হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ৬

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ০৬)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
— বলো না… পাখি… ওতা কি… ওতা কি আমাল মাম্মাম ?
আমিও আমার হৃদয়ে ঘৃণার আগুন জালিয়ে উত্তর দিলাম,
— নাহ্,,, ওটা তোমার মাম্মাম না সোনা।
.
রাত ৮ টার দিকে আরিয়ান বাড়িতে ফিরলো। আমরা সবাই ড্রইং রুমে সোফাই বসে ছিলাম। আমার কোলে মাথা রেখে আয়াত puzzle game খেলছিল। আরিয়ান আমাদের কাছে এসে ওর মাথার টুপি আর রিভলবার টা টি-টেবিলের উপর রাখলো। তারপর আয়াতকে কোলে নেওয়ার জন্য হালকা ঝুঁকে আমার দিকে হাত বাড়ালো। কিন্তু আয়াতের শরীর দূর্বল থাকায় ও লাফ দিয়ে কোলে উঠতে পারলো না। তাই আরিয়ান আরও অনেকটা ঝুঁকে ওকে নিতে চাইলো। তখন আরিয়ানের মাথাটা অনেকটা আমার বুকের কাছে। ওর পারফিউম আর ঘামের সংমিশ্রণের একটা ঘ্রাণ আমার নাকে ধাক্কা খেলো। আমিও ওই মাতাল করা ঘ্রাণটা খুব আবেগের সাথে নিঃশ্বাসে মিশিয়ে আমার ফুসফুসের মধ্যে ভরে নিলাম। আয়াতকে কোলে নিয়ে আরিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আর আমি খুবই ধীরে ধীরে ওর ঘ্রাণ মাখানো নিঃশ্বাসটাকে মুক্তি দিলাম। কেন জানি মনে হলো, ওই নিঃশ্বাসটা আরও কিছুক্ষণ যদি আমার ফুসফুসে আটকে রাখতাম তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো ? আরিয়ান কি ওর ঘ্রাণের দাম টা খুব বেশি চেয়ে বসতো আমার কাছে ? হয়তো…….. আচ্ছা এসব কি করছি আর কি ভাবছি আমি। নাহ্, একদম ঠিক হচ্ছে নাহ্ এসব। আমার উচিৎ নিজেকে সংযত রাখা।
.
আয়াতকে কোলে নিয়ে আরিয়ান জিজ্ঞাসা করলো,
— এখন কেমন আছো বাবা ?
— উমম্ ভালোই পাপায় ।
— মাই ব্রেভ্ বয়,,,
— পাপায় আমলা না পাখিল নাম দিয়েছি। আমি, দিদুন আল দাদুন ভাই মিলে।
আরিয়ানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল সাথে আমারও। সে বললো,
— তাই ? তা কি নাম দিয়েছো ?
— এ্যানজেল। সুন্দল না বলো পাপায় ?
— হ্যা বাবা খুব সুন্দর। সি’জ লুক লাইক এ এ্যান্জেল। ( কথাটা আমার দিকে শীতল চাহনীতে তাকিয়ে বললো)
— আমলা তোমালও নাম দিয়েছি। ইউ আল মাই সুপালম্যান।
— সুপারম্যান ? ( এটা বলেই আরিয়ান শব্দ করে হাসতে লাগলো। আর আয়াতকে চুমু দিলো)
আয়াত আবার ও বলতে লাগলো,
— পাপায় আমি বলো হয়ে গেলে তোমাল মতো পুলিছ ইনপেকতল হবো।
— হ্যা তো। আমার ছেলে বড় হয়ে একদম আমার মতো হবে।
কথাটা বলেই আবার চুমু খেল আর আয়াতও মুখ কুঁচকে সাথে সাথে বললো,
— পাপায় আমাকে এমন এত্তো পাপ্পি দিও না।
তোমাল খোঁচা খোঁচা দালিতে আমি ব্যাতা পাই।
.
আয়াতের এই কথা শুনে আমি নিজেই হেসে দিলাম। আংকেল আর আরিয়ান তো ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। এই প্রথম আমি আরিয়ানকে মন খুলে হাসতে দেখলাম। আয়াতকে কোলে নিয়ে ওকে এভাবে হাসতে দেখে আমার ভেতরকার স্বত্বা বলে উঠলো, “পাখি, এখনই একটা ছবি তুলে রাখো।” অতঃপর আমি আমার চোখকে সংযত করলাম। আন্টির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে আমার দিকে হাসি মুখে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ আমাকে বলছে, “দেখো আমার ছেলেটা হাসছে, তুমি চাইলেই আমার ছেলেটা সারা জীবন এমন হাসতে পারবে।”
.
কিছুক্ষণ পর আন্টি আরিয়ানকে বললো ফ্রেশ হয়ে নিতে। আরিয়ান আমার কোলে আয়াতকে দিতে আসতে নিলেই, আমি আমার নিঃশ্বাসটা বন্ধ করে আটকে রাখলাম।
.
আরিয়ান উপরে যেতে যেতে বললো, “মা আজকে পায়েশ রান্না করো তোহ, আমি আর আয়াত খাবো।” আন্টি বললো “ঠিক আছে আমার বাবা।” তারপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে ওনার হাতের কব্জি ঘুরাতে ঘুরাতে বললো, “আমার হাত দুটো কত্তো ব্যাথা। পাখি মা তুমি একটু কষ্ট করে ওদের জন্য পায়েশটা রান্না করো তো! ” ওনার কাহিনী দেখে আমার রাগও লাগছে আবার হাসিও পাচ্ছে ।
.
রাতে খাবার পর আমি পায়েশ এনে টেবিলে রাখলাম। আয়াত আর আরিয়ানকে প্রথমে দিলাম। সাথে সাথে আংকেল বললো “আমাকে কি একটু দেওয়া যাবে মা ?” সাথে সাথে আন্টি জোওয়ালামূখীর মত চোখ দিয়ে আগুন বের করে আংকেল এর দিকে তাকালো। আংকেলের মুখটা একদম আমচূড়ের মতো চুপসে গেল। আমি আন্টির আগুন রাঙা চোখকে উপেক্ষা করে খুব অল্প করে পায়েশ দিলাম আংকেলকে। আংকেল খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। মনে মনে বললাম “হায়রে ডায়বেটিকস্”
আয়াত বললো “পায়েশ টা খুউব মজা হয়েছে।”
আন্টিও ঢোল পিটিয়ে আরিয়ানকে জানিয়ে দিল যে পায়েশটা আজ পাখি রান্না করেছে। আরিয়ান এক পলক আমার দিকে তার শীতল চাহনি ছুড়ে দিয়ে পায়েশ খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
.
রাতে আন্টি বললো “লন্ড্রি থেকে কাপড় এসেছে, মা তুমি একটু আরিয়ানের কাপড় গুলো ওর আলমারিতে রেখে আসো তো প্লিজ।” আমি কাপড় গুলো নিয়ে ওর রুমে যেতে যেতে ভাবছি, আন্টি যে কারণে আরিয়ানের সব কাজে আমাকে যুক্ত করছে তাতে তার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। এটা সে কেন বুঝতে চাইছে না।
.
আরিয়ানের রুমের দরজা খোলায় ছিলো। দরজার কাছে গিয়ে দেখি সে তার স্টাডি টেবিলে ঝুঁকে বসে কিছু একটা লিখছে। ফর্মালিটির জন্য দরজায় কড়া নাড়লাম। সে আমাকে দেখে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তার লেখা খাতাটার উপর দ্রুত একটা ফাইল রেখে দিল। আমাকে মাথা নেড়ে ভেতরে আসতে বললো। আমি আলমারিতে কাপড় গুলো রাখতে লাগলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— আয়াত কি ঘুমে ?
— না, ওকে ওষুধ খাওয়ায়ে তারপর ঘুম পাড়িয়ে দিবো।
পিছনে ঘুরে দেখলাম আরিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে বললো,
— তুমি এখানে বসো। আমি আয়াতকে আমার রুমে আনছি, ওর সাথে খেলবো।
তারপর চলে যেতে নিয়েও ফিরে এসে ওর সেই কিছু একটা লেখার উপর থেকে ফাইলটা উঠিয়ে আগের জায়গায় রেখে চলে গেল। ও যেনো চাইছে আমি দেখি সে কি লিখছিল। আমিও সুযোগ পেয়ে দৌড়ে গেলাম। দেখলাম হলুদ রং এর ছোট কাগজে লেখা, “তোমার মতো তোমার হাতের রান্নাও অতুলনীয়। তোমার সব কিছুতে আমি মুগ্ধ হয়ে পরছি। এতোটা দূর্বল করো না আমাকে।”
.
ঠিক এই রকমই দু’টো চিরকুট আমার কাছে আছে। একই হাতের লেখা। অতঃপর চিরকুট প্রেরকের রহস্য উদ্ধার করলাম। সত্যিটা জেনেও যেন জানতে ইচ্ছা করলো না। শুধু মনে মনে একটা কথায় বললাম, আরিয়ান যা করছে তা খুব ভুল করছে। এটা ওকে আরও গভীর কষ্টে ফেলবে।
.
আয়াত আজ রাত প্রায় ১১ টায় ঘুমালো। আরিয়ানের রুম থেকে আসতেই চায়ছিলো না।আমি আয়াতের রুমেই থাকছি। আজ রাতেও আমার মনে হলো কারোর গরম নিঃশ্বাস আমার উপর পরছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কেউ আমাকে পর্যবেক্ষন করছে। কিন্তু আমি দরজা ভালো করে বন্ধ করেছি। তাই বিষয়টা ইগনোর করলাম।
.
সকালে উঠে আরিয়ানের অনেক কাজ আমাকে করতে হচ্ছে। তার জিনিসপত্র চোখের সামনে থাকা সত্বেও সে খুঁজে পায় না। তার সব কিছু আমাকে দিয়ে করাচ্ছে আন্টি। আর এ বিষয়ে আমাকে কোনো ছাড় ও দিচ্ছে না আন্টি। তাই আপাতত চরম বিরক্ত আমি। আমার মোবাইল টা আরিয়ানের টেবিলে রাখা। রুমে আমরা দুজনই আছি। হঠাৎ আমার কল আসলো ফোনে। আরিয়ান টেবিলের কাছে থাকায়, কে কল করছে তা দেখতে পেল। আমি পিছন ঘুরে দেখলাম সে ফোঁসফোঁস করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। গিয়ে দেখলাম আমার বন্ধু রিজভি কল করছে। ওর কারনেই আমি আয়াতকে কাছে পেয়েছি। তাই খুব খুশি হয়ে গেলাম ওর কল আসাতে। ফোনটা হাতে নিতেই আরিয়ান নাক লাল করে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
— রিজভী কে হয় তোমার ?
আমি হাসি মুখে উত্তর দিলাম,
— আমার বন্ধু হয়।
কল রিসিভ করে কানে নিয়ে হাসি মুখেই বললাম,
— হ্যা, রিজভী কেমন……
এটুকু বলতেই আরিয়ান আমার কান থেকে ফোনটা নিয়ে খুব জোড়ে একটা আছাড় মারলো। সাথে সাথে ফোনটা চানাচুর ভাজা হয়ে গেল। আমি আহাম্মক হয়ে গেলাম। আমার এতো কষ্টের টাকা দিয়ে কেনা ফোনটার এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার কান্না লাগছে। আমি রাগ দেখিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, “আমার ফোনটা ভাঙ্গলেন কেন? ”
সঙ্গে সঙ্গে আমাকে টেবিলের সাথে ধাক্কা মারলো। ওর এক হাত দিয়ে আমাকে টেবিলের সাথে চেপে ধরে আর অন্য হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরলো। এতো জোরে ধরলো যেন মনে হলো আমার দাঁতের মারির মধ্যে দিয়ে গাল দুটো কেটে ওর আঙ্গুল ঢুকে যাবে। তারপর রক্ত চক্ষু নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে আমাকে বললো,
.
— আজকের পর থেকে কোনো ছেলেকে যেন তোমার কোনো কিছুর সাথে যুক্ত হতে না দেখি।
.
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, ড্রেসিং টেবিলের উপর যা কিছু ছিল একটান দিয়ে সব ছুড়ে ফেললো। হাতের কাছে যা কিছু পেল সব ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
.
আমার ব্রেইনের রিএকশন সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে মনে হল। ওর এমন কান্ডে কি রিএকশন দেওয়া উচিৎ তাই খুঁজে পাচ্ছি না। লোক টা কি পাগল ?
·
·
·
চলবে……………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here