সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -৩২+৩৩

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩২

১২-০২-২০১৫
“হুট করে কেউ বড় হতে পারে? পারে কিশোরী থেকে পরিপূর্ণ নারী হতে? তবে সে কেন হলো? নাকি প্রেমিক চোখের ভুল? তবে কি তাকে বলার সময় এসে গেল?”

২২-০৩-২০১৫
“আজ তাকে বলব। বলব মনের ভেতরের গোপন কুঠরীতে লুকিয়ে রাখা অব্যক্ত কাব্য।”

২৮-০৩-২০১৫
“শ্যামল, রিফাত বলছে আমি নাকি রামবলদ। তুমিই বলো, আমার কি দোষ? তোমার দিকে একপা বাড়ালেই আমার হাঁটু কাঁপে, মাথা ঘুরে যায়। এটা কি আমার অপরাধ?”

০৮-০৫-২০১৫
“আজ বলবই বলব। বলতে না পারলেও সযত্নে লেখা চিঠিটা তোমাকে দেবই দেব। তুমি পড়ে দেখবে তো? পড়া শেষে মুচকি হাসবে? নাকি বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলবে?”

০৮-০৫-২০১৫
“আমি বোধহয় তোমার হারিয়ে ফেললাম কাঁচাগোল্লা!”

ইভানা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। নিজমনে বলল,
“পেলই না হারালো কিভাবে? আশ্চর্য!”

নোরার সাথে কথোপকথনের একপর্যায়ে পাশে তাকাল রিফাত। নোভাকে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে নজর বুলালো। ভীড়ের মাঝে এদিক ওদিক খুঁজেও নোভার সন্ধান মিলল না তার। অবশেষে নোরাকে রেখেই দ্রুত আশেপাশে খুঁজতে শুরু করল। সন্ধ্যা নেমেছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই। আবছা রোশনাইয়ে প্রেয়সীর দেখা পেল না রিফাত। মেলা চত্বরে বার কয়েক সুঁচ খোঁজা খুঁজেও যখন নোভার হদিস পেল না তখন হাঁটু কাঁপতে শুরু করল তার। তবে কি বিপদ হলো মেয়েটার! মাঠের কিনারা ঘেঁষে হাঁটুভেঙে বসে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল সে।
কিয়ৎক্ষণ পর নোরা শুভ্র রঙা একটা হাতব্যাগ রিফাতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এটা বোধহয় মেয়েটার।”
রিফাত মাথা উঁচু করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখ দু’টো টলটল করছে তার।
নোরা পাশে বসল। নমনীয় গলায় বলল,
“মেয়েটা কে রিফাত?”
রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি বলবে সে! কে হয় মেয়েটা!
নোরা কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে চাপড়ে দিল। বলল,
“তুমি ওর বাড়িতে একবার ফোন দিয়ে দেখো।”
রিফাতের সাহসে কুলালো না। কি বলবে সে? হারিয়ে গেছে নোভা! আমি দেখে রাখতে পারি নি। আগলে রাখতে পারি নি। নিজের চুল দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে পুনরায় আর্তচিৎকার করল রিফাত। অতঃপর তড়িৎগতিতে ছুটল মেলার প্রাঙ্গণের বাইরের পানে।

নোভা স্থির চিত্তে বসে আছে বকুল তলার ঠিক উল্টোদিকের রাস্তায়। দৃষ্টি সামনের খোলা জমিতে নিবদ্ধ। হৃদয় গহীনের বালু ঝড়ের কবলে পড়েছে গোটা শরীরটাই। থেকে থেকে কেঁপে ওঠছে সমস্ত কলেবর। মাথা নিচু করে মুখে আঁচল চেপে হৃদয় উগলে বেরিয়ে আসা হাহাকারটুকু গিলে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল পিচ্চি মেয়েটা।
সহসা এক পুরুষালী শক্ত হাতের চাপ নিজের বাহুতে পড়তেই নোভা শিউরে উঠল। কুঞ্চিত হলো ভ্রু যুগল। আঁতকে ওঠে সচকিত দৃষ্টিতে তাকাল পাশেই হাঁটু ভেঙে বসে থাকা মানুষটার দিকে।

ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখে ইভানা ফোন হাতে নিল। একাকী নিরবতা আর ভাল লাগছে না তার। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সহসাই মৃদু আওয়াজে বেজে উঠল ফোনটা।
ইভানা মুচকি হেসে মৃদুস্বরে বলল,
“মিস্টার রামবলদ এই আপনার সময় হলো আমাকে মনে করার?”
সেকেন্ড দুয়েক ভ্রু কুঁচকে থেকে শব্দ করে হেসে ফেলল আবরার। অতঃপর বলল,
“সব জানা শেষ?”
ইভানা মাথা নাড়িয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। কণ্ঠে একরাশ আবেগ ঢেলে বিনয়ী গলায় বলল,
“আপনার মুখে শুনতে চাই আবরার।”
আবরার হাসল। সুখী হাসি। বলল,
“কি জানতে শুনতে চায় আমার কাঁচাগোল্লা বউটা?”
ইভানা চোখ বন্ধ করে দু’দিকে দু-হাত ছড়িয়ে রিল্যাক্স ভঙ্গিতে বলল,
“সবটা।”
আবরার তার পুরুষালী ভরাট গলায় বলল,
“এমনই বসন্ত ছিল সেদিন। গাছে গাছে শিমুল পলাশের সাজ ছিল। কোকিলের কুহুতান ছিল। ছিল প্রেমিকের প্রেম প্রেম অনূভুতির আন্দোলন। এমনই এক বসন্তের দিনে চলতি পথে তোমায় দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। জানোতো ওই পিচ্চিতে আহামরি কিছু ছিল না। অথচ আমাকে বশ করে নিয়েছিল। বশ করে নিয়েছিল আমার সবটুকু সত্তাকে। নীল সাদা রঙের ইউনিফর্মে দুই পাশে ঘন কেশের দু’টো ঝুঁটি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল জানো! আমি আর ছুটতে পারিনি সেই বাঁধন থেকে। বিশ্বাস করো আমি চেষ্টা করেছিলাম। অতটুকু একটা বাচ্চাকে দেখে প্রেম জেগে ওঠার মত মানসিকতা আমার কোনো কালেই ছিল না। অথচ আমি প্রেমে পড়েছি তার। ভয়ংকর প্রেমে আসক্ত হয়েছি। ঠিক যেমন আসক্ত কোকিল বসন্তের।”
ইভানা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ রেখে শ্রবণ করতে লাগল মধুমাখা গলায় নিঃসৃত হওয়া বাক্যগুলো।
আবরার ইভানার সাড়াশব্দ না পেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“কাঁচাগোল্লা আছো?”
ইভানা অস্ফুটে বলল,
“আছি। আপনি বলুন না প্লিজ।”
আবরার মৃদু হাসল। প্রাণহারিনী তার আবেগে ভাসা সময়ে রচিত কাব্য জানতে চাইছে। এর চেয়ে মধুময় কিছু হতে পারে বসুন্ধরায়!

বাহু ছেড়ে এক ঝটকায় ছোট্ট শরীরটা নিজের বাহুডোরে আঁকড়ে ধরল রিফাত। সেকেন্ডের পরিক্রমায় আরও দৃঢ় হলো হাতের বাঁধন। লেপ্টে গেলে ইস্পাত কঠিন প্রশস্ত বক্ষপিঞ্জরে।
নোভা আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে দেহের ভার ছেড়ে নেতিয়ে পড়েছে। এতগুলো দিনের কাঙ্খিত জায়গায় স্থান পেয়েও দু’হাত তুলে ঝাপটে ধরতে পারছে না হৃদয় প্রাঙ্গণের ব্যক্তিগত পুরুষটিকে।
কিঞ্চিৎ সময় পেরুতেই রিফাত নামক কঠিন পুরুষটির কঠিন মনের পর্দা ফুঁড়ে চাপা কষ্টগুলো গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আবছা আলোয় তা কারো নজরে না আসার সম্ভাবনা থাকলেও তার শরীরের অতিরিক্ত কাঁপন অনুভব করে নোভা হুঁশ ফিরে পেল। মাথা উঁচিয়ে অবাক হয়ে বলল,
“রিফাত ভাই! তুমি কি কাঁদছো?”
রিফাত কিছু বলল না। কেবল এক ঝটকায় নোভার থেকে দূরে সরে গেল। তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এখানে সং দেখানো শেষ হলে চল বাড়ি ফিরব। আন্টি চিন্তা করছে। সে আমার কিছু না হলেও তোর মা হয়। আর কারো কথা না ভাবলেও তার কথা তোর ভাবা উচিৎ।”
নোভা প্রতিত্তোর করল না। অনড় রইল নিজের জায়গায়।
রিফাত বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“এখন কি তোর পা ধরে বলতে হবে? আমি কিন্তু ওসব পারব না। না গেলে আমি চলে যাচ্ছি। তুই থাক এই ভূতুরে গাছের তলায়।”
ভেতরে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নাগুলো মূহুর্তেই উগলে বেরিয়ে এলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সহসাই করুণসুরে বিলাপ করে কাঁদতে আরম্ভ করল নোভা। রিফাত হকচকিয়ে গেল। হাঁটু ভেঙে বসে নোভার গালে হাত রেখে বলল,
“এই পাগলি আমি আছি তো। কাঁদছিস কেন এভাবে? ভয় পাচ্ছিস? দেখ এইতো আমি। তাকা আমার দিকে।”

নোভা তাকাল না। আরও বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করল। রিফাত দিশা খুঁজে না পেয়ে মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
“এখানে খুব জ্বলছে রে পিচ্চি। কেন পোড়াচ্ছিস এভাবে?”
নোভা বিস্ময় ভরা নেত্রে তাকাল। কাঁপা কাঁপা হাত বুকের বাঁপাশটায় ছোঁয়াতেই অনুভব করতে পারল দ্রুত বেগে দৌড়ে চলা হার্টবিটগুলোকে। কিন্তু পরক্ষণেই অভিমান এসে ভীড় জমালো মনোর দোরগোড়ায়। অভিমানী গলায় বলল,
“আপনার নোরা? সে কোথায়? তার কাছে যান।”
এতক্ষণ হাঁটু ভেঙে বসে থাকা রিফাত সহসাই পুরোপুরি লেপ্টে বসল মাটির সাথে।
অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“সেজন্য লাপাত্তা হয়েছিলি? আরে বলদের বলদ একবার জিজ্ঞেস তো করবি কে হয় ও আমার। মনডা চাইছে কানের নিচে একটা দিয়ে কান গরম করে ফেলি। বেয়াদবের বেয়াদব।”
নোভা মাথা তুলে রিফাতের দিকে তাকাল। মুখে খুশি ভাব ফুটিয়ে তুলতে গিয়েও নতজানু হয়ে বলল,
“ভালবাসেন না তাকে?”
রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এখনো বলতে হবে?”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহুমা_রাহা
#পর্বঃ৩৩

রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এখনো বলতে হবে?”
নোভা আবছা আঁধারে রিফাতের মুখটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু ওই আলো আঁধারির খেলায় শ্যামবরণ মুখটা ধরা দিল না তার নজরে।
রিফাত পুনরায় বলল,
“ভ্যাদা মাছের মত পড়ে রইলি কেন? উঠে আয়। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই নাকি আজ?”
নোভার থেকে প্রতিত্তোর না পেয়ে মুখে বিরক্তিসুচক শব্দ উচ্চারণ করে নিচু হলো রিফাত। একহাত পিঠের নিচে গলিয়ে অন্য হাত হাঁটুর নিচে রেখে পাঁজা কোলা করে তুলতেই নোভা চেঁচিয়ে উঠল। পরক্ষণেই মুখে হাত রেখে চাপা স্বরে বলল,
“কি করছো রিফাত ভাই! নামাও, আমি হেঁটে যাচ্ছি।”
রিফাত কানে তুলল না চাপা গলার আওয়াজগুলো। নিজের মত পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল সামনে।

পিঠ পেঁচিয়ে রাখা হাতে নোভার শাড়িতে লেগে পেটের দিকটায় টান পড়তেই নোভা অস্ফুটে গুঙিয়ে উঠল। রিফাত তৎক্ষনাৎ চলার গতি থামিয়ে থমকে দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
“নোভা! কি হয়েছে?”
নোভা এক হাত পেটে চেপে ধরে বলল,
“লাগছে রিফাত ভাই। আমায় নামাও।”
নামিয়ে দিতেই নোভা দাঁড়িয়ে পেটের কাপড় ঠিক করে চোখ মুখ শক্ত করে ব্যথাটুকু গিলে ফেলল। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলল,
“এখন চলো।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে নোভার দিকে তাকাল। আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বলল,
“হাত সরা পেটের উপর থেকে।”
নোভা সরালো না। বরং আরও শক্ত করে চেপে ধরে রইল। রিফাত পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করে আলো জ্বালিয়ে তাকাতেই চোখ পড়ল পেটের সাথে লেপ্টে থাকা রক্তলাল একটুকরো জমির ওপর। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াতেই নোভা পেছনে সরে গেল। আঘাত পাওয়া জায়গাটুকু চেপে ধরে বলল,
“কি করছো রিফাত ভাই! আমি ঠিক আছি। বাড়ি চলো।”
রিফাত রক্তচক্ষু করে তাকাল। গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
“আমি হাত সরাতে বলেছি।”
নোভা তবুও শক্ত হাতে আঁকড়ে রইল জায়গাটা।
রিফাত একপা এগিয়ে এসে কব্জিতে শক্ত করে চেপে ধরে থমথমে গলায় বলল,
“আমি কিছু বলেছি কানে যাচ্ছে না?”
চেনা পুরুষটির অচেনা রূপ দেখে নোভা কেঁপে উঠল। ভয়ে সিঁটিয়ে দুপা পেছনে সরতেই রিফাত কব্জি ছেড়ে বাহুতে চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
“আমাকে ভয় পাচ্ছিস তুই? আমাকে? এমনিতে তো ভালবাসি ভালবাসি বলে মাথা চিবিয়ে খেয়ে ফেলিস।এখন কিসের ভয়? খেয়ে ফেলব আমি তোর সাদা পেট?”

নোভা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে উঠল। রিফাত অগ্যতা পিছিয়ে এলো। একহাতে মাথার চুল মুঠো করে ধরে চেষ্টা করল নিজেকে সামলাতে। কিঞ্চিৎ সময় পর নরম গলায় বলল,
“পিচ্চি তাকা না আমার দিকে। দেখ তোর রিফাত ভাই তো। ভয় পাচ্ছিস কেন? আচ্ছা,ঠিক আছে। আমি দেখব না। ডক্টরের কাছে চল। ডক্টর দেখে মেডিসিন দিয়ে দেবে।”

নোভার প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করে রিফাত সামনে ঘুরে একপা ফেলতেই হাতে টান পড়ল তার। ঘাড় কাত করে পেছনে তাকাতেই নজরে এলো নোভার আকুতি ভরা নয়ন। অশ্রু টলটল করছে সেখানে। কেবলই গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়।
রিফাত পেছনে ফিরে গালে হাত রেখে নমনীয় গলায় বলল,
“ব্যথা করছে? হেঁটে যেতে পারবে না? গাড়ি নিয়ে আসতে বলি?”
নোভা এবারেও প্রতিত্তোর করল না। হাত টেনে আঁচলের একপ্রান্ত ধরিয়ে দিয়ে মাথা নিচু ফেলল।রিফাত খানিক সময় পর হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপা হাতে পেটের বা পাশের কাপড় উঁচু করতেই বেরিয়ে এলো শুভ্র পুঞ্জীভূত মেঘে একটুকরো সিঁদুর রঙা ক্ষত। ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ন্যায় ক্ষত। ক্ষতর আশেপাশে জ্বলজ্বল করছে জমাট বাঁধা রক্তবিন্দু। তৎক্ষণাৎ কাপড় টেনে দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তখন শাড়িতে ঘষা লেগেছে?”
নোভা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রিফাত নরম গলায় বলল,
“হেঁটে যেতে পারবি? আমি বাইক আনাই?”
নোভা মুচকি হেসে বলল,
“আমি ঠিক আছি রিফাত ভাই। এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? একটুই তো।”
রিফাত স্থির দৃষ্টিতে তাকাল নোভার মুখপানে। উদাস গলায় বলল,
“তুই অনেক বদলে গেছিস নোভা। আগে তো এমন ছিলি না। আগে এক চিলতে ব্যথাও সহ্য করতে পারতি না। সামান্য সুচের আঘাতেই চিৎকার করে সকলের মাথা খারাপ করে ফেলতি। এখন পেট চিঁড়ে ভাগ হয়ে গেছে অথচ তুই টু শব্দটিও করছিস না।”
“আমি বড় হয়ে গেছি রিফাত ভাই।” গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো নোভা।
রিফাত সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিরবির করে বলল,
“এত বড় কেন হলি রে পিচ্চি! তোর বড় হওয়াটাই আমার যন্ত্রণার মুখ্য কারণ।”

সদ্য প্রেমে পড়া আনারি প্রেমিকার প্রেম আলাপে সহাস্যে তাল মেলাচ্ছে আবরার। বাঁধাহীন আলাপনে মত্ত ইভানা হঠাৎই মনে পড়ার মত বলল,
“আচ্ছা আপনি আমায় এটা বলুন তো, আপনি আমায় হারিয়ে ফেলার কথা কেন বলেছেন? পেলেনই তো না। তবে?”
আবরার হেসে বলল,
“প্রেমপত্র শ্বশুরবাবার কাছে চলে গিয়েছিল যে।”
“কিহ!” চেঁচিয়ে উঠল ইভানা।
“হুম। তোমাকে ভালবাসার কথা বলতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে যখন চিঠি লিখে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখনই কেলেংকারী ঘটে গেল। তোমার সামনে যাওয়ার তো সাহস পেতাম না। তাই এক পিচ্চি কে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পেছনে যে তোমার বাবা ছিল আমি জানতাম না। জানব কি করে? চিনতামই তো না। তারপর চিঠি হাতবদল হয়ে চলে গেল শ্বশুর মশাইয়ের হাতে। তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন সবটা। আমার তখন ঘাম ছুটে যাচ্ছিল, জানো! অতঃপর তিনি যখন এটা বললেন যে তিনি আপনার স্বনামধন্য পিতা। তখন বিশ্বাস করো আমার হার্ট অ্যাটাক হতে হতেও হয় নি। নেহাৎই হার্ট আমার সুস্থ সবল ছিল। নইলে সাত বছর আগেই পরলোকগমন করে ফেলতাম।”
ইভানা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আপনাকে রামবলদ নয়, রাম ছাগল বলা উচিৎ। সরি টু সে গাধার গাধা আপনি, বলদের বলদ। আপনি সত্যিই ভেড়া। শ্যামল ভাইয়া ঠিকই বলেছিল। আপনিই আসল ভেড়া। সত্যি সত্যিই ছোট ভেড়ার জন্ম দিতে হবে আমায়। জন্মেই ভ্যা ভ্যা করে ডাকবে। তারা আবার হবে হাই সোসাইটির উচ্চ লেবেলর ভেড়া। কি সাংঘাতিক!”

ডাক্তারের চেম্বারে আঘাত প্রাপ্ত জায়গায় প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত হলো নোরা। নোভা তখন চুপচাপ ভেতর ও বাহিরের জ্বলন দাঁতে দাঁত চেপে গিলছে। নোরা নোভার দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সহিত বলল,
“ঠিক আছো তুমি এখন? কোথায় চলে গিয়েছিলে ওভাবে? তুমি জানো রিফাত তোমায় খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। এভাবে কেউ যায় বোকা মেয়ে?”

নোভা একবার মাথা তুলে তাকিয়ে পুনরায় মাথা নিচু করে ফেলল। মনটা তার বড্ড খারাপ করছে এখন।
মনে মনে বলল,
” আপদ তো এখানে এসেও হাজির।”
নোভার নীরবতা লক্ষ করে রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল,
“ওর নাম তখন শুনেছিস না? ওর হচ্ছে নোরা। আমার জীবনের অনেকটা সময় আমি অনাথ আশ্রমে কাটিয়েছি। নোরা ছিল সেখানে আমার একমাত্র সঙ্গী। ভালো একজন বন্ধু এবং সর্বোপরি একজন বোন।সমবয়সী ছিলাম দুজনে। তাই সখ্যতাও ছিল বেশি। নোরা আমার কাছে আমার নিজেরই বোন। তোর জানা উচিৎ সে বিয়ে করে নিয়েছে এবং তার দুজন ফুটফুটে সন্তান রয়েছে। এবার নিশ্চয়ই তার সাথে কথা বলা যায়, রাইট?”

নোভা এতক্ষণে চোখ মেলে তাকাল নোরার দিকে। ওই তো মা মা আদরের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেয়েটির অভয়বে। কিন্তু মুখে কিছু বলার আগেই নোরা রিফাত কে কপট ধমক দিয়ে বলল,
“থামো তুমি। দেখছো মেয়েটা আহত। তবুও তুমি তাকে আঘাত করে কথা বলছো। ও তো ভালবাসে তোমাকে। সেজন্য আমাকে দেখে রিয়াক্ট করে ফেলেছে। নর্মাল ব্যাপার এটা। আমি হলেও এটাই করতাম। তুমি হলেও এটাই করতে। হয়তো দু চার ঘা লাগিয়েও দিতে। এখন ওর সময় খারাপ তাই তুমি ওকে বকছো। এটা কিন্তু একদম ঠিক নয় রিফাত। সরি বলো ওকে।”

রিফাত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বলল,
“সরি বলব? আমি? তাও আবার হাঁটুর বয়সী বাচ্চাকে?”

নোরা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“ওমা! হাঁটুর বয়সী বাচ্চা কে ভালোবাসতে পারো। তখন সমস্যা হয় না। সরি বলতে গেলে জাত যায়?”

রিফাত চোখ বড় বড় করে বলল,
“থামো এবার নোরা। এ মেয়ে মাথায় উঠে নাচবে আমার। চেনো না তো তুমি একে।”

নোভা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আমায় ভালবাসো রিফাত ভাই?”

রিফাত ভ্রুকুটি করে তাকাল। বলল,
“আমি বলেছি?”

নোভা দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল,
“না বললেও বাসো?”

রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নরম গলায় বলল,
“তুই আমাকে ভালবেসে সুখ পাবি না রে পিচ্চি। আমি আবরারের সামনে এই কথাটা মুখ ফুটে বলার সাহস রাখি না। তার পরিবারের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের ঘরের সম্মান নিয়ে খেলেছি। আমি মুনাফেকি করতে পারব না রে। তখন তো আমাকে তোর থেকে দূরে সরতেই হবে। তোর আগামী জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে আমার জন্য। এর থেকে ভালো তুই আমাকে ভুলে যা। এই মূহুর্ত থেকে ভুলে যা রিফাত নামে কেউ ছিল বা আছে।”

নোভা তিরস্কার স্বরুপ হেসে বলল,
“আমি ভবিষ্যতে কষ্ট পেতে পারি ভেবে তুমি আমায় বর্তমানেই মেরে ফেলছো রিফাত ভাই!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here