#হয়ত
পর্ব:- ৩
.
মধ্যাহ্নের কড়া রোদ জানলার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে তাপৌষির মুখে এসে পড়ছে। ঘুমটা তার ভালোই হয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে সে খাট থেকে নামলো।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো বাবা ফোন দিয়েছে কয়েকবার।
তাপৌষি কল ব্যাক করলো। তবে অপর পাশ থেকে এক নারী কণ্ঠ ভেসে আসছে।
‘ এই নম্বরটি এখন ব্যস্ত আছে। দ্যা নম্বার ইজ বিজি নাও।’
এখানে আসার পর থেকে তার বাবার সাথে কথা হয়নি। ফোন দিলেও ব্যস্ত দেখাচ্ছে বারবার। মানুষটা ভীষণ ব্যস্ত। স্ত্রী’র মৃত্যুর দিনও এই মানুষটা আসতে পারেননি। জানাজাতে অংশ নিতে পারেন নি। তাপৌষির আবার কান্না পাচ্ছে।
-‘ তুমিই রাজশাহী থেকে এসেছো? দিশাদের খালাতো বোন?’
মেয়েলি কণ্ঠ শুনে চোখের পানি মুছে পিছে ফিরল তাপৌষি। তার সামনে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা মিষ্টি তবে মুখে ধারত্ব বিদ্যমান। চেহারায় ক্লান্তি নেই। সুখী মানুষের মতো ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে।
-‘ এমা তুমি কাঁদছিলে? বাসার কথা মনে পড়ছে?’
-‘ জি আপু।’
-‘ ইশ রে! মেয়ে দেখি কেঁদে কেটে এক করে দিচ্ছে। আমরা এখানে অনেক মজা করবো। ঘুরতে এসে কেউ কাঁদে? এই যে দেখ দিশা শাড়ি পাঠিয়েছে কতগুলো। যেটা তোমার পছন্দ হয় নিয়ে নাও। ‘
কথা বলতে বলতেই মেয়েটি খাটের উপর শাড়ি রেখে দেয়। মোট পাঁচটা শাড়ি। তাপৌষির এখন শাড়ি দেখতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে খালি। বাধ্য হয়ে সবার উপরের শাড়িটা তুলে নিল সে।
-‘ বাহ! খুব সুন্দর পছন্দ তোমার। তোমাকে মানাবে এতে। অবশ্য ফর্সা মানুষ যা পড়ে তাতেই মানায় তাকে। সমস্যা তো সব আমাদের মতো কালো মেয়েদের। পছন্দের ড্রেস খুঁজে পেলে সবার প্রথমে মনে প্রশ্ন জাগে “ড্রেসটায় আমাকে মানাবে তো?”
এসব বাদ দাও। তা তোমার নাম কী?’
-‘তাপৌষি। আপনার?’
-‘ আমার নাম অথৈ। দিশার চাচাতো বোনের মামাতো বোন আমি। ওই কাজিনই বলতে গেলে। দিশা আর আমি সমবয়সী। দিশাকে তুমি কী বলে ডাকো?’
-‘ দিশা আপু। ‘
-‘ আমাকে তাহলে অথৈ আপু বলে ডাকবা। আমরা তো জানতামই না যে আন্টির কোন বোন আছে। বিষয়টা খুব মজার না? দিশারা হঠাৎ করেই জেনে গেলো ওদের একটা খালাতো বোন আছে। এই তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছো?’
সত্যি বলতে তাপৌষি খুবই বিরক্ত হচ্ছিল। ঘুম ভালো হলেও কান্নার কারনে তার মাথা ব্যাথা করছে। এসময় অথৈ এর বকবক ওর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে।
-‘ না আপু।’
-‘ তো মন খারাপ? গান শুনবে? সবাই বলে আমার গানের গলা খুব সুন্দর। ‘
মেয়েটি খুবই আন্তরিক। তাপৌষির বলতে ইচ্ছে হলো, “তুমিও খুব সুন্দর আপু।”
মেয়েটি তাপৌষির জবাবের অপেক্ষা না করেই গাইতে শুরু করলো,
”
সখী ভাবনা কাহারে বলে
সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয় !
সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল ?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই
তরে এমন দুখের আশ..
…….
তাপৌষি নিজেও গান পারে। রবীন্দ্র সংগীত গাইত ও ওর মায়ের সাথে। প্রায়ই মায়ের সাথে এই গানটা গায়ত। আচমকা চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের সাথে গান গাওয়ার একটি মুহূর্ত। তাপৌষির মনে হতে লাগলো সামনে ওর মা গান গাচ্ছে। চোখের পাতা জোড়া বন্ধ করে তাপৌষি সুর মেলাতে লাগলো অথৈ এর সাথে।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল,
সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো ।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়,
হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন,
না জানে সাধের যাতনা যত ।
…
তাপৌষির গানের মাঝেই ঘরে চারজন মানুষ উপস্থিত হলেন। তাপৌষির কণ্ঠস্বর শুনে অথৈ অনেক আগেই গান বন্ধ করে দিয়েছিল। অথৈ জানতো তার গানের গলা খুব ভালো। তবে আজ তার নিজের প্রতি সন্দেহ জাগ্রত হলো। মনে হতে লাগলো সামনে বসা বাচ্চা মেয়েটার গলার স্বর, মিষ্টতা আর সুরের যোজন বিয়োজন তার গলাকে ফিকে করে দিয়েছে। এ যেন বহু চর্চার ফল। স্কুল কলেজে গান গেয়ে কম পুরস্কার পায়নি অথৈ। এলাকার সবাই তাকে দ্বিতীয় শ্রেয়া ঘোষাল বলে ডাকে। তবে আজ…আজ নিজের প্রতিভা নিয়ে সঙ্কা হতে লাগলো তার।
তাপৌষি এক ধ্যানে গেয়ে চলেছে। মস্তিষ্কের মধ্যে একের পর এক ছবি ভেসে উঠছে। মায়ের সাথে কিছু সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের ছবি। যেগুলো কখনো ক্যামেরায় বন্দি করা হয়নি। তবে তাপৌষি সেগুলো নিজের মনের ক্যামেরায় বন্দি করে রেখেছিল।
স্মৃতির ক্যামেরায় বন্দি ছবিগুলো যখন ইচ্ছা তখন দেখা যায়। এই যে তাপৌষি এখন স্মৃতির ক্যামেরায় তোলা ছবি গুলোর অ্যালবাম খুলে বসেছে।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোক সাগরে
আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে।
আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান
শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল
একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একিদন নয় বিষাদ ভুলিয়া
সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা…
.
গান শেষ হতেই তাপৌষি চোখ খুলে দেখতে পেলো দশ জোড়া চোখ তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বাকী চারজন কে চিনলেও একজন কে সে চিনে না। ব্যক্তিটির চোখে চোখ পড়তেই হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠলো। কিছু আছে সেই চোখে।
-‘ তুমি তো খুব সুন্দর গাও। অথৈ তোর কম্পিটিশন পেয়ে গেছিস।’
তাপৌষি লজ্জা পেয়ে গেল। এমন নয় যে সে কখনো ষ্টেজ পারফর্ম করে নি। তবে এরা ওর পরিচিত। তাছাড়াও নিজের প্রশংসা করলে ওর ভীষণ লজ্জা করে।
অথৈ এক ধ্যানে তাপৌষির দিকে তাকিয়েছিল। মেয়েটি সত্যি ওর কম্পিটিশন। নিখুঁত গানের গলা। দেখতেও ভারী মিষ্টি। এই যে দিশার প্রশংসায় গাল দুটো ফুলে টমেটো হয়ে গেছে। মেয়েটি লজ্জা পাচ্ছে। দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
-‘ তাই তো দেখছি দিশা। এবার আমার কী হবে? এই তাপৌষি তোমার গানের গলা শুনে মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলি তোমাকে।’
তাপৌষি হেসে উঠলো। হিহি করে হাসছে। কানের সামনে আসা বেবি হেয়ার গুলো বাতাসে দুলছে। মেয়েটার সৌন্দর্য বড়ই রহস্যময়।
অথৈ মনে মনে বলল,” যাক মেয়েটার মন তো ভালো হলো।” দিশা এবং সে দৃষ্টি বিনিময় করলো।
.
.
চলবে…..
.
.
.
[দিল খুলে সমালোচনা করলে ও ভুল ধরিয়ে দিলে খুশি হবো]