অগোচরে তুমি পর্ব -০৫

#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

৫.

– এই বাড়িতে পা রাখার সাহস কি করে হলো তোর?

গেস্ট রুম থেকে কথাটা অর্কের কানে আসতেই থমকে দাঁড়ায়।সামনে থাকা মেহরাব সাহেবের দিকে ভয়ার্ত চোখ তাকিয়ে আছে অর্ক।মেহরাব সাহেবের চোখ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে।মুহূর্তেই কান গরম হয়ে আসে অর্কের।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে দাঁত কড়মড় করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বললো,

– ওই মেয়েটা তাহলে আঙ্কেলের চোখে আমাকে খারাপ বানিয়ে তবেই ছেড়েছে।বজ্জাত মেয়ে কোথাকার।

কথাটা শেষ করে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্ক।

– আবার বলে কি না,ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন কেন?বসুন না!

মুখ ভেঙিয়ে কথাটা বলে অর্ক।

– তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস?

চমকে উঠে অর্ক।চকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখে মেহরাব সাহেব হাতে ইয়া বড় এক লাঠি নিয়ে ওর দিকে তেড়ে আসছে।এটা দেখে অর্কের চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।মেহরাব সাহেবের রাগ দেখে মনে হচ্ছে আজ একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই কান্ত হবেন।অর্ক কি করবে বুঝতে পারছে না।এই লোক আবার ওর মাথা টাতা ফাটিয়ে দিবে না তো?ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে অর্কের।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজাচ্ছে বার বার।মেহরাব সাহেব কাছাকাছি চলে আসতেই অর্ক দৌড়ে গিয়ে উনাকে জাপটে ধরে।শুকনো একটা ঢোক গিলে করে মিনমিনে স্বরে বলে,

– আর কোনোদিন এমন ভুল হবে না আঙ্কেল।এবারের মতো ছেড়ে দাও।

বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মেহরাব সাহেবের রাগটা যেন থরথর করে বেড়েই চলেছে।এইদিকে অর্ক উনাকে এতটাই শক্ত করে চেপে ধরে আছে যে উনার প্রানটাই না এবার বেড়িয়ে আসে।একটুও নড়াচড়া করতে পারছেন না।জোর কাটিয়েও অর্কের কাছ থেকে মুক্ত হতে না পেরে জোরে একটা ধমক দিয়ে বললেন,

– এই ছেলে ছাড়ো আমাকে।

অর্কের ভয় যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।আরো শক্ত করে চেপে ধরেছে মেহরাব সাহেবকে।চোখ বন্ধ করে উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,

– না ছাড়বো না!আগে বলো তুমি আমাকে মারবে না!

কপাল কুচকে অর্কের দিকে তাকান মেহরাব সাহেব।এই ছেলে আবোল তাবোল এইসব কি বলছে?একে তাও এমন ভাবে জাপটে ধরে আছে তারউপর এমন অদ্ভুত সব কথা বলছে।মেহরাব সাহেব বেশ বিরক্ত হয়ে বলেন,

– এখন যদি আমাকে না ছাড়ো তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি মার খেতে হবে বলে দিলাম!

হাত আলগা হয়ে আসে অর্কের।ছেড়ে দিয়েছে মেহরাব সাহেবকে।ছাড়া পেয়ে মেহরাব সাহেব বুকে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন।অর্ক মাথা নিচু করে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।মেহরাব সাহেব একটু শান্ত হয়ে আবার লাঠি নিয়ে মারার জন্য উদ্যত হতেই আড়চোখে অর্ক তাকিয়ে দেখেই ও আবার মেহরাব সাহেবকে জড়িয়ে ধরে।এবার মেহরাব সাহেবের রাগ আর বিরক্তি চরম পর্যায়ে এসে পৌছায়।অর্কের হাত ঝাড়া মেরে ফেলে দিয়ে বাজখাঁই গলায় বললেন,

– এই ছেলে সমস্যা কি তোমার?বার বার আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ছো কেন?

– বারে!দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাবো নাকি?

মুখ ফুলিয়ে মিনমিনে স্বরে কথাটা বলে অর্ক।অর্কের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেছেন মেহরাব সাহেব।বিস্মিত সুরে বললেন,

– মানে?

– মানে আর কি!তুমি আমায় মারতে চাইছো কেন সেটা আগে বলো?

মেহরাব সাহেব অর্কের কথা শুনে টাশকি খেয়ে যান।পর মুহূর্তেই কর্কশভাবে বললেন,

– আমি তোমায় কেন মারতে যাবো?

– তুমি আমায় মারবে না?

অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো অর্ক।মেহরাব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,

– আরে বাবা রে আমি তোমাকে কেন মারতে যাবো!আমি ওই ওকে……কি হলো ও কোথায় গেলো?

মেহরাব সাহেব সারা ঘর তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজছেন।খাটের নিচে, সোফার নিচে, আলমারির উপরে, ব্যালকনিতে।অর্ক মেহরাব সাহেবের অর্ধেক কথার মানে বুঝতে পারে নি।এই ও টা আবার কে?এই ঘরে তো ও আর মেহরাব সাহেব ছাড়া আর কেউ নেই তাহলে উনি কাকে খুঁজছেন এমন করে?অর্ক এই কথাগুলো ভাবছে আর মেহরাব সাহেবের পিছন পিছন ঘুরছে।অর্ককে এমন পিছু পিছু হাটতে দেখে মেহরাব সাহেব কপালে বিরক্তির ভাজ ফেলে বললেন,

– কি তখন থেকে আমার পিছনে ঘুরঘুর করছ,তুমিও একটু খুঁজো না!

অর্ক উনার কথা মতো খুঁজতে শুরু করে দেয়। বিছানার নিচে,আলমারির ভেতরে,বাথরুমে, টেবিলে, চোখে সামনে যা পাচ্ছে সেটাই নেড়ে চেড়ে দেখছে।এতক্ষণ খুঁজার পর অর্কের খেয়াল হলো আসলে ও খুঁজছেটা কি?মেহরাব সাহেব বলেছেন আর ওউ সাথে সাথে খুঁজা শুরু করে দিয়েছে?আজব!অর্ক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাস করে,

– আচ্ছা আঙ্কেল আমরা এতক্ষণ ধরে কি খুঁজছি?

– বিড়াল!

মেহরাব সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠের উত্তর শুনে বিষম খেয়ে যায় অর্ক।উচ্চস্বরে বলে,

– কি বিড়াল?

মেহরাব সাহেব চোখ রাঙিয়ে বললেন,

– তা নয় তো কি?তোমার জন্যই তো ওকে ধরতে পারলাম না!এমন ভাবে আমাকে চেপে ধরেছিলে আরেকটু হলে তো এক্কেবারে পটল তুলতাম!

কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয় অর্ক।একটু অপ্রস্তুতও হয়ে পড়ে।সেকেন্ড দু-এক পরে আমতা-আমতা করে বলল,

– তখন তুমি দরজার দিকে ওইভাবে তেড়ে আসছিলে আমি ভাবলাম হয়তো আমাকেই মারতে আসছো!তাই তো তোমাকে আটকানোর জন্য জাপটে ধরেছিলাম।আ….

কেউ একজন ফিক করে হেসে উঠায় অর্ক ওর কথা শেষ করতে পারলো না।চমকে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে দরজার আড়ালে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।এগিয়ে গিয়ে দেখে ওইখানে মেহেনূর দাঁড়িয়ে।অর্ককে থেকে হাসি থামিয়ে দেয় মেহেনূর।মাথা নিচু করে চুপচাপ ওখান থেকে চলে যায়।রাগ হচ্ছে অর্কের।ওর এই অবস্থা দেখে এই মেয়ে হাসছে?কিন্তু রাগটা বেশিক্ষণ টেকে নি।মেহরাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,

– তা বিড়াল তোমার কি ক্ষতি করেছে শুনি?

– আরে কাল বাজার থেকে একটা ইলিশ মাছ এনেছিলাম।হতচ্ছাড়া বিড়াল মাছটা খেয়ে ফেলেছে।

মেহরাব সাহেব এমন ভাবে কথা বললেন যেটা দেখে অর্কের হাসি পায়।মুখ টিপে হেসে আহ্লাদী গলায় বলে,

– আহা রে!থাক,এখন তো খেয়েই ফেলেছে।বিড়ালকে ধরে পিটালে তো এখন আর মাছ ফেরত পাবে না।

মেহরাব সাহেব একটা হতাশার সুর দিয়ে বলেন,

– সেটা ঠিক।কিন্তু মাছটা আমি মেহেনূরের জন্য এনেছিলাম।আজকে সকালেও বাজারে গিয়েছিলাম কিন্তু ইলিশ মাছ পাই নি।

অর্ক সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

– পরে এক সময় নিয়ে এসো।এখন চলো গিয়ে দেখি আন্টি কি রান্না করছে।বড্ড খিদে পেয়েছে আমার,চলো চলো।

খাওয়ার টেবিলে সবাই একসাথে খাচ্ছে।অর্ক বার বার আড়চোখে মেহেনূরের দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটাকে শুধু শুধু ভুল বুঝলো ও।ওর কথা কাউকে তো কিছুই বলেই নি বরং ওকে যতেষ্ট হসপিটালিটিও দেখিয়েছে।অবাক হয় অর্ক।মেহেনূরের কি একটুও রাগ হয় নি ওর উপর?আমি হলে তো কখনই পারতাম না।অর্ক কথা গুলো ভাবছে আর খাচ্ছে।ওদের খাওয়ার মাঝেই আয়েশা বেগম চলে আসেন মেহেনূরদের বাসায়।ছেলেকে সকালে বিছানায় দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হয়ে ছিলেন ঠিকই।কিন্তু এখানে ছেলের দেখা পাবেন এটা তো উনার কল্পনাতেও আসে নি।মাকে দেখে অর্ক একটু লজ্জা পায়।তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে রেনুফা বেগমকে বলেই চলে যায়।মেহেনূরও ওর খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।আয়েশা বেগম অর্কের বিষয়ে জানার জন্য মেহেনূরের হাত ধরে ওর ঘরে নিয়ে যায়।মেহেনূরের মুখে সকালে অর্কের করা কান্ড কারখানার কথা শুনে আয়েশা বেগম তো হাসতে হাসতে শেষ।তৃপ্তি লাগছে খুব।যতই হোক মা তো!আয়েশা বেগম বুঝতে পারছেন ছেলের মনের অবস্থা।অনুশোচনা থেকেই ছেলে সাজ সকালে উঠে মেহেনূরদের বাসায় চলে এসেছে রেনুফা বেগম আর মেহরাব সাহেবের রাগ ভাঙাতে।উনার ছেলেকে তো তাদের সামনে ছোট হতে দেয় নি মেহেনূর।তারা তো আদৌ জানেনই না উনারা যাকে জামাই আদর করে খাওয়ালেন সেই অর্ক উনাদের মেয়েকে সহ্যই করতে পারে না!এমনকি সামনা সামনি অপমানও করেছে।বুকে জড়িয়ে ধরলেন মেহেনূরকে।মেহেনূরও মাথা রাখলো উনার বুকে।কিন্তু আয়েশা বেগমের মাথায় একটা শব্দ বার বার এসে ধরা দিচ্ছে,জামাই!জামাই শব্দটা কেন এতো মধুর মনে হচ্ছে।মুখের হাসি প্রশস্ত করে মেহেনূরকে বুকের সাথে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেন।প্রশান্তিতে আঁখিজোড়া বন্ধ করে নেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here