হৈমন্তীকা
৮.
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মাঠের একপাশে ইভানকে যেতে দেখা যাচ্ছে। কপালে, হাতে বেন্ডেজ তার। ডান চোখটাও কেমন ফুলে বড় হয়ে আছে। সাথে রয়েছে কিছু বন্ধুবান্ধব। হৈমন্তী গভীর নজরে ইভানের যাওয়া দেখল কিছুক্ষণ। সেদিক থেকে চোখ ফেরানোর আগ মুহুর্তে হঠাৎ তুষার গম্ভীর আওয়াজে আদেশ দিয়ে উঠলো,
— “এভাবে কোনো ছেলেকে দেখবেন না হৈমন্তীকা। আমার হিংসে হয়।”
হৈমন্তী আড়চোখে তাকালো তুষারের দিকে। ছেলেটার জ্বর এখনো কমেনি। শরীর অল্প গরম হয়ে আছে। গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে সে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের তেজস্বী কিরণ আধো আধো ভাবে পরছে তার মুখপানে। আচমকা তুষার চোখ মেলে তাকালো। হৈমন্তী হকচকিয়ে গেল এতে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই তুষার খানিক হেসে বললো,
— “আমার দিকে তাকাতে পারেন হৈমন্তীকা। এতে আমার হিংসে হয় না।”
হৈমন্তী লজ্জায় পরে গেল। গাল দু’টো কেমন ভারি হতে লাগল যেন। নিজের এই লজ্জা ঢাকতে ধমক দিয়ে উঠল সে,
— “চুপ থাকুন! ছোট ছোটর মতো থাকবেন। নইলে দেবো একটা!”
হৈমন্তীর বাঘিনী রুপ দেখে আরেকদফা হেসে দিলো তুষার। পরক্ষণেই মন খারাপ করে বললো,
— “আমি অসুস্থ হৈমন্তীকা। আপনি আমাকে অসুস্থ অবস্থায় মারবেন?”
হৈমন্তীর চাহনি করুন হলো এবার। ছেলেটার সঙ্গে কথায় পেরে উঠে না সে। তখন নিজের ওপরই রাগ হয় তার। তারওপর পারু মেয়েটাও আজকাল ভার্সিটি দেড়ি করে আসছে। ৯টা ৩০বাজছে এখন! তবুও এর আসার নাম নেই। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল হৈমন্তী। তুষারকে একদম পাত্তা না দিয়ে আবারো বইয়ে মনোযোগ দিলো।
তুষারও চুপ হয়ে গেল এবার। আরেকটু এগিয়ে হৈমন্তীর কাছ ঘেঁষে বসলো। হৈমন্তী শক্ত চোখে তাকাতেই দূর্বল হাসলো সে। হৈমন্তী সরে বসলো। তুষারও সরে এলো ওর দিকে। হৈমন্তী রেগে কিছু বলবে, তার আগেই কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়েটাকে দেখে বয়সে কিংবা উচ্চতায় বেশ ছোটই মনে হচ্ছে। ইন্টারে পড়ে সম্ভবত। তবে দেখতে বেশ রুপবতী। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে, কোনো কথা ছাড়াই একটা লাল কাগজের চিঠি তুষারের এগিয়ে দিলো মেয়েটি। এরপর লাজুক হেসে মিনমিনিয়ে বলতে লাগল,
— “ইয়ে,মানে… আসলে, এটা আপনার জন্য।”
তুষার ভ্রু উঁচালো,
— “এটা কি?”
— “আপনিই পড়ে দেখুন।”
মেয়েটা তার স্বভাবসুলভ লাজুকতা বজায় রাখলো। তুষার চিঠিটা নিতেই এক দৌঁড়ে গেল সেখান থেকে। তা দেখে মুখ বাঁকিয়ে হাসলো তুষার। কোলে রাখা হৈমন্তীর হাত দু’টোয় গুঁজে দিলো চিঠিটা। অতঃপর আবারও গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোখে বুজে বললো,
— “পড়ে দেখুন তো হৈমন্তীকা, চিঠিতে কি লিখা আছে।”
— “আমি কেন পড়ব? আপনাকে দিয়েছে আপনি পড়ুন।”
— “ইচ্ছে করছে না।”
তুষারের কণ্ঠে বিশাল ক্লান্তি। হৈমন্তী বিরক্ত হলো ভীষণ। একবার চিঠিটা রেখে দিতে গিয়েও আবার রাখলো না। অজানা কৌতূহল বশত বিড়িবিড়িয়ে পুরো চিঠিটা পড়লো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর কপালের ভাঁজও দৃঢ় হতে লাগল। পড়া শেষে মহাবিরক্তি নিয়ে সে বললো,
— “আপনাকে ভালোবাসে মেয়েটা। আপনিও ভালোবাসুন। আর আমার পিছু ছাড়ুন।”
— “আপনার পিছু ছাড়া অত সহজ হলে আমি ছেড়ে দিতাম, হৈমন্তীকা। কিন্তু তা অসম্ভব। মৃত্যুর পরও আমি আপনার পেছনেই পরে থাকব।”
প্রতিবারের মতো তুষারের এরুপ কথায় আজ রাগ হলো না হৈমন্তীর। আবার ভালোও লাগল না। মাঝামাঝিতে আটকে গেছে সে। অনুভূতি একদম শূণ্য। ওভাবেই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে তুষারের দিকে। মলিন মুখটা দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে তার। লাল চোখজোড়া দেখে খারাপ লাগছে। হৈমন্তী ব্যাগ হাতড়ে একটা নাপা ঔষধের পাতা বের করল। পুরো ঔষধের পাতাই তুষারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “মাথা ব্যথা করছে?”
— “অনেক।”
— “ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে ঔষুধ খেয়ে নেবেন। মাথা ব্যথা চলে যাবে।”
তুষার মাথা দুলালো। হৈমন্তী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেও তুষার তাকিয়েই রইলো। তাকিয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। সেই চিরচেনা দৃষ্টিতে, নির্নিমেষ, নিমেষহীন ভাবে। খানিক অস্বস্তি হতে লাগল হৈমন্তীর। তেজি গলায় বললো,
— “অন্যদিকে তাকান তুষার। নয়তো আপনার এই বেহায়াপনার জন্য আবারও চড় খাবেন আমার হাতে।”
— “আপনি যে দিন দিন পুরুষ নির্যাতনে লিপ্ত হচ্ছেন, তা কি জানেন হৈমন্তীকা?”
বিস্ফোরিত নয়নে চাইলো হৈমন্তী। বিমূঢ় হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কিহ্!”
— “কিছু না।” হাসতে হাসতে জবাব দিলো তুষার।
কি ভেবে সে আবারও বললো,
— “একটু আগের মেয়েটা সুন্দর, তাই না হৈমন্তীকা? ভাবছি, মেয়েটাকে আমার প্রেমিকা বানাবো আর আপনাকে বউ। দারুণ হবে না?”
হৈমন্তী জবাব দিলো না। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো মাত্র। যেই দৃষ্টি অদৃশ্য ভাবে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে তুষারকে।
_____
ভার্সিটি থেকে ফেরার পর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল তুষার। সকালে জ্বর অল্প কমলেও এখন যেন সেটা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সোফায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো তুষার। উঁচু গলায় হেনাকে ডাকল,
— “মা? পানি আনো।”
রান্নাঘর থেকে হেনার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “আনছি।”
তুষারের সামনের সোফায়ই বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন আফতাব সাহেব। ছেলের দিকে তাকিয়ে পত্রিকার কাগজ রেখে দিলেন টেবিলে। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়লেন,
— “তোমার না জ্বর? এই জ্বর নিয়ে ভার্সিটি গিয়েছ কেন?”
— “কিছু নোটের প্রয়োজন ছিল।”
সহজ উত্তর দিয়ে সোফার সঙ্গে আরও এলিয়ে বসলো তুষার। ততক্ষণে হেনাও এসে গেছেন। আফতাব সাহেব আবার বললেন,
— “তোমাকে আমি হৈমন্তী না কি যেন? ওই মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। কথাটা মনে আছে তোমার?”
তুষার হেনার থেকে পানির গ্লাসটা নিলো। এক চুমুকে পুরোটা পানি পান করে গ্লাসটা সশব্দে রেখে দিলো টেবিলে। অতঃপর বললো,
— “মনে আছে।”
— “মেয়েটার পিছু ছেড়েছ তুমি?”
নির্ভয় এবং স্বাভাবিক কণ্ঠে তুষারের ছোট্ট জবাব, “না।”
সঙ্গে সঙ্গে তেঁতে উঠলেন আফতাব সাহেব। ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “না, মানে? তাহলে আমার কথা মনে রেখে কি লাভ? তুমি কি আমার মানসম্মান খোয়ানোর ফন্দি করছো তুষার? নিজের চেয়ে ছোট মেয়ে ভালোবাসতে, আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু নিজের চেয়ে বড় মেয়ে! সমাজ কি বলবে তার কোনো চিন্তা নেই তোমার? সমাজ বাদ দাও, আমার তো ভাবতেই জঘন্য লাগছে।”
তুষার কোনোরূপ জবাব দিলো না। শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে রইল। ভাবলো, টেবিল থেকে রিমোট নিয়ে টেলিভিশন চালু করলে কি বাবা একটু বেশিই রেগে যাবেন তার ওপর? পরক্ষণেই ভাবলো, না থাক! রুমে গিয়েই টেলিভিশন দেখা যাবে।
চেঁচানোতে হেনা দিরুক্তি করে উঠলেন,
— “ছেলেটাকে অত বকো না তো। ওর কি দোষ?”
— “তুমি এ বিষয়ে একদম কথা বলো না হেনা। তোমার লাই পেয়েই ছেলেটা এমন বিগড়ে গেছে।”
স্বামীর ধমকে হেনা চুপসে গেলেন। তুষার ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবার। সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো,
— “মা? রাতে খিঁচুড়ি খাবো গরু ভুনা দিয়ে। এখন একটু বিরিয়ানি দাও তো!”
ছেলের এহেন অভিব্যক্তি দেখে আফতাব সাহেব রেগে তাকালেন নিজ স্ত্রীর দিকে। মনে মনে ভেবে নিলেন তাকে কি করতে হবে।
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা