আমাদের বিয়ের বন্ধনটা ভেঙ্গে ফেলতে তুরাব ভাইয়া আজ নিজেই কুমিল্লা আসেন,সাথে খালামণিও।প্রথমে আমি বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারি নি।ভাবলাম কৌতুক হয় ত।
কিন্তু যেই খালামণির দিকে তাকালাম ওমনি তিনি আমার দিকে একটা ডিভোর্স পেপার এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“সানা,দুঃখিত আমি।তোদের ছোট কালের বিয়েটা আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না।আসলে জানতাম না,বড় হলে ছেলেমেয়েদেরও যে নিজস্ব একটা অভিমত বা ইচ্ছা থাকে।তখন না জেনে,না বুঝে তোর এবং তুরাবের বিয়েটা দিই।কিন্তু এখন বুঝলাম কতটা ভুল করে ফেললাম!”
বলেই অপরাধী ভঙ্গিতে একটা দৃঢ় শ্বাস ছাড়েন।আমি হতচকিতে তুরাব ভাইয়ার দিকে তাকাই।উনি মুখটা কেমন গম্ভীর করে অন্যদিক তাকিয়ে আছেন। ভাবটা এমনভাবে নিচ্ছেন ডিভোর্স পেপারে সাইন করাটা যেন কাঁচকলা!
আমার বৃদ্ধ মাও পাশে ছিলেন। খালামণির থেকে এমন কিছু শুনতে হবে তা শুনতে তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।অবাক এবং বিস্ময় চোখে খালামণিকে বলেন,
“শাহিদা এসব তুই কি বলছিস!বিয়ে ভাঙ্গবি মানে?বিয়েটা ভাঙ্গলে আমার মেয়ের কত বড় সর্বনাশ হবে ভেবে দেখেছিস?দ্বিতীয়বার ওকে আমি বিয়ে দিব কিভাবে!?”
“দ্বিতীয় বার বিয়ে দেবে কিভাবে মানে? এটা কেমন কথা বললে!ছোটবেলার বিয়ে এসব কেউ গোনায় ধরে?হা হা হা হা।সংসার করে না,কখনো একে-অপরের সাথে আলাদা আলাপন করে না এটাকে বিয়ে বলা যায় না।কাগজে-কলমে বিয়ে হয়েছে,এখন কাগজে-কলমে শেষ হবে।ব্যাস্ এটুকুই ত!”
“সেটা নয়।তুই বুঝতে পারছিস না। সানার যে তুরাবের সাথে বিয়ে হয়েছে তা আশপাশের সবাই জানে!”
“সবাই জানে ত কি হয়েছে!সবার জানা-না জানা দিয়ে আমরা কি করবো!ওদের আমরা না খাই ,না ওদেরটা পড়ি।বুবু তুনি খামোখা উটকো জিনিস নিয়ে ভাবো বেশি!”
“উটকো কথা কই ভাবলাম!কিন্তু তোর সাথে আমার এমনতো কোনো কথা ছিলনা প্রাপ্ত বয়স হলে দুজনের ডিভোর্স হবে!বরঞ্চ কথা ছিল ওদের প্রাপ্ত বয়স হলে তুরাবের হাতে সানাকে তুলে দেওয়া হবে!”
শাহেদা খানিক বিরক্তি নিয়ে বলেন,
“বুবু,লাইফটা ওদের।আমাদের নয়!
মা খালামণির কথার পিঠে জবাব দেওয়ার আর কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না।বাকরুদ্ধ হয়ে স্তম্ভিতভাবে দাড়িয়ে রইলেন।আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।চোখের পানি কিণারে এসে টুপটাপ করছে। না পারি এখনই যেন কেঁদে দিই।কিন্তু এদের সামনে কেঁদেকুঁটে নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেবার মতো মেয়ে আমি নই!এদের এমন স্বার্থপরতা,হীনমন্যতাকে মনের ভেতর আগলে নিজেকে ছোট করতে ওরকম শিক্ষা নিয়ে বড় হই নি।মুখে সিরিয়াস ভাব এনে খুব শক্ত গলায় খালামণিকে আমি নিজেই বলে উঠলাম,
” বেশ ত এত রিজনের কোনো দরকার নেই।ডিভোর্স চাচ্ছেন সাইন করে দিচ্ছি!
আমার ওমন শক্ত কথায় তুরাব ভাইয়ার মাঝে কেমন প্রতিক্রিয়া হলো তা জানি না।তবে খালামণি এবং মা বেশ অবাক হলেন।আমি কলম হাতে নিয়ে পেপারে সাইন করবো এমতাবস্থায় তুরাব ভাইয়ার ফোন বেজে ওঠে।উনি হাত দিয়ে আমাদের থামিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যান কথা বলতে।তুরাব ভাইয়া বাইরে যাওয়ার পর পরই খালামণি কেমন স্বাভাবিক হয়ে যান।কপালের ঘন ভাঁজটা মসৃন করে মুখে একটা ইনোসেন্ট ভাব আনেন।বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে সোঁজা মায়ের সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসেন।আর অসহায় কন্ঠে বলেন,
“আমি খুবই দুঃখিত,বুবু।আমায় ক্ষমা করে দাও।কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না।ছেলে বড় হয়ে যে এমন হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।ওর কারণেই আসতে আজ বাধ্য হলাম।ও কোন মেয়েকে নাকি ভালোবাসে।তাকেই বিয়ে করবে।অন্য মেয়েকে সংসারে আনলে ও মরে যাবে এসব হ্যানত্যান বলে আমায় নিয়ে আসে।….”
খালামণি পুরো কথা শেষ করতে পারেননি তার আগেই তুরাব ভাইয়া ভেতরে চলে আসেন।খালামণি তড়িঘড়ি চোখের পানি মুছে নিয়ে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসেন।ভাইয়া এসেই হতাশ গলায় বলেন,
“মা,একটা সমস্যা হয়ে গেছে!”
“কী!”
” চাচীমা মাত্র কল করে বললেন রাতুল চাচা স্ট্রোক করেছেন!”
খালামণি বসা থেকে দাড়িয়ে যান।চোখমুখে আতঙ্কের গ্লানি স্ফুতিত হয়। হঠাৎ এমন একটা খবর শুনতে হবে তিনি তারজন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না!উৎকন্ঠা নিয়ে তুরাব ভাইয়াকে বলেন,
“কখন,কোথায়?ভাইজান এখন কোথায় আছেন?”
“তা জানি না।তবে,চাচীমা শুধু এটুকুই বললেন এখন চাচা “ঢাকা ল্যাব এইড হাসপাতালে”।আমরা তাড়াতাড়ি ঢাকায় যেতাম!”
“তাড়াতাড়ি?তাহলে দাড়িয়ে আছিস কেন তাড়াতাড়ি চল।হঠাৎ কি হলো ভাইজানের…!আচ্ছা, তোর বাবাকে কল করে এ ব্যাপারে জানিয়েছিস?”
“নাহ।বোধহয় চাচিমাই জানিয়ে দিয়েছেন এতক্ষণে।”
খালামণি আর কিছু না বলে এবার মায়ের দৃষ্টি দিকে ফেরেন।বলেন,
“বুবু,তোমার সাথে আমার পরে দেখা হবে!আমি এখন ঢাকায় চলে যাচ্ছি। শুনলে ত আমার ভাসুরের অবস্থা!”
বলেই খালামণি তুরাব ভাইয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে তরতর বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
খালামণি এবং তুরাব ভাইয়া চলে গেল। আর আমার সামনে পড়ে রইলো ডিভোর্স পেপার আর একটি কলম!তবে আমি এই দুটো জিনিসের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি নি।তার আগেই আমার অবাধ্য চোখের জল চোখের দু”কোল দিয়ে গড়গড়িয়ে বেয়ে পড়লো!মা তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।তারপর তিনি আমার কাছে এসে কাঁধে আলতো হাত রেখে পাশে বসতে বসতে বলেন,
“মা রে, কপাল আমাদের খারাপ!সেদিন চারপাশ অন্ধকার দেখে তুই অবুঝ খুকিটাকে বিয়ে দিয়ে দিই।আর আজ এর পরিণাম এতটা ভয়ংকর হবে ভাবতেই পারিনি।ক্ষমা করে দে মা আমাকে।আজ আমার জন্যে শুধুই আমার জন্যে এমন পরিস্থিতি…. !”
মা সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই আমি মাকে আমার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিই।মনের ক্ষুদ্রকোণে ওই মানুষগুলোর উপর এক ঘৃণাভরা অনুভূতি নিয়ে বলি,
“তোমার কোনো দোষ নেই, মা। সব দোষ ওই মানুষ গুলোর!যারা স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়!”
“তোর খালামণির দোষ আছে?”
“তা জানি না।”
“তোর খালামণি ত বললো চাপে পড়ে এরকমটা করতে বাধ্য হচ্ছে!”
“তাও জানি না।তবে,পৃথিবীর দেখা ভালো মানুষগুলোও অভিনয় করতে জানে।যে অভিনয়ের মঞ্চে আমরা নিরব দর্শক।”
“তাহলে তুই বলতে চাচ্ছিস তোর খালামণিই সব করতেছে?”
“জানি না,মা।”
বলেই মাকে ছাড়িয়ে উঠে দাড়াই।ধীর পায়ে হেঁটে আমার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিই।ক্লান্তি-অবসাদ শরীরটা নিয়ে আয়নার সামনে দাড়াই!গাঁয়ে লাল চকচকে একটা কাতান শাড়ি জড়ানো।চুলগুলো গুপড়ি করা।চোখে গাঢ় কাজল।কপালে লাল টিপ।কানে লতা দুল।নাকে নাকফুল।হাতে কাচের চুড়ি।আজ এত সব সাজগোজের আয়োজন কাকে ঘিরে ছিল!ওই মানুষটির জন্যে?যার সাথে সেই ছোট বেলায় মুখস্ত করা এক অর্থহীন শব্দে “কবুল” বলতে হয়েছিল!আর আজ “কবুল”শব্দটা ভেঙ্গেচুরে তিন খন্ড অক্ষর “ভাঙ্গন”-এ রূপ নিল।
মায়ের মুখ থেকে শোনা,তুরাব ভাইয়ার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে।আমার বয়স যখন আঁট বছর,তখন আমার বাবা মারা যায়।বাবার মৃত্যুতে মা খুব ভেঙ্গে পড়েন।আসলে আমাদের সংসারটা ছিল মধ্যবৃত্তের।বাবা খুব কম মাইনের একটা সরকারি চাকরি করতেন।তাই বাবাকে হারানোর তীব্র শোকে মনে মনে আমাকে নিয়েও শঙ্কায় পড়েন মা-বাবা মরা এই মেয়েকে কে দেখবে?কে পড়াবে?তার ভবিষ্যত কি হবে?ইত্যাদি ইত্যাদি।এই কষ্টগুলো মায়ের হৃদয়ে তখন বেশিক্ষণ আর ঠায় পায়নি তার আগেই আমার ছোট খালামণি এসে মাকে স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে দেন,
“সানাকে নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই!ওর ভবিষ্যৎ, পড়াশুনা,ওর দেখাশুনা সবটাই আমার উপর ছেড়ে দে।”
মা তখন কৌতূহল চোখে খালামণির দিকে তাকান শুধু।খালামণি মুখে হাসি টেনে মায়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“বিশ্বাস হয় না,তাইতো?ওর ভবিষ্যতটা আমি তুরাবের হাতে তুলে দিব।সানাকে আমি তুরাবের বউ করবো!”
সেই কথার তোড়েই দুজন নাবালিকা মেয়ে এবং ছেলেকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেয়।যারা কখনো “বিয়ে” নামক এই শব্দটির অর্থই বুঝতো না!তুরাব ভাইয়ার তখন বয়স ছিলো দশ,তিনি আমার বছর দুয়েক বড়।
আমাদের বিয়ের পরপরই খালামণি ঢাকায় চলে যান।আর ঢাকায় গিয়ে আমার সকল ভরণপোষণ, আমাদের সংসারের খরচাপাতি সব প্রতি মাসে মাসে পাঠাতে থাকেন।মাও বেশ খুশি হতেন। আমার কপালে তখন চুম্বন এঁকে দিয়ে বলতেন,
“তুরাবের মতো একটা ছেলে যেন আমার মায়ের চাঁদকপাল!সত্যিরে তুই অনেক ভাগ্যবতী।”
আমি মায়ের এসব কথা শুনে শুধু হাসতাম। অর্থ বুঝতাম না।যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি তখন তুরাব নামের ওই মানুষটির প্রতি আমার হৃদয়ঙ্গনে এক অন্যরকম ভালোলাগা আরম্ভ হয়।যাকে কখনো ভালোভাবে দেখি নি,জানি নি এমন সুক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কেন আলোছায়া বুনতো তা জানতাম না।তবে মায়ের ভাষ্যমতে,মনঃজগতে ওই মানুষটির সবকিছু মনে মনে কল্পনা করে নিতাম-মানুষটি খুব ভালো হাসতে জানে।কথা বলতে জানে।আদর করতে জানে ইত্যাদি ইত্যাদি।
একদিন ত ওই মানুষটির হাসার জগৎ কল্পনা করে আমি নিজেই অধোমুখ করে হেসে ফেলি।মা আমার হাসির শব্দ শুনে দৌড়ে রুমে এসে বললেন,
“কেন হাসছিস,সানা?”
আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাই।উত্তর করতে পারিনি।
আজ এতটা বছর কেটে গেল!বড় হওয়ার পর আজ এই প্রথম মানুষটিকে স্বচোখে দেখতে পেলাম।দীর্ঘকায় দেহের সুদর্শন এক পুরুষ।ছোটবেলায় দেখতে কেমন ছিল ঠিক খেয়াল নেই,তবে এখন সুন্দরের তুলনা আমার এই ছোটাক্ষরের মুখে অযৌক্তিক।
স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
সূচনা পর্ব
চলবে….
(কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না।অবশযই যুক্তি মূলক মন্তব্য চাই❤।হ্যাপী রিডিং।)