হঠাৎ_হাওয়া পর্ব ৬

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৫

পরেরদিন সকাল এগারোটার দিকে নিরু আর ফারহান ফারিয়াদের বাসায় চলে এল। ওদের বাসা থেকে আসতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। নিরু চেয়েছিল রাস্তাটা যেন দীর্ঘ হয় কারণ ওর জার্নি করতে অনেক ভালো লাগে। সতেজ লাগে নিজেকে কিন্তু রাস্তা ফুরিয়েই গেল।

ওরা ফারিয়া আর আতিকের (ফারিয়ার হাসবেন্ড) সাথে কথা বলে সোফায় গিয়ে বসলো। ওরা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রাত্রি। সে ফারিয়ার ননদ। এবার অনার্স শেষ করেছে।

রাত্রি নিচে এসে ফারহানের পাশে নিরুকে বসে থাকতে দেখে মুখটা কালো করে ফেললো। পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “কেমন আছেন ভাইয়া?”

ফারহান অবাক হলো কিছুটা কেননা এর আগে রাত্রি কখনো তাকে ভাইয়া বলে ডাকেনি। হাজার বারণ সত্ত্বেও নাম ধরেই ডেকেছে। অবশ্য গত দুমাস ধরে কথা হয় না বলেই হয়তো এত পরিবর্তন। ফারহান অবাক ভাবটা কাটিয়ে মৃদু হেসে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো রাত্রি?”

“আমিও ভালো।” তারপর নিরুকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ও নিশ্চয়ই নিরু? কেমন আছো তুমি?”

নিরু ওকে চিনতে না পারলেও সৌজন্যমূলক হেসে বললো, “জ্বি, ভালো।”

রাত্রি পুনরায় হেসে বললো, “বয়সে তুমি আমার থেকে প্রায় চার বছরের ছোট তাই নাম ধরেই ডাকলাম। তোমাকে তো আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি। আমি রাত্রি। ভাবীর একমাত্র ননদ। অসুস্থতার কারণে তোমাদের বিয়েতে যেতে পারিনি তাই আগে দেখোনি।”

নিরু বিনিময়ে কিছু না বলে হাসলো। তার কাছে রাত্রির হাসিটা ঠিক ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে জোর করে হাসছে কাউকে দেখানোর জন্য।

নিরু ওর পাশের সোফায় ইশারা করে বললো, “আপু আপনিও বসুন আমার সাথে।”

রাত্রি তাড়াহুড়ো করে বললো, “না, নাহ। আমার একটা জরুরি দরকার আছে। বাইরে যেতে হবে। থাকো তোমরা। দোয়া করি যাতে অনেক অনেক সুখী হও।”

আর কেউ না বুঝলেও ফারহান ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে রাত্রি তার চোখের আড়াল হওয়ার জন্যই এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হয়তো তারা না যাওয়া পর্যন্ত আর বাসার ভেতরে পা দেবে না। কিন্তু তারও যে কিছু করার নেই শুধু দেখা ছাড়া।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে এসে বসে আছে নিরু। ফারহান তার পাশেই শুয়ে আছে। ওদের জন্য আলাদা রুম পরিষ্কার করে রেখেছে ফারিয়া। বাড়ির বেশিরভাগ রুমগুলোই খালি থাকে কেননা মানুষ বলতে বাড়িতে শুধু তিনজনই। ফারিয়া, আতিক আর রাত্রি। ফারিয়ার শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক আগেই মারা গেছেন।

ফারহান নিরুকে তার পাশে শুতে ইশারা করতেই নিরু শুয়ে পড়লো। ফারহান তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, “কী এত ভাবছো নিরু?”

নিরু না সূচক মাথা নেড়ে বললো, “না, তেমন কিছু না।”

ফারহান ভ্রু খানিকটা উঁচিয়ে বললো, “কিছু একটা তো ভাবছো। সেই কখন থেকে দেখছি শুধু ভেবেই যাচ্ছো।”

নিরু একটু সংকোচ বোধ করছে। কথাটা বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। তার দেখা তো সঠিক না-ও হতে পারে। তবুও সংকোচ নিয়েই বললো, “আসলে রাত্রি আপুর সম্পর্কে ভাবছিলাম। সকালবেলা উনার হাসিটা আমার ঠিক লাগেনি। কেমন যেন লোক দেখানো। ভেতর থেকে হাসছিলেন না উনি। তাছাড়া সে-ই যে বেরিয়ে গেলেন এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো কিন্তু এখনো আসলেন না। সকালে উনার যাওয়া দেখে মনে হলো পালিয়ে যাচ্ছে।”

ফারহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিল। নিরুকে একটু শক্ত হাতেই জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা ভীষণ বিচক্ষণ। মানুষের চালচলন দেখেই কী সুন্দর অর্ধেক কাহিনীটা বুঝে গেছে। ফারহান চোখ খুলে নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর এভাবে পালিয়ে যাওয়ার পেছনে অবদানটা কিন্তু সম্পূর্ণই আমার।”

নিরু কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “মানে?”

“মানে হলো- আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে রাত্রি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। ও বেশ চটপটা স্বভাবের তাই হয়তো মেয়ে হয়েও আগে আগেই প্রপোজ করেছিল মানে মেয়েরা তো সাধারণত প্রপোজ করে না তাই আরকি বললাম। সে যাই হোক আমি ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বারণ করে দিয়েছিলাম কারণ তার আগেই তুমি আমার জীবনে এসেছিলে। তাছাড়া ওকে আমি সবসময় আপুর ননদের নজরেই দেখেছি। আলাদা কোনো ফিলিংস ছিল না কখনো। তারপর থেকে ও আমাকে এ বিষয়ে কখনো কিছু বলেনি ঠিকই কিন্তু চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে কারণে-অকারণেই কথা বলতো কিন্তু ঐ ঘটনার পরে আর কথা হয়নি। আর আজকে দেখেই ওমন করে বেরিয়ে গেল।”

“এরকমটাই তো স্বাভাবিক তাইনা? কেউ চাইবে না ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর পাশে সহ্য করতে।”

ফারহান কিছুটা অবাক হয়ে বললো, “তোমার রাগ হয়নি?”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“ওইযে রাত্রি আমাকে প্রপোজ করেছিল শুনে।”

“প্রথমে হয়েছিল একটু কিন্তু আপনি তো আর রাজি হননি।”

ফারহান দুষ্টুমির ছলে বললো, “রাজি হলে কী করতে?”

নিরু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “রাজি হতেন ই না আপনি। কারণ আপনি নিজেই বলেছেন আমি আপনার জীবনে আগে এসেছি।”

ফারহান নিরুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো, “নিরু?”

নিরু নরম স্বরে উত্তর দিল, “হুম?”

“কবে ভালোবাসবে আমায়?”

নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। কী উত্তর দেবে সে? তার কাছে তো কোনো উত্তরই নেই। এটা ঠিক যে ফারহানের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই তার প্রতি ভালোলাগা কাজ করেছে। কিন্তু সেটা কী ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি কী কাউকে ভালোবাসা যায়? অবশ্য এত তাড়াতাড়িও নয়। প্রথম দেখা, বিয়ে ঠিক হওয়া, বিয়ে সবমিলিয়ে মাসখানেক পার হলো বলে। কোনো কিছুর উত্তর স্পষ্টভাবে পায় না নিরু। কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতিরা মনের মাঝে উঁকি দিতে থাকে।

নিরু কথা ঘোরাতে বললো, ” আমরা বাসায় যাব কখন?”

নিরুর প্রশ্নে ফারহান আলতো হাসলো। সে বুঝতে পেরেছে যে নিরু তার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেল। যাক, অনুভূতি প্রকাশ করতে পর্যাপ্ত সময়টা নিক। একদিন হয়তো সে নিজ মুখেই বলবে। এ আশায়ই আছে ফারহান। স্বাভাবিক ভাবেই বললো, “একটু পরে বের হবো। আপু তো আজকে যেতে দিতে রাজি-ই হচ্ছিলো না। খুব কষ্টে রাজি করিয়েছি। কাল থেকেই তো আবার অফিস জয়েন করতে হবে।”

নিরু একটু মন খারাপ করে বললো, “হুম।”

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ফারিয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো ওরা। একটা সিএনজি নিয়েই রওনা হয়েছে। সিএনজি অন্য দিকে যেতেই নিরু ফারহানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

ফারহান স্বভাবসুলভ হেসে বললো, “গেলেই দেখতে পাবে।”

“এখন বললে কী হবে?”

“কিছুই না। কিন্তু বলবো না।”

নিরু মুখ ফুলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখন বললে কী এমন হবে? ধৈর্য ধরতে মোটেও ইচ্ছা করছে না তার।

প্রায় আধঘন্টা পরে ওরা ওদের গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছালো। নিরু তড়িঘড়ি করে সিএনজি থেকে নেমে গেল। কোথায় এসেছে দেখতে হবে তো তাড়াতাড়ি!

নিরু সিএনজি থেকে নেমে দেখলো ওরা একটা পার্কে এসেছে যা একবারে নদীর তীর ঘেঁষে বানানো। আশেপাশে গুটিকয়েক দম্পতির দেখা মিলছে। নদীর কলকল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বর্ষাকাল হওয়ায় নদী পানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে। হালকা বাতাসও আসছে। নিরুর মনটা নিমিষেই ক্লান্তি ভুলে সতেজ হয়ে উঠলো। সে নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়ালো।

ফারহান ওর পিছুপিছু গিয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললো, “সাবধানে, পড়ে গেলে কিন্তু রক্ষা নেই।”

নিরু মৃদুস্বরে হেসে বললো, “আমি একটু দূরেই আছি। পড়বো না। শুধুশুধুই ভয় পাচ্ছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

ফারহান ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“এইযে এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে এলেন। কত্ত সুন্দর আবহাওয়া। আমার না অনেক খুশি খুশি লাগছে।”

ফারহান অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে তার নিরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। একটুতেই কত খুশি হয়ে গেছে।

ফারহানও হেসে বললো, “এত খুশি যখন হয়েছো তখন তো শুধু ধন্যবাদে কাজ হবে না নিরুপাখি।”

“নিরুপাখি!” নামটা শুনে কেমন যেন অনুভূতি হলো নিরুর। তবে তা লুকিয়ে রেখেই ভ্রু কুচকে বললো, “তাহলে আর কী লাগবে?”

ফারহান অসহায় মুখ করে বললো, “খুশি হয়ে তো একটু জড়িয়েও ধরতে পারতে। শুধু ধন্যবাদে কী আর মন ভরে?”

নিরু নিচুস্বরে বললো, “আমার লজ্জা করবে না বুঝি?”

“একটু লজ্জা করলে কিছু হবে না।”

“কত মানুষ এখানে দেখেছেন?”

ফারহান ভ্রু উঁচু-নিচু করে বললো, “তাহলে মানুষ না থাকলে ধরতে?”

নিরু চোখ পাকিয়ে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি কী জানেন যে আপনি অনেক দুষ্টু?”

“বউয়ের সাথে সবাই-ই দুষ্টুমি করে। তুমি আমার দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বউ। তোমার সাথে তো দুষ্টুমি করবোই।” বলেই চোখ মেরে দিল ফারহান।

নিরু লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। লোকটা করছে কী এখানে? নিরু তার পাশের একটি বসার বেঞ্চিতে বসে পড়লো। ফারহানও তার পাশে গিয়ে বসলো। নিরু প্রশ্ন করলো, “হঠাৎ করে এখানে নিয়ে এলেন যে?”

ফারহান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো, “বিয়ের পরে তোমাকে নিয়ে তো দূরে কোথাও ঘুরতেই যাওয়া হলো না। দাওয়াত খেতে খেতেই ছুটি শেষ। কাল থেকেই আবার অফিস জয়েন করতে হবে। আরেকটু বেশি ছুটি হলে ভালো হতো দূরে কোথাও যেতে পারতাম। তোমার তো জার্নি করতে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু সাতদিনই তো অনেক বেশি। তাই আপাতত এখানে নিয়ে এলাম। একান্তে কিছু সময় কাটাতে। ঘুরতে না যেতে পারায় তোমার মনটাও খারাপ লাগবে না। কয়েকদিন যাক। এরপর ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও যাবো। চলবে তো?”

নিরু খুশি হয়ে বললো, ” অনেক চলবে।”

কিছুক্ষণ নিরব হয়ে বসে রইলো দুইজন। ফারহান নিরুর হাতটা আঁকড়ে ধরে আছে। নিরুও হালকা করে ধরেছে। অস্বস্তি হচ্ছে না তার বরং ভীষণ ভালো লাগছে। দিন দিন ফারহানের মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে সে। তার প্রতিটা কাজেই মুগ্ধ হচ্ছে।

নিরবতা ভেঙে নিরু প্রথমে বললো, “আচ্ছা আমরা বাসায় ফিরবো কখন? রাত তো হয়েই গেছে।”

“আরেকটু থাকি। ভালো লাগছে এভাবে থাকতে।”

নিরু-ও সায় জানালো।

পার্কের ভেতরে আরো কিছুক্ষণ হেঁটে ওরা বাইরে বেরিয়ে আসলো। বাইরে বেরোতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে নিরুকে বাজে ইঙ্গিত করে কিছু কথা বললো। ফারহান তো রেগে আগুন। নিরুর ওদের কথা শুনে রাগ হলেও এখন ফারহানের এমন চেহারা দেখেই ভয় হচ্ছে। এত সুন্দর হাসি-খুশি লোকটা আবার রাগতেও পারে না-কি? কী করবে এবার কে জানে?

#চলবে__??

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here