হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ৭

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ০৭)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, ড্রেসিং টেবিলের উপর যা কিছু ছিল একটান দিয়ে সব ছুড়ে ফেললো। হাতের কাছে যা কিছু পেল সব ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
.
আমার ব্রেইনের রিএকশন সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে মনে হল। ওর এমন কান্ডে কি রিএকশন দেওয়া উচিৎ তাই খুঁজে পাচ্ছি না। লোক টা কি পাগল ?
.
আরিয়ান চলে যাওয়ার পর ফাহমিদা আন্টি হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলেন। তিনি এসে, আমার অবস্থা আর রুমের অবস্থা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
— জানো মা, আমার ছেলেটার না প্রচন্ড রাগ ছিল। আগে ঠিক এমনই রাগারাগি করতো। কিন্তু গত চারটা বছর ধরে ও নিজেকে সব কিছুতে কেমন জানি শান্ত রাখতো। যেন কোনো কিছুতেই ওর কিছু আসে যায় না। আমার চোখের সামনে ওকে এভাবে বদলে যেতে দেখে, খুব কষ্ট হতো। কিন্তু আজ ওকে আবার এভাবে রাগতে দেখে আমার কি যে খুশি লাগছে তা তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।
তারপর তিনি উনার ভ্রু জোড়া নাচিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
— আচ্ছা তোমাদের মাঝে কি হয়েছিল গো, আমাকে একটু বলবে ? ( কথাটা বলেই মুচকি হেসে তিনি উনার কাঁধ দিয়ে আমার কাঁধে হাল্কা করে ধাক্কা দিলেন। যেন আমি উনার বান্ধবী )
.
আমি উনার কথা শুনে আর অঙ্গভঙ্গি দেখে পুরা টাস্কি খেয়ে গেলাম। তারপর আমার কোমরে দুই হাত রেখে, রাগ এবং বিরক্তি দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। এভাবে আমাকে রাগতে দেখে উনি আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন,
— আ… আ… আয়াতকে ঘুম থেকে উঠাতে গেলাম… হি হি। ( ক্যাবলা মার্কা একটা হাসি দিয়ে, ঠিক যেভাবে এসেছিলেন সেইভাবেই হুরমুর করে চলে গেলেন।)
.
আর আমি ভাবতে লাগলাম, এই বাড়ির মানুষ গুলো নিশ্চয় মঙ্গল গ্রহের এলিয়েন। ঐ গ্রহে জায়গা হয়নি তাই পৃথিবীতে চালান করে দিয়েছ। শুধুমাত্র আমার আয়াতই এ বাড়িতে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ।
.
আজ দুপুরে আরিয়ান খাবার খেতে বাড়িতে আসলো না। আমিও আয়াতকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলাম। আর আমারও প্রচুর রাগ হয়ে আছে আরিয়ানের উপর। শুধু শুধু আমার ফোনটা ওর রাগের স্বীকার হলো। ফাহমিদা আন্টির ফোন থেকে আম্মুর সাথে কথা বললাম।
.
দুপুরে আয়াতকে খাওয়ায়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেল তবু আয়াত উঠছে না। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর আরিয়ান ডিউটি থেকে ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে আয়াতের কাছে আসলো। ও ঘুমে তাই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েকটা চুমু খেলো। তারপর আমাকে বললো, “আমার রুমে আসো পাখি, কিছু কথা আছে।” তারপর চলে গেল।
.
হুহ্,,, আমি পাগল, না আমার মাথা খারাপ যে আবার ওই অদ্ভুত লোকের কাছে একা একা যাবো। আয়াতটা জেগে থাকলে না হয় ওকে নিয়ে যেতাম। এখন তো মরে গেলেও আমি যাবো না। আয়াতের পাশেই আধশোয়া হয়ে পরে থাকলাম। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, ভাবছি আয়াতকে এইবার জোর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিই। ওকে ফ্রেশ করে কিছু খাওয়াতে হবে। ঠিক তখনই আমার হাত ধরে কেউ হেঁচকা টান দিয়ে এক ঝটকায় শোয়া থেকে দাঁড় করলো। তাকিয়ে দেখলাম আরিয়ান। কিছু না বলে টেনে হেঁচড়ে আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেল। আমি শুধু চারিদিকে ফাহমিদা আন্টিকে খুঁজতে লাগলাম। পৃথিবী এখন উল্টায় গেলেও আমি তাকে একবার বলতে চাই যে,,, দেখেন, দেখেন আন্টি আপনার আদরের ছেলে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করছে।
.
আমাকে ওর রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড় করায় রাখলো। আর নিজে বিছানায় বসলো। মাথা নিচু করে বসে আছে। ওকে ওভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমার কেমন জানি ভয় ভয় করছে। হঠাৎ আমার দিকে করুন চোখে তাকালো। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে আর ভাসা ভাসা। ওর ঐ করুন চাহনিতে আমার মায়া হচ্ছে না। আমার ভয় করছে। ভয়ে আমার হৃদয়ে আতংকের বিস্ফোরণ ঘটছে।
.
আমাকে অবাক করে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,
— Sorry, তোমাকে দেওয়া প্রতিটা ধমকের জন্য। Sorry, পার্কের সামনে জোড়ে তোমার হাত চেপে ধরার জন্য। Sorry, আজ সকালে ওতো জোড়ে তোমার গাল চেপে ধরার জন্য। I’m very sorry, আমার করা কঠোর ব্যবহারের জন্য। আমার জানা মতে মানুষের কঠোর ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি মনে আঘাত করে। আমি মন থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
.
আমি মনে মনে বললাম, আপনার জানা ঐ মত টা একদম ভুল। ওগুলো আপনার কোনো অপরাধই না। আপনার সবচেয়ে বড় অপরাধ, আপনার চোখের শীতল চাহনি। যা আমাকে সারাক্ষণ খুব জ্বালাতন করে।
.
সে আবারও বললো,
— পাখি, আমাকে ক্ষমা করবে তোহ্ ?
— হুম
— আজ সকালে আমি তোমার ফোনটা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। তাই তোমার জন্য একটা নতুন ফোন কিনে এনেছি। wait, just a second…
.
তারপর আমার সামনে একটা অনেক দামী নতুন ফোন ধরলো। যার দাম প্রায় আমার বেতনের তিন গুণ বেশি। আর তা দেখেই আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল। আরিয়ান হাসি মুখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
— ফোন টা পছন্দ হয়েছে ?
আমি আর আমার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। বললাম,
— ভাবেন কি আপনি নিজেকে ? আমি জানি আপনার অনেক টাকা আছে। কিন্তু তাই বলে আমি ভিক্ষারী না, যে আপনি ফোনটা দিবেন আর আমি নিয়ে নিবো। আমার পাঁচ হাজার টাকার ফোন ভেঙ্গে দিয়ে, পঞ্চাশ হাজার টাকার ফোন নিয়ে এসে বলছেন পছন্দ হয়েছে নাকি !
(কথা গুলো খুব দ্রুত বলে একটা বড় নিশ্বাস ফেললাম। ভাবছি আমি হয়তো একটু বেশিই বলে ফেললাম। কিন্তু এখন তো আর ভেবে লাভ নাই। কথা গুলো তো বলা হয়েই গেছে। তাছাড়া আমার আত্মসন্মানে আঘাত করুক, এমন কোনো কিছুই আমি সহ্য করবো না।)
.
দেখলাম আরিয়ান ভ্রু গুলো ধনুকের মতো কুঁচকে, হা করে আমার দিকে তাকায় আছে। হয়তো সে আমার এমন উত্তর আশা করেনি। ওর ওমন তাকানো দেখে আমি একটা ছোট্ট শুকনো ঢোক গিললাম। না জানি আবার কি করে বসে।
.
তারপর সে অতিরিক্ত শান্ত কন্ঠে ধীরে ধীরে আমাকে বললো,
— আসলে কি বলো তো পাখি, তোমাকে আমার Sorry বলা টা একদম ঠিক হয়নি। আমার উচিৎ তোমাকে সব সময় ধমকের উপর রাখা। না হলে তোমার উল্টা পাল্টা চিন্তা ভাবনা কখনোও বন্ধ হবে না। আর আমার ছেলেটা কেও ঐসব আবোল তাবোল ভাবতে শেখাবা।
অতঃপর ফোনটা আমার হাতে জোর করে ধরায় দিয়ে বললো,
— আমি ভাবছি আমাদের ভবিষ্যৎ এর কথা। কি যে করবা তুমি আল্লাহ জানেন।
তারপর সে একটা সয়তানি মার্কা বাকা হাসি দিয়ে চলে গেল।
আমি মনে মনে বললাম, “ভবিষ্যৎ এ আর কি হবে, ঘোড়ার আন্ডা আর হাতির মন্ডু। যত্তসব অদ্ভুত এলিয়েন।
.
.
দুইদিন পর,,,
.
সবাই একসাথে বাগানে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আরিয়ান বিকালেই চলে এসেছে ডিউটি থেকে। ও বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
— পাখি এক্ষুনি একটু ছাদে আসো তো। তোমার সাতে কিছু কথা আছে।
আমি ভাবলাম আয়াতকে নিয়ে যায় সাথে। ওকে কোলে নিতে যাবো ঠিক তখনই দেখলাম, আরিয়ান যেতে যেতে থেমে গেল, পিছন ঘুরে আমাকে দেখলো। ওকে জানি কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। বললো,
— আমি বলেছি, তোমার সাথে কথা আছে…….. তুমি একা আসবে…….. এক্ষুনি…….. মানে এক্ষুনি। ( গম্ভীর কন্ঠে)
তারপর গটগট করে চলে গেল। আর ফাহমিদা আন্টি হাল্কা কেশে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো।তার পর কিছুটা সুর করে বললো,
— উমম… উমম… হুমম… মনে হচ্ছে কিছু মিছু চলছে। ( হুট করে সাথে একটা চোখ মেরে দিলো )
.
আমি যেতে যেতে ভাবছি, কে বলবে যে উনার ত্রিশ বছর বয়সের একটা ছেলে আছে। এবং তার নাতির আর ক’দিন পর চার বছর পূর্ণ হবে। এমন বান্ধবী সুলভ শাশুড়ীকে ছেড়ে মিরা যে কেন চলে গেল কে জানে !
.
এ বাড়িতে এই প্রথম আমি ছাদে উঠলাম। ছাদ টা অনেক বড়। ছাদে গিয়ে দেখি আবহাওয়াটা কেমন যেন স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে। এই বিকালে চারিদিকে গাড় কমলা রঙে রঙ্গিন হয়ে উঠেছে। সূর্যটা হয়তো ক্লান্ত তাই ভুল করে তার, সন্ধ্যার লালিমা বিকালেই পৃথিবীতে ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু এখন সন্ধ্যা না। তাই হয়তো এমন কমলা রং দেখাচ্ছে সব। সাথে প্রচুর সতেজ বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে। আমার বেশ শীত লাগছে। আনমনেই আমি হেসে দিলাম।
.
হঠাৎ কোথাথেকে আরিয়ান এসে আমার চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো, তারপর নেশাতুর দৃষ্টি আমার উপর নিক্ষেপ করে আমার চুলের ঘ্রাণ শুকতে লাগলো…..
·
·
·
চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here