সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -১০+১১

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১০

“তুই কি বাচ্চা? এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে হয়েছিস। অথচ নিচতলা থেকে ছাদে যেতে হলে তোর একজন বডিগার্ড লাগছে। এই তুই বড় হয়েছিস? নাকি বিয়ে বাড়ি এসে আহ্লাদীপনা করতে ইচ্ছে করছে? ছেলেদের দেখাতে ইচ্ছে করছে সাথে বডিগার্ড নিয়ে ঘুরিস? ইচ্ছে করলে বল সাথে বন্দুক নিয়ে আসি।”
নোভা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলল,
“যার একটুখানি নজর পড়ার জন্য চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকি, তার নজর তো পড়ে না। বাকি ছেলেদের নজর দিয়ে কি আমি নজরানা দেব?”
রিফাত পেছনে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল,
“কি হলো? কি বিরবির করছিস? জোরে বল।”
নোভা মাথা নিচু করে বলল,
“একটা ছেলে তাকিয়ে ছিল রিফাত ভাই।”
রিফাত সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“একটা ছেলে তাকিয়ে ছিল, তো? তোর কোথাও ক্ষয়ে গেছে? দেখা দেখি কোথায় ক্ষয় গেল? এটা বিয়ে বাড়ি নোভা। আর তুই একটা সুন্দরী মেয়ে। ছেলেরা একটু আধটু তো তাকাবেই। কথাও বলতে চাইবে। তাই বলে তুই এভাবে পাহারাদার নিয়ে ঘুরবি? তোর ভাইয়ের বেতন করা বডিগার্ড আমি?”
নোভা বিস্ময়কর চাহনি মেলে তাকাল। এত অল্প কারণে কেউ এভাবে রেগে যেতে পারে?
নিচু গলায় বলল,
“আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।”
রিফাত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নোভার কাছাকাছি এসে বিরবির করে বলল,
“ঠিক এভাবে আমারও অস্বস্তি হয়। যখন তুই আমার দিকে হ্যাংলার মত তাকিয়ে থাকিস। তখন আমি তোর ভাইকে ডাকি? ডাকি না তো। তবে তুই কেন ডাকবি?”
নোভা আর কিছু বলল না। চুপচাপ হেঁটে ছাদের এক কোণে চেয়ারে বসে পড়ল।

শ্যামল দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিমূর্তি সায়মার সামনে। সায়মার লাল লাল চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“কি হয়েছে তোমার? আমার উপর রেগে আছো? কেউ কিছু বলেছে? এভাবে এখানে কেন নিয়ে এলে?”
সায়মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেই বলল,
“সুইটহার্ট কাকে বলছিলে?”
শ্যামল অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এজন্য রেগে আছো?”
সায়মা পুনরায় বলল,
“সুইটহার্ট কাকে বলছিলে?”
শ্যামল ফোন বের করতে করতে বলল,
” নিজেেই দেখে নাও।”
সায়মা ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল,
“ফোনে কে ছিল শ্যামল? আমি কিন্তু আর চাপ নিতে পারছি না। তাড়াতাড়ি উত্তর দাও। কে ছিল ফোনে?”
শ্যামল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নোভা। আবরারের বোন। ইভানার ননদ। যে ভবিষ্যতে তোমারও ননদ হবে।”
সায়মা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“সত্যি সত্যি বলছো তো? কসম, নোভাই ছিল?”
শ্যামল ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো ?”
“করছি।” সায়মার ভাবলেশহীন উত্তর।
“এই দিন দেখতে হলো আমাকে? তুমি পারলে এটা করতে?”
“না পারার তো কিছু নেই। যে আমাকে প্রপোজ করার সাহস পায় নি। আমাকে পাওয়ার জন্য আমার বান্ধবীর পিছু পিছু ছুটেছে। সে আজ হঠাৎ ফোনে সুইটহার্ট সুইটহার্ট বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছে। আমার সন্দেহ হবে না? আজ অবধি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল না। অথচ তার এগিয়ে আসার জন্য লোক পাঠাচ্ছে। আমার সন্দেহ হবে না? বেশ করেছি সন্দেহ করেছি। আরও করব। একশবার করব। হাজার বার করব। বুড়ো বয়সেও করব। দেখি তুমি কিভাবে ঠেকাও।”
শ্যামল মুচকি হেসে বলল,
“এটা তুমি ভুল বললে জানে মন। আমি তোমার দিকে তাকাই। তাকাই বলেই দেখতে পাচ্ছি ধবধবে ফর্সা পেটটা মেরুন ওড়নার ফাঁক গলে উঁকি মারছে।”
সায়মা তাড়াহুড়ো করে ওড়নার কোণা টেনে ঠিক করে বলল,
“তুমি অসভ্য হয়েছো কবে থেকে? আগে তো এমন ছিলে না। কি করছো তুমি আজকাল?”
শ্যামল আশেপাশে নজর বুলিয়ে একটু এগিয়ে এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে বলল,
“আমি অসভ্য হইনি সোনা। যদি হতাম তবে চিপায় চাপায় তাকাতাম। আমি তাকিয়েছি একবারও?”
সায়মা দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“থাকো তুমি। আমি গেলাম।”
শ্যামল হেসে বলল,
“ওড়নায় পিন লাগিয়ে নিও। আমার সম্পদে বহিরাগত দস্যুর নজর কিন্তু আমি বরদাস্ত করব না।”

বিয়ের লগ্ন উপস্থিত। কাজী এসেছে মেয়ের সম্মতি নিতে। ইভানা কাজীসহ জনা চারেক মানুষের উপস্থিতিতে নড়েচড়ে বসল। বুকের ভেতরটায় উথাল-পাথাল শুরু হয়েছে তার। শুধু তিনটি শব্দ! জীবনকে জুড়ে দেবে অন্য একটা জীবনের সাথে। অন্য একটা পরিবারের সাথে। ইভানার বুক ফেটে কান্না উপচে পড়তে চাইছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে চলেছে অনবরত।
কাজী সাহেব বিয়ের কাজ শুরু করতেই সায়মা এসে কানে ব্লুটুথ গুঁজে দিল। ইভানা কিছু বলার আগেই কর্ণকুহরে শব্দের উৎস খুঁজে পেল।
আবরার কথা বলছে। মৃদুস্বরে বলা কথাগুলো শুনে ইভানার কান্নারা থমকে গেল। ভাবনারাও নিজেদের জায়গায় স্থগিত রইল।
আবরার কাজীর বলা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। কাজী প্রথম বার কবুল বলতে বলার পর আবরার বলল,
“কথা দাও জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত কেবল আমার ভালবাসার রঙেই নিজেকে রাঙাবে। তোমার প্রতিটি স্পন্দনে কেবল আমার নামই প্রতিধ্বনিত হবে।”
ইভানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদুস্বরে বলল, “কবুল।”
কাজী আবার কবুল বলতে বলার পর আবরার বলল,
“কথা দাও আমি না থাকলেও আমার পরিবার কে তুমি আমার অভাব বুঝতে দেবে না। আমি না থাকলেও আমার জায়গাটা কেবল আমার জন্যই রাখবে। আমার জায়গায় আমি কাউকে সহ্য করতে পারব না। সেটা হোক এপারে বা ওপারে। কথা দাও আমার অনুপস্থিতিতেও কাউকে জীবনে জড়াবে না। আমার জন্য তোমার মনের গহীনে একটা কুঁড়েঘর বানাবে। যে ঘরের পরদে পরদে সাজানো থাকবে ভালবাসা। কেবলই ভালবাসা।”
ইভানা আবারও বলল, “কবুল।”
এবার কাজীর পর আবরার মৃদু হেসে বলল,
“এটাতে কিছু চাইব না। এটা আমার ব্ল্যাং চেক। তুমি শুধু কবুল বলো। আমার যখন যা ইচ্ছে করবে আমি সময়মত বসিয়ে নেব। আদায় করে নেব৷”
ইভানা কিছু বলতে চেয়েও পারল না। আশেপাশে বসা মানুষ তাড়া দেওয়াতে নিশ্বাস চেপে ধরে বলল,
“কবুল।”
আবরার শব্দ করে শ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল,
“আমার বউ। শুধু আমার।”
ইভানার গা কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। আজ থেকে নিজের অস্তিত্বে ধারণ করতে হবে অন্য একটা মানুষের অস্তিত্ব। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে তো সে? নাকি বিলীন হবে আবরার নামক স্রোতে।

নোভা নিজের পরিচিত মানুষ জন ছেড়ে ছাদের এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আকাশের ওপারে গিয়ে ঠেকেছে। বরযাত্রী হিসেবে আসা তার কাজিন মহল বার কয়েক এসে সঙ্গ দিতে চাইলেও নির্বিকার ছিল সে। রিফাতের বলা কথাগুলোই ঘুরে ফিরে রেকর্ডারের মত কর্ণকুহরে বাজছে তার। সকলের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে পড়ার ভয়ে ইচ্ছে না থাকা সত্বেও খেয়ে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে সে। ঘন্টাখানেক কেটে গেলেও নিজের অবস্থান পরিবর্তন করার কোনো ইচ্ছে দেখা দিচ্ছে না তার। আনন্দে মজে থাকা বিয়ে বাড়িটাকেও মনে হচ্ছে শোকাহত কোনো মজলিশে দাঁড়িয়ে আছে সে।

“তুমি এখানে লুকিয়ে আছো? তুমি জানো আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি?”
নোভা ইচ্ছে না থাকা সত্বেও ভদ্রতাসূচক মুচকি হেসে বলল,
“আমাকে কেন খুঁজছিলেন? কোনো দরকার?”
সাজিদ নিরাশ গলায় বলল,
“তুমি কি সবসময় কম কথা বলো?”
নোভা মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় আকাশের দিকে নজর দিল।
উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার কথাই বলতে ইচ্ছে করে না। আল্লাহ চাইলে আমাকে বোবা কালা বানিয়ে দিতে পারতো। আমি অভিযোগ করতাম না কখনো।”
সাজিদ কপাল কুঁচকে তাকাল। বিরবির করে বলল, “পাগল নাকি?”
পরক্ষণেই মৃদু হেসে বলল,
“এমন সুন্দর সৃষ্টিকে বোবা কালা বানালে ধরণী দ্বিধা হতো না?”
নোভা আগ্রহ দেখালো না। প্রশংসা পেয়ে আপ্লুত হলো না। লজ্জাও পেল না। নিজস্ব ভঙ্গি বজায় রেখে আকাশ পানে তাকিয়ে রইল।
সাজিদ পুনরায় বলল,
“তুমি কি ডিপ্রেসড? আমাকে বলতে পারো। বয়ফ্রেন্ড ধোঁকা দিয়েছে?”
নোভার এবার মেজাজ খারাপ হলো। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি অনধিকার চর্চা করছেন?”
সাজিদ মৃদু হেসে বলল,
“অনধিকার হলে হবে। কিন্তু ভরা পূর্ণিমাকে তো আমি অমাবস্যায় রূপ নিতে দিতে পারি না।”
নোভা বিরক্ত হয়ে তাকাল।
মন গহীন থেকে কেউ একজন বিরবির করে বলল,
“আমি তো চাঁদ হতে চাইনি। চাইনি পূর্ণিমা হতে। অমাবস্যা হয়েও যদি তাকে পাওয়া যেত তবে আমি আজীবন অমাবস্যা হতে রাজি।”

বিদায় লগ্নে মাকসুদা খানম মেয়ের দুগালে হাত রেখে বললেন,
“যে সম্পদ আজ তোমার হলো তার যথাযথ পরিচর্যা করো। মনে রেখো সম্পর্ক একটা চারাগাছের মতো। তুমি যত এর যত্ন নেবে ততটাই বাড়বে সে। তত বাড়বে এর শিকড়ের গভীরতা, ডালপালার বিস্তার। সম্পর্কও তেমন। যত যত্ন নেবে তত পরিধি বাড়বে, বিশ্বাস বাড়বে। ভালবাসাও বাড়বে। এমন কিছু করো না যাতে তোমার বাবা মায়ের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে কেউ। একজন মা পেয়েছো, একজন বোন পেয়েছো তাদের ভালবেসো। মনে রাখবে ভালবাসা দিলে তা ভালবাসা হয়েই ফিরে আসে। কাটা ছুড়লে তা কখনো ফুল হয়ে ফিরবে না কিন্তু। তাই চেষ্টা করবে কাটা না সকলকে ফুল উপহার দিতে।ফুলের মত পবিত্র ভালবাসা দিতে।”
ইভানা মা’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠতেই তিনি বাঁধা দিয়ে বললেন,
“কান্না নয় মা। আজ তোমার নতুন করে জন্ম হলো। জন্ম লগ্নে কাঁদতে নেই মা। এটা তো খুশির সময়, আনন্দের সময়। হাসি হাসি মুখে শ্বশুরবাড়ি পদার্পণ করবে।”
আবরারের দিকে তাকিয়ে নমনীয় গলায় বললেন,
“আমার মেয়েটাকে দেখো বাবা। বড় বিশ্বাস করে তোমার হাতে দিয়েছি। বিশ্বাসের অমর্যাদা করো না বাবা।”

ইয়াসিন মোন্তাজ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন,
“একা যেতে ভয় পাচ্ছিস? আমি কাল সকালেই চলে আসব। একদম ভোর হতেই। আবরার কোনো ঝামেলা করলে আমাকে বলবি। একদম শুট করে দেব। আমার একটা মাত্র মেয়ে। কোনো হেলাফেলা সহ্য করব না আমি।”
ইভানা বাবার বুকে আগলে থেকেই ইভানের দিকে ইশারা করে বলল,
“আয়।”
ইভান সাথে সাথে বোনের কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
ইভানা মৃদু হেসে বলল,
“কি ব্যাপার আজ পাঁচ মিনিট বললি না কেন? ডাকলাম আর চলে এলি। শরীর ভালো আছে তো?”
ইভান মাথা নিচু করেই বলল,
“আপু যাস না। আমি একা একা কি করে থাকব? কে আমাকে পাঁচ মিনিটের জন্য গালি দেবে? তুই যাস না আপু। আমি আর পাঁচ মিনিট বলব না। তোর সব কথা শুনব। প্রমিস। যাস না আপু।” বলতে বলতে ফুপিয়ে উঠল ইভান।
ইভানা ভাইকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল,
“কালই চলে আসব তো। কাঁদিস না ভাই। মিথি দেখে ফেলবে। ছিচকাদুনে ইভান কে ও কিন্তু আর পছন্দ করবে না। আচ্ছা ভাই তুই কি যাবি আমার সাথে?”
ইভান কিছু বলার আগেই ইয়াসিন মোন্তাজ বললেন,
“ও কাল যাবে আমার সাথে। আজ তোর সাথে সাজিদ আর ইফতি যাচ্ছে।”
ইভানা ইভানের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কাঁদে না পাগল। এখন আমাকে টাটা বাই বাই কর।”

বিদায় নিয়ে কিছুদূর পৌঁছাতেই ইভানা ফোপাঁতে শুরু করল। ক্রমে ক্রমে কেবল ফোঁপানোর মাত্রা বেড়েই চলল। আবরার চুপিচুপি শান্তনা দিয়েও থামাতে না পেরে হাত টেনে বুকের সাথে চেপে ধরল। করুণ মুখে বলল,
“আমারও কষ্ট হচ্ছে এবার। প্লিজ থামো।”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১১

ফুলে ফুলে সাজানো সাদা রঙের গাড়িটা এসে থামল মরিচ বাতিতে সজ্জিত একটি হালকা নীলাভ বর্ণের ভবন বিশিষ্ট বাড়ির সামনে। গেটের ঠিক সামনেই অবস্থান করছে গাড়িটা। একে একে সবাই নেমে যাওয়ার পর আবরার ইভানার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার নতুন ঠিকানা। ওয়েলকাম মিসেস ফাইয়াজ। আমার ছোট্ট কুটিরে আপনার সাদর আমন্ত্রণ।”
ইভানা মুচকি হেসে মাথা নোয়ালো।
আবরার নামতেই ইভানা বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ঠিক তখনই নোভা তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ভাবী পা বাইরে বের করো না। দুমিনিট অপেক্ষা করো। মা আসছে এক্ষুনি।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফাহিমা করিম বেরিয়ে এলেন বাড়ির ভেতর থেকে । গাড়ির দরজা খুলে ইভানার হাত ধরে বাইরে বের করে দাঁড় করালেন।
মিষ্টিমুখ করিয়ে একটা স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
“আমার ঘর দিনের আলোর মত আলোকিত করো মা। সামলে রেখো আমার একাকিত্বের সংসার।”
ইভানা মাথা নুইয়ে আশ্বাস দিল।

“দাদাভাই এবার ভাবীকে কোলে নিয়ে ভেতরে চলো।”
নোভার সাধারণভাবে বলা কথাটাও ইভানার কানে বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো।
এতগুলো মানুষের সামনে কোলে তুলে নিয়ে যাবে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল ইভানার।
ফাহিমা করিমের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আমি হেঁটে যেতে পারব তো আন্টি।”
ফাহিমা করিম বিস্মিত হয়ে বললেন,
“ওমা! আন্টি কি বলছো? মা হই তো আমি। আবরারের মা মানে তোমারও মা। ইদানিং কালের ওভার স্মার্ট বউদের মত আন্টি ফান্টি বলা চলবে না কিন্তু। এতদিন কিছু বলিনি বিয়ে হয়নি বলে। এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন তো তুমি আমার আবরারের বউ। আমার আরেকটা মেয়ে। মা বলবে কেমন?”
ইভানা লজ্জিত মুখে বলল,
“ঠিক আছে মা।”
ফাহিমা করিম এবার হাসিমুখে বললেন,
“হাঁটাচলা করতে পারা বউতো দেখে শুনেই এনেছি মা। তাই হেঁটে তো যেতেই পারবে। কিন্তু এখান থেকে ভেতরে তো বরের কোলে চেপেই যেতে হবে। এটা বহুবছরের পুরনো নিয়ম। এ বাড়ির পূর্ব পুরুষেরা এভাবেই মেনে এসেছে। আবরারের বাবাও আমাকে নিয়ে এভাবেই বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। তোমরাও করবে। ভবিষ্যতে তোমার সন্তানেরাও করবে। ইনশাআল্লাহ।”

আবরারের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,
“বান্ধবী হয়েছি বলে কি বউকে কোলে নেওয়াও শিখিয়ে দিতে হবে বাপ?”
আবরার মাথা চুলকে হেসে বলল,
“নিচ্ছি মা।”
পরমূহুর্তেই এক ঝটকায় কোলে তুলে বিনা সংকোচে সামনে পা ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। পাত্তা দিল না ইভানার বিস্ময়ে কোটর হতে প্রায় বেরিয়ে আসা চোখ দু’টোকে।

নতুন বউয়ের নিয়মের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ইভানা কে নিয়ে যাওয়া হলো নোভার রুমে। নোভা ইভানাকে বিছানায় বসতে দিয়ে রুমের সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাবীর এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনারা প্লিজ অন্য রুমে গিয়ে বসুন।”
সকলে চলে যেতেই নোভা ইভানার পাশে বসে বলল,
“ভাবী একটু শুয়ে থাকতে পারো এখন। কিছুক্ষণ পরেই দাদাভাইয়ের রুমে ওপস সরি তোমাদের রুমে গিয়ে যাওয়া হবে। ততক্ষণ এখানেই বিশ্রাম নাও। সারাদিন তো বোধহয় সুযোগ পাও নি। ততক্ষণে আমি ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নেই।”
ইভানা বিছানা থেকে নিচে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“আমিও ফ্রেশ হব । লাগেজ কোথায় রাখা আছে? এই ভারী শাড়ী আর ভালো লাগছে না। নিয়মনীতির পাঠ তো চুকে গেছে তাই না?”
নোভা ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়েও ফিরে এসে বলল,
“ওমা, তুমি ফ্রেশ হবে কি বলছো? যার জন্য সাজলে তাকে দেখাবে না?”
ইভানা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই নোভা মুচকি হেসে বলল,
“আমি দাদাভাইয়ের কথা বলেছি।”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল। পুনরায় বসল বিছানায়। অস্থির মনে শরীর ছেড়ে দিতেই হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে পা রাখল ফাহিমা করিম।
ইভানা তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতেই ফাহিমা করিম বাঁধা দিয়ে বললেন,
“আস্তে আস্তে এত তাড়াহুড়ো করার কি হয়েছে? আমিই তো। নিজের মা হলে এভাবে উঠতে?”
ইভানা কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইল।
ফাহিমা করিম খাবারের প্লেট হাতে ধরিয়ে দিতেই বলল,
“আমি খাব না মা। খিদে পায় নি।”
ফাহিমা করিম কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,
“বকা দিতে হবে?”
“সত্যি খিদে নেই মা। খেয়েছি আমি। কিছুক্ষণ আগেও তো মিষ্টি খেলাম কতগুলো।”
ফাহিমা করিম আয়েস করে বসে বললেন,
“আচ্ছা! তা কখন খেয়েছো? দুপুরে? নাকি তারও আগে? শোনো মেয়ে আমিও বিয়ে করে এবাড়িতে এসেছি। আমি জানি বিয়ের সময় কত খাওয়া হয়। আমার বেলায় কি হয়েছিল জানো? আমার তো শ্বাশুড়ি ছিল না। আত্নীয় স্বজন থাকলেও কেউ খাওয়ার কথা বলে নি। হয়তো ভুলে গিয়েছিল। মাঝরাতে সেকি ক্ষুধা পেয়েছিল। শেষে সদ্য বিবাহিত বউ হয়ে তোমার শ্বশুর কে বলেছিলাম। তাকে দিয়ে খাবার আনিয়ে খেয়ে তারপর শান্তি। তুমিও কি আমার ছেলেটাকে এভাবে জ্বালাতে চাইছো?”
ইভানা মুচকি হেসে প্লেট হাতে তুলে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল আগে হাত ভালো করে সময় নিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
ফাহিমা করিম মুচকি হেসে বললেন,
“দাও আমি খায়িয়ে দিচ্ছি।”
ইভানা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মন গহীন থেকে কেউ একজন বলল- এমনও শ্বাশুড়ি হয়?

“আপনারা এই রুমে থাকুন। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই ডাকবেন। আমি না থাকলে অন্য কাউকেও বলতে পারেন। সংকোচ করবেন না। আসছি।”
এতটুকু বলে নোভা সাজিদ এবং ইফতির জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো।
সাজিদ পেছন থেকে বলল,
“এক মিনিট শোনো।”
নোভা পেছনে ঘুরে মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“জ্বি, কিছু লাগবে?”
সাজিদ মনে মনে বলল,
“তোমাকে লাগবে।”
কিন্তু মুখে বলল,
“হ্যা। এই ইফতি যা তো ঘুরে আয় বাইরে থেকে।”
ইফতি চলে যেতেই সাজিদ নোভার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। নোভা পিছনে সরে দুরত্ব বজায় রেখে বলল,
“কোনো সমস্যা?”
সাজিদ নরম গলায় বলল,
” সমস্যা তো অনেক বেয়াইন। তুমি এত সুন্দর কেন বলো তো?”
নোভার মেজাজ তড়াক করে সপ্তমে পৌঁছে গেল। কিন্তু মাথা যথা সম্ভব ঠান্ডা রেখে বলল,
“প্রথমত বেয়াইন শব্দটা স্কিপ করুন। আই জাস্ট হেট দ্যাট ওয়ার্ড। দ্বিতীয়ত আমি সুন্দর এটা আল্লাহর সৃষ্টি। তাই আমাকে না বলে প্রশ্নটা আল্লাহ কে করুন। তবে আমি সুন্দর না হয়ে কুৎসিত হলেই বেশি খুশি হতাম।”
সাজিদ কৌতুহলী হয়ে বলল,
“সৌন্দর্যের প্রতি এত কেন অনিহা তোমার?”
নোভা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার জীবনের মূল্যবান জিনিসটা এই সৌন্দর্যের জন্যই হারিয়েছি, হারাচ্ছি। এক সময় পুরোটা হারিয়ে ফেলব। আর এই সৌন্দর্যের জন্যই তো আপনি এভাবে বার বার কথা বলতে আসছেন। কালো হলে আসতেন না। তাই কালো রঙটাই আমার জন্য মানানসই ছিল।”
বলেই গটগট করে হেঁটে চলে এলো কক্ষ ছেড়ে।
সাজিদ মৃদু অপমানটা মুখ বুজে সহ্য করে নিল। মনে মনে বলল- সুন্দরীদের জন্য এতটুকু করাই যায়।
দরজার বাইরে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা রিফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কেন নোভা? কেন পাগলামি করছিস? কেন বুঝতে পারছিস না তোর এই পাগলামির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি পারব না তোকে রাজপুত্রের মত পক্ষীরাজে চেপে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। আমি তোর জন্য নই নোভা। তোকে তো বুঝতে হবে। এতটা অবুঝ হওয়া তোর সাজে না।”

তাজা ফুলের সৌরভে সুরভিত সদ্য বিবাহিত দম্পতির কক্ষ। আবরার নিজের পরিচিত রুমে প্রবেশ করে অপরিচিত বোধ হলো। এ ঘরটাকে মোটেও তার এত বছরের পরিচিত, আপন ঘর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সাজানো এক বাগান। যেখানে শতশত শুভ্র ফুলের হাট বসেছে।
কিন্তু রুমে কোথাও ইভানা কে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখল সেই লাস্যময়ী রমণী বারান্দা বিলাস করছে। মৃদুস্বরে ধ্যানরত কন্যা কে ডাকল।

ইভানা চকিতে পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে ফুলে সজ্জিত বিছানার কাছাকাছি আসতেই মনে পড়ল সালাম করার কথা। পুনরায় আবরারের দিকে এগিয়ে আসতেই আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বাই এনি চান্স তুমি কি সালাম করতে চাইছো?”
ইভানা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
আবরার যথাসম্ভব দূরে সরে বলল,
“একদম না। কোনো প্রয়োজন নেই। এসব আদিকালের সংস্কৃতি। কিন্তু তুমি এখনো এগুলো পরে বসে আছো কেন? ফ্রেশ হও নি কেন? এগুলো পরেই ঘুমোবে?”
ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার জন্যই তো।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার জন্য? কিভাবে? আমি বলেছিলাম?”
“আসলে… ”
“কি আসলে?”
“আপনার দেখার জন্য।” ইভানা চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলল।
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তাই! তবে এসো দেখি।”
ইভানা ঘাবড়ে গিয়ে দুপা পিছিয়ে গেল।
আবরার হেসে বলল,
“আচ্ছা আচ্ছা আর দেখে কাজ নেই। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। লাগেজ ওইযে টেবিলের সামনে। তোমার তো স্পেস লাগবে। তুমি রুমে থাকো। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।”
ইভানা সায় জানালো।
আবরার ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে বলল,
“হেল্প লাগবে?”
ইভানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল,
“গহনা, খোঁপার ফুলের ক্লিপ খুলতে পারবে?”
ইভানা মাথা নিচু করে বলল,
“চেষ্টা করছি।”
আবরার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।

মিনিট কয়েক পর বেরিয়ে দেখল ইভানা আয়নার সামনে বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। আবরার আসতেই অসহায় মুখ করে বলল,
“পারছি না।”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“আগেই বলেছিলাম।”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল।
আবরার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ঠিক ইভানার পেছনে। আরশিতে নববধূর মুখ দর্শন করতে করতেই হাত বাড়াল শুভ্র রঙা বেলি ফুলের গাজরায়।

শাড়ি বদলে কাঁঠাল রঙা তাঁতের শাড়ি পরে এসে আবরারের মুখোমুখি বসে বলল,
“আমি কি কাছে আসব?”

চলবে….

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১১

ফুলে ফুলে সাজানো সাদা রঙের গাড়িটা এসে থামল মরিচ বাতিতে সজ্জিত একটি হালকা নীলাভ বর্ণের ভবন বিশিষ্ট বাড়ির সামনে। গেটের ঠিক সামনেই অবস্থান করছে গাড়িটা। একে একে সবাই নেমে যাওয়ার পর আবরার ইভানার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার নতুন ঠিকানা। ওয়েলকাম মিসেস ফাইয়াজ। আমার ছোট্ট কুটিরে আপনার সাদর আমন্ত্রণ।”
ইভানা মুচকি হেসে মাথা নোয়ালো।
আবরার নামতেই ইভানা বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ঠিক তখনই নোভা তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ভাবী পা বাইরে বের করো না। দুমিনিট অপেক্ষা করো। মা আসছে এক্ষুনি।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফাহিমা করিম বেরিয়ে এলেন বাড়ির ভেতর থেকে । গাড়ির দরজা খুলে ইভানার হাত ধরে বাইরে বের করে দাঁড় করালেন।
মিষ্টিমুখ করিয়ে একটা স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
“আমার ঘর দিনের আলোর মত আলোকিত করো মা। সামলে রেখো আমার একাকিত্বের সংসার।”
ইভানা মাথা নুইয়ে আশ্বাস দিল।

“দাদাভাই এবার ভাবীকে কোলে নিয়ে ভেতরে চলো।”
নোভার সাধারণভাবে বলা কথাটাও ইভানার কানে বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো।
এতগুলো মানুষের সামনে কোলে তুলে নিয়ে যাবে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল ইভানার।
ফাহিমা করিমের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আমি হেঁটে যেতে পারব তো আন্টি।”
ফাহিমা করিম বিস্মিত হয়ে বললেন,
“ওমা! আন্টি কি বলছো? মা হই তো আমি। আবরারের মা মানে তোমারও মা। ইদানিং কালের ওভার স্মার্ট বউদের মত আন্টি ফান্টি বলা চলবে না কিন্তু। এতদিন কিছু বলিনি বিয়ে হয়নি বলে। এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন তো তুমি আমার আবরারের বউ। আমার আরেকটা মেয়ে। মা বলবে কেমন?”
ইভানা লজ্জিত মুখে বলল,
“ঠিক আছে মা।”
ফাহিমা করিম এবার হাসিমুখে বললেন,
“হাঁটাচলা করতে পারা বউতো দেখে শুনেই এনেছি মা। তাই হেঁটে তো যেতেই পারবে। কিন্তু এখান থেকে ভেতরে তো বরের কোলে চেপেই যেতে হবে। এটা বহুবছরের পুরনো নিয়ম। এ বাড়ির পূর্ব পুরুষেরা এভাবেই মেনে এসেছে। আবরারের বাবাও আমাকে নিয়ে এভাবেই বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। তোমরাও করবে। ভবিষ্যতে তোমার সন্তানেরাও করবে। ইনশাআল্লাহ।”

আবরারের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,
“বান্ধবী হয়েছি বলে কি বউকে কোলে নেওয়াও শিখিয়ে দিতে হবে বাপ?”
আবরার মাথা চুলকে হেসে বলল,
“নিচ্ছি মা।”
পরমূহুর্তেই এক ঝটকায় কোলে তুলে বিনা সংকোচে সামনে পা ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। পাত্তা দিল না ইভানার বিস্ময়ে কোটর হতে প্রায় বেরিয়ে আসা চোখ দু’টোকে।

নতুন বউয়ের নিয়মের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ইভানা কে নিয়ে যাওয়া হলো নোভার রুমে। নোভা ইভানাকে বিছানায় বসতে দিয়ে রুমের সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাবীর এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনারা প্লিজ অন্য রুমে গিয়ে বসুন।”
সকলে চলে যেতেই নোভা ইভানার পাশে বসে বলল,
“ভাবী একটু শুয়ে থাকতে পারো এখন। কিছুক্ষণ পরেই দাদাভাইয়ের রুমে ওপস সরি তোমাদের রুমে গিয়ে যাওয়া হবে। ততক্ষণ এখানেই বিশ্রাম নাও। সারাদিন তো বোধহয় সুযোগ পাও নি। ততক্ষণে আমি ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নেই।”
ইভানা বিছানা থেকে নিচে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“আমিও ফ্রেশ হব । লাগেজ কোথায় রাখা আছে? এই ভারী শাড়ী আর ভালো লাগছে না। নিয়মনীতির পাঠ তো চুকে গেছে তাই না?”
নোভা ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়েও ফিরে এসে বলল,
“ওমা, তুমি ফ্রেশ হবে কি বলছো? যার জন্য সাজলে তাকে দেখাবে না?”
ইভানা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই নোভা মুচকি হেসে বলল,
“আমি দাদাভাইয়ের কথা বলেছি।”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল। পুনরায় বসল বিছানায়। অস্থির মনে শরীর ছেড়ে দিতেই হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে পা রাখল ফাহিমা করিম।
ইভানা তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতেই ফাহিমা করিম বাঁধা দিয়ে বললেন,
“আস্তে আস্তে এত তাড়াহুড়ো করার কি হয়েছে? আমিই তো। নিজের মা হলে এভাবে উঠতে?”
ইভানা কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইল।
ফাহিমা করিম খাবারের প্লেট হাতে ধরিয়ে দিতেই বলল,
“আমি খাব না মা। খিদে পায় নি।”
ফাহিমা করিম কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,
“বকা দিতে হবে?”
“সত্যি খিদে নেই মা। খেয়েছি আমি। কিছুক্ষণ আগেও তো মিষ্টি খেলাম কতগুলো।”
ফাহিমা করিম আয়েস করে বসে বললেন,
“আচ্ছা! তা কখন খেয়েছো? দুপুরে? নাকি তারও আগে? শোনো মেয়ে আমিও বিয়ে করে এবাড়িতে এসেছি। আমি জানি বিয়ের সময় কত খাওয়া হয়। আমার বেলায় কি হয়েছিল জানো? আমার তো শ্বাশুড়ি ছিল না। আত্নীয় স্বজন থাকলেও কেউ খাওয়ার কথা বলে নি। হয়তো ভুলে গিয়েছিল। মাঝরাতে সেকি ক্ষুধা পেয়েছিল। শেষে সদ্য বিবাহিত বউ হয়ে তোমার শ্বশুর কে বলেছিলাম। তাকে দিয়ে খাবার আনিয়ে খেয়ে তারপর শান্তি। তুমিও কি আমার ছেলেটাকে এভাবে জ্বালাতে চাইছো?”
ইভানা মুচকি হেসে প্লেট হাতে তুলে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল আগে হাত ভালো করে সময় নিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
ফাহিমা করিম মুচকি হেসে বললেন,
“দাও আমি খায়িয়ে দিচ্ছি।”
ইভানা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মন গহীন থেকে কেউ একজন বলল- এমনও শ্বাশুড়ি হয়?

“আপনারা এই রুমে থাকুন। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই ডাকবেন। আমি না থাকলে অন্য কাউকেও বলতে পারেন। সংকোচ করবেন না। আসছি।”
এতটুকু বলে নোভা সাজিদ এবং ইফতির জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো।
সাজিদ পেছন থেকে বলল,
“এক মিনিট শোনো।”
নোভা পেছনে ঘুরে মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“জ্বি, কিছু লাগবে?”
সাজিদ মনে মনে বলল,
“তোমাকে লাগবে।”
কিন্তু মুখে বলল,
“হ্যা। এই ইফতি যা তো ঘুরে আয় বাইরে থেকে।”
ইফতি চলে যেতেই সাজিদ নোভার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। নোভা পিছনে সরে দুরত্ব বজায় রেখে বলল,
“কোনো সমস্যা?”
সাজিদ নরম গলায় বলল,
” সমস্যা তো অনেক বেয়াইন। তুমি এত সুন্দর কেন বলো তো?”
নোভার মেজাজ তড়াক করে সপ্তমে পৌঁছে গেল। কিন্তু মাথা যথা সম্ভব ঠান্ডা রেখে বলল,
“প্রথমত বেয়াইন শব্দটা স্কিপ করুন। আই জাস্ট হেট দ্যাট ওয়ার্ড। দ্বিতীয়ত আমি সুন্দর এটা আল্লাহর সৃষ্টি। তাই আমাকে না বলে প্রশ্নটা আল্লাহ কে করুন। তবে আমি সুন্দর না হয়ে কুৎসিত হলেই বেশি খুশি হতাম।”
সাজিদ কৌতুহলী হয়ে বলল,
“সৌন্দর্যের প্রতি এত কেন অনিহা তোমার?”
নোভা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার জীবনের মূল্যবান জিনিসটা এই সৌন্দর্যের জন্যই হারিয়েছি, হারাচ্ছি। এক সময় পুরোটা হারিয়ে ফেলব। আর এই সৌন্দর্যের জন্যই তো আপনি এভাবে বার বার কথা বলতে আসছেন। কালো হলে আসতেন না। তাই কালো রঙটাই আমার জন্য মানানসই ছিল।”
বলেই গটগট করে হেঁটে চলে এলো কক্ষ ছেড়ে।
সাজিদ মৃদু অপমানটা মুখ বুজে সহ্য করে নিল। মনে মনে বলল- সুন্দরীদের জন্য এতটুকু করাই যায়।
দরজার বাইরে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা রিফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কেন নোভা? কেন পাগলামি করছিস? কেন বুঝতে পারছিস না তোর এই পাগলামির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি পারব না তোকে রাজপুত্রের মত পক্ষীরাজে চেপে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। আমি তোর জন্য নই নোভা। তোকে তো বুঝতে হবে। এতটা অবুঝ হওয়া তোর সাজে না।”

তাজা ফুলের সৌরভে সুরভিত সদ্য বিবাহিত দম্পতির কক্ষ। আবরার নিজের পরিচিত রুমে প্রবেশ করে অপরিচিত বোধ হলো। এ ঘরটাকে মোটেও তার এত বছরের পরিচিত, আপন ঘর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সাজানো এক বাগান। যেখানে শতশত শুভ্র ফুলের হাট বসেছে।
কিন্তু রুমে কোথাও ইভানা কে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখল সেই লাস্যময়ী রমণী বারান্দা বিলাস করছে। মৃদুস্বরে ধ্যানরত কন্যা কে ডাকল।

ইভানা চকিতে পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে ফুলে সজ্জিত বিছানার কাছাকাছি আসতেই মনে পড়ল সালাম করার কথা। পুনরায় আবরারের দিকে এগিয়ে আসতেই আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বাই এনি চান্স তুমি কি সালাম করতে চাইছো?”
ইভানা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
আবরার যথাসম্ভব দূরে সরে বলল,
“একদম না। কোনো প্রয়োজন নেই। এসব আদিকালের সংস্কৃতি। কিন্তু তুমি এখনো এগুলো পরে বসে আছো কেন? ফ্রেশ হও নি কেন? এগুলো পরেই ঘুমোবে?”
ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার জন্যই তো।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার জন্য? কিভাবে? আমি বলেছিলাম?”
“আসলে… ”
“কি আসলে?”
“আপনার দেখার জন্য।” ইভানা চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলল।
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তাই! তবে এসো দেখি।”
ইভানা ঘাবড়ে গিয়ে দুপা পিছিয়ে গেল।
আবরার হেসে বলল,
“আচ্ছা আচ্ছা আর দেখে কাজ নেই। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। লাগেজ ওইযে টেবিলের সামনে। তোমার তো স্পেস লাগবে। তুমি রুমে থাকো। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।”
ইভানা সায় জানালো।
আবরার ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়েও ফিরে তাকিয়ে বলল,
“হেল্প লাগবে?”
ইভানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল,
“গহনা, খোঁপার ফুলের ক্লিপ খুলতে পারবে?”
ইভানা মাথা নিচু করে বলল,
“চেষ্টা করছি।”
আবরার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।

মিনিট কয়েক পর বেরিয়ে দেখল ইভানা আয়নার সামনে বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। আবরার আসতেই অসহায় মুখ করে বলল,
“পারছি না।”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“আগেই বলেছিলাম।”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল।
আবরার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ঠিক ইভানার পেছনে। আরশিতে নববধূর মুখ দর্শন করতে করতেই হাত বাড়াল শুভ্র রঙা বেলি ফুলের গাজরায়।

শাড়ি বদলে কাঁঠাল রঙা তাঁতের শাড়ি পরে এসে আবরারের মুখোমুখি বসে বলল,
“আমি কি কাছে আসব?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here