অখণ্ড তুমি অন্তিম পর্ব

#অখণ্ড_তুমি
অন্তিম পর্ব

দূরের আকাশ ক্লান্ত হয়ে ঘুমানোর আয়োজন করছে, আকাশের বুকে বিন্দুবিন্দু তারা ঝিকিমিকি করে জ্বলছে, চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়ে আছে সবমিলিয়ে অন্ধকার এক অবয়ব। হাওয়াটা বড্ড তেজ গতিতে ছুটছে, অকারণ এত জোরে হাওয়ার ছুঁট যেন যে কারো হুঁশ উড়িয়ে দেওয়ার জোগাড়। জানলার কাঁচটা গ্রিলের সাথে ঠেসে ধপাস ধপাস আওয়াজ তুলছে। ঈশিতা দু’হাত আড়মোড়া করে তার মধ্যে নিজের মাথাটাকে লুকিয়ে চুপটি করে মেঝেতে বসে আছে। শরীরের মধ্যে একটা লাগামহীন চিন্তা আর শূন্যতা হুহু করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মনটা অস্থির হয়ে আছে, ক্রমশ আরও অস্থির হয়ে উঠছে। বিকেলের দিকেই কি এক অজানা কারণে রম্মনের সাথে বিয়ের ডেটটা আরও দু’দিন এগিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন রুম্মনের পরিবার। সমাজের মানুষগুলোর উপর ঈশিতার ঘেন্না হচ্ছে খুব, এই রুম্মন ছেলেটাকে তো ঈশিতা কিছুই লুকোয় নি, পুরোটা খুলে বলেছিল অনেক আগেই কিন্তু ছেলেটার যেন তাতে কোন বিকার নেই। তার সাথে যে মেয়েটির বিয়ের কথা চলছে সেই মেয়েটির জীবন-মনে অন্য কারো দখল, মেয়েটি নিজের সমস্ত দিয়ে লড়ছে তার প্রিয় মানুষটার আঙ্গিনায় যাওয়ার জন্য। এসব কিছু জেনেও রুম্মন কিভাবে ঈশিতাকে বিয়ের জন্য লাফাচ্ছে তা ঈশিতার যেন কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। যেখানে ছেলেটার নিজ থেকে এ বিয়ে ভেঙে দেওয়া উচিত, আত্মসম্মানবোধ থেকে ঈশিতার পরিবারকে দু’কথা শুনিয়ে বিয়ের আয়োজন ভেস্তে দেওয়া উচিত সেখানে ছেলের পরিবার কোন যুক্তিতে বিয়ের দিনতারিখ আরও এগিয়ে নিয়ে আসার জেদ ধরেছে সেটা যেন ঈশিতার বোঝার একেবারে বাইরে।

পুরো বাড়ি জুড়ে মানুষের একটা গমগম আওয়াজ। এরা সবাই বিয়ের জোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত। সমস্ত বাড়ি জুড়ে লাল,নীল অসংখ্য রঙের লাইটিং এর ব্যবস্থা
করা হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের লিস্ট করা হচ্ছে, খাবারের মেন্যু ঠিক করা হচ্ছে। স্বনামধন্য ডিজাইনার কে বাড়িতে ডেকে এনে ঈশিতার বিয়ের ল্যাহেঙ্গার মাপ নেওয়া হয়েছে। ল্যাহেঙ্গাতে কোন রঙের সাথে কোন রঙের মিশেল কারুকার্য থাকবে সে নিয়ে ডিজাইনার নিজেও যেন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। ঈশিতার মা তার আলমাড়িতে পুরা সমস্ত গয়নাগাটি নামিয়ে সেগুলোকে পলিশ করিয়ে আনতে ব্যস্ত।

এত সমস্ত আয়োজনের ভীড়ে ঈশিতার মাথায় একটা ছোট্ট বুদ্ধি তার ডানাপালা মেলছে অসীম সাহস নিয়ে। হ্যাঁ, ঈশিতা আবার পালাবে বাড়ি থেকে কিন্তু এবারে আর সে এ বাড়িতে ফিরবে না। বাবা-মায়ের যেহেতু তাকে নিয়ে কোনপ্রকার চিন্তা নেই, তার ইচ্ছের যেহেতু কোন মূল্যই তাদের কাছে নেই ঈশিতাও আর মূর্তি হয়ে থাকবে না। সারাটা জীবন একটা দুর্বোধ্য, অপ্রত্যাশিত মানুষের সাথে মন লুকিয়ে ঘর করার চেয়ে নিজের প্রিয় মানুষটার আশপাশে অসার হয়ে পড়ে থাকাও যেন বহু শান্তির মনে হলো তার কাছে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বলে এরকম একটা সিদ্ধান্ত ঈশিতা কোনকালেই নিতে চায়নি কিন্তু ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর। একসাথে সব সুখ পাওয়া ভার, কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয় এই বুঝি জগতের নিয়ম।

রাত বাড়ছে, ধীরেধীরে পুরো বাড়ি নিরব হচ্ছে। বাইরে থেকে আসা মানুষগুলো কাজ শেষে ফিরে যাবে সবাই আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। এদের সাথেসাথে ঈশিতাও এ বাড়ি ছেড়ে যাবে চিরতরে। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ঈশিতার চোখের সামনে আয়নাতে সৃষ্ট প্রতিবিম্বের মত স্বচ্ছ হয়ে ভেসে উঠছে। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ভিন্ন এক মানুষের জন্য আজ পাকাপোক্ত ভাবে তাদের ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে। অথচ ছোটবেলা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে ঈশিতা বলেছিল,

–আমি বিয়ে করব না বাবা। সারাজীবন তোমার আর মায়ের সাথে থাকব। খবরদার বলছি আমাকে কখনো বিয়ে দেবে না।

সেদিন বাবাও মেয়ের কথায় সায় বলেছিল,

–হ্যাঁ,নিশ্চয়ই । আমার মেয়েকে আমি সারাজীবন আমার কাছেই রাখব৷ কোন বিয়ে টিয়ে দিব না।

কথাগুলো মনে হতেই ঈশিতার চোখ গড়িয়ে টপটপ করে পানি ঝরতে শুরু করল, চোখের পানির জোরে দু’গাল আদ্র, সিক্ত হয়ে উঠল। মনে হলো জীবন বড় অদ্ভুত! বাবা তুমিও ওয়াদা ভেঙে তোমার
মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জোগাড় করছ আর তোমার মেয়েও ওয়াদা ভুলে তোমাকে ছেড়ে, মা’কে ছেড়ে, এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জোগাড় করছে। সব বদলে গেল বাবা, সব।

—————————————————–

ঈশিতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই দুপ করে গিয়ে খাটের উপর বসে পড়ল, কিন্তু জুয়েল বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর কপালের উপরের ছোটছোট সিল্কি চুলগুলো মৃদ্যু নড়ছে। ঘুমোলে জুয়েলকে বাচ্চাছেলে লাগে, যেন ওর বয়স পাঁচ কি সাত। ঈশিতা একবার জুয়েলের কাছে গিয়ে ওর চুলগুলোতে আঙুল বুলিয়ে দিল এরপরে একটা অভিমানী নিঃশ্বাস ফেলে হাতে রাখা প্রেগন্যান্সি টেস্টারের কিটের দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হাসল, এইতো মিনিট পাঁচেক আগেই কিটে পজিটিভ রেজাল্ট দেখেছে সে। অর্থাৎ ঈশিতার মধ্যে এখন একটা নতুন প্রানের সঞ্চার হচ্ছে, ঈশিতার ভেতরে একটা ক্ষুদ্র মানব সত্তা ক্রমশ সন্তানরুপে ঈশিতার কোলে আসার জন্য দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছে, ঈশিতা নিজেও দিন গুনতে শুরু করেছে কিন্তু এই জুয়েল ছেলেটা এখন কি এক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এমন একটা খবর পেটে চেপে কিভাবে চুপ থাকা যায়! একবার মনে হচ্ছে জুয়েলকে টেনে ডেকে তুলে কানেকানে খবরটা দিয়ে খিলখিল করে হেসে দিবে ঈশিতা পরক্ষণে মনে হলো এমন একটা খবর ঘুম থেকে টেনে তুলে দিলে জুয়েল হয়ত এর পুরোপুরি অনুভবটা ঠিক করে উঠতে পারবে না। তারচেয়ে এখন ও ঘুমিয়েই থাক কাল সকালে ঘুম ভাঙতেই জুয়েলের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে খবরটা পাড়বে ঈশিতা।

ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে তিনটা, মধ্যরাত যাকে বলে। মনের খুশির জোয়ারেই যেন আজকের ঘুমটা মাটি হয়েছে ঈশিতার। জুয়েলের পাশে বসে পরম যত্নে ওর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে সে। গত তিনটে বছর! এই তিনটে বছরে কম তো ধকল যায়নি ওদের উপর দিয়ে। কতটা দিন যাযাবরের মত উদ্বাস্তু জীবনযাপন করেছে তারা! কতটা দিন পালিয়ে বেড়িয়েছে এখান থেকে সেখানে, কতটা রাত কেটেছিল নির্ঘুমে আর ভয়ে!

বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যেদিন ঈশিতা জুয়েলের বাড়ি গিয়ে উঠেছিল, কি এক কান্ড ঘটেছিল সেদিন! ভাবতেই ধূলো জমা পুরনো স্মৃতির বাক্সটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠলো। প্রথমত জুয়েল বিশ্বাসই করতে চায়নি যে ঈশিতা তার জন্য সব ছেড়েছুঁড়ে একেবারে চলে এসেছে। কথাটা শুনে জুয়েল কিছুটা ভড়কেই গিয়েছিল বটে। ঈশিতাকে চোখের সামনে পেয়ে মনটাতে তার খুশির লহর বয়ে গেছে, চোখের কোনেও খুশি চিলিক দিয়েছে সানন্দে কিন্তু সবটা চেপে আবার সেই কাঠ কাঠ মুখে জুয়েল বলেছিল,

–মস্ত বড় ভুল করেছ ঈশিতা, এ সম্ভব না কিছুতেই ফিরে যাও তুমি৷ প্লিজ ফিরে যাও।

কিন্তু জুয়েলের কোন কথাতেই কোন লাভ হয়নি। ঈশিতা জেদ ধরে বসে ছিল,

–হয় তুমি আমার দায়িত্ব নাও, বিয়ে কর! নইলে আমার পরবর্তী জীবন নিয়ে আর কোন প্রশ্ন কিংবা উপদেশ দেওয়ার কোন দরকার নেই তোমার। যে বাড়ি থেকে আমি চলে এসেছি সেখানে আবার ফিরে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব না আমার পক্ষে।

জুয়েল তবুও বলে গেছে,

–আমার পক্ষে তোমার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব না ঈশিতা। বাস্তবতাটা বুঝতে চেষ্টা করো প্লিজ।

ঈশিতা ডুকরে কেঁদে বলেছে,

— তোমাকে ভালোবাসি জুয়েল, তোমার সাথে আজীবন থাকতে চাই। দূরে সরিয়ে দিও না এভাবে। আজ আমার সাথে যদি এমনকিছু হতো তুমি কী তবে আমায় ছেড়ে যেতে বলো তো!

এর উত্তরে জুয়েল চুপ হয়ে গিয়েছিল৷ বাড়ির সবাই প্রথমে অমত থাকলেও পরে ঈশিতার পক্ষেই কথা বলেছে। হয়ত সবাই চেয়েছে ঈশিতার বদৌলতে হলেও জুয়েল একটা স্বাভাবিক জীবন পাক! ঈশিতার ভালো থাকার চেয়ে জুয়েলের ভালো থাকাটা তাদের বেশি ভাবিয়েছিল। ঈশিতা জেদ ধরে পড়ে ছিল সে রাত জুয়েলের বাড়িতে, ভোরের দিক ভাবি জুয়েলের কাছে এসে একটি কথাই বলেছিলেন,

–সকাল হলে ঈশিতা চলে যাবে। মেয়েটা যা জেদি ও যে ওর বাবার কাছে ফিরবে না এ নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই শহরে একা একটা মেয়ে কই যাবে বল? আর তোমার এই কঠোর আচরণটা সইতে না পেরে ও যদি ভুলভাল কোন সিদ্ধান্ত নেয় তখন তুমি ভালো থাকবে তো জুয়েল? ঈশিতা ভালো থাকবে তো?

কথাগুলো বলে ভাবি উত্তরের জন্য আর এক মুহূর্ত ও দাঁড়ায় নি সেখানে। ভাবি চলে যাওয়ার পরে জুয়েলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সত্যিই তো ঈশিতা যদি ভুল কিছু করে বসে তখন? এই মেয়েটা এখন জুয়েল নামে পাগল, ওকে কে বোঝাবে যে জীবন এত সহজ না! কিন্তু আজ সকালেই যদি ও এ বাড়ি ছেড়েও চলে যায় তবে কী হবে ঈশিতার!

এমন নানাবিধ প্রশ্নের বানে জর্জরিত হয়ে জুয়েল শেষমেশ সিদ্ধান্তটা নিয়েই নেয় যে আগামী জীবনটা সে ঈশিতার সাথেই কাটাবে, ঈশিতার হাত দু’টো আর ছাড়বে না সে কোনদিনও। সকাল হতেই কাজি ডেকে ওদের দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়, সকাল ১১টার দিকে ঈশিতার বাবা পুলিশ নিয়ে হাজির হন জুয়েলের বাড়িতে। কিন্তু ঈশিতার বয়ানে বাবাকে শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হয়।

দু’দিন থেকেছিল ঈশিতা তার শ্বশুরবাড়ি, ৩য় দিনই জানা যায় যে বাবা জুয়েলের নামে বেশ কয়েকটা আজগুবি মামলা ঠুকে দিয়েছেন। মেয়ে হারানোর শোধটা বাবা পুরোপুরি জুয়েলের উপর থেকেই উশুল করবেন বলে ঠিক করেছেন সেটা বুঝতে পেরেই ঈশিতা আর জুয়েল সেদিন ই ঘর ছেড়েছিল। হুইল চেয়ারে বসা জুয়েলকে নিয়ে ঈশিতা পালিয়ে বেড়িয়েছে ঢাকা শহরের কত অলিগলি কিন্তু তারা যেখানেই যেত কিভাবে করে বাবা যেন খোঁজটা জেনেই যেতেন। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে এর ক’মাস পরেই ওরা পাড়ি দিয়েছিল ভারতে। পশ্চিমবঙ্গে ঈশিতার বাল্যবন্ধু ঝিনুক এর বাড়িতে। ছোটবেলা রক্ত বিসর্জন দিয়ে ঝিনুক আর ঈশিতা আজীবন তরে বন্ধুত্বের শপথ নিয়েছিল, শৈশবের খেলার ছলে করা সেই শপথের শতভাগকে টেনে সহস্রভাগ করে তা পুরোপুরি পালন করেছে ঝিনুক।

৪টা মাস পড়ে ছিল ওরা ঝিনুকের ব্যাচেলর বাসাটাতে। এরপরে কত কী হয়ে গেছে, বাবা হাজার খুঁজেও ওদের আর খুঁজে পাননি। ঈশিতার নিজের নামে ব্যাংকের একাউন্টটা কাজে লেগে গিয়েছিল তাদের। ছোট মূলধন দিয়েই ঈশিতা শুরু করেছিল তার বুটিক হাউস। নিচতলায় বুটিক হাউস আর তার সাথেই এটাচড বাসা। সবকিছু বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল তাদের জন্য, জুয়েল বেশ কয়েকটা অনলাইন বিজনেস পোর্টাল গুলোতে কনটেন্ট রাইটারের কাজ করছে। দক্ষ আর ভিন্নধর্মী কনটেন্ট রাইটার হিসেবে সুনাম ও কুড়িয়েছে বেশ সে, দু-জনের যা ইনকাম হয় তা দিয়ে বাসা ভাড়া এ বিল সে বিল চুকিয়েও দিব্যি চলে যায়।

এই এতসবের ভিতরে জুয়েলের পায়ের অভাবটা ঈশিতা খুব সহজেই যেন মানিয়ে নিয়েছে, উলটো সারাক্ষণই জুয়েলকে কাছে পাওয়া যায় বলে ঈশিতা মাঝেমাঝে বলেই বসে যে,

–এমন হলো বলেই হয়ত তোমাকে এত কাছে পাচ্ছি।

জুয়েলের অবশ্য প্রায়ই মনে হয় নিজের খামতির কথা,অসম্পূর্ণতার কথা কিন্তু দিনশেষে ঈশিতার মুখের হাসি ওর সমস্ত চিন্তা আর অসম্পূর্ণতায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে জীবনটাকে সুখ আর শান্তিতে ছেয়ে দেয়।

জ্যোৎস্না রাতগুলোতে ওরা জানালার পাশ ঘেঁষে বসে চাঁদ দেখে, জুয়েল খালি গলায় টুকটাক গান ধরে। গতমাসে ঈশিতা শখ করে ওর জন্য একটা গিটার ও কিনে এসেছে। হালকা ব্লুইস কালারের গিটার, ঈশিতার বড্ড পছন্দের রঙ। গিটারটা এনে ঈশিতা জুয়েলের সামনে রেখে খুশিতে রীতিমতো ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেদিন জুয়েল গিটারটা হাতে ধরে খালি গলায় আনমনেই গেয়ে উঠেছিল,

–“ভালোবাসা যত বড় জীবন ততো বড় নয়
তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়…”

ঈশিতা জুয়েলের ডান হাতটা টেনে এনে নিজের গালে ছোঁয়াল, মনেমনে বলে উঠলো -নাহ জীবনে সুখী হতে আসলে খুব বেশি কিছু লাগে না, দুটো মনের মানুষ একসাথে কাছাকাছি থাকলেই স্বপ্নপুরীর পরীর মতো সুখ চারপাশে ঘোরাফেরা করে, আর জীবনটা রাঙিয়ে দেয়। ভাবতে ভাবতেই ঈশিতা জুয়েলের একটা হাত টেনে এনে ওর পেটের উপরিপৃষ্ঠে ছোঁয়াল, বোঝার চেষ্টা করল এখানটাতে একটা নতুন মানুষ আছে আর সে খুব শীঘ্রই দুনিয়াতে আসবে ওদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন হয়ে। ঈশিতার চোখদুটো শান্তিতে বুজে এলো, প্রশান্তির আবেশে সে জুয়েলের হাত আঁকড়ে ধরে কখন শুয়ে পড়লো কে জানে!

সকালের মিষ্টি রোদটা এসে ঈশিতার চোখের উপর পড়তেই ঈশিতা দু-চোখ মেলে তাকাল, দেয়াল ঘড়িতে আটটা বেজে চার মিনিট। ঈশিতা জুয়েলের মাথায় আলতো করে একটা গাট্টা মেরে আহ্লাদ করে বলল,

–কী ঘুম রে বাবা! এখনো ঘুমচ্ছে মশাই!

হঠাৎ ডোর বেলটা বেজে উঠলো, এত সকালে কে এসেছে ভাবতে ভাবতেই ঈশিতা দরজার কাছে গেল। দরজা খুলতেই দেখা গেল ঝিনুক দাঁড়িয়ে আছে, ঈশিতা হন্তদন্ত হয়ে ওকে ঘরে টেনে আনলো। এক পাড়ায় থাকলেও ইদানীংকাল ওদের দেখাটা খুব কম হচ্ছে, বেশ চার মাস পরে আজ হুট করে ঝিনুককে দেখে ঈশিতা যেন বাঁধভাঙা খুশি পেল।

–কীরে কই থাকিস তুই বল তো? দেখাই হয় না এখন।ঈশিতা বলল

–একটু ব্যস্ত হয়ে গেছি রে। দেখনা তোর জন্য দেশ থেকে একটা চিঠি এসেছিল গত সপ্তাহে। আমার বাসার ঠিকানায় এসেছে, আন্টি পাঠিয়েছেন। আমি তো গত সপ্তাহে বাড়িতে ছিলাম না অফিসের কাজে শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম ফিরলাম এখন। ফিরতেই চিঠিটা দিল আমার বুয়া। কোন জরুরি খবর কিনা সেটা ভেবেই এখনই এলাম তোকে দিতে।

–সে কি! আন্টি মানে কি মা? ঈশিতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

–তাই তো লেখা। মিসেস আঞ্জুমান ।

–এ তো মা! কিন্তু ঠিকানা কী করে পেল!

–জানি নারে।

–কই দে তো।

ঈশিতা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। ঝিনুক ব্যস্ত হয়ে বলল,

–আমি মাত্রই ফিরলাম তো। যাই একটু ফ্রেশ হই। তুই দেখ কি লিখেছে।

গত আড়াই বছরে বাবা-মা’র সাথে ঈশিতার সব রকমের যোগাযোগ একেবারে বন্ধ। এতদিন পরে মায়ের চিঠি পেয়ে ঈশিতা ঠিক কিভাবে নিজের আনন্দ ধরে রাখবে বুঝে উঠলো না। চিঠিটা খুলতেই
চোখমুখ আনন্দে ছলছল হয়ে উঠল। তাতে প্রথমেই লেখা,

————ঈশিতা মা কেমন আছিস? ভালো আছিস?
খুব কষ্ট করে ঝিনুকের ঠিকানাটা পেলাম। তোকে একটা কথা বলবার ছিল তোর বাবার, চাইলে হয়ত তোর নাম্বারটা জোগাড় করতে পারতাম কিন্তু সামনাসামনি কিংবা ফোনে কথাটা বলার শক্তি আমার নেই তাই এই চিঠি লেখা। মা তুই যেদিন ইন্ডিয়া চলে গেলি তোর বাবা খুব চেষ্টা করেছে তোদের খোঁজার, কিন্তু পায়নি। তার পাঁচ মাস পরেই তোর বাবা স্ট্রোক করে। এর আগেও একবার হয়েছিল তুই তো জানিস ই। এবারের স্ট্রোক এর পরে তোর বাবা বেঁচে গেছে যদিও কিন্তু সেই থেকে লোকটা বিছানায় পড়ে আছে। তোর বাবার অর্ধেক শরীরই প্যারালাইজড মা। গত একটা বছর হলো আমি এই লোকটার সাথে আছি সারাটাক্ষণ। মারে আমাদের ক্ষমা করে দিস। ডাক্তার গতকাল বলে গেছেন আর বেশিদিন নেই হাতে। কথাটা শুনলে জানি তুই খুব কষ্ট পাবি, আমাদের হয়ত আরও বেশি ঘৃণা করবি কিন্তু তবুও না বললে আমি কিংবা তোর বাবা কেউই মরেও শান্তি পাবো না। জুয়েলের এক্সিডেন্টটা তোর বাবাই করিয়েছিল সেটা আমি জানতে পারি রুম্মনের সাথে তোর বিয়ের দিন। তোর বাবা এই বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি উনি ভেবেছিলেন অসুস্থ জুয়েলকে তুই বিয়ে করবি না, কিন্তু তুই যে ওকেই বিয়ে করবি এটা তোর ভাবা কখনোই ভাবতে পারে নি। তোর বিয়ের পরে যখন উনি বুঝলেন তোকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না! সেদিন থেকেই উনি তিলেতিলে অপরাধবোধে ভুগেছে, আমাকে বারবার বলত, জুয়েলকে না আমি আমার মেয়েটাকে পঙ্গু করে দিলাম। তোর টেনশনে টেনশনেই লোকটা ২য় বার স্ট্রোকটা করল। প্যারালাইজড হবার পরে ওনার মুখের কথা ঠিকভাবে বোঝা যায় না কিন্তু উনি যে তোর কাছে ক্ষমা চায় সেটা আমি বুঝি মা। জানিনা এই চিঠি পড়ে তুই কি করবি কিন্তু মা হিসেবে তোর কাছে আমি কিছু চাইবো ঈশিতা। আমার স্নেহের দামে হলেও তোর বাবাকে মাফ করে দিস মা। নইলে লোকটা মরেও শান্তি পাবে না আর আমিও শান্তিতে মরতে পারব না। যদি পারিস তোর বাবাকে ক্ষমা করে দিস মা।

ইতি তোর মা।””

চিঠিটা শেষ হতেই ঈশিতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, পায়ের নিচটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হতে লাগল৷ পড়া শেষ হতেই ওর হাত থেকে কাগজটা উড়ে গিয়ে বিছানার চাদরে গেঁথে গেল জুয়েলের পায়ের কাছে। ঈশিতার চোখ বেয়ে দরদরিয়ে পানি পড়ছে ফোটায় ফোটায়, বুকের ভিতরে ভীষণ একটা ঝড় শুরু হয়েছে, যে ঝড়টা তার সমস্ত কিছু উলোটপালোট করে রেখে দিচ্ছে৷ এতটা কষ্ট বোধহয় আজ অবধি কখনোই হয়নি তার, জুয়েলের এক্সিডেন্ট হওয়ার পরে, ওর সাথে বিয়ে ভাঙার পরে কিংবা প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয় বুকে চেপে কাটানো দিনগুলোকে এই ঝড়টা যেন এক ধাক্কায় দূরে উপড়ে ফেলে দিলো, একাই দখল করে নিল পুরোটা। মুহূর্তেই ঈশিতা মেঝেতে দুপ করে বসে পড়লো, তার নিজেকে ঠিক কি মনে হচ্ছে সে জানে না। সমস্তটা একটা দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। বাবার স্ট্রোক হয়েছে শুনেই বুকটা ধক করে লাফিয়ে উঠেছিল তার, সেই লাইনটা পড়া মাত্রই মনটা ছুটে যেতে চেয়েছে জন্মদাতা পিতার কাছে, নিজেকে এতটা অপরাধী মনে হয়েছে যে লজ্জা হচ্ছিল তার নিজের উপর। কিন্তু তার এই জীবনটাতে যে এরকম কোন সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে তা ঈশিতা কোনদিন ঘুণাক্ষরে ও টের পায় নি, কোনদিন ভাবে নি।

বাবার উপরে বরাবরই ছিল তার অগাধ ভালোবাসা আর বিশ্বাস। এই যে তিনটে বছর ঈশিতা পিতামাতা ছাড়া দূরে আছে একমাত্র অন্ধকার রাত্রি সাক্ষী যে কত রাত সে তার জন্মদায়িনী মায়ের কথা ভেবে কেঁদে ভাসিয়েছে, তো কত রাত বাবাকে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গের দায় তার অন্তরটাকে পুড়িয়েছে। সে খবর রাতের অন্ধকার আর ঈশিতার অন্তর আত্মা ছাড়া কেউ জানে না, জানেন শুধু উপরওয়ালা।

পিতামাতার উপরে এই আবেগটা ঈশিতা সবসময় জুয়েলের থেকে আড়াল করে রেখেছে পাছে জুয়েলের ঈশিতাকে নিয়ে কষ্ট হয়, ঈশিতা ওর সাথে সুখে নেই এমন কোন ধারণা জন্মে।

হ্যাঁ, ঈশিতা সুখে ছিল নিজের উপরে অপরাধবোধ নিয়ে, বাবা-মায়ের অযোগ্য সন্তান হওয়ার গ্লানি নিয়ে কিন্তু সেই সুখটার মধ্যে নিজের পিতার কি জঘন্য পাপকাজটা লুকিয়ে ছিল এতদিন তা ঈশিতা আজ জানলো!

জন্মদাতা পিতার এই ভয়াবহ, নির্মম পাপ কাজের বোঝাটা এক লাফে এসে ঈশিতার বুকের উপরে পাথর হয়ে বসে পড়ল। এতদিন সে এই সুখে বেঁচে ছিল যে জুয়েলকে সে ভালো রেখেছে কিন্তু জানা গেল জুয়েলের এই খামতির জন্য, এই অসম্পূর্ণতার জন্য, এই অর্ধ জীবন বয়ে বেড়ানোর পিছনে ভাগ্যের যে কলকাঠিটি দায়ী তার নাম বাবা! বাবা শব্দটার উপরে ঘেন্নায় ঈশিতার গা ঘিনঘিন করে উঠল, নিজেকে অপবিত্র মনে হতে লাগল এমন একজন মনুষ্যত্বহীন মানুষের সন্তান হয়ে জন্মানোর দায়ে।

এতদিন ঈশিতা জুয়েলের বাবা-মা, পরিবারের কাছে দেবীর আসনে ছিল কিন্তু পুরোটাই একটা মিথ্যার যাত্রাপালা হয়ে দাঁড়াল। এ তো হবার ই ছিল! পিতার পাপমোচনে কন্যার তো নিজের জীবনের আহুতি দেওয়া উচিত ছিল তা না করে সে কি-না অবচেতনে সুখের সংসার সাজিয়েছে বাবা-মার দোয়া ভিক্ষা করে!

ছিহ! ছিহ! ধিক্কার তোমায় ঈশিতা। জগতে তোমার জন্ম হয়েছে জঘন্য এক কূপে আর তুমি সে খবর আজ জানলে! সারাটা জীবন কি এক মিথ্যের স্তম্ভে তুমি নিজেকে আদর্শ পিতামাতার সন্তান বলে দাবি করে এসেছ আর আজ তাদের এই রুপ দেখলে তো!

দু’হাত দিয়ে মুখটা জেঁতে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ঈশিতা, বুকের ভিতরে হৃদপিন্ডটা যেন ঘেন্নায় বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, দম বন্ধ লাগছে ওর।

হঠাৎ ঘাড়ের উপরে একটা শীতল স্পর্শে ঈশিতা ইতস্তত হয়ে উঠল, হাতটা জুয়েলের! অনেক কষ্টে সে একাই হুইল চেয়ারে উঠে ঈশিতার পাশে এসে বসেছে। চোখের পানি মুছতে গিয়ে আরও জোরে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল ঈশিতা, জুয়েলের হাতটা সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,

–তুমি জানো জুয়েল তোমার এক্সিডেন্টটা কেন হইছে? জানো না তো! এটা আমার বাবা করিয়েছে! তোমার ঈশিতার বাবা তোমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে জুয়েল। ঘেন্না করো আমাকে প্লিজ, অনেক ঘেন্না করো আমাকে। শাস্তি দাও আমাকে প্লিজ তুমি, যা খুশি শাস্তি দাও।

কথাগুলো শেষ না হতেই জুয়েল ঈশিতার মুখের কাছে নিজের একটা আঙুল এনে সশব্দে বলে উঠল,

–এ কথা আমি জানি ঈশিতা। সে-দিন ই জানি যেদিন আমার এক্সিডেন্টটা হয়েছিল।

ঈশিতার চোখের পানি স্থির হয়ে গেল, তার গলা জড়িয়ে গেল যেন তাকে বোবায় ধরেছে। পুরো ঘর জুড়ে পিনপতন নিরবতায় কাটালো কয়েকটা মুহূর্ত। ঈশিতা মেঝের উপরে নিজের হাতদুটোকে শক্ত করে জেঁতে ধরে বিড়বিড় করে বলল,

–সবাই ঠকিয়েছে আমাকে! সবাই! তুমিও লুকোলে আমার থেকে!

জুয়েল হুইল চেয়ারটা ছেড়ে বহুকষ্টে মেঝেতে বসল, ঈশিতার মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে ফিসফিস করে বলল,

–যদি বলে দিতাম তবে কী তোমাকে এভাবে করে পেতাম বলো? সবকিছু বলতে নেই মাঝেমাঝে স্বার্থপর হতে হয় আমিও হয়েছি।

ঈশিতা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলতে চাইলো কিছু শব্দ কিন্তু জুয়েল ওর মুখে আঙুল চেপে থামিয়ে দিল,

— কষ্ট হয়েছিল খুব প্রথমে ঈশিতা। প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম সত্যি। হয়ত নিতাম ও কিন্তু আমার উপর তোমার পাগলামি গুলো সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। প্রতিশোধ নিয়ে কি পেতাম বলো? তোমাকে কী পেতাম? পেতাম না তো! তোমার এই পবিত্র আর নিখাঁদ ভালোবাসাটা সবকিছুকে ভুলিয়ে দিয়েছে, সব হারিয়ে দিয়েছে, ক্ষতগুলো ভরে যাচ্ছে ঈশিতা। একদিন হয়ত একেবারেই মিইয়ে যাবে, হয়ত দাগটা থাকবে কিন্তু আগের মত ব্যথা আর হবে না। ভুলে যাও সব, মাফ করে দাও তাকে। কেউ মাফ চাইলে মাফ করে দেওয়াই ধর্ম আর জন্মদাতা পিতার কাছে তুমি ঋনি, আমিও ঋণী। ওই লোকটার জন্যই আমি তোমাকে পেয়েছি। তুমি যখন আমার পাশে থাকো তখন আমি ঠিক এ জন্যও ওনার উপর ক্ষোভটা কাটিয়ে উঠি। মাঝেমাঝে কৃতজ্ঞতায় ও মনটা ভরে যায় যে তোমাকে সেই লোকটা এই দুনিয়ায় এনেছে। তুমি তার ঔরসজাত সন্তান। ক্ষমা করে দাও ঈশিতা, চলো দেশে ফিরে যাই। বহুদিন বাবা-মায়ের জন্য মনটা খুব কাঁদছে, চলো ফিরে যাই।

ঈশিতা দু-চোখ ভরে জুয়েলকে দেখছে, ওর মনটা এখন কালবৈশাখী ঝড়ের পরের ঝুম শীতল ঠাণ্ডার মত। মনটা বলছে একজীবনে এতগুলো ভালো মানুষের যোগসূত্র জীবনে থাকতে নেই, জুয়েলের যোগসূত্রকে ব্যালেন্স করতেই বোধহয় বাবা শব্দটা এতটা ভয়ংকর হল তার জীবনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঈশিতা সাথে চোখদুটো মুছে নিল, মনে মনে বলল একটা খবর তোমাকে এখনও দেওয়া বাকি জুয়েল সেটা বোধহয় সত্যিই তোমাকে হাসাবে। ঈশিতা বুঝি এবারে সত্যিই তোমাকে কিছু দিতে পারবে…

~~~সমাপ্ত ~~~

শারমিন আক্তার সেজ্যোতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here