#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩১
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
এ’শহর শুধু ভগ্নহৃদয়ের গল্পে ভরপুর। এ শহরের আনাচে কানাচে রয়েছে ব্যর্থ প্রেমিকদের আহাজারির দৃশ্য, হৃদয়বিদারক সুরধ্বনি। চোখের সম্মুখে দশজোড়া মানব-মানবীদের দেখা মিললে তাদের ন’জোড়ার থেকেই শুনতে পাওয়া যাবে না পাওয়া গল্পের কথাগুলো। যাদের শুরুটায় ভরপুর ছিলো সীমাহীন প্রাপ্তিতে,সীমাহীন ভালোবাসায়,মনোমুগ্ধকর প্রেমের গল্প। আর শেষটায় রয়েছে এক বুক যন্ত্রণা, না পাওয়া বেদনায় ভরপুর। তাদের চোখে থাকবে দায়িত্ববোধ, একে অপরকে ভালো রাখার অবিরাম চেষ্টা। কিন্তু ভালোবাসা? ভালোবাসার কিঞ্চিৎ আভাসও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সে দশজোড়ার একটি জোড়া অবশ্যই থাকবে যাদের মধ্যে না পাওয়ার কোন বেদনা থাকবে না। চোখে, মুখে থাকবে একরাশ প্রাপ্তি। তাদের গল্পের শুরুটায় থাকবে বহু ত্যাগ বহু তিতিক্ষা আর শেষটায় থাকবে পূর্ণতা। সে একজোড়া মানব-মানবীর মধ্যেই পড়ে ইমন এবং মুসকান৷ তবে তাদের সম্পর্কের বিশেষত্ব হলো, অভাবনীয়, অকল্পনীয় এক বন্ধনে কিছুটা আবেগ, কিছুটা বিবেক আর সীমাহীন ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়েছে তারা। যে সময়টা বিয়ে করে সংসার শুরু করার কথা ছিলো ইমনের সে সময়টায় যৌবনের প্রথম ধাপে পা দেওয়া এক যুবকের ন্যায় প্রেমে পড়েছিলো সে। আটাশ বছর বয়সী ইমন চৌধুরী চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরী মুসকানের প্রেমে মজে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। সে কিশোরীটিও কিন্তু কম ছিলো না। তার অবুঝ মনের আশকারাতে দিশেহারা হয়ে আবেগান্বিত রূপে ধরা দিয়েছিলো প্রেমিক পুরুষটির কাছে। যেখানে সবাই চিন্তিত ছিলো তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সেখানে তাদের মনোবল ছিলো দৃঢ়। একজন আবেগে আরেকজন বিবেক বর্জিত করে ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পাবার নেশায়। বহু ঝড় উপেক্ষা করে, বহু ঝামেলা পাড় করে ছোট্ট কিশোরীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তার কিশোরী কালের প্রথম পুরুষ হয়ে যেমনটি ঘটিয়েছিলো প্রণয়ের সম্পর্কে ঠিক তেমনি যৌবনের প্রথম পুরুষ হয়েই প্রণয় থেকে ঘটালো পরিণয়।
আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তাকে পাওয়া যেখানে অসম্ভব থাকে সেখানে সে অসম্ভব কে সম্ভব করে, মান -অভিমান,দুঃখ,কষ্ট যন্ত্রণার ইতি ঘটিয়ে যখন সম্পর্কটি বৈবাহিক সম্পর্কে রূপ নেয় কেমন অনুভূতি হয়? দূরত্ব অতঃপর কাছে আসা তারপর? আবারো হারিয়ে ফেলার ভয় আবারো ফিরে পাওয়া। সম্পর্কে উন্নতি, অবনতি চলতে থাকা কালীন সর্বশেষ যখন দুটি দেহ দুটি হৃদয় এক হয় উপরওয়ালার উপহার সরূপ আগাম বার্তা আসে তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা সরূপ দুনিয়াতে আসছে ছোট্ট একটি প্রাণ। তাদের একে অপরের সন্তান অনুভূতি তা ঠিক কেমন হয়? একটু কল্পনা করে দেখা যাবে কি? কিছু সেকেন্ড চোখ বুঝে মূহুর্তগুলো অনুভব করলেই টের পাওয়া যাবে কতো সুখ… এ সীমাহীন সুখ, এ সীমাহীন প্রাপ্তিকেই ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করা যায়। ইমন মুসকানের ভালোবাসা বলেই আখ্যায়িত করা যায়। যে ভালোবাসা বিবেচনা করেনি পরিবেশ,বিবেচনা করেনি একে অপরের বয়স, বিবেচনা করেনি পারিপার্শ্বিক মানসিকতাকে। তারা সর্বদা অটল ছিলো নিজ অনুভূতিতে, নিজ ভালোবাসাতে। তারা সর্বদা মত্ত থেকেছে একে অপরের মাঝে। এ অনুভূতি গুলো যেনো চির স্মরণীয়।
.
ড্রাইভ করছে ইমন। তার কাঁধে মাথা রেখে পাশেই চোখ বুজে বসে আছে মুসকান৷ আচমকাই গাড়ি থেমে যাওয়াতে চোখ মেলে তাকালো মুসকান। নম্র ভণিতায় ইমনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি হলো? ”
ইমন ইশারা করলো নামতে। মুসকান ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে চেয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,
“এ’মা এটাতো আমাদের বাড়ি তুমি না আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে? ”
“হুম বাবার বাড়ি,ভাইয়ের বাড়ি ঘুরতে নিয়ে এলাম। ”
“এটাকে ঘোরা বলে এভাবে ঘোরানোর মানে কি? অন্তত রেষ্টুরেন্টে তো নিয়ে যেতে পারতে…। ”
“নো ম্যাডাম এখন থেকে ঘুরতে হলে এভাবেই ঘুরতে হবে। আর খানাদানার ব্যাপারটাও বাসার ভিতরে সারতে হবে। বাইরের খাবার খাওয়া নিষেধ। যা খেতে চাও সব বাসায়ই তৈরি করে দেওয়া হবে। ”
“ওও আচ্ছা আপনি তাহলে নতুন নিয়ম তৈরি করছেন। ”
“নতুন সদস্য আসবে আর নিয়ম পুরোনো তাই কখনো হয়। ”
ডোর খুলে নেমে দাঁড়ালো মুসকান। গাড়ি লক করে ইমন নেমে আসার পর দু’জন একসাথেই বাসার ভিতরে ঢুকলো। ওদের দেখেই মুয়াজ ছুটে এসে মুসকানকে জড়িয়ে ধরলো। আধোআধো সুরে বললো,
“ফুমনি ফুমনি। ”
তিন’বছরের মুয়াজকে কোলে তুলে নিলো মুসকান। ইমন বিচলিত ভঙ্গিতে তৎক্ষনাৎ মুসকানের থেকে মুয়াজকে কেড়ে নিলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
“তুমি ওকে কোলে তুলেছো কেন ভারী জিনিস একদম ওঠাবে না। ”
মুসকান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
“কিহ ও ভারী ছিঃ এমন কথা তুমি বলতে পারলে? দাঁড়াও আমি ভাবিকে এখুনি বলছি। ”
ওদের কথার মাঝেই রিমি চলে এলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
“এই তোরা এসে গেছিস… আরে ভাইয়া দাঁড়িয়ে কেন আমি আম্মাকে ডাকছি। মুসু কিছু বলবি? ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো রিমি। মুসকান ইমনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হবে তার পূর্বেই ইমন মুয়াজের গাল টেনে রিমিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ভাইস্থা আমাদের খুব গুলুমুলু এটাই বলতে চাচ্ছে মুসকান তাইনা? ”
রিমি মাথা চুলকে হাসলো বললো,
“তোমরা বসো আমি তরকারি বসিয়ে আসছি। আম্মাকেও বলে আসি তোমরা আসছো। ”
রিমি চলে যেতেই মুসকান দ্রুত পায়ে গিয়ে সোফায় বসলো। গলা শুকিয়ে এসেছে তার ইমন বুঝতেই মুয়াজকে নিচে নামিয়ে ডায়নিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। গ্লাসে পানি ভরে মুসকানের সামনে ধরতেই মুসকান সেটা এক চুমুকে শেষ করলো। মুয়াজ এসে আবার মুসকানের কোলে বসতে নিলেই ইমন খপ করে তাকে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো৷ মুসকান কপাল কুঁচকে হাত বাড়ালো শাসিয়ে বললো,
“ওকে আমার কোলে দাও ভালো হবে না বলছি। ”
“একদম না ও ছোট তোমার সমস্যা বুঝবে না। দেখো কেমন নড়াচড়া করে তুমি সামলাতে পারবে না ব্যথা দিয়ে দেবে। ”
“আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি এমন করছো কেন? মুয়াজ বাবা দেখি আসোতো কোলে আসো। ”
মুসকান হাত বাড়াতেই ইমন বললো,
“মুয়াজ বাবা আমরা এখন কি খাবো বলোতো আমরা এখন চকলেট খাবো ”
বলেই পকেট থেকে চকলেট বের করে সোফা থেকে ওঠে বাইরে চলে গেলো। মুসকান লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে বললো,
“তোমার খবর আছে তুমি একবার আমার কাছে এসে দেখো আমি কি করি। ”
_____________________
আড়াই মাস চলছে মুসকানের। শুরুর দিক শরীরটা বেশিই খারাপ যাচ্ছে। সারাদিন ইমনের অফিস থাকে। সময় দিতেই পারেনা তাই ইরাবতীর থেকে পারমিশন নিয়েই মুসকানকে বাপের বাড়ি রাখা হলো। ইরাবতী অবশ্য রাগ করেনি কারণ তার শরীর টাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ইচ্ছে থাকলেও মুসকানকে সেভাবে দেখতে পারছে না। যেহেতু বাইরের খাবার খাওয়া নিষেধ করেছে ইমন সেহেতু নিজেও রান্না করে খাওয়াতে পারছেনা। এ সময় নিজের মায়ের কাছে থাকাটাই মঙ্গলজনক ভেবে পাঠানো হলো মুসকানকে। ইমনও যখন সময় পায় তখন চলে যায় সেখানে। বাড়ি বসে বোরিং হয়ে যায় মুসকান তাই প্রতি শুক্রবার বিকেলে ঘুরতেও নিয়ে যায়৷ কখনো মাঝরাতে নিজহাতে রান্না করেও খাওয়াতে হয় বউটাকে। দিনগুলো তাদের এভাবেই বেশ যেতে থাকে। মা,ভাই,ভাবি, স্বামীর ভালোবাসায় কোন ত্রুটি নেই। তাদের ভালোবাসায় নিজের অসুস্থতাটুকুও ভুলে যায় সে। বাচ্চা পেটে আসার প্রথম ক’মাস যতোটা অসুস্থ বোধ করেছে এখন অনেকটাই কমেছে সে অনুভূতি। এখন তার পাঁচ মাস চলছে। দুপুর দুটা বাজে বারোটার দিকে খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলো সে। আচমকাই ঘুম ভেঙে যায় মুসকানের। তলপেটের যে অংশটুকু কিঞ্চিৎ উঁচু হয়েছে সেখানটায় কেমন অদ্ভুত ব্যথা অনুভব করে। এই ব্যথার অর্থ কিছু সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে ব্যথাটা বাড়তে থাকে। নিঃশ্বাস হয়ে আসে রুদ্ধ। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা, তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের সঙ্গে কি ঘটছে ভাবতেই পুরো শরীর শিউরে ওঠলো মুসকানের। হাত,পা কাঁপতে শুরু করলো অবিরত। ভয়ে কথাও বলতে পারছেনা৷ পেটের ভিতর কেমন বুদবুদ উঠছে এমন অনুভব হচ্ছে। বালিশের পাশ থেকে কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে ইমনকে ছোট্ট একটি ম্যাসেজ করলো মুসকাম যেটাতে লিখা ছিলো – “নানাভাই আমার পেটে অস্থির লাগছে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমার খুব পেইন হচ্ছে। ”
ম্যাসেজটা পাঠানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কল করলো ইমন৷ ফোন রিসিভ করে মুসকান ক্রন্দনরত কন্ঠে হাঁপানো সুরে বললো,
“তুমি কোথায়। ”
“আমি এখনি আসছি এই বেরিয়েছি ভয় পেয়ো না। তুমি রিমিকে ডাকো দরজা কি আঁটকে রেখেছো? ”
“না তুমি আসো। ”
“আরে বোকা কাঁদছো কেন এইতো গাড়িতে ওঠেছি। তুমি রিমিকে ডাকো, কাকিমাকে ডাকো মুসু। ”
মুসকান কিছু বললো না শুধু ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো৷ ইমন ফোন কেটে রিমিকে কল করলো। ছেলেকে সবেই ঘুম পাড়ালো রিমি। তখনি ইমনের কল এলো। কল পাওয়া মাত্রই মরিয়ম আক্তার কে নিয়ে ছুটে মুসকানের ঘরে গেলো ওরা। পরিস্থিতি ঠিক কি বোঝা মাত্রই হেসে ফেললো রিমি। মুসকান মরিয়ম আক্তারের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। রিমি বললো,
“আরে পাগলী বেবি রেসপন্স করছে এতো নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই। বরং খুশি হো তোর বাচ্চা ঠিক আছে বলে। ”
গেটে শব্দ হতেই রিমি চটপট গিয়ে গেট খুলে দিলো। ইমনের চিন্তান্বিত মুখখানা দেখে বললো,
“বড্ড ভয় পেয়েছেন বুঝি? এই ননদিনীকে নিয়ে আর পারিনা অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়। ”
কথা বলতে বলতেই গেট লাগিয়ে ভিতরে গেলো দু’জন। ইমন রুমে ঢুকতেই মরিয়ম আক্তার বললো,
“আব্বা অফিস থেকে আসলা? ”
স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ইমন বললো,
“হুম ছুটি নিয়ে নিয়েছি ওকে কি ডক্টরের কাছে নিতে হবে? হঠাৎ এমন হলো যে…। ”
মরিয়ম আক্তার ওঠে দাঁড়ালো ইমন গিয়ে বসলো বিছানায়। রিমি বললো,
“আরে ভাইয়া তেমন কিছুনা এটা স্বাভাবিক পাঁচ মাস পড়েছে বেবি নড়াচড়া করবেই আর দুমাস পরে তো আরো বেশি নড়াচড়া করবে তখন তো এর থেকেও কষ্ট হবে। ”
ইমনের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। মুসকান’কে দেখে সে বেশ বুঝতে পারছে বেচারীর ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে। আর রিমি কিনা বলছে এর থেকেও কষ্ট হবে? মরিয়ম আক্তার রুমের বাইরে চলে গেলেন। ইমন মুসকানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“অনেক পেইন হচ্ছে? ”
মুসকান মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। রিমি চেয়ার টেনে ওদের সামনে বসতে বসতে বললো,
“আরে ভাইয়া টেনশন করবেন না। মুসু ব্যথার থেকে ভয়েই এমন করছে এতো ভয়ের কিছু নেই এটা স্বাভাবিক। ”
ইমন অবুঝের মতো অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিমির দিকে। মুসকান ইমনের একটি হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। রিমি ইমন মুসকান দু’জনের দিকেই দৃষ্টি বুলিয়ে বললো,
“আহারে এরা তো দেখা যায় দু’জনই বেশ ভীতু। ভয়ের কিছুই নাই একটু সাহসী হো মুসু আর ভাইয়া আপনি ওকে সাহস দিন। ”
রিমি কিছু সময় থামলো তারপর আবার বললো,
“গর্ভবতী থাকাকালীন সবথেকে দারুণ সময় তো এটাই মুসু আর তুই কিনা ভয়ে এ সময়টা উপভোগই করছিস না। কদিন পর বেবি যখন বড়ো বড়ো কিক মারবে তখন কি করবি তাহলে? ”
ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেলো ইমনের। মুসকান দুর্বল চোখে তাকিয়ে রইলো ইমনের দিকে। ইমন বললো,
“সে যাইহোক ওর অবস্থা এমন হচ্ছে কেন রিমি? আমার মনে হয় ডক্টরের কাছে যাওয়া উচিৎ একবার। ওর শরীর ঠিক আছে কিনা বেবি ঠিক আছে কিনা সেটা জানা দরকার। ”
“আজ তো সময় নেই কাল না হয় যাবেন। এতো ভয় পাবেন না তেমন কিছুই হয়নি এটা স্বাভাবিক বিলিভ না হলে সায়রী আপুকে ফোন করুন সেম কথাই বলবে। ”
কথাগুলো বলে ওদের একাকী সময় কাটাতে দিয়ে বেরিয়ে গেলো রিমি। ইমন ওঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আগে পোশাক পাল্টে নিলো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মুসকানের দিকে। আধশোয়া হয়ে বসে আছে মুসকান। ইমন তার ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মুসকানের পাশে বসলো। মুসকান দুর্বল চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার জন্য আজ অফিসটা মিস গেলো। ”
ইমন কিছু বললো না নিঃশব্দে কেবল মুসকানের পরিহিত কামিজের একপার্ট ওঠিয়ে পেটের নিচের ভাগ উন্মুক্ত করে দিলো। আলতো হাতে স্পর্শ করে শান্ত গলায় বললো,
“মুসু এখানটায় ওকে ফিল করছো? ”
শিউরে ওঠলো মুসকান। আনন্দানুভূতিতে ছেয়ে গেলো বুকটা। ইমনের আলতো ছোঁয়া হাতটির ওপর দৃঢ় স্পর্শ করে বললো,
“ফিল করছি এখনো ফিল করছি ওকে আমি। আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা তোমরা দু’জন এমন কেন বলতো? তোমাদের উপস্থিতির সাথে আমার নিঃশ্বাসের কি সম্পর্ক ? ”
আলতো হাসলো ইমন। মুসকানের হাতটি সরিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে উদরে গভীরতমভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। সে গভীর ওষ্ঠজোড়া কিঞ্চিৎ হালকা করে উদর ছুঁয়ে ছুঁয়ে বললো,
“কারণ আমরা দু’জনই তোমার হৃদস্পন্দনের সাথে জড়িত। আমি যদি হই তোমার হৃদপিণ্ড সে তোমার কলিজার টুকরো ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে আছে মুসকান। তার এক হাত ইমনের চুলগুলো আঁকড়ে ধরে আছে। ইমন মাথা তুলে এক পলক মুসকানকে দেখে নিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
“হায়রে বউ আমার বাচ্চা এসে গেলো তবুও তার খিঁচমারা বন্ধ হলোনা। “#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩২
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
সকাল থেকে চিল্লাতে চিল্লাতে গলা বসে গেছে সায়রীর। মুসকানের আটমাস চলছে। বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। দু’দিন আগে ডক্টর দেখানোও হয়েছে। রিপোর্ট কি এসেছে জানেনা সায়রী তবে ভালো কিছু না তা বেশ বুঝতে পেরেছে। গতকাল রাতে ইমন আবার কল করে জানিয়েছে আজ দুপুরে তাদের বাড়িতে ছোটখাটো আয়োজন করা হবে। মুসকান আবদার করেছে এই আয়োজন করার। আবার শর্তও দিয়েছে রান্নাবান্না সব ছেলেদের করতে হবে। ইমন একাহাতে সব পারবেনা বলেই দিহান আর মুরাদকে তার ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু দিহান ঘুম থেকে ওঠতে দেরি করেছে৷ এদিকে একবার মুরাদ আরেকবার ইমন ফোন দিতে দিতে সায়রীর ফোন এবং কান দু’টোই উত্তপ্ত করে ফেলেছে। খাবার রেডি করে দিহান’কে বারকয়েক ডেকে ছেলে’কে খিচুরি খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলো সায়রী। ছেলে রিহান দু’বার খিচুরি মুখে নিলেও তৃতীয় বার নিতে অনিহা প্রকাশ করলো। সায়রী আহ্লাদ করে ছেলে’কে বুঝিয়ে জোর পূর্বক খিচুরি মুখে দিলে রিহান উগ্রে ফেলে দিলো। মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হলো সায়রীর। গতকালই ইমন ফোন করে কড়াভাবে জানিয়েছে সকাল সকাল যেনো তাদের বাড়ি চলে যায়। অথচ দশটা বেজে গেলো এখন অবদি তাদের সকালের খাবারই খাওয়া হলো না৷ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রিহানের পিঠে মৃদু কিল বসিয়ে সোফায় বসালো। রিহান ঠোঁট ফুলিয়ে বা,বা বলে কাঁদতে শুরু করলো। দিহান গোসল সেরে পুরো রেডি হয়েই খাবার ঘরে এলো। এসেই সায়রী’কে ফোঁস ফোঁস করতে দেখে এবং রিহানকে কাঁদতে দেখে বিরবির করে বললো,
“এই মহিলার মেজাজ সব সময় চারশো ডিগ্রি হয়ে থাকে কেন? ”
রিহানকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে ডায়নিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো দিহান। সায়রী’কে বললো,
“বার বার বলছি খাওয়ানোর সময় ওকে মারবানা কথা কি কানে যায় না? ”
সায়রী আরেক লোকমা খিচুড়ি রিহানকে সাধলে সে বাবার দিকে গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো। চোখ কটমট করে খিচুড়ির প্লেট ঠাশ করে টেবিলে রেখে সায়রী বললো,
“তোর ছেলেকে তুই খাওয়া আমি চললাম। ”
“এই না ঐ না সায়ু জান প্লিজ এতোবড়ো শাস্তি দিওনা। ”
সায়রী তেলেবেগুনে জ্বলতে জ্বলতে নিজ রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। বের হলো এলদম রেডি হয়ে। বেরিয়েই দেখতে পেলো রিহানের সম্মুখে ফোন রেখে ডি.জে গান বাজাচ্ছে। রিহান একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে আছে আর দিহান ওর মুখে খিচুড়ি ঢোকাচ্ছে। ছেলেও দিব্যি ফোনের নেশায় খাবার গিলছে। কপাল চাপড়ে সায়রী এগিয়ে গিয়ে রিহানের থেকে ফোন কেড়ে নিলো। অমনি রিহান ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সায়রী ধমকে বললো,
“চুপপপ!” রিহান তবুও থামলো না। সায়রী এই অবুঝ শিশুকে আর কিছু না বলে বোঝ শিশুর কলার চেপে ধরলো। চিৎকার করে বললো,
” এই শিক্ষা দিচ্ছিস ছেলেকে? আমার ছেলেকে তুই তোর মতো বানাতে চাচ্ছিস? ”
“ঐ তুই তুই করবি না হাজব্যান্ড আমি তোর সম্মান দিবি। ”
“শালা রাখ তোর সম্মান বাপ হওয়ার এতো শখ এগুলা কি বাপের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে? ”
“আরে তুই বুঝোস না ক্যান ও যেভাবে খেতে চায় সেভাবেই খাওয়াইতাছি। ”
কলার ছেড়ে চেয়ার টেনে বসলো সায়রী। রিহানকে কোলে বসিয়ে নিজে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো আর বললো,
“ভালো কিছু দেখাতি একটা কার্টুন বের করতি। কোরানতেলাওয়াত শোনাতি এসব কি? ”
দিহান মাথা চুলকে বললো,
“সরি জান আর হবে না। ”
সায়রী গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ওকে এবার চুপচাপ খাওয়া শেষ করো তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। ”
“আহা এইতো এখন বউ বউ লাগছে। ”
আড়চোখে চেয়ে ভেঙচি কাটলো সায়রী বললো,
“এবার জামাই + বাবা হওয়ার ট্রাই করেন মহাশয়। ”
“করছিতো জান শুধুমাত্র বউ,বাচ্চাকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই বলে বাবা,মা পরিবার ছেড়ে আলাদা থাকছি। অশান্তি যতোটুকু আমাদের স্পর্শ করেছে করেছেই ভবিষ্যতে যেনো না করতে পারে আমার সন্তান যেনো কোন জটিলতার সম্মুখীন না হয় তাই তো এই পথ বেছে নেওয়া। চোখদুটো চিকচিক করছে সায়রীর। দিহান মাথা নিচু করে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। সায়রী নিচু স্বরে বললো,
” থ্যাংকস দিহান। ”
“চুপ নিজ বাচ্চার বাবাকে থ্যাংস বলতে লজ্জা করেনা? ”
হেসে ফেললো সায়রী মায়ের হাসি দেখে হাসলো রিহানও। ছেলের মাথা বুলিয়ে হাসলো দিহানও।
.
চেয়ারে বসে পিছন দিক চুলগুলো মেলে দিয়েছে মুসকান। ইমন নিপুণ হাতে চুলগুলো আঁচড়ে বেণি করে দিচ্ছে। ইদানীং একা একা কিছুই করতে পারেনা মুসকান। যতোটুকু পারে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ততোটুকুও করেনা সে। প্রকাশ্যে অবশ্য ইমনকে বলেও, ” মা ডাক শোনা যে সহজ কথা নয় তা আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। আর বাবা ডাক এতো সহজেই শুনে ফেলবে তুমি? কিঞ্চিৎ ভোগান্তি তো পোহাতেই হবে মি.। ”
ইমন তখন ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসি ফুটিয়ে বলেছিলো,
“একটুও ভোগান্তি হবে না বরং সুবিধাই হলো আমার। ”
.
চুল বেণি করে মুসকান পাঁজা কোল করে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ইমন৷ ওকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে ইরাবতীকে গিয়ে বললো উপরে গিয়ে রেষ্ট করতে বাকিটা সে বুঝে নেবে। ইরাবতী সম্মতি দিয়ে বয়াম থেকে বাটিতে আচার বেড়ে মুসকানকে দিয়ে উপরে চলে গেলো। মুসকান রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে ওঠে দাঁড়ালো। পেট হাত দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ইমনের পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“দাদাভাই আসছে না কেন? ”
ইমন সবজি গুলো ধোয়া শেষ করে পিছন ঘুরে বললো,
“কাছাকাছিই এসে গেছে তুমি ওখানে গিয়ে বসো যাও। ”
“না যাব না আমি রান্না দেখবো। ”
ইমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“বাবু আচার খাবে যাও খাওয়াও ওকে। ”
“না খাওয়াবো না আজ বাবু’কে না খাওয়িয়ে রাখবো। ”
এক পা এগিয়ে এলো ইমন এক হাত মুসকানের কানের পিছনে দিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
” আটটা মাস না খাওয়িয়ে রেখে শান্তি হয়নি সবার গুলুমুলু বাচ্চা আর আমাদের চুনোপুঁটি বাচ্চা হবে? ”
“তা হবে কেন? ”
“হবে না আট মাস চলছে অথচ বাচ্চার ওজন মাত্র দেড় কেজি! যদি ও এখানে না থেকে বাইরে থাকতো তোমাকে পিটিয়ে পিটিয়ে খাওয়াতাম আমি। ”
খিলখিল করে হেসে ওঠলো মুসকান পরোক্ষণেই শান্ত হয়ে পেটে চেপে ধরলো। ধীরগতিতে সরে যেতে যেতে বললো,
“আমি গিয়ে বসছি তুমি কাজ করো। ”
ইমন বুঝলো পেইন হচ্ছে তাই নিজেও সাথে গিয়ে বসিয়ে দিলো সোফায় আচারের বাটি হাতে দিয়ে মাথায় বুলাতে বুলাতে বললো,
“প্লিজ মুসু আর যে কয়েকটা দিন আছে কষ্ট হলেও খাওয়া দাওয়া করো বাচ্চামি করো না। এতোগুলো মাস এতোটা কষ্ট করে পুষ্টিহীন সন্তান দেখতে তোমার ভালো লাগবে বলো? ”
“কি করবো আমিতো চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা বমি হয়ে যায়। ”
“হবে না তুমি এটা শেষ করো আমি পাস্তা বানিয়ে আনছি ওরা আসতে আসতে কমপ্লিট হয়ে যাবে। ”
.
মুরাদ আর দিহান উপস্থিত হয়েছে অনেকক্ষণ। সায়রী রিহানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য উপরে ওঠে গেলো। মুসকান চুপচাপ বসে টিভি দেখছে। ইমন কাজের ফাঁকে কখনো কখনো এসে মুসকানকে সঙ্গ দিচ্ছে। দুপুর পড়ে গেছে ওদের রান্না-বান্নাও শেষ। ইরাবতী সায়রী মিলে সকলের জন্য খাবার বাড়ছে৷ ইমন তখন একটি প্লেটে মুসকানের জন্য খাবার নিয়ে সোফায় গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো। নিজ হাতে মেখে ওর সামনে খাবার ধরতেই টিভি দেখতে দেখতে খেতেও শুরু করলো। প্রশান্তিতে ভরে গেলো ইমনের বুকটা। সেই সাথে অনুভূতও হলো আজ অফিস নেই বলে মুসকানকে সে বেশ সময় দিতে পারছে। ঠিকমতো কেয়ার নিতে পারছে৷ এমনটা রোজ করলে হয়তো আজ এই অবস্থা হতো না। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হতে লাগলো পরোক্ষণেই ভাবলো তার দোষটা কোথায়?
চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস ছাড়লো ইমন। মনে পড়ে গেলো ডক্টরের বলা কথা গুলো। মুসকান ইমনের বাহুতে হাত চেপে ধরে বললো,
“আবার টেনশন করছো আমি কিন্তু খাব না। ”
স্মিথ হাসলো ইমন বললো,
“একটুও টেনশন করছিনা বরং দিন গুনছি আমার সোনামুনিটার জন্য। ”
ইমন মুসকানকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো মুরাদের। আল্লাহ তায়া’লার নিকট কেবল প্রার্থনা করলো সব যেনো ঠিক থাকে। অন্তত পক্ষে তার বোনটা যেনো ঠিক থাকে। নয়তো বন্ধু বোন দু’টোকেই হারাতে হবে।
_________________
সকাল সকাল অফিস বেরিয়ে গেছে ইমন। নানারকম টেনশনে অফিস করাটা তার জন্য বড়ো কষ্টকরই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি আর করার কিছুদিন পর ছুটি নেবে যেহেতু একদিন নিয়মিত অফিস করতেই হবে।
অফিসে ঢোকার ঠিক পনেরো মিনিট পরই ইমনের ফোনে কল এলো। ইরাবতী জানালো মুসকানের প্রচন্ড পেইন হচ্ছে এ মূহুর্তেই হসপিটাল নিতে হবে। মায়ের ফোন পাওয়া মাত্রই অফিস থেকে ছুটে বের হয় ইমন। যতোক্ষণ সে রাস্তায় থাকে ততোক্ষণই মুরাদকে ফোন দিতে থাকে। মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে কেবল একটি বাক্যই তার স্ত্রীর শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুবই কম। ডেলিভারির পর ইমিডিয়েট রক্ত প্রয়োজন পড়তে পারে।
.
মুসকানকে ধরে ধরে আকরাম চৌধুরী আর ইরাবতী সিঁড়ি বেয়ে নিচ অবদি নামিয়েছে তখনি ছুটে এলো ইমন৷ দ্রুত বাবা মা’কে সরিয়ে পাঁজা কোল করে আবারও ছুটে বেরিয়ে পড়লো। পিছন পিছন গেলো ইরাবতী আর আকরাম চৌধুরীও। কিন্তু পথিমধ্যেই মুসকানের রাপচার্ড মেমব্রেন হয়৷ সঙ্গে সঙ্গেই মুসকান ভয়ে চিৎকার করে সেন্সলেস হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে ইমন৷ ইরাবতী মুসকানের গালে হাত দিয়ে সমানে ডাকতে থাকে। ইমন সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্র বাবা মায়ের সামনে মুসকান’কে জড়িয়ে ধরে। দু-চোখ বেয়ে অঝড়ে পানি ঝড়তে থাকে। ইরাবতী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বাবা কিছু হবেনা বাচ্চা হওয়ার সময় হয়ে গেছে তাই এমন টা হচ্ছে। ”
ইমন বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে মুসকান’কে বুকে জড়িয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে,
“মা একটু পানি দেবে? ”
.
হসপিটালের সামনে মুরাদ,মরিয়ম আক্তার, দিহান দাঁড়িয়েই ছিলো। ইমনের গাড়ি থামতেই মুরাদ ছুটে এলো। ইমন মুসকানকে কোলে করেই গাড়ি থেকে বের হলো। মুরাদ মুসকানের মাথায় হাত দিয়ে বললো,
“বোন কিছু হবে না তুই ভয় পাস না আমরা আছি। ”
ইমনের শার্ট খামচে ধরে মুসকান চিৎকার করে ওঠলো বললো,
“আমি আর পারছি না হয় আমাকে মেরে ফেলো নয় আমাকে এই অসহনীয় ব্যাথা থেকে মুক্ত করো। আমি পারছিনা, পারছিনা আমি। ”
রুদ্ধ শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হসপিটালের ভিতর ঢুকলো সকলে। সব কিছু রেডিই ছিলো কেবল মুসকান’কে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করারও সময় নেই তাই বাচ্চা টা কি হালে আছে সেভাবে কারো বোধগম্য হলো না। কিন্তু ডক্টর, নার্স সকলেরই ধারণা বাচ্চা বাঁচবে না৷ ইতিমধ্যে মুসকানের থেকে যতোদূর জেনেছে বাচ্চা রেসপন্স করছে না। মুসকানের সম্মুখে সব বলা সম্ভব নয় তাই তার বাড়ির লোকদের জানানো হলো – বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ইমন হতভম্ব হয়ে নিচু স্বরে বললো,
“আমার স্ত্রী ঠিক থাকলেই চলবে আপনারা প্লিজ ওকে বাঁচান। ”
এ সময় একপাশে দিহান অপর পাশে সায়রী দাঁড়িয়ে ছিলো। মুরাদ মরিয়ম আক্তারকে সামলাচ্ছেন। তখনি কিছু কাগজপত্র ইমনের সম্মুখে দেওয়া হলো। যেখানে লেখা ছিলো তার সন্তানের প্রতি তার কোন দাবি নেই। ইমন কোন কিছু না ভেবে সাইন করে দিলো। কিন্তু সাইন করার কিছু সেকেন্ডের মাঝেই ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। বিরবির করে কেবল একটি বাক্যই উচ্চারণ করলো,
” হে আল্লাহ আমি কখনো বাবা ডাক শুনবো কিনা জানিনা কিন্তু আমার স্ত্রী’কে তুমি ভিক্ষা সরূপ দান করো। ”
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩৩ [শেষ পার্ট]
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
এতোগুলো মাস যে দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলো ইমন সেই দিনটি যে তাকে এতো ভয়াবহ অনুভূতি উপহার দেবে কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। আর পাঁচ টা স্বাভাবিক মানুষের মতোই তো তার চাওয়া, পাওয়া তবুও সব কিছুতে এতো জটিলতা কেন তৈরি হয়? সবাই ভালোবাসে, সবাই বিয়ে করে,সবাই বাবাও হয়। কই তার মতো ভোগান্তি তো কাউকেই পোহাতে হয় না। কি দোষ করেছে সে একটি মানুষ’কে ছাড়া তার পৃথিবী শূন্য। তাই বলে এতো এতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে?
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে ইমন। সকলের মুখেই ভয় স্পষ্ট। কে কি বলবে, কি বলে স্বান্তনা দেবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। ইরাবতী ইমনের সম্মুখে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ইমন রোবটের মতো স্থির হয়ে আছে। কিছু সময় পর হঠাৎ দিহানের দিকে তাকিয়ে ইমন বললো,
“আমি ওকে কিভাবে সামলাবো দিহান? এতোগুলো মাস এতোটা কষ্ট করার পরও আমি ওকে সুখ দিতে পারবো না। আমার সন্তান ওর কোলে দিতে পারবোনা। ”
ইমনের অবস্থা দেখে দিহানকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো সায়রী। ইমনকে এ অবস্থায় দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর সেই সাথে অবাক হচ্ছে ইমনের কথা শুনে। এমন পরিস্থিতিতে এসেও ইমন নিজের জন্য চিন্তা করছে না। বরং মুসকানকে নিয়ে তার যতো ভয় যতো চিন্তা। এই ছেলেটা এতো ভালোবাসতে পারে বলেই কি এতো কষ্ট, এতো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়?
.
ওটির বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানেনা মুসকান। তার সন্তান মৃত ইমনকে দিয়ে বন্ড সই করানো হয়েছে সেসবের কিছুই জানেনা সে। সে কেবল নিজের কান সজাগ করে রেখেছে তার বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য। পেটের উঁচু ভাগে সবুজ রঙের একটি পর্দা টানা রয়েছে। সবটাই বুঝতে পারছে সে শুধু কিছুটা অনুভূতি শূন্য লাগছে। কানে স্পষ্ট শুনতে পারছে ডক্টর এবং নার্স কি বলছে।
মুসকানের পেট থেকে যখন ভারী কিছু একটা টেনে বের করা হলো মুসকান তখন নিজের কানটা সজাগ করে রাখলো। কিন্তু কোন আওয়াজই শুনতে পেলো না। ঠিক তখনই ডক্টর নার্সকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“বাচ্চা আছে? ”
নার্স বললো,
“জি স্যার জি স্যার বাচ্চা নড়ছে। ”
এমন কথোপকথন শোনার ঠিক কিছু সময়ের মধ্যেই নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনতে পেলো মুসকান। নার্স শিশুটিকে তয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে মুসকানের সম্মুখে নিয়ে এলো। তার গালে শিশু বাচ্চাটির গাল ছুঁইয়ে বললো,
“আপনার মেয়ে হয়েছে। ”
দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়ালো মুসকানের। নার্সটি আর দেরি করলো না বাচ্চাটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
.
থমথমে পরিবেশটি হঠাৎই উৎফুল্লতায় ভরে গেলো। যখন নার্স নবজাতককে নিয়ে এলো ঘোষণা করলো মিসেস চৌধুরীর মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। মরিয়ম আক্তার প্রায় ছুটে এসেই ক্রন্দনরত গলায় প্রশ্ন করলো,
“আমার মেয়ে আমার মেয়ে ঠিক আছে? ”
নার্স মাথা নাড়ালো সায়রী বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। ইমন নিশ্চুপ হয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়েই রইলো সায়রীর দিকে। একে একে সকলে এসেই বাচ্চার মুখ দেখতে লাগলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো সকলেই। কিন্তু ইমন থেকে কোন রেসপন্স কেউই পেলো না৷ পাবে কি করে এই যে তার সামনে যে নবজাতকটি গলা ফাটিয়ে কাঁদছে তাকে তো মৃত ঘোষণা করা হয়েছিলো। বাবা হয়ে সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলো সে করেছিলো বন্ড সই। তার ভিতরকার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অনুভূতিটুকু কি আর কারো বোঝা সম্ভব?
.
মুসকান কে অন্য কেবিনে শিফ্ট করা হয়েছে। মুসকানের একটি হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে খানিক পর পরই চুমু লেপ্টে দিচ্ছে ইমন। মুসকান দুর্বল গলায় বললো,
“তুমি আমার মেয়েকে একটুও কোলে নাওনি এইজন্য আমি রেগে আছি খুব। ”
ইমন কিছু বললো না শুধু নিশ্চুপ ভঙ্গিতে একটি চুমু হাতের পিঠে আরেকটি চুমু ললাটে এঁকে দিলো। মৃদু হেসে মুসকানও চুমু দিতে চেষ্টা করলো তাই ইমন তার সুবিধার জন্য নিজ ললাট এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলো দিতে মুসকান পরপর তিনটি চুমু দিয়ে বললো,
“এবার যাও আমাদের সোনামণিকে কোলে নাও গিয়ে। ”
ছোট্ট একটি শ্বাস ত্যাগ করলো ইমন। মুসকানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“বাবা, মা হওয়া এতো কঠিন কেন মুসু? ”
মুসকান তৃপ্তিময় হেসে উত্তর দিলো,
“এমন ফুটফুটে বাচ্চার মুখে মা,বাবা শুনবো আমরা আর এটুকু কষ্ট করবো না? ”
অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ইমন। এই তো কয়েকঘন্টা আগের ঘটনা ভয়ে,যন্ত্রণায় মেয়েটা কি ছটফট করছিলো। বাঁচতে চাইছিলো,মুক্তি চাইছিলো অসহনীয় যন্ত্রণাগুলো থেকে। অথচ কয়েকঘন্টার ব্যবধানেই তার মধ্যে ঠিক কতোটা সাহস কতোটা ধৈর্য্য দেখতে পারছে। এটাকেই কি বলে মায়ের ত্যাগ, মায়ের ধৈর্য্য?
বাচ্চার কান্নার শব্দে চমকে দরজার দিকে তাকালো ইমন। মরিয়ম আক্তারের কোলে ক্ষুদ্র মানবীটা কাঁদছে। মুসকানের মুখোভঙ্গি কেমন বদলে গেলো। নিচু স্বরে ইমনকে বললো,
“বাবুর কান্নার শব্দ শুনলে আমার এখানটায় খুব অস্থির লাগে। ”
ইমন মুসকানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মরিয়ম আক্তারের দিকে তাকালো। মরিয়ম আক্তার বললো,
“ওকে খাওয়াতে হবে তাহলেই চুপ হবে। ”
___________________
চারদিন পর হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় মুসকান কে। বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুসকান কাঁদছে। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। সকলেই প্রশ্ন করলে কান্নার কারণ জানতে চাইলে একটি কথাও বলছে না। শুধুমাত্র মুরাদকে বলেছে তাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। এমন কথা ইমন শুনেও মন টা ভীষণ খারাপ করে রেখেছে। সেও কারো সাথে কোন কথা বলছে না। তাই সকলেই ধারণা করে নিয়েছে তাদের সঙ্গেই কোন মনমালিন্য হয়েছে।
রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। বাচ্চার বয়স পাঁচদিন। গতরাতে মরিয়ম আক্তার সাথে থাকায় সমস্যা হয়নি। কিন্তু আজ ইমন ছাড়া কেউ নেই। মেয়ের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ইমন মুসকান দু’জনেরই। একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কিছুক্ষণ। খুব কষ্টে ওঠে বসে মুসকান। ইমন সাহায্য করতে এলেও হাত দিয়ে বাঁধা দেয়৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েটাকে কোলে নিতে যায় ইমন। কারণ কিছুক্ষণ পর পরই খাওয়াতে হয় মেয়েকে। একদিনে শাশুড়ি কিভাবে তার বউ বাচ্চার সেবা করেছে তা ঠিক মাথায় নিয়ে রেখেছে সে। তাই মেয়েকে কোলে করে মুসকানের কোলে দিতে চেয়েছিলো। তার পূর্বেই মুসকান বাঁধা দেয় অর্থাৎ সে তার মেয়েকে কোলে নিতে দেবে না। দৃষ্টিজোড়া দৃঢ় করে হাত সরিয়ে নেয় ইমন। মুসকান একাই মেয়েকে কোলে নিতে গিয়ে নিজের পেটেও চাপ খায় বাচ্চাকেও ব্যথা দেয়। পিচ্চিটা কেঁদে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে ইমন আলতো হাতে মেয়েকে ধরে চোখ রাঙিয়ে তাকায় মুসকানের দিকে। নিজ হাতে বক্ষস্থল উন্মুক্ত করে দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“একদম ফাইজলামি করবে না। কি হয়েছে এমন আচরণ কেন দিচ্ছো আর কতো জ্বালাবে আমাকে। ”
” আমার জন্য আমার মেয়ের জন্য তোমার আর জ্বলতে হবে না কাল সকালেই আমি ওকে নিয়ে চলে যাব। ”
“মুসু… ”
“কি মুসু কি শুরু করেছো তুমি? চারদিন ধরে তোমার আচরণ দেখছি আমি। ওকে কোলে নিতে সমস্যা ওর নামটা পর্যন্ত রাখতে সমস্যা। এমন একটা আচরণ দিচ্ছো ও তোমার সন্তান নয় অন্যকারো সন্তান এনে তোমার ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। ”
“মুসকান…”
মৃদু চিৎকার করলো ইমন। আঁতকে ওঠে কেঁদে দিলো বাচ্চা টা মুসকানও কিছুটা কেঁপে ওঠে মেয়েটাকে দু’হাতে আগলে নিলো। ছেড়ে দিলো ইমন। রাগান্বিত হয়ে গলা নিচু করে বললো,
“বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই একটা থাপ্পড় দিব। ”
এক ঢোক গিললো মুসকান। দুচোখ বেয়ে ঝড়তে থাকলো অগণিত অশ্রুকণা। মেয়েটা কোলেই ঘুমিয়ে গেছে৷ ছোট্ট করে ওর নাম রাখা হয়েছে মুন। মুসকানের শুরুর লেটার মু ইমন এর শেষর লেটার ন নিয়েই মুন রেখেছে মুসকান। তবে মুসকান চেয়েছিলো নামটা ইমনই রাখুক। কিন্তু ইমন কিছুই বলেনি। বাচ্চাকে তেমন কোলে না নেওয়া নাম না রাখা সবটা মিলিয়ে ইমনের ওপর দারুণ ক্ষেপে আছে মুসকান। মুন’কে শুইয়ে দিতে নিলে ইমন সাহায্য করলো। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“কি নিয়ে রেগে আছো ক্লিয়ারলি বলবে? ”
কিছু বললো না মুসকান চুপচাপ শুয়ে পড়লো। দশমিনিট পর আবারো মুন কাঁদতে শুরু করলো। এবার আর মুসকান কে ওঠতে হলো না। ইমন ওঠে মুনকে নিয়ে মুসকানের কাছে এসে খাওয়ার প্রসেস করে দিলো। এভাবে প্রায় সারারাতই ডিউটি চললো ওদের। ঠিকঠাক ঘুম হলো না কারোরি। সকাল বেলা ইরাবতী আসলে ইরাবতীর কোলে মুনকে দিয়ে মুসকানকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো ইমন। তখনই বললো,
“মুসু এতো ছোট বাচ্চা কোলে নিতে ভয় হচ্ছিল আমার। তাই ওকে কিভাবে কোলে নিতে হবে কিভাবে কি করতে হবে এ’কদিনে ভালোভাবে শিখে নিয়েছি৷ আর ওর নাম রেখেছি ইয়ুমনা চৌধুরী মুন। ইয়ুমনা অর্থ সৌভাগ্য পছন্দ হয়েছে ? ”
” রাখতে হবে না নাম চলে যাব ওকে নিয়ে আমি। ”
” যেতে দিলে তো যাবে। কি বাঁধনে বেঁধেছি এটুকু মাথায় রেখে এমন কথা বলো মুসু। ”
আড়চোখে তাকালো মুসকান। মুচকি হেসে মুসকানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ইমন বললো,
“আমার বাচ্চার মা তুমি। ”
.
কেটে গেছে একটি বছর। এই এক বছরে ইমন মুসকানের জীবনে এসেছে বহু পরিবর্তন। মুন এখন গুটিগুটি পায়ে পুরো ঘরময় ছুটে বেড়ায়। আধোআধো সুরে মা’কে ডাকে মাম… বাবাকে ডাকে পাপা…। স্বামী, সংসার বাচ্চা সামলে নিজের পড়াশোনাও কন্টিনিউ করছে মুসকান। মেয়েকে ইরাবতীর কোলে দিয়ে রুমে বসে পড়ছিলো মুসকান। এমন সময় ইমনের কল এলো সে জানালো আজ আসতে তার লেট হবে। অথচ গতকালই সে মুসকানকে কথা দিয়েছিলো আজ তাকে আর মুনকে নিয়ে ডিনার করতে বাইরে বের হবে। কিন্তু যখন শুনলো ইমনের ফিরতে লেট হবে ভয়ংকর রেগে গেলো। অতিমাত্রায় রেগে কিছু বলতে যাবে তখনই একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“আরে ইমন ফোনে কথা বলছিস তাড়াতাড়ি চল লেট হয়ে যাবে আমাদের। ”
এটুকু শোনামাত্রই পুরো শরীর শিউরে ওঠলো মুসকানের। চোখ, মুখ শক্ত করে চিৎকার করে বললো,
“তুমি কার সঙ্গে আছো? কোথায় যাবে তুমি? ”
“মুসু আমি পৃথার সঙ্গে আছি খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটি আলোচনায় বসছি। পরে ফোন করছি। ”
“না তুমি ফোন কাটবেনা তুমি এখনি বাসায় আসবে।”
ইমন ফোন কেটে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মুসকান আবার কল করলো। কেটে দিলো ইমন। মুসকান বার বার কল করেই যাচ্ছিল বিধায় ফোন অফ করেও দিলো। মুসকান বার বার ট্রাই করে যখন ফোন বন্ধ পেলো তখন নিরাশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মুনকে নিতে। তৎক্ষনাৎ মুন’কে রেডি করে নিজেও রেডি হয়ে বাড়ির গাড়ি করেই চলে গেলো বাপের বাড়ি। ইরাবতী জিগ্যেস করাতে বললো তার মায়ের শরীর খারাপ। রাত এগারোটার দিকে যখন বাড়ি ফিরলো ইমন আর জানতে পারলো মুনকে নিয়ে রাত আটটার দিকে মুসকান নিজের বাড়ি চলে গেছে মাথা গরম হয়ে গেলো তার। ইরাবতীর দিকে শান্ত চাহনী তে চেয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
“রাত করে ওকে বের হওয়ার অনুমতি না দিলেও পারতে। ”
ইরাবতী উত্তরে মরিয়ম আক্তারের অসুস্থতাকে স্মরণ করিয়ে দিলো। ইমন আর কিছু বললো না। চুপচাপ চলে গেলো নিজের রুমে। কাজের চাপে ইদানীং সময় দেওয়া হয় না মুসকান’কে। কথা দিয়েও আজ কথা রাখতে পারলো না। রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক তাই বলে বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে এই শীতের রাতে বের হবে? রাগ এবার ইমনেরও হলো খুব। অপেক্ষা শুধু সকালটার৷
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে বের হলো ইমন। উদ্দেশ্য প্রেয়শীর অভিমান ভাঙানো। রাস্তার পাশের ফুলের দোকানগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে এক গুচ্ছ টাটকা লালগোলাপ কিনলো। ভোর সকালে তেমন কোন দোকান খোলা নেই তাই পরিচিত এক দোকানওয়ালাকে ডেকে দোকান খুলিয়ে বউ আর মেয়ের জন্য কিটকাট চকোলেট কিনলো। তারপর আবার গাড়ি করে শ্বশুর বাড়ির পথে রওনা দিলো।
সকাল সকাল মুনকে ওঠিয়ে ফ্রেশ করে মরিয়ম আক্তার ডিম আর আপেল সিদ্ধ খাওয়াচ্ছে। কতোদিন পর সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমুচ্ছে মুসকান৷ মেয়ের জন্য তার শান্তিতে ঘুমানো হয় না। হয় মেয়ে নয়তো মেয়ের বাবা তার ঘুমের পরম শত্রু। আজ শান্তিতে ঘুমাতে পেরে মন মস্তিষ্ক বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঘুম ছেড়ে গেলেও চোখ বুজে আছে মুসকান। এমন সময় মুনের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো আধোসুরে সে বলছে,
“পা-পা এলেচে পাপা এলেচে। ”
কথাটি শোনামাত্রই ভালোভাবে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে রইলো মুসকান। ইমন মুনকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে মরিয়ম আক্তারের কোলে দিলো। তারপর চলে গেলো মুসকানের ঘরে। দরজার সিটকেরি লাগানোর শব্দ পেতেই মুসকান নড়েচড়ে এক ঢোক গিললো। ইমন নিঃশব্দে কম্বলের ভিতর ঢুকে দু-হাতে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো মুসকান’কে। নাক মুখ ডুবিয়ে দিলো ওর গলায়৷ সঙ্গে সঙ্গে মুসকান চেঁচিয়ে ওঠলো,
“উফফ কি ঠান্ডা, ইশ ছাড়ো। ”
ইমন জোরপূর্বক ওকে জাবটে ধরে ঘার মাথা নাচিয়ে বললো,
“মাথাটা যে মাত্রায় গরম হয়েছিলো না এখান থেকে তুলে সোজা একটা আছাড় দিতাম৷ সকাল সকাল অতিরিক্ত শীতে মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে তাই এটুকু সহ্য করো। ”
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেলো মুসকানের। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বললো,
“সকাল সকাল কি শুরু করলে ছাড়ো। ”
“চুপপ ”
এক আঙুলে মুসকানের ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরে ধীরে ধীরে নিজ পা দ্বারা মুসকানের দু’পা আবদ্ধ করে ফেললো। বললো,
“এই পা গুলো ছোটই মানায় এতো বড়ো মানায় না। ”
“ওওও এখন সব দোষ আমার আর তুমি তুমি কি করছিলে কাজের নাম করে ঐ পৃথার সাথে নাইট পার্টি করতে গেছিলে? ”
“উহুম মুসকান না বুঝে না জেনে কথা বলবে না। একটা কেসের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। পৃথার ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে তাই উকিল ঠিক করে দিলাম। ”
“ব্যস আর কিছু শুনতে চাইনা। ”
দু’গাল মৃদু চেপে ধরে ইমন নিজ ওষ্ঠজোড়া মুসকানের ওষ্ঠে এগুতে এগুতে বললো,
“আমি আর কিছু বলতেও চাইনা শুধু করতে চাই। ”
মুসকানের ওষ্ঠজোড়ায় দীর্ঘ সময় টর্চার করে যখন গলার দিকে নামলো ইমন ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেলে। বুড়ো আঙুল দিয়ে গলার সাইটে বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলো,
“এটা কিভাবে হলো এমন দাগ… ”
“এমন দাগ আপনি ছাড়া আর কেউ যখন দিয়েছে সেটা কে হতে পারে ভেবে দেখুন।”
আশ্চর্য হয়ে ইমন বললো,
“মুন! কিন্তু কেন ইশ কি অবস্থা করে ফেলছে।”
“রাক্ষসের মেয়ে রাক্ষসী হয়েছে তাই এমন করেছে। এতো রাগ এতো জেদ খাওয়ানোর সময় ফোনে কথা বলছিলাম ওর খেতে সমস্যা হচ্ছিল রাগ ওঠে গেছে তাই কামড়ে দিয়েছে। ওর রাগ নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। ”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ইমন কামড়ের জায়গায় আলতো চুমু খেয়ে বললো,
“ওর হয়ে আমি আদর করে দিলাম। ”
মুসকান কিছু বললো না শুধু শোনা গেলে তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দগুলো। ইমন ধীরে ধীরে আরো গভীরতম স্পর্শে শিহরিত করে তুললো ওকে। দুজনই যখন দুজনাতে মত্ত প্রায় এমন সময় দরজার সম্মুখে এসে মুন মাম মাম বলে ডাকতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে কাঁদতেও শুরু করলো। মেয়ের কান্নার শব্দ শুনে দুজনই দুজনের থেকে ছিটকে সরে গেলো। ইমন দ্রুত গোলাপের গুচ্ছটি মুসকানকে দিয়ে আফসোসের সুরে বললো,
“আমাদের আর বাচ্চার মুখ দেখা হবে না মুসু…।”
.
দরজা খুলে মুনকে কোলে তুলে নিলো ইমন। মুন আধোসুরে বললো,
“পা-পা মাম মাম। ”
ইমন বুঝলো মুন মায়ের কাছে যেতে বলছে। মুসকান দ্রুততার সাথে কোনরকম ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর মুনকে কোলে নিয়ে দুগ্ধ খাওয়াতে লাগলো। খেতে খেতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো মুন। নিশ্চিন্ত হয়ে ওকে শুইয়ে দিয়ে সকালের খাবার খেতে চলে গেলো ইমন মুসকান। খাবার টেবিলে সকলের সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ইমন মুরাদকে বললো,
“তোর বউটাই ভালোরে রাগ করলেও বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয় না তেমন রাগও দেখায় না। ”
মুরাদ বললো,
“রাগ দেখিয়ে লাভ আছে আমার বোনের মতো রাগ করে বাড়ি ছাড়তে তো পারবেনা। বাপের বাড়ি যেতে হলেও পাশের ঘরে যেতে হবে। ”
মুরাদের কথা শুনে হেসে ফেললো সবাই।
.
খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হলে ইমন মুসকান কে বললো রেডি হতে আজ সারাদিন তাকে আর মুনকে নিয়ে ইমন ঘুরবে। মুসকান খুব খুশি হলো। উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি পড়বো মানে কোন শাড়িটা পড়বো? মুনকে সাদা ড্রেসটা পড়াই ওটা এখানেই আছে। ”
ইমন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো তার মুগ্ধময়ীর মুখশ্রী তে। এই অল্পখানিতেই কতো খুশি হলো মেয়েটা। অথচ এটুকুই সে দিতে পারছিলো না। জাষ্ট একটু সময়। কিছু মেয়ে আছে যাদের খুব একটা চাহিদা থাকেনা। প্রিয়জন অল্পখানি সময় দিয়ে হাতে হাত ধরে পাশে থাকলেই চলে। মুসকান ঠিক ঐ মেয়েদের তালিকাতেই পড়ে। শাড়ি পড়ে মুসকান যখন ফুল রেডি হয়ে ইমনের সম্মুখে এলো প্রশ্ন করলো,
“সাজ কমপ্লিট। ”
ইমন বাঁকা হেসে ধীরগতির মুসকানের পিছনে দাঁড়ালো আলতোহাতে ব্লাউজের ফিতা লাগিয়ে দিয়ে কাঁধে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে বললো,
“আমি ছাড়া তোমার কোন কিছুই সম্পূর্ণ নয় ডিয়ার হার্টবিট। ”
সমাপ্ত❤