হঠাৎ বৃষ্টি পর্ব -০২ শেষ

#হঠাৎ_বৃষ্টি (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

সতের বছর পর হঠাৎ মৌরির বিয়ের অনুষ্ঠানে রুমেলের সাথে দেখা। স্বামী মৃত তবে আমার একটা টিনেজ মেয়েওতো আছে। তমাল মারা যাওয়ার পর থেকে জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে, এখনো জীবন যুদ্ধেই আছি। তাইতো আমার সম্পর্কে না জেনে প্রথম দেখাতে রুমেলের দেওয়া সরাসরি প্রপোজটা মোটেও ভালো লাগেনি।

প্রচন্ড অস্হিরতায় বিয়ে বাড়ির খাবারও মুখে উঠলো না। এরপর পুরো অনুষ্ঠানে আমি আর রুমেলের সামনা সামনি হই নি। এমনিতেই আমার জীবনে অনেক সমস্যা, অযথা নতুন কিছুতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা নেই।

বিয়ের অনুষ্ঠানে রুমেলের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই আমার মধ‍্যে অনেক পরিবর্তন, বিষয়টি আমার মেয়ে জারার নজরেও এসেছে। মায়ের সাথে জীবন যুদ্ধে থাকা এই মেয়েটা বয়সের চাইতে অনেক পরিনত। কোন রাখ ডাক না রেখেই মেয়ের করা প্রশ্ন “ঐ লোকটা কি তোমার পুরনো কোন বন্ধু মা?” ভদ্রতা রাখতেই মেয়ের করা প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারলাম না। হঠাৎ করে আসা ঝড়, আবার নিমিষেই চলে গেছে এই ভাবনা থেকে।

শ‍্যামলীর একটা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক এই আমি সব ঝেরে ফেলে দিয়ে নতুন করে আরেকটা দিন শুরু করলাম। আশ্চর্য স্কুল শেষ হতে না হতেই দেখি গেটে রুমেল দাড়িয়ে। তিন ঘন্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষায়, গেটের দারোয়ান তথ‍্যটা কনফার্ম করতেই পুরনো কতো শত স্মৃতি মনে পড়ে গেলো।

আমি সিদ্ধেশ্বরী কলেজের এইচএসসির স্টুডেন্ট আর রুমেল এইচএসসি পাশ করে বেকার সময় কাটাচ্ছে। এক বিকেলে বাইরে লুকিয়ে ডেটিং শেষে রাগ করে বাসায় ফিরেছি, সম্পর্ক শেষ বলে ওকে জানিয়েও এলাম। এরপর রাত এগারোটাতেও দেখি বাসার সামনের ল‍্যাম্প পোস্টে ঠেস দিয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছে, পরে ইশারা দিয়ে এখনো সম্পর্ক আছে এই আশ্বাসটা দিতেই ওর বাড়ি যাওয়া। আমার জন‍্য ওর ঘন্টার পর ঘন্টা এই রকম দাড়িয়ে থাকার অভ‍্যাসটা পুরনো, তাইতো এতো বছর পর এসেও অবাক হইনি।

দুপুর দুটোর দিকে আমার স্কুল শেষ হলে সাধারণত আমি বাসায় চলে আসি, দ্রুত কিছু রান্না করে বিকেল চারটার দিকে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাই। এরপর ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়েকে আমি নিজেই পড়াই। আজ আর বাসায় গেলাম না রুমেলের সাথে হাটতে শুরু করলাম, আগারগাঁওয়ের রাস্তাটা ধরে। একটা চায়ের দোকানে চা বিরতিও নিলাম, সেই সাথে হাজারো কথায়। রুমেলকে কিন্তু আমার মোটেও অপরিচিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না। ও যেন বিশ্বস্ত ভালোবাসার মানুষদের একজন।

এতো বছর পর এসে রুমেলের মধ‍্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম, ছেলেটার দীর্ঘদিন মানসিক অসুস্থতার মধ‍্যে দিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও আমার কাছে স্পষ্ট। কথা বার্তাতেও প্রায়ই অসংলগ্নতা। আমাকে শুধু বললো ও ওর লন্ডন জীবনের অংশটা ভুলে যেতে চায়। অভিশপ্ত এই জীবনটাকে আবার নতুনভাবে শুরু করতে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাকে দেখার পর থেকেই ওর সংসার করার ইচ্ছা জেগেছে। আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতোই মেনে নিয়ে ওর সংসারে কোন আপত্তি নেই।

আমি অবশ‍্য আজ শুধু ওর কথাই শুনে গেলাম। তবে এরই মধ‍্যে রুমেল যে আমাকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছে এটা স্পষ্ট। বুঝলাম চাইলেই জীবনের সব ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রুমেল এখন আমার জীবনের আরেকটা ইস‍্যূ হয়ে এসেছে।

এরপর মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তবে রুমেল সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো। লিরা আমাদের পাড়ার ছোটবেলার বান্ধবী, এখন লন্ডনে স্হায়ী। অনেকদিন পর আমার পাওয়া কলটায় ও বেশ অবাক হলো।

রুমেলকে লিরা খুব ভালো করে চিনে। ইস্ট লন্ডনের যে বাসাটায় ও থাকতো তার কাছাকাছি নাকি এক সময় লিরাদেরও বাসা ছিলো। রুমেল নষ্ট ছেলে, লন্ডনে বহু কুকর্ম করে এখন দেশে ফিরেছে। কিছুটা অতিরঞ্জতা থাকলেও লিরার দেওয়া তথ‍্যটায় মোটেও অবাক হই নি। রুমেল নিজেও কিন্তু ওর লন্ডন জীবনকে ভুলতে চায়। কিন্তু আমার অনুসন্ধিৎসু মন ওর সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চায়, কতোটুকুন অন্ধকার ছিলো এই ছেলেটার জীবন।

সোহেল আমার কাজিন, লন্ডনে ও অনেক বছর ধরে থাকে। রুমেল সম্পর্কে ওর খুব ভালো জানা। লিরার মতো না হলেও ও রুমেলের মূল সমস‍্যাটা ও আমাকে বুঝিয়ে বলতে চাইলো। দেড় যুগ আগে এমনিতেই নাকি রুমেল আমার সাথে সম্পর্কের ব‍্যর্থতায় বিষন্নতায় ছিলো, তার উপর বিদেশ বিভুঁইয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। রেস্টুরেন্টের কিচেন হ‍্যান্ড আর ডেলিভারি কাজের মধ‍্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। একটা সময় পর শুধু কাজ আর কাজ করতে গিয়ে ওর স্টুডেন্ট ভিসাও ক‍্যানসেল হয়ে যায়।

এরপরই রুমেল লন্ডনে থাকার অবৈধ পথটাকেই বেছে নেয়। এক পোলিশ মেয়ের সাথে পার্টনার ভিসার চুক্তিতে যায়। সেই সময়টায় মেয়েটার এপার্টমেন্টের ভাড়া থেকে শুরু করে সব খরচ দিয়েছে রুমেল। কিন্তু ঐ মেয়েটা একটা সময় পর ওর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে চলে যায়। রুমেল আবারো এক রোমানিয়ান মেয়ের সাথে কন্ট্রাক্টে যায়, আবারো প্রতারিত হওয়া রুমেল এরপর থেকেই ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়ে।

ইস্ট লন্ডনের কিছু বাংলাদেশীও নাকি ওকে বিভিন্নভাবে ব‍্যবহার করেছে। মিথ‍্যা আশ্বাস দিয়ে। এরপর বাজে সঙ্গে এলকোহলিক হয়ে যাওয়া রুমেলের স্বাস্থ্য অবনতি হলে প্রায় দু সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। সেবারই ও সুস্থ হয়ে লন্ডনের মিছে জীবনের পিছনে না দৌড়ে, তল্পি তল্পাসহ এক প্রকার রিক্ত হাতে রুমেলের এই দেশে ফেরা।

সোহেল আমার কাজিন ওকে আমি খুব ভালো করেই জানি, ও যে এক বর্ণও মিথ‍্যা বলবে না এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সোহেল বারবার আমাকে বোঝাতে চাইলো আপাতত দৃষ্টিতে রুমেলকে যতোই খারাপ ভাবা হউক কি না, লন্ডনে সে পরস্হিতি ও পরিবেশের শিকার। লন্ডন বা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম বহু রুমেল রয়েছে, প্রবাস যুদ্ধে বহু চেষ্টার পরও অসফল।

এই চল্লিশে এসেও রুমেলের অবিবাহিত থাকার কারণটা বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রেমে ব‍্যর্থতার চাইতেও ওর টিকে থাকার যুদ্ধটা যে বিয়ে করার বাধা ছিলো, এটা আমার কাছে স্পষ্ট।

রুমেল এখন আমাকে ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে। সবসময়ই কথা বলতে চায়, প্রচন্ড কেয়ারিংনেস আছে। পুরো বিষয়টিই যেন আমার জন‍্য মিশ্র অনুভবের। আমার এক সময়ের ভালোবাসার মানুষ, এখন আমাকে চায়। কথাটা ভাবতেই বেশ ভালো লাগে। কিন্তু সময়ের সাথে মানুষটি ও আমি, দুজনের জীবনেই যে অনেক পরিবর্তন। সবকিছু ভেবে সম্পর্কে জড়ানোর সাহস পাই না। রুমেলকে নিয়ে একটা চিন্তা ও দুশ্চিন্তায় ঘুরপাক খেতে লাগলাম, অনেকদিন ধরে।

রুমেল কিন্তু ঠিকই আমার পিছনে চিনে জোঁকের মধ‍্যে লেগে রইলো। এরই মধ‍্যে আমার মেয়ের সাথেও ওর সখ‍্য। তবে একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো, রুমেল আমাকে সরাসরি চাপ দিচ্ছে না। সত‍্য বলতে কি গত পাঁচ বছর আমার জীবনে যে ঝড় গিয়েছে তারপর আর কোন চাপ নেওয়ার সুযোগও নেই। তবে বন্ধু রূপে রুমেলের সঙ্গ কিন্তু আমার মোটেও খারাপ লাগছে না।

তমাল অসুস্থ হওয়ার আগ পযর্ন্ত ওর সাথে ভালো ভাবেই সংসার করছিলাম। বাবর রোডে যৌথ পরিবারে ওর সাথে একান্তে সংসার করতে না পারলেও সুখের কোন কমতি ছিলো না। জারার স্কুল, আমার চাকুরী আর তমালের পেশাগত ব‍্যস্ততার মধ‍্যেও আমরা ছুটিতে এদিক ওদিক বেড়াতে গিয়েছি। তমাল আমাদের মেয়ে ও মায়ের জন‍্য দুহাত ভরে খরচ করেছে।

পাঁচ বছর আগে ওর ক‍্যান্সারের ডায়োগনসিসের পর থেকেই আমার পুরো জীবন পরিবর্তিত। বলতে গেলে এক হাতেই স্বামীকে নিয়ে লড়ে গেলাম। একেবারে শেষের দিকে আপনজনকেও পাশে পাইনি। ওর লাশ দাফনের পর থেকেই শ্বশুর বাড়িতে আমি আমার মেয়ে সহ অপাংতেয়। এরপর অনেক লাঞ্চনা বঞ্চনায় আমার বাবার বাড়ির স্বার্থপর লোকদেরও সমর্থন পাইনি। এরপর একটা সময় বাধ‍্য হয়েই বিদ্রোহ করলাম। সিঙ্গেল মাদার আইডেনটিটি নিয়ে সমাজের বহু কিটদের মোকাবিলা করে এখনো কোন রকমে বেঁচে আছি। রুমেল ধীরে ধীরে যেন এ পরিবারের একজন।

প্রায় দশ মাস পর রুমেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নিলাম, মূলত আমার মেয়ের উৎসাহেই। আগেই বলেছি, রুমেল আমার মেয়ে জারার সাথে খুব ভালো একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছে। আর এই সময়টায় আমার যাবতীয় সমস‍্যায় ছেলেটা আপনের মতোই আমাদের মা মেয়ের পাশে ছিলো। এক মুহূর্তের জন‍্যও আমার দিকে ওর অশ্রদ্ধার দৃষ্টি দেখিনি। রুমেল প্রায়ই বলে আমার জন‍্য না কি ও আজীবন অপেক্ষা করবে। আমার কথাটা খুব ভালো লাগতো।

আমি দীর্ঘদিন ধরে নীরবে রুমেলকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। ওর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিটা স্পষ্ট। আট মাসা আগের বিষন্ন রুমেল ইদানিং কথায় কথায় হাসে। বেশ উৎফুল্ল। নিজে লন্ডনে রেস্টুরেন্টে শেফের কাজ করেছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে কাছের কিছু বন্ধুদের নিয়ে এরই মধ‍্যে মিরপুরে একটা ক‍্যাফে শপও দিয়েছে। আয়টাও মন্দ না। বদ অভ‍্যাস সব ঝেরে ফেলে দিয়ে, ধর্মের দিকেও ঝুকেছে। আর এ সব যে ওর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা, এটা আমি বেশ বুঝি।

আমি নিজেও প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই সিঙ্গেল মাদার, টিনেজ মেয়েকে নিয়ে প্রতি মুহূর্তেই খাবি খাচ্ছি। ঘরে বাইরে শকুনে শ‍্যেন দৃষ্টিতে। নিজের ঘোর বিপদে বাবা বা শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও নির্বিকার। ভাবখানা এমন যে আমার জীবনটায় আমাকেই লড়তে হবে। আমিও গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত যুদ্ধে ভীষণ ক্লান্ত।

এইতো সে দিন এক রাতে নিজের মেয়ে জারার কাছে সব খুলে বললাম। আমার কিশোর বেলার প্রেমের গল্প থেকে শুরু করে এই সময়ে এসে পাশে থাকার আশ্বাস। জারা, এতটুকুন মেয়ে যেন এখন আমার মায়ের দ্বায়িত্বে। সামনে এখনো লম্বা পথ, আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুর পথটা পাড়ি দেওয়া সমীচিন, বিজ্ঞ মেয়ের মতামত। আমি নিজেও অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্তটা মেনে নিলাম, রুমেলকেও জানালাম। পরিবার বিচ্ছিন্ন রুমেল প্রিয়জনদের নিয়ে আবারো পরিবার গড়ার সুযোগ পাচ্ছে, এই আনন্দেই সে আত্মহারা।

সময় চলছে বহতা নদীর মতো।

পাঁচ বছর আগে হঠাৎ বৃষ্টির মতো আসা রুমেলকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা যে সঠিক ছিলো, তা আমি বেশ বুঝি। রুমেলের সাথে সতের বছর পর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিময় এক দিনে। কাকতালীয় ভাবে আজও ঢাকায় তুমুল ঝড় বৃষ্টি বইছে। আমার চার বছর বয়সী ছেলে আদিব বাবা মায়ের কাছে বায়না ধরেছে বৃষ্টিতে ভিজবে। আমি রুমেল আর আদিব ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলাম, যদিও দমকা বাতাসে টেকা দায়। নীচে নেমে আসতে বাধ‍্য হলাম।

ও হ‍্যাঁ, একটা কথা বলতে কিন্তু ভুলে গিয়েছি, বিয়ের বছর খানেকের মধ‍্যেই আমাদের ঘর আলো করে এক ছেলে সন্তান এসেছে। জারা তার ভাই আদীবকে নিয়ে ব‍্যস্ততায় ছিলো এইতো কিছুদিন আগ পযর্ন্ত। আমার মেয়ে জারা এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মুন্নুজান হলে থাকছে। মেয়েটা ছুটির জন‍্য উন্মুখ হয়ে থাকে ওর বাবা ভাইকে দেখার জন‍্য। আর আমি প্রতি রাতে অপেক্ষায় থাকি রুমেলের জন‍্য, ক‍্যাফে বন্ধ করে ও বাসায় আসবে। বাবা ছেলে খেলবে, আমি টুকটাক গল্প করবো। আর এরপর নিশ্চিন্ত ও নির্ভার হয়ে ওর বুকে মাথায় রেখে ঘুমাতে যাবো। জীবন সত‍‍্যই অনেক সুন্দর।

(শেষ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here