#হয়ত
পর্ব:- ৯
.
আজ উঠানটা আলোয় আলোয় সজ্জিত। চারপাশে ছোট ছোট টুনি বাল্ব জ্বলছে। উঠানে প্রবেশের মুখে রঙিন ঝালর কাপড় দিয়ে গেট তৈরি করা হয়েছে। তাপৌষি দিশার সাথেই এসেছে। একা এখানে আসতে তার সাহসে কুলাচ্ছিল না। চৌকির স্টেজের সামনে প্লাস্টিকের কিছু চেয়ার রাখা। অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি। উঠানের একপাশে কয়েকটা চেয়ার গোল করে রৌদ, অথৈ, বর্ষণ, প্রাপ্তিসহ আরও অনেক ছেলে-মেয়ে বসে আছে। দিশা তাপৌষিকে সেখানেই নিয়ে গেল।
“ছেলেরা পাঞ্জাবি আর মেয়েরা শাড়ি” এই অদৃশ্য তত্ত্বটা যেন প্রতিটি হলুদের একমাত্র বিষয়। তাপৌষিকে শাড়ি পড়তে না দেখে সবাই একটু অবাকই হলো। মেয়েরা তো শাড়ি পড়ার জন্য এসব অনুষ্ঠানের মুখিয়ে থাকে। অথচ তাপৌষি শাড়ি পড়লো না কেন?
.
তাপৌষি আজকে চুল খোলা রেখেছে। কোমর অবধি চুল।
বর্ষণ মাথা নিচু করেই আছে। তাকাবে না ও তাপৌষির দিকে। তাপৌষি এখন ওর কাছে ” নিষিদ্ধ সৌন্দর্য “।
বর্ষণের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো কুচকে গেলো তাপৌষির। লোকটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে সবাই তাপৌষির সাজগোছের প্রশংসা করলেও লোকটি চোখ তুলে ওর দিকে তাকাচ্ছেও না। এতই খারাপ লাগছে ওকে!
তাপৌষির মনে হতে লাগলো সারা দুনিয়া উচ্ছন্নে যাক, সবাই তার প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলে ফেলুক তবুও এই একটি মানুষটির প্রশংসা তার লাগবেই। হাতের চুড়িগুলোতে ইচ্ছা করেই কয়েকবার শব্দ করলো তাপৌষি। কিন্তু বর্ষণ চোখ তুলে তাকালোই না। আজ নিজের সাজ ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজের কাছে। পর মুহূর্তে মনে হতে লাগলো মাত্র দুদিনের পরিচয় বর্ষণের সাথে। কেন ওর মতামত লাগবে? কেউ না এই লোকটি। একে আর পাত্তাই দিবে না ও।
.
গ্রামের কোন অনুষ্ঠানে মানুষ বরাবরই বেশি থাকে। এখানে শহরের মতো কমিউনিটি সেন্টার নেই। ডেকোরেটর আছে। যারা বাড়ি সাজানো থেকে রান্নাবান্না সব পারিশ্রমিকের বিনিময়ে করে থাকে। হাড়ি-পাতিল, প্যান্ডেল, লাইট, চেয়ার-টেবিল এগুলো সব ভাড়ায় দেয়।
আজ সাদা- লাল -নীল প্যান্ডেল আর ঝালোর কাপড়ে সজ্জিত চারপাশ। সাদা কাপড়ের প্যান্ডেলে বর,বউ, পালকি, পালকি বাহকের ছবি রয়েছে। হলুদ আলোয় চারপাশ আলোকিত। তবে এত মানুষের ভীড়ে খুব গরম লাগছে তাপৌষির। জরজেটের জামাটা না পড়লেই হয়তো ভালো হতো। এই অঞ্চলে হলুদ দেওয়ার পর কেউ কনের হাতে টাকা দেয় না। কিন্তু রাজশাহী বা তার আশে পাশের এলাকায় হলুদ ছোঁয়ানোর পর কনের হাতে টাকা দেওয়া হয়। সবাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দেয়। তাপৌষির এক সহপাঠী মেয়ে একদিন গল্পে গল্পে তার বড় বোনের হলুদের কাহিনী শুনিয়েছিল। এই টাকার গল্প তাপৌষি সেখান থেকেই জানতে পারে।
.
রিমির হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে হতে রাত একটা বেজে যায়। তাপৌষির মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছিল। এরা খুব গান বাজিয়েছে। বাংলা, হিন্দি গান চলেছে পালাক্রমে। সাউন্ড স্পীকারের জোরালো শব্দের উপশম এখন টের পাচ্ছে তাপৌষি। ঘরে এসে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলো সে। ওর ঘরে নীল রঙের হালকা ড্রিম লাইট জ্বলছে। এখন শুধু ঘুম দরকার। একটু ঘুমাতে পারলেই শান্তি।
.
তাপৌষির ঘুম ভাঙে সাউন্ড বক্সে বাজা ‘লীলা বালি লীলা বালি’ গানে। ঘুম থেকে উঠেই ও বলে উঠে,
‘উফ! আবার গান।’
দুইহাত দিয়ে কান চেপে ধরে। মনে হচ্ছে আবার মাথা ব্যাথা শুরু হবে। গা ঝাড়া দিয়ে চুল বেঁধে নেয় ও। তবে কথায় আছে “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়”। দাঁত ব্রাশ করতে করতে বারান্দায় যেয়ে বর্ষণকে দেখতে পায়। মানে কী? বাথরুমের মতো কী বারান্দাও কমন? এ কেমন বাসা?
তাপৌষি মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে নিল। একদম ঠিক ধরেছে ও। বারান্দায় প্রবেশের দুটো পথ। একটা ওর ঘর আরেকটা বর্ষণের। মনে মনে তাপৌষি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়িছে গতকাল রাতে। ও আর কখনোই কথা বলবে না এই লোকটির সাথে।
মুখটা ভেংচিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় তাপৌষি।
বর্ষণ তাপৌষির বারান্দায় প্রবেশ দেখে নি। এক দৃষ্টিতে দূরে কোথাও তাকিয়ে ছিল। ওর মন ভালো হওয়ার কথা। আজ ওর চাচাতো বোনের বিয়ে। তবুও মন ভালো নেই। কেন নেই তা ও নিজেও বলতে পারছে না। তাপৌষির দরজা লাগানোর শব্দে পিছনে ফিরে সে। মেয়েটা হয়তো ওকে দেখে বারান্দায় থাকলো না।
.
-‘দিশা আপু আমি আর মেকাপ করবো না। মুখ ভারী ভারী লাগছে। এই কানের দুলটায় মনে হচ্ছে কান ছিঁড়ে যাবে।’
-‘ না কিচ্ছু ছিঁড়বে না। তুমি চুপচাপ বসো। শুধু হাইলাইটার দেওয়া বাকী এখন।’
তাপৌষিকে দিশা’ই সাজিয়ে দিয়েছে। আজকে চুলটা খোপা করা হয়েছে। চুলে বেলি ফুলের মালা, ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক, চোখে কাজল আর হালকা মেকাপ। তবে এই হালকা মেকাপ তাপৌষির কাছে অনেক মনে হচ্ছে। বারবার আয়নাতে তাকাচ্ছে। হাইনেকের ব্লাউজের সাথে সোনালি পাড়ের সাদা শাড়ি। আজকেও তাপৌষি সাদা পাথরের টিপ দিয়েছে কপালে। আর কানে পড়েছে ঝুমকা। দিশা নিজের একজোড়া পায়েল পড়িয়ে দিয়েছে ওকে।
-‘ তাপৌষি তুমি সব সময় আমার অথবা অথৈর পাশে পাশে থাকবে। ঠিক আছে?’
-‘ আচ্ছা আপু।’
এতক্ষণে তাপৌষি অথৈর দিকে তাকায়। অথৈর ও সাজ কমপ্লিট। হালকা গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি পড়েছে সে। সাজও খুব হালকা। ভারী মিষ্টি লাগছে দেখতে।
বিয়ে বাড়িতে ঢুকে তাপৌষির মনে হতে লাগলো এটা বুঝি গ্রীষ্মকাল। প্যান্ডেলের নিচে মানুষের ভীড়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। অথৈ তাপৌষির হাত ধরে ছিল। যেই আসছে একবার করে তাপৌষির সাথে পরিচিত হয়ে নিচ্ছে। দিশা হাপিয়ে গেছে মামাতো বোন বলে পরিচয় দিতে দিতে। রিমির একমাত্র ভাই নিজেও আজ বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেননি। উনি দেশের বাইরে থাকেন। ঢাকার এই সাইডে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ প্রবাসী। আর এরা নিজেদের মেয়ের বর হিসেবে প্রবাসী ছেলেদের পছন্দ করে।
বরপক্ষ আসার পর বরের প্রবেশ নিয়ে রীতিমত একটা দাঙ্গা বেজে যায়। কনেপক্ষের দাবি নগদ ত্রিশ হাজার টাকা। কিন্তু বরপক্ষ রাজি না এত টাকা দিতে। ফলে দর কষাকষি শুরু হয়ে যায়। তাপৌষির ভালোই লাগছিল। এই ধরনের মজা ও আগে করেনি।
শেষে বিশ হাজার টাকায় সব মিটমাট হয়। বিয়েতে কনেপক্ষ হলে যে এত টাকা পাওয়া যায় তাপৌষি জানতোই না। জুতা চুরি, হাত ধোয়া, গেট ধরা সব কিছুতেই টাকা। তার থেকে বেশি মজা সবার হৈচৈ তে।
.
বিয়ে পড়াতে পড়াতে বিকাল হয়ে যায়। পাত্রপক্ষ এসেছে ঢাকা থেকে। কনে নিয়ে ফিরতে হবে তাদের। বাবুবাজার ব্রীজের কিছু পথ আগে ও পরে প্রচুর জ্যাম হয়। আর সন্ধ্যা হলে তো কথাই নেই। আজ বৃহস্পতিবার। এরপর দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি। তাই বোঝায় যাচ্ছে, আজকে বড় আকারে জ্যাম লাগবে ওই দিকে।
প্রথমে কনেকে কবুল পড়ানো শেষে কাজী বরের দিকে যায়। তারপর কনের পিতা নিজ মেয়ের হাত যোগ্য পাত্রের হাতে দিয়ে কন্যা দায়মুক্ত হন। নিজের আদরের ধনকে চিরদিনের জন্য আরেকজনের হাতে তুলে দেন। কতটা ভরসা থাকলে একজন পিতা এমন করতে পারে তা ভাবতেও তাপৌষির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
রিমির বিদায় ছিল তাপৌষির নিকট সবচেয়ে বিষাদময় এক মুহূর্ত। বাবা-মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে মেয়েটা। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাবে, যদি এভাবেই কাঁদতে থাকে। তাপৌষির নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে। ওর মা এভাবে বিদায় নিতে পারে নি। রিমি বাবার কাছে থেকে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে এটা সঠিক। তবে চাইলেই নিজের বাবার সাথে দেখা করতে আসতে পারবে। অথচ ওর নিজের মা কখনোই বাপের বাড়ি যেতে পারেননি। তাপৌষি কখনো নানা বাড়ি যায় নি। নিশ্চয় ওর মায়ের খুব কষ্ট হয়েছে! তাপৌষি জানতো মা নানার কত প্রিয় ছিল। মাঝে মাঝে সে মায়ের কাছে নানার গল্প শুনতো। আচ্ছা নানা ভাইয়ের নিজ মেয়ের কথা মনে পড়েনি আর কখনো?
.
রাত এখন বারোটা বেজে দশ মিনিট। তাপৌষি ফ্রেস হয়ে বিছানায় বসে। খুব ধকল গেছে আজ। এত ভারী শাড়ি ও কখনোই পড়ে নি। সকালের পর সারাদিনে একবারের জন্য ও বর্ষণের দেখা পায়নি। বিদায়ের সময় সকলে উপস্থিত থাকলেও বর্ষণ উপস্থিত ছিল না। বিয়েতে যায় নি নাকি? চাচাতো বোন হোক তবুও বোন তো। স্বার্থপরের মতো সেখানে উপস্থিত না থাকা তো অন্যায়।
.
.
চলবে….