হয়ত পর্ব ২২

#হয়ত
পর্ব:- ২২
.
সকালের নাস্তা নাকেমুখে খেয়ে বের হয়েছে তাপৌষি, দিশা ও বর্ষণ। এমনিতেই ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়া খুব দুষ্কর, তার উপর সিরিয়াল যদি মিস হয় তাহলে তো কোন কথাই নাই। ডাক্তার আর দেখানো হবে না সেদিন।
বর্ষণ ফোনে কথা বলছে কারও সাথে। দিশা আর তাপৌষি ডাক্তারের রুমের সামনে বসে আছে। অনেক মানুষ আশেপাশে। সবাই ডাক্তার দেখাতে এসেছে। তাপৌষির সিরিয়াল বর্ষণ ফোনে আগেই দিয়ে রেখেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ওদের ডাক পড়বে।
তাপৌষি মাথা উঁচু করে ডাক্তারের দরজার সামনে লাগানো কাগজটা পড়ে নিল। “প্রথম ভিজিট ১০০০ টাকা। দ্বিতীয় ভিজিট ৭০০ টাকা। ছয়মাস পরের ভিজিট আবার ১০০০ টাকা।”
তাপৌষি মনে মনে ভাবছে, এ ডাক্তার নাকি কসাই রে বাপ!
তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল বেশির ভাগ মানুষ নিন্মবিত্ত। গ্রাম থেকে আগত মানুষের সংখ্যা বেশি। এদের মধ্যে হয়তো কারও কারও আত্মীয়ের শারীরিক অবস্থা খুব শোচনীয়। প্রিয়জনকে বাঁচাতে এরা হয়তো সর্বস্ব বেচে এসব শহুরে বড় ডাক্তারদের কাছে আসে। আর এই ডাক্তাররা চিকিৎসার নামে এদের অন্তশ্বাসটুকু খুবলে খায়।
-‘ কী ভাবছ এখন?’
তাপৌষি পাশে তাকিয়ে দেখলো বর্ষণ এসে বসেছে। ও তো খেয়ালই করেনি বর্ষণের আসা। অর্থাৎ বর্ষণ অনেকক্ষণ ধরেই হয়তো ওকে লক্ষ্য করছে।
-‘ কসাই ডাক্তারদের কথা ভাবছি। দেখুন দরজায় কত সুন্দর সাইনবোর্ড ঝুলানো।’
বর্ষণ লেখাটা পড়লো। মাথা উপর নিচে নাড়লো।
-‘ দেখেছেন? এবার আশে পাশে তাকিয়ে দেখুন। কী মনে হয়? এদের সামর্থ্য আছে প্রতি ছয়মাস অন্তর অন্তর একহাজার টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখানোর। আবার এরা কিন্তু অত্যধিক শিক্ষিত নয়। দেখুন বেশিরভাগ মানুষ গ্রাম থেকে আগত। স্মার্টফোনের অত্যাধুনিক ব্যবহার সম্পর্কে এদের ছেলেমেয়েরা জানলেও এরা কিন্তু জানে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়ালের জন্য বসে থাকে। ফোনে সিরিয়াল দিয়ে দেওয়ার মানুষ নেই। সিরিয়াল পাওয়ার পর প্রথমবার ডাক্তার দেখিয়ে যাওয়ার পর আবার যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে ছয় মাঝের মধ্যে ‘৭০০ টাকা’ দিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে। এতেই শেষ নয়। পনেরো বিশটা টেস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে টেস্টগুলো করিয়ে আনুন। সেই টেস্ট করাতে চলে যাবে দশ-বারো হাজার টাকা।’
তাপৌষির কথা শুনে দিশা সোজা হয়ে বসলো। একবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
-‘ সরকারি হাসপাতাল আছে তাপৌষি। সেখানে খরচ কম।’
-‘ ডাক্তার কই সরকারি হাসপাতালের? গেলেই বেশিরভাগ সময় শুনতে হবে, “ডাক্তার নিজের চেম্বারে বসেন এই সময় অথবা অমুক ক্লিনিক কী তমুক ডায়াগোনস্টিক সেন্টারে পাওয়া যাবে উনাকে।” তখন রোগী নিজের রিপোর্ট নিয়ে দৌড়ে বেড়াবে?’
তাপৌষির কথা গুলাও যুক্তি সংগত। দিশা চুপ করে গেছে। আসলেই এই ধরণের ঝামেলা পোহাতে হয় সাধারণ মানুষদের। বর্ষণ খানিকক্ষণ চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে তারপর বলল,
-‘ তাপৌষি এই যে তোমার এই নিন্মবিত্ত মানুষদের জন্য খারাপ লাগছে এটা স্বাভাবিক। তবে এটা এক ধরণের বাস্তুতান্ত্রিক শিকল বলতে পারো। মানুষের প্রয়োজন বাড়ছে। ডাক্তাররাও মানুষ। ওদেরও টাকার প্রয়োজন। একজন মানুষ যদি এতই অভাবে থাকে তাহলে সে কোন ক্লিনিকে না যেয়ে মেডিকেলে যাবে। তোমার জন্য, আমার জন্য, দেশের সকলের জন্য সরকার অনেক মেডিকেল বানিয়েছে। এসব মেডিকেলের লাইট,সুইচ, ফ্যান, মেশিন, যন্ত্রপাতি সব দিনের পর দিন অব্যবহারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। “অব্যবহার” বলেছি তাপৌষি। আমরা জনগণ মেডিকেল গুলোতে যাইনা, তাই ডাক্তারও পাইনা ওখানে। যদি নিজেরা শক্ত হতাম তাহলে এমনটা হতো না। আর এমন নয় যে সব ডাক্তার টাকা গ্রহণের মেশিন। এমনও অনেক ডাক্তার আছে যারা রোজরোজ সরকারি মেডিকেলে ডিউটি করতে যান, রোগী দেখেন, নিজের টাকা দিয়ে হলেও সাধ্যমত রোগীর চিকিৎসা করেন।’
বর্ষণের কথার মাঝেই ডাক পড়ে..
“তানজিনা হোসেন তাপৌষি…”
.
-‘ আসসালামু আলাইকুম, মা বলো।’
-‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ রে বর্ষণ তাপৌষি ঠিক আছে তো? ডাক্তার কী বললো?’
-‘ টেনশন, রক্তচাপ আর না খাওয়ার অভ্যাস। তাপৌষি খুব কম খায় তাই ওর শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। আর জ্বর এসেছিলো খোলা বারান্দায় বৃষ্টিতে ভিজার কারণে। রক্ত পরীক্ষা টেস্ট দিয়েছে। ডাক্তার চিন্তা করছে ওর শরীরে হিমোগ্লোবিন কম। ও বেশি ফর্সা বলে বিষয়টা ধরতে পারছে না। টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্ট বিকালে দিবে। সন্ধ্যার দিকে তাপৌষিকে নিয়ে যেয়ে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে আনবো। তুমি চিন্তা করো না।’
-‘ চিন্তা করতে চাই না। তাও চিন্তা হয় রে। মা মরা মেয়ে। বাপে আরেকটা বিয়া করছে। এইটুকু মেয়ের কপালে কী সুখ নেই?’
-‘ এতো ভেবো না তো মা।’
-‘ রাতে ফোন দিয়ে জানাস ডাক্তার কী বললো।’
-‘ আচ্ছা মা। এখন রাখি। আল্লাহ্‌ হাফেজ।’
.
ল্যাবের রিপোর্ট ডেলিভারি টাইম ছিল বিকাল ৫:০০ টা। কিন্তু এখানে এসে জানা গেল আরও সময় লাগবে। বর্ষণ তনয়া বেগমের থেকে কথা লুকিয়েছে। তাপৌষির সিটিস্ক্যান, X ray PNS ( হেড রিজিয়নের এক্সরে) ও করা হয়েছে। ওগুলোরও রিপোর্ট দিবে। বর্ষণ তনয়া বেগমের স্বভাব জানে। ওর মা একটুতেই টেনশন করা মানুষ।
ডাক্তারের মতে তাপৌষির মাইগ্রেনের কোন ব্যথা নেই। তবে নাকের ভিতরে দুই পাশে মাংস বেড়ে গেছে। এতে শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে ওর। এর ফলে মাথা ব্যথা করছে।
-‘ সময় লাগবে বলল তো। তোমার খারাপ লাগছে তাপৌষি?’
-‘ না। বরং ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে খাঁচা ছাড়া পাখি।’
-‘ এক দিনেই এই বাসাকে খাঁচা লাগছে?’
-‘ এমা তা নয়। আসলে বন্দি থাকতে ভালো লাগছিল না।’
-‘চলো হেটে আসি। বসে থাকতে ভালো লাগছে?’
-‘ না। চলুন।’
তাপৌষিরা হাটছে রমনার পাশ দিয়ে। এই দিকে অনেক ফুলের দোকান। রাস্তার অপর পাশেও অনেক দোকান রয়েছে। তবে সেগুলো ফুলের নয়। হাতে তৈরি ঝাড়বাতি, মাটির তৈরি বিভিন্ন ঘর সাজানোর সৌখিন পাত্র, নানা নকশার মাটির ব্যাংক, শিকা, কাঠের খেলনা, বিভিন্ন আসবাবপত্র, কাঠের চুড়ি, কাঁচের চুড়ি, ছোট বাচ্চাদের প্লাস্টিকের খেলনা ইত্যাদি সে সকল দোকানে শোভা পাচ্ছে।
-‘ আমরা অপর পাশের দোকান গুলোতে যেতে পারি?’
-‘ কেন নয় তাপৌষি। চলো।’
তাপৌষি প্রথমেই একটা দোকানে ঢুকে কিছু চুড়ি তুলে নিল। লাল রঙের চুড়ি। বেশ পছন্দ হয়েছে ওর। কিন্তু এই চুড়ি ও কিনতে পারবে না। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নিজের সাথে কোন টাকা আনেনি। বর্ষণের থেকে চাইতেও বিবেকে বাধছে। এই যে ওর চিকিৎসার জন্য কম খরচতো করছে না এরা।
-‘ পছন্দ হলে নিয়ে নাও তাপৌষি। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’
-‘ না এমনি দেখছিলাম।’
বর্ষণ হালকা হেসে বলল,
-‘ আমি এমনি বলছিনা। সত্যি বলছি নিয়ে নাও।’
-‘ আচ্ছা।’
তাপৌষি নিজের জন্য নেওয়ার পাশাপাশি দিশার জন্যও একই চুড়ি কিনলো।
দোকানে গোল গোল ঝোলা জিনিসটাকে দেখে তাপৌষির মনে বেশ কৌতুহল জেগেছে।
-‘ চাচা এটা কী?’
তাপৌষিকে উত্তর বর্ষণ দিল।
-‘ এটা ল্যাম্প তাপৌষি। রাতের বেলা আসলে দেখতে পাবে এটা কত সুন্দর জ্বলে। একে “Wrapped Balloon Lamp” বলে।’
-‘ বাহ বেশ সুন্দর তো।’
-‘ কিনবে?’
-‘ কিনে কই লাগাবো? ‘
-‘ কেন তোমাদের নতুন তেরোশ স্কয়ারফিটের বাসায় লাগাবা।’
কথাটা বলা বলার পর বর্ষণ বুঝলো ও ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তবে ব্যালুন ল্যাম্প ও নিজেই কিনলো। তাপৌষি আর একটাও কথা বলেনি।
ডাক্তারের চেম্বারেও তাপৌষি চুপচাপ ছিল। ডাক্তার যা সন্দেহ করেছিল তাই হয়েছে। তাপৌষির পলিপাস হয়নি। তবে এলার্জির কারণে নাকের ভিতরের মাংস ফুলে গেছে। কিছু ঔষধ আর একটি ন্যাসাল স্প্রে দেওয়া হয়েছে তাপৌষিকে। ঠাণ্ডা কোন কিছু খেতে পারবে না ও।
বাসায় আসার পথেও তাপৌষি চুপ ছিল। শেষে বাসার লিফটে উঠে বর্ষণ তাপৌষির সাথে কথা বলতে শুরু করে।
-‘ সরি তাপৌষি।’
-‘ইট’স ওকে।’
-‘ ইট’স নট ওকে। আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি।’
-‘হুম। ভুল করেছেন।’
-‘ সেই জন্যই তো মাফ চাচ্ছি।’
তাপৌষি মিষ্টি করে হেসে বলল,
-‘ মাফ করে দিয়েছি তো।’
টোল পড়েছে তাপৌষির গালে। চমৎকার লাগছে ওকে দেখতে। বর্ষণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-‘ উফ! বাঁচালা। ধন্যবাদ। এই যে তোমার জিনিস পত্র। চলো তোমাদের ঘরে এগুলো রেখে দিয়ে আসি।’
-‘ আমাকে দিন। আমি নিতে পারবো।’
-‘ অনেক ভারী। আমি নিচ্ছি। তুমি আগে আগে হাটো।’
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here