#হঠাৎ_বৃষ্টি। (প্রথম পর্ব)
সতের বছর পর হঠাৎ করেই আজ রুমেলের সাথে দেখা। মৌরির বিয়ের অনুষ্ঠানে।
মৌরি আমার কাজিন, মেজো খালার একমাত্র মেয়ে। আমার খালু রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার, মেয়ের জন্যও এক ফৌজি পাত্র বেছে নিয়েছেন। বিয়েও দিচ্ছেন বেশ ধুমধাম করে।
জমকালো বিয়ের এই অনুষ্ঠানটায় আমি নিজেও আজ যথেষ্ট সাজগোজ করেছি। দু বছর আগে তমাল মারা যাওয়ার পর, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু অনুষ্ঠান এভয়েড করার সুযোগ থাকে না। আর সত্য বলতে কি আমার তেরো বছরের কন্যা জারাও মৌরি আন্টি বলতে অজ্ঞান। তাইতো আন্টির এই বিয়ের অনুষ্ঠানটায় ওর উপস্হিতি সব জায়গায়। আমাদের মা ও মেয়ের চলমান কষ্টের জীবনে মৌরির বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগ করছি, প্রাণভরে।
বরপক্ষ অনুষ্ঠানস্হলে আসতেই রুমেলের দিকে আমার চোখ পড়লো। ছয় বছর চুটিয়ে প্রেম করা আমার প্রাক্তন এই প্রেমিককে চকিতেই চিনে ফেললাম, যদিও ওর এখন মুখ ভর্তি দাড়ি, যা আগে কখনোই দেখিনি। আড়াল থেকে খালাকে রুমেল সম্পর্কে বরের কি হয় জেনে নিলাম। মৌরির বরের নাম ফায়াজ, রুমেল যে আর্টিলারির এই মেজরের আত্মীয় এটা জেনে খুব অবাক হলাম।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, সতের বছর পর এক্স বয়ফ্রেন্ডকে দেখে আমার বুকে ধরফরানি শুরু হয়ে গেলো। এই ভরা মজলিশেও ওর মুখোমুখি হওয়ার সাহস হলো না। তবে আড়াল থেকে আমি রুমেলকে দেখছি, কেনো জানি আগের মতো করেই, তীব্র ভালোবাসার চোখে। আমার দুচোখ এখন রুমেলের স্ত্রীকে খুঁজছে। ভীষণ জানার আগ্রহ, কোন সে নারী যে কি না আমার প্রাক্তনের বাহুলগ্না! পৃথিবীর সব প্রাক্তনরাই সম্ভবত প্রাক্তনদের স্ত্রী সম্পর্কে ভীষণ কৌতুহলী।
“খালা রুমেলকে চিনতে পেরেছো? ঐ যে আমার ফ্রেন্ড। তমালের সাথে বিয়ের আগে অনেক নাটক করেছিলো? পরে তোমরা ওকে হাজতে ডুকালে।” খালা মানে মৌরির মাকে এই কথাগুলো বলতেই চুপ মেরে গেলেন। নিজের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততায় থাকা খালা রুমেলকে চিনতে পেরে যারপরনাই অবাক।
“ছেলেটা ফায়াজের কাজিন। বহুদিন লন্ডনে ছিলো। বিয়ে থা করেনি, এ টুকুই আমার জানা। তবে এই রুমেল যে তোর বন্ধু রুমেল এটা বুঝতে পারিনি। আর শোন সুমি, ওদের সাথে এখন আমাদের নতুন আত্মীয়তা। নিজে থেকেই সবার সাথে পরিচিত হয়ে নে।” খালার দেওয়া মুচকি হাসিটা আমাকে আর নাড়া দেয় না। রুমেলকে দেখে আমার দম বন্ধকর অনুভূতি হলেও, ও কে নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখার কোন ইচ্ছা জাগেনি। এমনকি এই চল্লিশে এসে ছেলেটা অবিবাহিত জেনেও।
গলফ ক্লাবের অডিটোরিয়ামের ভিতরে জমকালো অনুষ্ঠান হলেও বাইরে আজ প্রকৃতি ঝড়ো পরিবেশে। দমকা হাওয়া আর আকাশ জুড়ে মেঘ যেন আমার মনের প্রতিচ্ছবি।
“সুমি, আমার কথা তোমার এখনো মনে আছে যেনে ভালো লাগলো। তোমার মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও, আর তোমার হাসব্যান্ডের সাথে।” রুমলের কথা বলার ধরন একেবারেই বদলায়নি। একেবারে রাখডাক ছাড়া, মনে যা আসে তা বলে ফেলা।
“তমাল তিন বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে বছর দুয়েক আগে মারা গেছে। আর আমি একটা স্কুলে চাকুরী করি, মেয়েকে নিয়ে কল্যানপুরে ছোট্র একটা এপার্টমেন্টে জীবন যুদ্ধে। বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে আমার এই জীবন। সত্য বলতে কি মেয়েটাকে কিভাবে বড় করবো এই ভাবনাতেই সময় কিভাবে চলে যাচ্ছে টের পাচ্ছি না।” তমালের মৃত্যুর পর কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, শ্বশুর বাড়ি থেকে এক প্রকার তাড়িত হয়ে আমার বর্তমান জীবনের কথা অকপটেই রুমেলকে বললাম।
“সুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্য কি করিনি বলো? তোমাদের পরিবার পাড়ার মাস্তান দিয়ে আমাকে মারধোর করালো। তারপরও তোমার পিছু ছাড়িনি বলে আমাকে থানার যোগ সাজশে হাজত খাটতে হলো। আর সেই সময়টুকুতে তুমিও অন্যকে কবুল করে ফেললে। নাটক সিনেমার নায়কদের মতো আমি তোমাকে শেষ পযর্ন্ত ছিনিয়ে নিতে পারিনি। আমি অবশ্য কখনোই তোমাকে দোষ দেইনি। বিশ বাইশ বছরের একটা মেয়েরও বা কি করার আছে। যেখানে সমবয়সী চাল চুলোহীন এক বেকার প্রেমিক।” রুমেলের কথাগুলো আমার তীরের মতো বিধতে লাগলো। প্রায় দেড় যুগ আগে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক নাটক সাজিয়ে তমালের সাথে আমার বিয়েটাতে আমার বাবা সত্যই রুমেলের প্রতি ভীষণ অন্যায় করেছিলো।
“সরকারি বড় চাকুরের সাথে বিয়ে হয়েছে, বেশ ভালো আছো এটা জেনেছি। তারপর আমিও বছর দুয়েক ঢাকায় এটা ওটো করার চেষ্টা করলাম। সুবিধা করতে পারিনি বলে স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডন পাড়ি জমালাম। এইতো টানা পনের বছর ওখানে থেকে টিকতে না পেরে বলতে গেলে রিক্ত হাতেই ঢাকায় ফিরলাম। আবার শূন্য থেকে শুরু করবো বলে।
বিয়ের এই জমজমাট অনুষ্ঠানে আমার আর রুমেলের দীর্ঘ কথোপকথনটা অনেকের চোখেই পড়লো। এরই মধ্যে একবার আমার মেয়ে জারার সাথে রুমেলকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এখনকার বাচ্চারা অতিমাত্রায় স্মার্ট, কি বুঝে মেয়েও একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো। আমার অবশ্য ততোক্ষণে রুমেল সম্পর্কেই জানার আগ্রহ।
“লন্ডনে আমার ভালো সময় যায়নি। একটা সময় পর লেখাপড়া কন্টিনিউ করতে পারিনি। অড জবে জবে সময় পার হয়ে গেলো। ওখানে স্হায়ীও হতে পারলাম না, আবার খুব বেশি টাকাও জমাতে পারিনি। সবচাইতে বড় কথা জীবনে সংসার করার বিষয়টি আর প্রায়োরেটি লিস্টে আনিনি। ভালোই কাটছে। তবে হুম তোমাকে মিস করতাম, ইনফ্যাক্ট এখনো করি।” রুমেল আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো এটা আমার মতো শাহজাহানপুরের সবাই জানতো। তবে আজো আমার জন্য ভালোবাসা রয়েছে এটা জেনে অবাক হলাম।
“সুমি, আমি ভনিতা না করেই বলছি। অগোছালো এই জীবনে তোমাকে আমার খুব দরকার। আমাকে বিয়ে করবে জান?” সেই প্রিয় ডাকটা, সেই একই দরদে বলা রুমেলের কথায় এবার আতঁকে উঠলাম। কোন কথা না বলে ওর ওখান থেকে দ্রুত সরে এলাম। বুক ধরফরানিটা আরো বেড়ে গেলো। অডিটোরিয়ামের বাইরে আসতেই দেখি আকাশ ভেঙ্গে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। এ যেন হঠাৎ বৃষ্টি। তবে এই মুহূর্তে আমার হৃদয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়টা নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেশি।
(