পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে আরাবী।পাত্রপক্ষ বললে অবশ্য ভুল হবে কারন পাত্রই তো আসেনি এসেছে পাত্রপক্ষের পরিবার।তাও আবার তারই বাবার অফিসের বস।আরাবী’র বাবা জিহাদ সাহেবের অফিসের বস নিহান সাহেব স্বপরিবারে তার ছেলের জন্যে আরাবী’কে দেখতে এসেছেন। তার একমাত্র ছেলে জায়ান সাখাওয়াতের জন্যে আরাবীর হাত চাইতে এসেছেন তিনি।জিহাদ সাহেব প্রথমে বেশ ভড়কে গেলেও পরক্ষনে তার অফিসের বস মানে নিহান সাহেবের অমায়িক ব্যবহারে তার ভ’য়টুকু গায়েব হয়ে গিয়েছে।এদিকে শাড়ি পরে তাদের সামনে পুতুলের মতো বসে আছে আরাবী।কি থেকে কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।হাত-পা কেমন যেন কাঁ’পছে বাজেভাবে।ভীষন নার্ভাস লাগছে আরাবীর।বাবার দিকে একবার তাকালো আরাবীর।জিহাদ সাহেবের হাস্যজ্বল চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার এই সম্বন্ধে পুরোপুরি মত আছে।
**
-‘ জিহাদ সাহেব তো ধরে নিবো সম্পর্ক’টা পাকাপোক্ত? ‘
জিহাদ সাহেব নিহান সাহেবের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলেন।তিনি অবশ্য রাজি এই সম্বন্ধে। জায়ানকেও তার ভালোলাগে।ছেলেটা ভালো।তবে কথাবার্তা একটু কম বলে এই আরকি।কিন্তু যতোই হোক।তাদের কথায় তো আর কিছু হবে নাহ? ছেলে মেয়ের নিজেরও একটা পছন্দ আছে।তাদের যদি একে-অপরকে পছন্দ হয় তবেই না আহাবে সম্পর্কটা। জিহাদ সাহেব আগেই তো সম্মত্তি দিতে পারেন না। জিহাদ সাহেব আমতা আমতা করতে দেখে নিহান সাহেব হালকা হেসে বলেন,
-‘ কোন সমস্যা থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন জিহাদ সাহেব।কোন সমস্যা নেই।’
জিহাদ সাহেব যেন কিছুটা সাহস পেলেন এই কথায়।তাই কোন ভণিতা না করেই বললেন,
-‘ ভাবছিলাম যে স্যার আমাদের কথায় তো আর কিছু হবে নাহ।জায়ান বাবা আর আমার আরাবী তো একে-অপরকে দেখলো না।তাদের যদি দুজন দুজনকে পছন্দ হয় তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।কিন্তু তাদের মতামত ছাড়া তো আর আগানো যাবে না স্যার।’
নিহান সাহেব হেঁসে উঠলেন।বললেন,
-‘ এই সমস্যা? তাহলে আমি এক্ষুণি আমার ছেলেকে ফোন করে আসতে বলছি।আসলে ওকেও নিয়ে আসতাম কিন্তু ও আবার মিটিংয়ের জন্যে একটু ধানমন্ডির দিকে গিয়েছে।’
-‘ স্যার জরুরি মিটিং তো থাক পরে নাহয় দুজন একসাথে দেখা করে নেবে।’
নিহান সাহেব হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলেন।তারপর বলেন,
-‘ মিটিং বোধহয় ১৫ মিনিট পরেই শেষ হয়ে যাবে। কোন সমস্যা হবে নাহ।’
নিহান সাহেব ফোন করে তার ছেলেকে জানিয়ে দিলেন এখানে আসার কথা।তারপর ফোন রেখে বললেন,
-‘ তা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন জিহাদ সাহেব?’
-‘ এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আর গোটা পাঁচেক পরেই অফিস জয়েন করবো।’
-‘ প্রেসার নিতে হবে নাহ।মাত্রই আপনার এপেন্ডিসাইটিস এর অপা’রেশন হলো ঠিকঠাক বিশ্রাম নিন।শরীর পুরো সুস্থ্য হলে তবেই অফিসে আসবেন।’
জিহাদ সাহেব হেঁসে মাথা দুলালেন। দুজন আরো খোশগল্প করতে লাগলেন।তাদের দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না যে তাদের সম্পর্কটা অফিসের বস আর এমপ্লয়িয়ের।আরাবী টুকুরটুকুর চোখে এতোক্ষন সবটাই দেখছিলো।কিন্তু যখন নিহান সাহেব জায়ানকে ফোন করে এখানের আসার কথা বললেন তা শুনেই আরাবীর ভ’য়ের মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেলো।গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে একেবারে। আরাবী কোনরকম ইনিয়েবিনিয়ে সেখান থেকে কেটে পরলো।সোজা নিজের রুমে প্রবেশ করলো আরাবী।চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। আরাবী বিরবির করে বলে উঠলো,
-‘ আব্বু মনে হয় এইবার আমার বিয়েটা পাকাপোক্ত করেই ফেলবেন যে অবস্থা দেখছি।’
নানান রকম চিন্তাভাবনা চলছে আরাবীর মাথার ভীতরে। বিছানায় সুয়ে চোখ বুজে নিলো আরাবী।ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো।আরাবীর মা লিপি বেগম ডাকছেন আরাবীকে।আরাবী লাফ দিয়ে উঠে বসলো।তারপর জলদি গিয়ে দরজা খুলে দিলো।আরাবী দরজা খুলতেই লিপি বেগম বেশ রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠেন,
-‘ কি সমস্যা তোর?বাড়িতে মেহমান ভরা আর তুই দরজা আটকে আছিস কেন? বড়লোক বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে এইজন্যে কি ভাব বেরে গিয়েছে?’
আরাবী মায়ের কথাগুলো শুনে মন খারাপ করে মাথা নিচু করে নিলো।হালকা আওয়াজে বলে,
-‘ না আম্মু।এমন কিছু না।’
-‘ তাহলে কেমন কিছু? এখনই এই অবস্থা বিয়ে হলে তো তোর ভাবের চো’টে মনে হয় মাটিতে পা পরবে নাহ।’
আরাবী চোখ ভরে উঠলো। মায়ের কথাগুলো তীরের মতো এসে বিধছে বুকে।আরাবী আর কোন কথা বললো না।চুপচাপ রইলো।লিপি বেগম আরাবীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলেন,
-‘ এইভাবে সং সেজে না দাঁড়িয়ে থেকে যা ভালোভাবে হাত মুখ ধুয়ে আয়।তোকে ছেলের পছন্দ হলেইবিয়েটা পাকাপোক্ত হবে।হালকা সাজগোছ করে নিস। ভালোই ভালোই বিয়েটা হলেই হলো। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে এই বাড়ি থেকে বিদায় হো তুই।তাহলেই আমি বাঁচি।’
কথাগুলো বলেই লিপি বেগম চলে গেলেন।আরাবী অ’শ্রু চোখে মায়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।টলমলে নয়নজোড়া আলতো হাতে মুছে নিলো আরাবী।ভাবলো ওর মা ওর ভাই আর বোনকে অনেক ভালোবাসে।তাহলে ওর সাথেই কেন এমন করে? কেন ওর ভাই আর ছোট্টো বোনের মতো ওকেও ভালোবাসে না আদর করে নাহ।কেন সবসময় এইভাবে রু’ক্ষ ব্যবহার করে ওর সাথে। কি এমন করেছে আরাবী যে মা ওকে একটুও দেখতে পারে নাহ।আরাবী তো মায়ের একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে ছটফট করে সারাটাক্ষন।মা যা পছন্দ করেননা এমন কোন কাজ করে নাহ আরাবী।মায়ের সাথে সাথে সকল কাজে সাহায্য করে ও।বাড়িতে থাকলে সুয়ে বসে সময় কাটায় না ওর ছোট বোনের মতো।সেদিন একা হাতে সব করে আরাবী।তবুও মা কোন দিন ওর প্রসংশা করেনি আজ পর্যন্ত। বুঝার বয়স হতেই সবসময় মা’কে তার সাথে এইরকম রু’ক্ষ ব্যবহার করে আসতেই দেখছে আরাবী।হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লো আরাবী।তারপর চলে গেলো ওয়াশরুমে। হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজেকে পরিপাটি করে নিলো আরাবী।বাহির থেকে বেশ শোরগোলের আওয়াজ আসছে। তাহলে কি কাঙ্খিত ব্যাক্তিটি এসে পরেছে। অজানা ভ’য়ে উত্তেজনায় হিম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আরাবী। বুকটা ধ্বুকপুক করছে ভীষনভাবে।দরজার বাহিরে লিপি বেগমের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কেঁপে উঠলো আরাবী।তিনি আরাবীকে বাহিরে আসতে বলছেন।
-‘ আরাবী?হলো তোর? জলদি বাহিরে আয়।ছেলে এসে পরেছে।’
আরাবী মায়ের কথায় দুরুদুরু বুক নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো।লিপি বেগম চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।লিপি বেগম বলেন,
-‘ জলদি আয়!’
আরাবীকে নিয়ে লিপি বেগম বসার ঘরে আসলেন।আরাবী মাথা নিচু করেই ধীর স্বরে সালাম জানালো।ঠিক তখনই ওর কানে তীব্রভাবে গম্ভীর গলার একটা পুরুষালি কন্ঠ এসে বারি খেলো। ওর সালামের জবাব দিয়েছে মূলত।আরাবীকে নিয়ে নিহান সাহেবের স্ত্রী সাথি বেগমের পাশে বসালেন। সাথি বেগম আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-‘ মেয়ে আমার তোর বাবা তোর চাচ্চু আর ছোটমায়ের খুব পছন্দ হয়েছে।এখন তুই কি বলিস?তুই যা বলবি তাই হবে।’
আরাবী কান পেতে। লোকটা কি বলে শোনার জন্যে।কিন্তু কোন রকম উত্তর এলো না অপরপাশ হতে।আরাবী ঠোঁট চেপে বসে রইলো।ভাবছে লোকটা বোবা না-কি? নিহান সাহেব ছেলের দিকে একবার তাকালেন।ছেলে যে তার ঘার’ত্যারা সেটা তিনি ভালোভাবেই জানেন।এখানে আসতে চাইছিলো না।কোনরকম বুঝিয়ে শুনিয়ে এনেছে।ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে আনার কারনে ঠ্যা*টামি ধরে বসে রয়েছে।নিহান সাহেব বলে উঠলেন,
-‘ জিহাদ সাহেব।বলছিলাম কি আমার ছেলে আর আরাবী মা’কে একটু আলাদা কথা বলতে দেওয়া উচিত কি বলেন?’
জিহাদ সাহেব নিহান সাহেবের কথায় হেসে বলেন,
-‘ অবশ্যই তা কেন নয়।আরাবী মা?’
আরাবী’র জবাব,
-‘ জি আব্বু।’
-‘ যাও জায়ান বাবাকে নিয়ে ছাদে যাও।’
আরাবী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলালো।কিন্তু ওর মনের ভীতরে তৈরি হওয়া উথা*লপাথা*ল ঝড়টা কেউ বুঝতে পারছে না।দমটা কেমন যেন আটকে আসছে আরাবী’র।পাজোড়া যেন সামনের দিকে অগ্রসর হতেই চাচ্ছে না।কি একটা অবস্থা।আরাবী হেটে দু-একপা সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।লিপি বেগম আরাবীর কানে ফিসফিসিয়ে বেশ কিছু কথা বলে দিলেন তারপর সরে গেলেন।
এদিকে জায়ানকে কোনরকম নড়চড় করতে না দেখে নিহান সাহেব জায়ানের গা ঘেসে ফিসফিস করে বলেন,
-‘ কি হচ্ছে জায়ান?উঠছো না কেন? চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো আরাবী মায়ের সাথে যাও।কোন রকম অভ’দ্রতা করে আমায় লজ্জা দিও নাহ।’
জায়ান বাবার কথায় শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাবার দিকে।অতঃপর শক্ত গলায় নিচুস্বরে বললো,
-‘ যা করছো ভালো করছো নাহ।’
কথাটা বলেই জায়ান হনহনিয়ে চলে গেলো।নিহান সাহেব ছেলের দিকে হতা*শ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন।যাই হয়ে যাক আরাবীকেই তিনি পুত্রবধু রূপে ঘরে তুলবেন ব্যস।
#চলবে___________
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#সূচনা_পর্ব
অনেকদিন পর লিখলাম। জানিনাহ কেমন হয়েছে। অনেকদিন পর লিখায় বেশ অগোছালো লাগবে আমি জানি।একটু মানিয়ে নিয়েন আপনারা।আর হ্যা সবাই রেস্পন্স করবেন প্লিজ। আপনাদের পছন্দের জুটি নিয়েই ফিরে এসেছি।