হঠাৎ_হাওয়া পর্ব ৬

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৬

যে ছেলেটা বেশি বাজে কথা বলছিল সেই ছেলেটার কাছে গিয়ে ফারহান ঠাটিয়ে এক চড় কষে দিল গালে। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে হতবম্ভ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবেনি যে ফারহান এমন কিছু করতে পারে। আশেপাশে দাঁড়ানো ছেলেগুলোও বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। ফারহান ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই ওরা দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। রয়ে গেল শুধু ওই ছেলেটা। তারও চেহারায় রাগের আভাস ফুটে উঠেছে। কিন্তু ফারহানের রাগের কাছে তা অতি নগন্য।

ফারহান ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকে বললো, “সাহস কী করে হয় ওসব কথা বলার? বউ হয় আমার। বউ। বয়সে ছোট বলে শুধু একটা চড়েই সীমাবদ্ধ রাখলাম। এরপর যদি দেখি আর কোনো মেয়েকে কোনোদিন বিরক্ত করেছিস তাহলে সেদিন আর ছোট বলে মাফ করবো না।”

ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বললো, “স…সরি ভাই। আর কখনো এমন হবে না।”

“আমাকে সরি বলছিস কেন?”

ছেলেটা এবার নিরুর দিকে তাকিয়ে বললো, “সরি আপু। এবারের মতো মাফ করে দিন প্লিজ।”

নিরু এতক্ষণ একপাশে জড়সড় দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটার এমন আচরণে এবার বেশ অপ্রস্তুত বোধ করলো সে। তবুও অস্পষ্ট স্বরে “ইট’স ওকে” বলে ফারহানের হাত ধরে হাঁটা ধরলো।

ফারহান নিরুর সাথে চলতে চলতে রাগত স্বরে বললো, “তুমি ওরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলে কেন? না-হলে ছেলেটাকে আরো দু ঘা লাগিয়ে দিতাম।”

“ও বিষয়ে কথা বাদ দিন না। চলুন বাসায় যাই।”

“না, আগে ডিনার করবো। তারপরে বাসায় যাব।”

“আচ্ছা চলুন।”

নিরু আর ফারহান কাছের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করে তারপরে বাসায় ফিরলো। বেশ রাত হয়ে গেছে।

নিরু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে আছে। ফারহান ফ্রেশ হয়ে এসে বললো, “চলো বারান্দায় গিয়ে বসি। তোমাকে আজকে আমার প্রথম বিয়ের কাহিনী শোনাবো।”

নিরু অবাক হয়ে বললো, “প্রথম বিয়ের কাহিনী মানে? আপনি কী সত্যিই আগে একটা বিয়ে করেছিলেন না-কি?”

ফারহান বারান্দার দিকে যেতে যেতে বললো, “আরে আগেই এত কিছু ভেবো না। শুনলেই সব বুঝতে পারবে।”

নিরুও মাথা নাড়িয়ে তার পেছন পেছন গেল। ফারহান রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

নিরু উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিরুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান মৃদু হাসলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো, “আজ থেকে প্রায় মাস ছয়েক আগের ঘটনা। আমি তখন সবেমাত্র চাকরি পেয়েছি। তাতেই মা পাত্রি দেখার জন্য বিভিন্ন ঘটক লাগিয়ে দিলেন। আমিও মায়ের কথার বিরুদ্ধে যেতে পারিনি। অবশ্য না করার কোনো কারণও ছিল না। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক পাত্রি দেখা হচ্ছিলো। কিন্তু মায়ের কাউকেই পছন্দ হয়নি। অবশেষে একজনকে দেখে পছন্দ হলো মায়ের। আমাকে দেখানোর পর আমিও অমত করিনি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। বিয়েও ঠিক হয়েছিল। বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে তাই গায়ে হলুদের দুই দিন আগেই বাড়ি-ঘর সব সাজানো হয়েছিল।”

ফারহান একটু থামায় নিরু চটজলদি প্রশ্ন করলো, ” তারপর?”

ফারহান আবারো বলতে শুরু করলো, “কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো গায়ে হলুদের আগের দিন। মেয়ের বাড়ি থেকে খবর এল, মেয়ে না-কি অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছে। বিষয়টাকে গোপন রাখা হয়েছিল তখন। মান-সম্মানের ব্যাপার ছিল। যাদের যাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল তাদের সবাইকে না করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগে থেকেই সাজানো হয়েছিল বলে কযেকজন মানুষ মনে করে যে আমি আগেও একটা বিয়ে করেছিলাম। সেই গুটিকয়েক মানুষের কথাই তোমার কানে এসেছিল সেদিন। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার কী জানো?”

নিরু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কী?”

“সে পালিয়েছিল আমার এক বন্ধুর সাথে। আমার বন্ধু জানতো না যে তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল আর সেও জানতো না যে তার প্রেমিকই আমার বন্ধু। ইমন বললো, মাসখানেক আগেই না-কি তাদের বিয়ে ভেঙে গেছে। নিয়মিত অশান্তির কারণেই এ পরিণতি। তার চাহিদা না-কি অনেক বেশিই ছিল। ইমন যথাসম্ভব দেয়ার চেষ্টা না-কি করেছে। সবটাই শোনা। আমি নিজের চোখে কিছু দেখিনি। তাই নির্দিষ্ট একজনকে দোষও দিতে পারি না।”

“আপনার সাথে তার আর দেখা হয়েছিল? নাম কী উনার?”

“নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। আর তারপরে কখনো দেখাও হয়নি। তুমিই আমার ভাগ্যে লেখা ছিলে তাই হয়তো বিয়ে হতে গিয়েও হয়নি। তোমার দেখা পাওয়ার পরেই মনে হয়েছে যে, ভালোই হয়েছে যে বিয়েটা তখন হয়নি।”

“আচ্ছা ওসব কথা বাদ দিন। চলুন ঘুমাবো।”

“এত তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে গেছে তোমার?”

নিরু ফারহানের হাত ধরে বললো, “হুম। আপনিও চলুন।”

ফারহান মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা, চলো। পরশু থেকেই তো তোমার ভার্সিটি শুরু। কালকের দিনটাই রেস্ট করার জন্য পাবে।”

“হুম, আপনার অফিস পরশু থেকে হলে ভালো হতো।”

“কেন? আমাকে মিস করবে বুঝি?”

নিরু হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো, “একটু একটু।”

ফারহান নিরুর মতো করেই বললো, “সত্যিই একটু একটু?”

নিরু মেকি হেসে বললো, “আরেকটু বেশি।”

ফারহানও এবার হেসে ফেললো।

__________________

পরেরদিন সকাল সকাল ফারহান অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগলো। নিরু সবকিছু তাকে হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে। ফারহান একবার বলছে টাই বেঁধে দাও, তো একবার বলছে হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দাও। নিরুও তাই করছে। বিবাহিত জীবনের নতুন নতুন বিষয়গুলো বড্ড ভালো লাগছে তার। নতুন নতুন অনুভূতি হচ্ছে। ফারহান নিরুর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে ওকে বিদায় জানিয়ে, মাকে বিদায় জানিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেল।

সারাটা দিন শুয়ে বসেই কেটে গেল নিরুর। ফারহানকে বড্ড বেশিই মিস করছে।

সন্ধ্যা প্রায় হয়েই এসেছে। নিরু অপেক্ষা করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফারহান চলে আসবে। সারাদিনে ফারহান কাজের ফাঁকে দু’বার কল করেছিল। কিন্তু নিরুর তো ওকে দেখতে মন চাইছে। এ কয়দিন তো দিনের বেশিরভাগ সময় তারা একসাথেই কাটিয়েছে তাই মিস করার পরিমাণটা একটু বেশি। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। তাছাড়া কাল থেকে তো নিরুরও ভার্সিটি শুরু।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বাসায় ফিরলো ফারহান। মেইন দরজা খোলাই ছিল। হয়তো তার বাবা কিছুক্ষণ আগে বাইরে গেছে। ফারহান ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই দেখলো নিরু আর ওর মা একসাথে সোফায় বসে কী নিয়ে যেন কথা বলছে আর কিছুক্ষণ পরপরই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কথা বলার মাঝখানে হঠাৎ করে হেসে উঠছে।

ওদের এভাবে হাসতে দেখে ফারহানের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো। সব ছেলেই হয়তো এমন একটা বউয়ের আশাই করে যে তার মা-বাবাকে নিজের মা-বাবা ভেবে আপন করে নিবে। ফারহানের সে আশাটাও যে পূরণ হয়েছে।

ফারহানকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে দেখে ওর মা নিরুকেও উপরে পাঠিয়ে দিল।

নিরু ওদের রুমে গিয়ে দেখলো ফারহান রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ আসছে। হয়তো ফ্রেশ হচ্ছে। তাই নিরু রান্নাঘরে গেল ফারহানের জন্য এক কাপ চা আনতে।

নিরু চা নিয়ে রুমে আসতেই দেখলো ফারহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নিরু ওর কাছে গিয়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “একটা কথা বলি?”

ফারহান চায়ের কাপটা নিয়ে বললো, “অবশ্যই। জিজ্ঞেস করে নিতে হবে না-কি? তোমার যখন যা ইচ্ছা তাই জিজ্ঞেস করবে।”

“আপনি সিগারেট খান?”

ফারহান একটু আমতা আমতা করে বললো, “ঐ আরকি বন্ধুদের সাথে একসাথে হলে দু একটা খাওয়া হয়। তবে নিয়মিত নই।”

“ওহ আচ্ছা।”

“হুম, তুমি কী রাগ করলে?”

“না, রাগ করবো কেন? সিগারেট খেতেই পারেন। সেটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা। তবে একটা কথাই বলবো, আমি আপনার সাথে বেশিদিন বাঁচতে চাই।”

ফারহান নিরুর কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে বললো, “আচ্ছা, আর খাবো না।”

অজান্তেই নিরুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। হাসিমুখ বজায় রেখেই বললো, “আচ্ছা, এবার চা টা খান। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”

“হুম। সারাদিন অনেক মিস করেছি তোমাকে।”

“আমিও।”

চা শেষ করে ফারহান কাপটা পাশের চেয়ারে রেখে নিরুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। নিরু চোখ বন্ধ করে আছে।

ফারহান নরমস্বরে বললো, “ভালোবাসি নিরু।”

“ভালোবাসি” শব্দটা শুনে নিরুর কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। ভালোলাগা কাজ করছে মনের মাঝে। এই প্রথম ফারহান তাকে ভালোবাসার কথা বললো।

নিরু নিশ্চুপ হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো উত্তর দিল না।

ফারহান শুধু মুচকি হাসলো। কোনো উত্তরের আশায় তো সে কথাটা বলেনি। শুধু নিজের অনভূতিটা প্রকাশ করেছে।

__________________________

পরেরদিন সকালবেলা নিরু ফারহান দুজনেই তৈরি হয়ে একসাথে বেরিয়ে গেল। ফারহান নিরুকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে।। বাড়ির সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে দুজনে রওনা হলো।

ফারহান নিরুকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেল। ভেতরেই যেত কিন্তু এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে তাই নিরু-ই মানা করে দিয়েছে। তবে বলে গেছে ছুটির সময় এসে নিয়ে যাবে।

ভার্সিটিতে সারাদিন ভালোই কেটেছে নিরুর। নতুন দু-একজন বান্ধবীও হয়েছে। প্রথমদিন তাই পরিচয় পর্বেই ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। নিরু এখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহান কল করে একটু অপেক্ষা করতে বলেছে। ও রাস্তায় আছে।

পাঁচ মিনিট বাদেই ফারহান নিরুর সামনে এসে রিকশা থামালো। নিরু রিকশায় উঠে বললো, ”আপনি কী আবার অফিসে যাবেন? না-কি একেবারের জন্যই এসেছেন?

“লাঞ্চ করতে এসেছি। আবার চলে যাবো।”

#চলবে__??

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here