অগোচরে তুমি পর্ব -০৮+৯

#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

৮.

রাওনাফ সোজা ওদের বাড়ির সামনে এনে গাড়ি থামায়।গাড়ি থামতেই মেহেনূর তাড়াতাড়ি করে নেমে দৌঁড়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।অর্ক মেহেনূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়।রাওনাফ সিট বেল্ট খুলতে খুলতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে রোশনি এখনো ল্যাপটপেই মুখ গুজে বসে আছে।নিজের কাজে এতটাই মগ্ন হয়ে আছে গাড়িটা যে এখন আর চলছে না এটাও টের পায় নি।রাওনাফ ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বললো,

– হ্যালো মিস!শ্বশুর বাড়ি দেখবেন না?

……

রাওনাফ গাড়ির চাবিটা হাতে নিতে নিতে বললো,

– গাড়ি থেকে নামেন এবার।চলে এসেছি আমরা।

……..

রোশনির কোনো রেসপন্স না পেয়ে কপাল কুঁচকে আসে রাওনাফের।পিছনে তাকিয়ে দেখে রোশনির কোনো হেলদোল নেই।ও আগের মতোই বসে কাজ করছে।এতক্ষণে রাওনাফ খেয়াল করে দেখলো রোশনির কানে হেডফোন গুঁজে বসে আছে।নিজের বোকামি দেখে নিজে নিজেই হাসলো।তারপর গাড়ি থেকে নেমে এসে এবার রোশনির পাশে বসে।একটা মানুষ যে ওর পাশে এসে বসেছে এতেও রোশনির ভাবাবেগের কোনো পরিবর্তনই হয় নি।রাওনাফ উঁকি দিয়ে দেখলো রোশনি এত মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কি করে?পর মুহূর্তেই ফট করে রোশনির গালে শব্দ করে একটা চুমো দিয়ে দেয়।চোখ বন্ধ করে নেয় রোশনি।বেশ খানিকটা শব্দ করেই ল্যাপটপটা বন্ধ করলো ও।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রাওনাফের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো,

– এটা কি হলো?

রাওনাফ ওর দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসছিল।রোশনির কথার প্রত্যুত্তরে বললো,

– ওয়েলকাম কিস!চলো নামো এবার, তাড়াতাড়ি।

রোশনিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে আসে রাওনাফ।ওরা নেমে দাঁড়াতেই সামনে তাকিয়ে দেখে মেহেনূর দৌঁড়ে ওদের দিকে আসছে।মেহেনূর ওদের কাছে এসে বললো,

– ভাইয়া,ভাবী চলো।

রাওনাফ আর রোশনিকে ধান দুব্বো দিয়ে বরণ করে ঘরে তুললেন রেনুফা বেগম।রোশনিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো মেহেনূর।অর্ক রাওনাফের মুখোমুখি হতে চায় না বলে ওদের বাসার ভিতরে যায় নি।ও ওদের বাসায় চলে যায়।হঠাৎ করেই রাওনাফের মনে পড়লো অর্ককে গাড়ির চাবিটা ফেরত দেওয়া হয় নি।রাওনাফ চাবিটা দিতে অর্কদের বাসার সামনে অব্দি যায় কিন্তু বাসার ভেতরে গেলো না।দারোয়ানকে দিয়ে চাবিটা পাঠিয়েছে ও।

– অর্ক বাবা গাড়ির চাবিটা।

দারোয়ানের কন্ঠ শুনে সিঁড়ির মধ্যেই থমকে দাঁড়ায় অর্ক।ভ্রু কুচকে তাকায় দারোয়ান দিকে।দারোয়ান স্মিত হেসে ধীর কন্ঠে বললো,

– ওই বাসার রাওনাফ দিয়ে পাঠালো।
– ওহ!

অস্পষ্ট স্বরে বললো অর্ক।পর পরেই দারোয়ানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

– তুমি গিয়েছিলে ওদের বাসায়?

দারোয়ান হেসে বললো,

– আরে না না।ওই তো এসেছিল গেইট অব্দি।
– আচ্ছা তুমি যাও।

একসময় তো বাসায় খেয়ে এই বাসায় এসে দম না ছাড়লে পেটের ভাত হজম হতো না।আর এখন দারোয়ানকে দিয়ে চাবি পাঠাচ্ছে।কথাগুলো ভেবেই ঠোঁট বাঁকিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় অর্ক।

_______________

সকালে অর্ক খেয়ে দেয়ে চলে যাওয়ার পর আয়েশা বেগমও একটু বেড়িয়েছিলেন।রাওনাফকেও নিজের আরেকটা ছেলে মনে করেন তিনি।আর সেই ছেলের বউয়ের মুখ দেখবেন খালি হাতে?এটা একটু কেমন দেখায় না?তাই আয়েশা বেগম একটু বেড়িয়েছিলেন আশীর্বাদ সরূপ রোশনির জন্য কিছু কিনার জন্য।একটু আগেই বাড়িতে ফিরেছেন।বাসায় এসে দেখতে পায় অর্ক ড্রয়িং রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে।উনি একটু উঁকি দিয়ে দেখলেন অর্ক ভিডিও কলে আছে।তাই অর্কের কল শেষ হওয়া অব্দি উনি একটু অপেক্ষা করছেন।কারণ অর্ককে সাথে নিয়েই উনি মেহেনূরদের বাসায় যাবেন।অর্ক কথা বলা শেষ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে বললো,

– কি বলবে?

– হুম,চল মেহেনূরদের বাসায় যাবো।

অর্ক মায়ের কথায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো,

– তো তুমি যাও না।আমাকে কেন যেতে হবে?

আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে ভারী কন্ঠে বললো,

– আমি বলেছি তাই।

অর্ক মায়ের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির রেখে ধীর কন্ঠে বললো,

– না মা আমি এখন যেতে পারবো না।আমার অনেক কাজ জমে গেছে এই কয়েকদিনে।আজকে শুক্রবার তাই সবাই বাসায় আছে।এই সুযোগে আমি কাজ গুলো করে নিতে পারবো।আর ওদের সাথে তো আমার দেখা হয়েছেই।এখন তুমিই যাও না।

আয়েশা বেগম অর্কের দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে উঠে যেতে নিলেই অর্ক উনার হাত ধরে থামিয়ে দেয়।মুখের উপর না করে দেওয়ায় যদি উনি কষ্ট পেয়ে থাকেন।না না বাবা মাকে কষ্ট দিতে চায় না ও।ওর কাজ না হয় পরেই করবে।অর্ক উঠে দাঁড়ায়।আয়েশা বেগম অর্কের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন।মায়ের প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে অর্ক ফোঁস করে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নিষ্পাপ কণ্ঠে বললো,

– চলো যাচ্ছি!

ছেলের কথার বিনিময়ে এক টুকরো হাসি ফেরত দিলেন আয়েশা বেগম।কলিং বেল বাজতেই মেহেনূর এসে দরজা খুলে দেয়।আয়েশা বেগমকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দেয়।আয়েশা বেগম ভেতরে ঢুকতেই মেহেনূর দরজা বন্ধ করতে গেলেই আয়েশা বেগম বললেন,

– বাহিরে অর্ক আছে।
– সরি আন্টি, আমি খেয়াল করি নি।

মেহেনূর একটু ইতস্ততভাবে বললো।আয়েশা বেগম মেহেনূরের গালে হাত রেখে স্মিত হেসে বললো,

– ইটস ওকে,তাঁরা কোথায়?
– আন্টি আপনি বসুন।আমি ভাবীকে নিয়ে আসছি।

মেহেনূর চলে গেলো রোশনিকে আনার জন্য।রেনুফা বেগম রান্নাঘর থেকে আয়েশা বেগমের কাছে এসে গল্পগুজব করতে থাকেন।রোশনি খুব সুন্দর একটা বেবি পিংক কালারের জামদানী শাড়ি পড়েছে।দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।রাওনাফ কিছু একটা নেওয়ার জন্য মেহেনূরের ঘরে এসেছিল।দরজার কাছে আসতেই রোশনিকে দেখে তো ওর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে গলা খাঁকারি দিয়ে এগোয় রুমের দিকে।রাওনাফের গলার আওয়াজ শুনতে মেহেনূর আর রোশনি দুজনেই চমকে উঠে।রোশনি শাড়ির আঁচল ঠিক করে মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,

– কারো রুমে ঢুকতে হলে পারমিশন নিতে হয় জানো না?

রাওনাফ মেহেনূরকে চোখে ইশারায় বললো রুম থেকে চলে যেতে।মেহেনূর ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

– একটু তাড়াতাড়ি আসিস।নিচে আয়েশা আন্টি অপেক্ষা করছে।

মেহেনূর চলে যাওয়ার আগে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যায়।রাওনাফ স্মিত হাসে।ওর বোনটা বরাবরই একটু বেশিই ম্যাচিউর!মেহেনূর চলে যেতেই রাওনাফ এগোলো রোশনির দিকে।পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রোশনি ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়।কানের লতিতে আলতো করে চুমো দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– আমাকে পাগল করার পারমিশন কে দিলো শুনি?

রোশনি এবার ঘুরে রাওনাফের কাধের উপর হাত রাখে।রাওনাফ রোশনির কোমড় ধরে টেনে আরেকটু কাছে নিয়ে আসে।রোশনি একটু চমকে উঠে।তবে পরমুহূর্তেই রাওনাফের নাকে ঠোঁট ছুইঁয়ে দিয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,

– তুমি!

রাওনাফ একটা তৃপ্তির শব্দহীন হাসি দিয়ে সবে রোশনির দুগাল ধরেছে ওমনি নিচ থেকে মেহেনূরের ডাক শুনতে পেয়ে রোশনিকে এক ঝটকায় ছেড়ে দেয়।রোশনি রাওনাফের কান্ড দেখে ফিক করে হেসে দেয়।রাওনাফও কিছুটা লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।তারপর দুজনেই নিচে চলে আসে।রাওনাফ এসে আয়েশা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।আয়েশা বেগমও রাওনাফকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলেন।রোশনি এসে উনাকে সালাম করলো।আয়েশা বেগম রোশনির হাত ধরে উনার পাশে নিয়ে বসিয়ে এক জোড়া ডায়মন্ডের বালা পড়িয়ে দিলেন।এটা দেখে রেনুফা বেগম বললো,

– ভাবী এটার কি খুব দরকার ছিল?

– আমার ছেলের বউয়ের মুখ কি আমি খালি হাতে দেখবো নাকি!

আয়েশা বেগম জোর গলায় কথাটা বলেন।উনার কথার প্রত্যুত্তরে রেনুফা বেগম এক গাল হাসি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না।রোশনি আয়েশা বেগমের কথায় বেশ বিস্মিত চোখে রেনুফা বেগমের দিকে তাকালে উনি বলেন,

– উনিই হচ্ছে অর্কের মা।আর ওকে তো চিনোই।সকালেই পরিচয় হয়েছে তোমার সাথে।

অর্ককে দেখিয়ে বললেন রেনুফা বেগম।রোশনি এতক্ষণ অর্ককে খেয়াল করে নি।কারণ অর্ক ওর ঠিক পিছনে বসে আছে।অর্ক টিভিতে গোপাল ভাঁড় দেখছে আর ক্ষনে ক্ষনেই খিলখিল করে হেসে উঠছে।রোশনি এক পলক অর্ককে দেখে বললো,

– হ্যাঁ,কিন্তু আমাদের রিসিভ করতে অর্ক না গিয়ে ড্রাইভারকে কেন পাঠালো?

রোশনির কথা শুনে টাশকি খেয়ে যায় আয়েশা আর রেনুফা বেগম।দুইজনেই নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আবার রোশনির দিকে তাকায়।রোশনি ওর উত্তর না পেয়ে রেনুফা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।হবু বউমার মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে আয়েশা বেগমের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন রেনুফা বেগম।এইদিকে আয়েশা বেগম রেগে আগুন।ছেলেটা এত অবাধ্য হয়ে গেছে?ও না গিয়ে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে ওদেরকে আনার জন্য?আয়েশা বেগম আঁড়চোখে অর্কের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন,

– ওদের রিসিভ করতে তুই যাস নি?

অর্ক মায়ের কথায় পিছনে না ফিরেই নরম গলায় বললো,

– গিয়েছিলাম মা!

আয়েশা বেগম একটু অবাক হন।অর্ক বলছে গিয়েছিল আর রোশনি বলছে যায় নি।আয়েশা বেগম সন্দিহান চোখে অর্কের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার কড়া গলায় বললেন,

– তাহলে কি বউমা মিথ্যা বলছে নাকি?

অর্ক উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে করুন গলায় বললো,

– তোমার ছেলেকে যদি দেখতে ড্রাইভার মনে হয় তাহলে এখানে আমার কি করার আছে বলো তো মা!

অর্কের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রোশনি।মুখ কিঞ্চিৎ হা করে আছে।আর চোখ তো কোটর থেকে প্রায় বেড়িয়েই আসে আসে।ওই অর্ক!

আয়েশা বেগম ছেলের কথা বুঝতে না পেড়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রোশনির সবটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো।নিজের বোকামির জন্য কিছুটা লজ্জাও পেয়েছে।রোশনি ধীর কন্ঠে বললো,

– সরি অর্ক।
– ইটস ওকে।
– কিন্তু তুমি বলো নি কেন যে তুমিই অর্ক?
– বলার আর সুযোগ পেলাম কই?তার আগেই তো আমাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিলেন।

রোশনি লজ্জা মাখা মুখে আরো একবার সরি বলে অর্ককে।কিন্তু রোশনি আর অর্কের কথার মানে আয়েশা বেগম বা রেনুফা বেগম কেউই বুঝতে পারছেন না।আয়েশা বেগম বললেন,

– তোমরা কি বলছো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

– আন্টি আমি বলছি!

মেহেনূর এসে রোশনির পাশে বসে।আয়েশা বেগম কৌতূহলী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেনূর সকালের ঘটনা খুলে বলে।মেহেনূরের কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ।তারপর রেনুফা বেগম আর মেহেনূর গিয়ে সবার জন্য দুপুরে খাবার নিয়ে আসে।আয়েশা বেগম খেতে না চাইলেও অর্ক ঠিকই সবার আগে গিয়ে টেবিলে বসে পড়ে।ছেলের এমন হেংলামো মোটেও উনার পছন্দ না উনার।তারপর সবাই একসাথে লাঞ্চ করে অর্ক আর আয়েশা বেগম মেহেনূরদের বাড়ি থেকে চলে আসেন।

চলবে……..…#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

৯.

বিকালের দিকে রাওনাফ রোশনি আমার মেহেনূর শহর দেখবে বলে বেড়িয়েছে।যাওয়ার সময় অর্ককেও এক প্রকার জোর করেই নিয়ে আসা হয়েছে।অর্ক কিছুতেই আসতে চাইছিল না। কিন্তু রোশনি কি আর কম চালাক মেয়ে।দুপুরের ওইটুকু সময়ের মধ্যে ঠিক বুঝে গেছে মায়ের একদম বাধ্য ছেলে অর্ক।রোশনি অর্ককে যখন ফোনে বললো ওদের সাথে যাওয়ার জন্য তখন অর্ক কাজের বাহানা দিয়ে না করে দেয়।তখন আয়েশা বেগমকে দিয়ে অর্ককে বাধ্য করেছে ওদের সাথে বেরুনোর জন্য।

অর্ক ড্রাইভ করছে আর বার বার লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাচ্ছে।পিছনে বসে থাকা রাওনাফ আর রোশনির মধ্যে চলা প্রেমালাপ ওর কানে আসছে।অর্কের কেন যেন বেশ আনইজি লাগছে।অর্কের পাশে বসে আছে মেহেনূর।কানে হেডফোন গুঁজে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।অর্ক মেহেনূরের দিকে বিরক্তির চোখে বার বার তাকাচ্ছে।এখন ওর খুব বোরিং লাগছে।রাওনাফ রোশনি নিজেদের মতো প্রেম করছে।আর মেহেনূর কানে হেডফোন গুঁজে কে জানে কি করছে?হয়তো গানই শুনছে!মেহেনূর শান্ত শিষ্ট মেয়ে ঠিক আছে!কিন্তু তার সাথেসাথে ও যে এতটা বোরিংও এটা অর্কের জানা ছিল না।অবশ্য না জানাটাই স্বাভাবিক।ওকে জানার চেষ্টা বা আগ্রহ কোনোটাই অর্কের মধ্যে নেই।তাও একটা মানুষ পানশে মুখে কতক্ষণ বসে থাকতে পারে?এবার নিজেকে সত্যি সত্যি ড্রাইভার মনে হচ্ছে অর্কের।নিজের কাজ ফেলে রেখে এসে এইভাবে বোরিং হওয়ার কোনো মানেই হয় না।চোয়াল শক্ত হয়ে আসে অর্কের।গাড়ির ব্রেক কষার সাথে সাথে চমকে উঠল পিছনের সিটে বসে থাকা রাওনাফ আর রোশনি।চোখ খুলে হুড়মুড় করে উঠে বসে মেহেনূরও।রাওনাফ লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাতেই দেখে অর্ক ওর দিকেই চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে।অর্কের রাগের কারণ বুঝতে সক্ষম হয় রাওনাফ।চোখ সড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখে অদূরেই চিরপরিচিত লেকের দেখা পেল।রাওনাফের দৃষ্টি ফিরে গাড়ির দরজা লাগানোর শব্দে।অর্ক গাড়ি থেকে নেমে ওর রাগটা বোধহয় দরজাটার উপরই ঝাড়লো।বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে মেহেনূর।অর্ক যে রাগী এটা ও জানে কিন্তু এখন আকস্মিক এই রাগের কারণ বুঝতে পারছে না।রোশনি বিস্মিত হয়ে বললো,

– অর্কের কি হয়েছে?

রাওনাফ মুচকি হেসে বললো,

– একটি সুদর্শন যুবককে ড্রাইভার বানিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞাস করছো “ওর কি হয়েছে?”

রাওনাফের কথা মানে বুঝতে না পেরে রোশনি ভ্রু কুঁচকে তাকায়।রাওনাফ গলায় স্বর উঁচু করে বললো,

– হয়তো একটু বেশিই বোরিং হচ্ছিলো।তাই হয়তো চলে গেছে!

রোশনি কপাল প্রশস্ত করে অস্পষ্ট স্বরে বললো,

– ওহ!

মেহেনূর গাড়ি থেকে নেমে লেকের দিকে এগোলো।রোশনি আর রাওনাফও গাড়ি থেকে নেমে মেহেনূরের পিছন পিছন যাচ্ছে।কিছুটা পথ যেতেই অদূরে অর্কের দেখা পেলো মেহেনূর।মুখে স্মিথ হাসি ফুটে উঠে।হাসির কারণটা হয়তো অর্কের রাগের বাহার দেখে!লেকের পাড় ঘেঁষে পেতে রাখা বেঞ্চটাতে বসে লেকের পানিতে আপন মনে ঢিল ছুড়ছে অর্ক।গলা খাঁকারির শব্দ শুনতেই হালকা নড়েচড়ে উঠলো অর্ক তবে চমকায় নি।আরেকবার গলা খাঁকারির শব্দে মাথা ঘুরিয়ে পাশ ফিরে এক পলক তাকিয়ে ফের নিজের কাজে ব্যস্ত অর্ক।রোশনি এসেছে!বেঞ্চের অবশিষ্ট জায়গাটা দখল করে নিলো।অর্কের হাত থেকে এক টুকরো পাথর নিয়ে রোশনিও ঢিল ছুড়লো লেকের পানিতে।আরেকটা পাথর নিতে নিতে শীতল কন্ঠে বললো,

– সেদিন তোমার দেখাটাই শেষ দেখা ছিল না অর্ক!

অর্ক বিস্ফোরিত চোখে রোশনির দিকে তাকায়।রোশনির হাতে থাকা পাথরটা লেকের পানিতে বিলীন করে দিয়ে ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ছাড়ে।অর্কের প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

– পনেরো বছর আগে,সবে টিনএজ এ পা দিলে তোমরা।তখন চোখে রঙিন চশমা!কলেজ লাইফে দুজনেই জীবনের প্রথম প্রেমে পরলে তাও আবার একই মেয়ের!দুজনের কেউই জানতে না তোমাদের ভালোবাসার মানু….না ভালোবাসার মানুষ বলে ভালোবাসাটাকে আর ছোট করতে চাই না!যদিও তোমরা তখনো ভালোবাসার আসল সঙ্গাটাই বুঝতে শিখো নি!ওই যে বললাম টিনএজ!চোখ তখন চাকচিক্যময় সামগ্রীতে ঠাঁসা!যাইহোক বাদ দাও।তো কি যেন বলছিলাম?ও হ্যাঁ মনে পরেছে।দুজনের কেউই জানতে না তোমাদের পছন্দের মানুষটি একজনই।শুধু জানতে রাওনাফ কারোর প্রেমে পরেছে আর রাওনাফ জানতো তুমি কারোর প্রেমে পরেছো।দুজনের কেউই কাউকে সেই ব্যাক্তির নাম বা পরিচয় বলো নি।ভালোবাসার দিবস হিসেবে বরাদ্দ দিনটাকেই বেচে নিলে তোমরা।বলেছিলে ওইদিনই একজন আরেক জনের সাথে তোমাদের প্রিয় মানুষটিকে পরিচয় করিয়ে দেবে।বহুল প্রতিক্ষিত দিনটি যেদিন এলো সেদিন দুজনেই বাসা থেকে বের হলে একই সময়ে একই সাজে, সাদা পাঞ্জাবীতে!তবে দুজন চলে গেলে দুই রাস্তায়।রাওনাফ ওর প্রেমিকাকে নিয়ে…..

এতটুকু বলেই থেমে যায় রোশনি।চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,

– আ’ম নট শিওর!বাট রাওনাফের মুখে বর্ণনা শোনে যা মনে হচ্ছে সম্ভবত এই লেকের ধারেই ওইদিন রাওনাফ ওর প্রেমিকাকে নিয়ে এসেছিল?

আবার থামে রোশনি।জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় অর্কের দিকে।অর্ক বুঝতে পেরেছে রোশনি ওদের অতীত সম্পর্কে অবগত।তাচ্ছিল্যে হাসে অর্ক।রোশনি উত্তর পেয়ে গেছে।একটু দম টেনে নিয়ে বললো,

– তোমারো এই লেকের ধারেই আসার কথা ছিল।তুমি এসেও ছিলে!কিন্তু যখন তোমাকে বলা হলো,মুনমুনকে রাওনাফ জোড় করে কিস করেছে তখন তুমি ওই মেয়েটার কথা বিশ্বাস করলে আর প্রথম বারের মতো নিজের প্রানপ্রিয় বন্ধুর গায়ে হাত তুললে!রাওনাফের বলতে চাওয়া কথাগুলো শুনতেই চাও নি!তোমাকে ভুল বোঝানো হলো আর তুমি ভুলই বুঝলে?ওকে ভুল বুঝে চলে গেলে?বরাবরের জন্য!

অর্ক আরো একবার বিস্ফোরিত চোখে তাকায় রোশনির দিকে।ভুল?কি ভুল ছিল?মুনমুন যেটা বলেছিল সেটা?নাকি যেটা ও নিজের চোখে দেখেছিল সেটা?অর্ক উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,

– কোনটা ভুল ছিল?যেটা আমি…..

– দুইটাই!

অর্ককে বলতে না দিয়ে রোশনি বললো।অর্ক হতভম্ব হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো।রোশনি আবার বললো,

– ওইদিন রাওনাফ কোনোভাবে জানতে পেরে গিয়েছিল শুধু ও না তুমিও মুনমুনকেই পছন্দ করো।আর এটাও জেনে গিয়েছিল মুনমুন একসাথে তোমাদের তুই বন্ধু সাথেই গেইম খেলছে।বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে এই খেলায় মেতে উঠেছিল ও।কিন্তু অভিনয় করতে করতে মুনমুন সত্যি সত্যি রাওনাফকে ভালোবেসে ফেলে।তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহস রাওনাফ কখনোই দেখাতে পারতো না।তাই মুনমুনের এই নোংরা খেলার সমাপ্তি ঘটাতে ওকে বলেছিল তোমার কাছে ফিরে যেতে।কিন্তু মুনমুনকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলো না।মুনমুন রাওনাফকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে।কিন্ত তাঁতেও রাওরাফের মন নরম হলো না।রাওনাফ চলে আসতে নিলেই মুনমুন হঠাৎ করেই আর্তনাদ করে উঠে।রাওনাফ ব্যাতিব্যস্ত হয়ে ওর কাছে গিয়ে জানতে চাইলো হয়ে কি হয়েছে?তখন মুনমুন উতলা হয়ে বলল ওর চোখে কিছু একটা পরেছে।ব্যাস!পরমুহূর্তেই তোমার আগমন ঘটে।কিন্তু ওই দিন তোমার দেখা বা মুনমুনের বলা কোনোটাই সত্যি ছিল না!তুমি ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর মুনমুন রাওনাফকে বলেছিল,

– আমার প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে রাওনাফ!অর্ক আমাদের পথের কাঁটা ছিল না?তুমি ওর জন্যই আমাকে অস্বীকার করছিলে না?নাও এখন রাস্তা ক্লিয়ার।তোমার আর আমার মাঝখানে ও আর জীবনেও আসবে না!এবার আমায় স্বীকার করো।

সপাটে চড় পরলো মুনমুনের গালে।মুনমুন গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে।রাওনাফের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে।চোখের দৃষ্টি দিয়েই যেনো ওকে ভস্ম করে দেবে। চোয়াল শক্ত করে কঠোর গলায় বললো,

– তোর সাহস কি করে হয় এটা বলার?এতকিছুর পরেও আমি তোকে স্বীকার করে নেবো?তুই ভাবলি কি করে যে,তুই একটা মিথ্যাবাদী বিশ্বাসঘাতক ছলনাময়ী এটা জানার পরেও আমি তোকে মেনে নেবো?তাও আমি শুধু অর্কের জন্যই চুপ ছিলাম!কিন্তু তোর এই নোংরা মানসিকতার পরিচয়ের পরে তো আমিই তোকে ওর জীবনে ফিরে যেতে দেবে না।তুই তো আমার বা ওর কারো জীবনেই স্থান পাবি না।মাঝখানে আমাকে কলঙ্কিত করে দিলি?ওর চোখে আমাকে দোষী বানিয়ে দিলি?এই বুঝি তোর আমার প্রতি ভালোবাসা ছিল?তোর ভাষায় এটাকেই বুঝি ভালোবাসা বলে?তুই যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতি তাহলে তো তুই চাইলে সত্যিটা অর্ককেই বলে দিতে পারতি।আমি যেমন সরে আসতে চেয়েছি?ঠিক তেমনি অর্কও সরে যেতো কোনো বাক্য ছাড়াই!

মুনমুনের অন্যগালেও থাপ্পড় পড়ে রাওনাফের।কিন্তু আশ্চর্য!মুনমুনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে,

– এই বুঝি তোমাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসার অন্ধবিশ্বাস?এই বন্ধুর জন্য তুমি আমায় গ্রহণ করতে পারছো না?যে বন্ধ কদিনের পরিচিত একটা মেয়ের কথা বিশ্বাস করে এত দিনের বন্ধুত্ব ছিন্ন করে চলে যাতে পারে সে আর যাইহোক কখনো পরমবন্ধু হতে পারে না!

রাওনাফ নিরুত্তর ছিল।মুনমুনের কথার প্রত্যুত্তর করার মতো কোনো শব্দই ও খুঁজে পেলো না।তোমাদের নিজেদের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝির কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা সেই নোংরা ঘটনার কথা কিভাবে বলতো সবাইকে?কাউকে মুখ ফুটে কিচ্ছু বলতে পারে নি।হয়তো বুকের চাপা কষ্টটা বুকে চাপা দিয়েই সহ্য করে নিয়েছিল!নিজের শরীরে সূর্যের আলোটা অব্দি পড়তে দেয় নি।নিজেকে সম্পূর্ণ ঘরবন্ধি করে নেয় যতদিন না কানাডার ভিসা পাচ্ছে ততদিন!বাবা মা ওর এমন ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে বলতো, বিদেশের মাটিতে পড়াশোনার ভিত্তিটা শক্ত করে নিচ্ছে!অবশেষে ও সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল ওই অচেনা শহরে।মেহেনূরের বয়স তখন আর কত ছয় কি সাত।ভাইকে ছাড়া থাকতে পারে না বলে ওকেও সাথে করে নিয়ে যায় রাওনাফ।এতবছরে একটা বারের জন্যও দেশে আসতে চায় নি!যখন বাবা মায়ের জন্য মন বেশি উতলা হয়ে উঠতো তখন উনাদেরকেই নিয়ে যেতো কানাডায়।মেহেনূর মাঝে মাঝে আসে।তবে ভাইয়ের এই বিষাদের শহরে ওরো মন বিষিয়ে যায়!ওরো নাকি এই শহরের মানুষদের বড্ড বেশি স্বার্থপর মনে হয়।যে শহরে ওর ভাইকে বুঝার মতো শেষ মানুষটিও অবশিষ্ট রইলো না সেই শহরে ফিরতে ওউ বিমুখী।তবে এবার কিন্তু রাওনাফ আমার প্রেমে পড়ে নি!আমি পড়েছি বারংবার!

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো রোশনি।অর্কের দিকে করুন চোখে তাকায়।অর্কের চোখ থেকে বিরামহীন অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়ছে।রোশনি বুঝতে পারছে ওর অগোচরে থাকা অনেক বড় একটা সত্যের মুখোমুখি হয়েছে অর্ক।নিজেকে সামলানোর জন্য ওর একটু সময় প্রয়োজন!ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় রোশনি।

– কলঙ্ক তো আমি করেছি।

কদম ফেলতে গিয়ে থেমে যায় রোশনি।ফিরে অর্কের দিকে।অর্ক তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

– কলঙ্ক করেছি আমি,দোষী আমি!অথচ শাস্তি পেলো ও।

অর্ক একটু থেমে হতাশার সুর টেনে বললো,

– আমিও পুড়েছি এতগুলো বছর,প্রতিমুহূর্তে।কিন্তু ওইদিনের ঘটনার কথা মনে পড়তেই জন্মানো অনুভূতি গুলো ঘৃণায় পরিনত হতো।অথচ সেই ঘৃণ্য বর্বরোচিত ব্যক্তিটি ছিলাম আমিই!

শেষ কথাটা বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে অর্কের।রক্তিম দৃষ্টি দিয়ে রাওনাফকে আবিষ্কার করলো ঠিক ওর অপজিটে একটু দূরে।রোশনি কিছু বুঝে উঠার আগেই হনহনিয়ে চলে গেল অর্ক।এক পলক অর্কের দিকে তাকিয়ে রোশনি আবার বেঞ্চে বসে পড়ে।আপন মনে অর্কের করা কাজের রিপিট করতে লাগলো।বিষয়টা বেশ ভালোই লাগছে ওর কাছে।রোশনির টনক নড়ে পানিতে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here