতের কথার উত্তর টাও না দিয়েই চলে গেল।
আবরার শ্যামলের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। নোভা চলে যেতেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“শ্যাম নোভার সাথে আর এভাবে কথা বলবি না।”
শ্যামল অবাক হয়ে তাকাল। মুখে বিস্ময় ফুটিয়েই বলল,
“এটা বলতে পারলি তুই? নোভা তোর একার বোন? আমাদের কেউ নয়?”
আবরার উঠে দাঁড়িয়ে শ্যামলের মুখোমুখি হয়ে বলল,
“আমি বাজে মাইন্ডে কিছু বলি নি শ্যাম। নোভা ছোট মানুষ। তোর এই কথাগুলো শুনে ওর কিশোরী মনে ভিন্ন অনূভুতি জন্ম নিতে পারে। ও এখনো পৃথিবীর কিছুই দেখেনি শ্যাম। হাতে গোনা কয়েক জন মানুষের সাথেই ওর পরিচয়। তাই তোর এই কথাগুলো ওর মনে প্রভাব ফেলতে সময় নেবে না। আমি বোঝাতে পারছি তো তোকে? তুই আমাকে ভুল বুঝিস না দোস্ত। ভাই তো। ভয় হয়। বোনটা যদি কষ্ট পায়।”
শ্যাম মৃদু হেসে বলল,
“ভয় পাস না। পৃথিবী এফোড় ওফোড় হয়ে গেলেও তোর বোন আমার প্রেমে পড়বে না। আমি তার কাছে আরেকটা আবরার”
আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“এতো কনফিডেন্স?”
“অবশ্যই। দেখবি? ওয়েট। নোভা, সুইটহার্ট শুনে যাও তো এদিকে।”
গলা বাড়িয়ে ডাকতেই নোভা এসে বলল,
“শ্যামদা, কিছু বলবে?”
শ্যামল বিনা সংকোচে বলল,
“আমাকে বিয়ে করবে সুইটহার্ট?”
নোভা মিনিট খানেক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“সায়মাপু কে বলব? ঠ্যাঙাবে কিন্তু।”
শ্যামল ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। আবরার পেট চেপে ধরে হেসে উঠল। পেছনে দাঁড়িয়ে রইল কেবল রিফাত। তার মস্তিষ্কে এখনো আবরারের কথাগুলো রেকর্ডারের মত বাজছে। কি হবে অদূর ভবিষ্যতে?

বর পক্ষের সামনে টেবিলে হরেকরকম শরবত, মিষ্টির পশরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কনে পক্ষ। সায়মা সেখানে মধ্যমণি। আবরার ল্যাদা বাচ্চার মত যে যা বলছে সায় দিয়ে যাচ্ছে। রিফাত উপভোগ করছে সবটা। মুখে রা কাটছে না সে । তার পাশেই উৎসুক দৃষ্টিতে সবটা অবলোকন করছে নোভা।
কনে পক্ষ থেকে সায়মা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে পাঁচ হাজার টাকা না পেলে পথ ছাড়বে না।
শ্যামল অবাক হয়ে বলল,
“তুমি আমার কাছ থেকে এভাবে টাকা আদায় করবে? লজ্জা করছে না?”
সায়মা দ্বিগুণ অবাক হয়ে বলল,
“এমন ঢং করছো যেন টাকাগুলো তোমার পকেট থেকে দিচ্ছো। তুমি যে কিপটা আমাদের বিয়ের সময় আমার কাজিনদের পকেটে যে একটা কানাকড়িও জুটবে না সেটা আমি জানি।”
শ্যামল গলা নামিয়ে বলল,
“তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো মেয়ে।”
সায়মাও ফিসফিস করে বলল,
“তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও। নইলে আমার মুখ আরও খুলে যাবে। তখন মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়বে। বন্ধুর বিয়েতে যতগুলো মেয়ে পটানোর প্ল্যান করেছো সব জলে যাবে গো।”
শ্যামল ছিটকে দূরে সরে বলল,
“আস্তাগফিরুল্লাহ। এসব কি কথা?”
সায়মা আশেপাশে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল,
“তাহলে এত মাঞ্জা মেরেছো কেন? তোমার হচ্ছে আজ। ভালোয় ভালোয় টাকাগুলো ছাড়ো। তারপর তোমার ক্লাস নিচ্ছি আমি।”
শ্যামল শুকনো ঢোক গিলে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই তুই কিছু কর। আমি বাঘিনীর খপ্পরে পড়েছি। মেছো বিড়ালের মত মিউ মিউ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ এই মূহুর্তে বের হবে না। আবরারের পকেট বাঁচা।”
আবরার ওদের কথোপকথন শুনে মৃদুস্বরে বলল,
“এত কিপ্টেমি করছিস কেন তোরা? দিয়ে দে না। পাঁচ হাজারই তো। পাঁচ লক্ষতো চায় নি।”
শ্যামল হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,
“যাহ শালা! যার জন্য করি চুরি সেই কয় চোর। দিয়ে দিচ্ছি। দেখি তোর পকেটে কত জোর। আজ তো পদে পদে তোর পকেট খসাবে ওরা। দেখ কতক্ষণ চালাতে পারিস।”

নোভা ভেতরে ঢুকেই ইভানার খোঁজ করে। একজনের কাছে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দেয় ইভানার অবস্থানরত কক্ষ । পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ থেমে যায় একটি পুরুষালী কণ্ঠে নিজের পরিচিত উপমা শুনে।
“হ্যালো মিস বিদেশিনী।”
নোভা পায়ের গতি থামিয়ে পেছনে তাকাল। ফর্সা গোলগাল মুখের একটি ছেলে তার দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
নোভা মৃদুস্বরে বলল,
“আমাকে বলছেন?”
ছেলেটি হেসে বলল,
“বাহ, বাংলাও জানো দেখছি। নাম কি তোমার?”
নোভা অপ্রস্তুত বোধ করল। এভাবে অপরিচিত কারো থেকে তুমি সম্মোধন সে কোনো কালেই আশা করে না। তবুও ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোক ভেবে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“নোভালি ফারহানা।”
“নাইস নেম। আমি সাজিদ আহমেদ। ইভানার কাজিন। তুমি কে?”
“বরের বোন। আচ্ছা ভাইয়া আমি আসছি। ভাবীর কাছে যাব।”
বলেই আর অপেক্ষা না করে দ্রুত হেঁটে ইভানার কাছে চলে গেল।
ইভানা নোভা কে দেখে উঠে দাঁড়াতেই নোভা হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ইসস পুতুলের মত লাগছে ভাবী। দাদাভাই আজ ত্যাড়া হয়ে যাবে। তাইতো বলি গেইটে এত তাড়া ছিল কেন তার।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই গেইটের সামনে বলা আবরারের কথাগুলো গড়গড় করে বলে দিল। ইভানা হাসতে গিয়েও গিলে ফেলল।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নোভার দিকে তাকিয়ে আছে সাজিদ। নোভার অস্বস্তি হতেই এদিক সেদিক তাকাল। সাজিদের দিকে নজর পড়তেই বুঝতে পারল অস্বস্তির কারণ। ইভানার দিকে ঘুরে বসতেই ইভানা বলল,
“খেয়েছো তুমি?”
“মাত্রই তো এলাম। তুমি খেয়েছো?”
“হ্যা। তুমি যাও আগে খেয়ে এসো।”
নোভা পুনরায় দরজার দিকে তাকাল। সাজিদ নামের ছেলেটিকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তি পেল। কিন্তু দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেল অদূরে দাঁড়িয়ে সে দরজার দিকেই দৃষ্টি নিপতিত করে আছে ।

শ্যামলের ফোন ক্রমাগত গর্জন করে চলেছে। রিফাত বিরক্ত হয়ে বলল,
“এই বধিরের বংশধর তোর ফোন বাজছে।”
শ্যামল সরু চোখে তাকিয়ে ফোন বের করল। নোভার নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“নোভা কোথায় রে?”
রিফাত সচকিত হয়ে বলল,
“নোভার ফোন?”
“হুম। দেখেছিস?”
রিফাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বলদের বাচ্চা, ফোন ধরলেই না বুঝতে পারবি কোথায় গেছে। ধর তাড়াতাড়ি।”
শ্যামল কড়া চোখে তাকিয়ে ফোনে নজর দিল।

“হ্যালো, শ্যামদা কোথায় তুমি?”
শ্যামল হাসি হাসি মুখে বলল,
“আমি তো আবরারের কাছে। তুমি কোথায় সুইটহার্ট?”
নোভা ইভানার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আমি একটু ফেঁসে গেছি শ্যামদা। এখন ভাবীর রুমে আছি। এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে প্লিজ?”
শ্যামল রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তুমি থাকো। আমি রিফাত কে পাঠাচ্ছি।”
রিফাত ইশারায় বলল, “কি?”
শ্যামল মৃদু হেসে বলল,
“তোর ডাক পড়েছে। নোভা ইভানার রুমে আছে। নিচে গিয়ে ওকে নিয়ে আয় ফার্স্ট।”
রিফাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে চলে গেল।
শ্যামল নজর দিল আবরারের দিকে। কি সুন্দর শালীদের নির্যাতন সহ্য করছে সে।
এপাশ ওপাশ দেখতে গিয়ে বেচারা শ্যামল দেখতেও পেল না দূরে দাঁড়িয়ে সায়মা নামক ধ্বংসবীজ তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here