অঙ্গারের নেশা, পর্ব:২৫+২৬

“অঙ্গারের নেশা”
পর্ব-২৫

অন্যান্য দিনের চেয়ে সেই সকালটা ছিলো অন্যরকম।
আকাশ তখন হলদে রঙে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। নারীর দেহে অলংকারের ন্যায় আকাশেরও হলদে রঙ বেশ শোভা ছড়াচ্ছে। না আছে রোদ আর না আছে কোনো মেঘলা ভাব। চমৎকার একটা পরিবেশ। এরকম একটা সময়ে ভালোবাসার মানুষের হাতটা যদি নিজের মুঠোয় থাকে তাহলে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে বেশি কিছু লাগে না।
হসপিটালের ৩০৯ নাম্বার কেবিনে আড়াআড়ি ভাবে লম্বা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুফিয়ান। জানালার বাহিরের সৌন্দর্যে মোড়ানো এক টুকরো অপার্থিব দৃশ্য উপভোগ করছিলো। একাকিত্বের এই মূহুর্তগুলোতে প্রানেশার স্মৃতিগুলো খুব কঠোর ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে অতৃপ্ত শ্বাস।
পাশের ঝুলানো ক্যালেন্ডারে লাল কালির দাগ জ্বলজ্বল করছে৷ সুফিয়ানের মনে পড়লো, আজ নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে চলে এসেছে ৫ বছর ৩ মাস। এর আগে চারটা ক্যালেন্ডারেও সে এভাবেই লাল কালির একটা দাগ কেটে দিতো৷ কোনো লাভ নেই, কিন্তু কোথায় কিছু একটা ভালো লাগে তার৷ গায়ে সাদা রঙের একটা শার্ট ইন করা। পাশের ডেস্কে সার্জিক্যাল স্যুট, গ্লাভস, মাস্ক পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আজ তার পাঁচ নাম্বার অপারেশন ছিলো।
নতুন ডাক্তার হওয়ায় খুব বেশি অপারেশন করে না সে৷ সার্জারির জন্য বেশি প্রেশার পড়লে তবেই করে।
এখন, মেডিসিনের উপর ২ বছরের একটা কোর্স করবে ঠিক করলো। নাহলে, শুধু সার্জারী করে আত্মতুষ্টি পাওয়া যায় না বলে মনে করে সুফিয়ান। ঠিক করলো, মেডিসিন কোর্স শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সে বাংলাদেশেই ফিরবে না। এতগুলো দিনে একবারো বাংলাদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। ইচ্ছে যে হয়নি তা না, বরং মাকে, রেয়ুকে খুব মনে পড়েছে কিন্তু বললেই যে বাংলাদেশে চলে যেতে মন চাইবে।
জাস্টিন বেইবারের ‘বেবি ‘ গানের রিংটোন বেজে উঠতেই হাল্কা চমকপ্রদ হলো সুফিয়ান। ডেস্কের কাছে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। ‘ইভ’ নামটা উঠে আছে৷ সুফিয়ানের চোখে তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। যে তার বিপদে আপদে মনে রাখে, ঠিক এমনটাই তো মনে করে সুফিয়ান!
কল রিসিভ করে কানে তুলতেই শোনা গেলো সুর টেনে ইভানান বলছে-
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ‘

সুফিয়ান অবাক হয়ে গেলেও পরে মনে করলো আজ তার জন্মদিন। এত ব্যস্ততায় সে ভুলে বসেছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-
‘তুইও না! বুড়ো হয়ে বাচ্চাদের মতো বার্থডে উইশ করিস ‘

ইভানান হাসতে হাসতে বললো-
‘আমি কী আর তো মতো বুড়ো নাকি! আই এম ফিট এন্ড ফাইন। ত্রিশ পেরোলেই না তার আগেই তুই বুড়োর মতো গম্ভীর হয়ে থাকিস বুড়োদের মতো আচরণ করিস’

‘মনের রঙ ঘুচে গেলে তখন আর নিজেকে জুয়ান মনে হয় না, শরীর তরতাজা থাকলেও মনটা মরা মাছের মতোন ‘

‘হয়েছে, এবার তোর জ্ঞান শুরু করে দিস না। ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –

‘আচ্ছা তা না হয়, না দিলাম। তোর খবর কী বল, দুই বছর ধরে আলাদা থাকছিস’

‘এখানে থেকে আমি একটু শান্তি অনুভব করি। প্রকৃতির রূপে ডুবে থাকি, আমি তো চাকরি- বাকরি
করবো না। তাই, আঁকাআকি করে এক্সিবিশন গুলোতে যা পাই তা দিয়েই চলি ‘

‘হাহাঃ আমি দুইটা সার্জারী করেও যা পাইনা তার ডাবল তুই একটা এক্সিবিশনেই পেয়ে যাস। ‘

প্রতুত্তরে হাসলো ইভানান। সত্যি বলতে প্রচুর টাকার মালিক ইভানান। প্রকাশ না করলেও তা সুফিয়ান ভালোই জানে। বেশ ভালো একটা হোটেলে থাকছে এখন সে, প্রতি ছয় মাস পরপর নানান হোটেল বুক করে ঘুরাফেরা করে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –

‘ওহ শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ‘

‘সারপ্রাইজ! ‘

‘হ্যা, তোর জীবনের সেরা উপহার হবে এটা সুফি’

সুফিয়ান হেঁসে বললো –
‘ঠিক আছে, টাইম ইজ স্টার্ট নাও ‘

কল কেটে দিতেই সুফিয়ান নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ৷ দুই মিনিট পর ডোরে কেউ নক করায় ভ্রু কুচকে সুফিয়ান বললো-
‘ কাম ইন ‘

বিদেশি কালোমতো একটা ছেলে ভেতরে এসে গুড মর্নিং বললো৷ এখন বাজে সাড়ে এগারোটা, তাই গুড মর্নিং শুনে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুফিয়ান তাকালো। ছেলেটার হাঁটু কাপছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো-

‘সে ইট কুইকলি ‘

ছেলেটা কেঁপে কেঁপেই বললো-

‘এ ম্যান হ্যাজ কাম টু সি ইউ, স্যার’
(আপনার সঙ্গে একজন লোক দেখা করতে এসেছে স্যার)

সুফিয়ান হাতের বইটা সাইডে রেখে বললো –
‘নেম? ‘

‘তনিম ‘

সুফিয়ান চকিতে তাকালো। তনিম! এখানে তার সাথে দেখা করতে কেনো এসেছে! তনিমকে তো সে প্রানেশার খোঁজ নিতে পাঁচ বছর আগে পাঠিয়েছিলো।
মাথা তুলে বললো-

‘সেন্ড হিম ‘

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পরই ভেতরে স্যুট প্যান্ট পড়া ভদ্রলোক আসলো৷ সুফিয়ান বেশ খানিকটা অবাক হলো৷ তনিম যে এতটা বদলাবে ভাবেনি। উঠে দাঁড়াতেই তনিম তার স্বভাবমতোন সুফিয়ানের কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ান পিঠ চাপড়ে বললো-
‘কী ব্যাপার তনিম? কেমন আছো?’

তনিমকে অনেক উত্তেজিত দেখালো৷ যেনো কিছু বলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে সে৷ সুফিয়ানের প্রশ্নে বললো –

‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই, ভালো আছি ‘

কিছুটা থেমে আবার বললো-
‘ভাই, আপনাকে কিছু কথা বলা অনেক জরুরি। ‘

‘ঠিক আছে, বসো আগে ‘

তনিম সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। হাতের তালু কচলে আমতাআমতা করতে করতে বললো –

‘ভাই, একটা ভুল হয়ে গেছে ‘

সুফিয়ান ভ্রু বাকিয়ে বললো-
‘কী ভুল তনিম?

তনিম আচমকা ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেললো৷ সুফিয়ান থতমত খেয়ে বললো-
‘আরে! কাঁদছো কেনো? কী হয়েছে বলবে তো?’

‘অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে ভাই। পাপ করেছি আমি, আজ শাস্তি ভোগ করছি, পাঁচ বছর আগের করা ভুলের মাশুল গুনছি আমি ‘

এতটুকু বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো তনিম। সুফিয়ান তনিমের কাঁধে হাত রেখে বললো –

‘কী করেছো খুলে বলো ‘

তনিম দুই হাতে চোখ মুছে নিলো৷ লম্বা শ্বাসে বললো-

‘আপনি তো জানেনই ভাই, আমি গরীব ঘরের ছেলে। এলাকায় বড় ভাই টাইয়ের সাথে ঘুরতাম তাই মানুষ চিনতো৷ বাবা যখন মারা গেলো, তার কয়েক দিন পরই আবার মায়ের একটা কিডনি নষ্ট হলো৷ আমি আকূলপাথারে পড়লাম৷ তখন আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি সাহায্যের জন্য সবার আগে আপনার কাছে গেলাম, কিন্তু আপনি তো হসপিটালের বেডে তখন৷ তবুও, আপনাকে দেখার জন্য একবার হসপিটালের ভিতর ঢুকলাম। দেখে চলে আসছিলাম, ঠিক তখন পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকলো। ফিরে দেখি ইভানান ভাই। আমি তাকে দেখে সালাম দিলাম, সে আগে থেকেই বোধ হয় আমার মায়ের ব্যাপারটা জানতো৷ সে নিজে থেকেই আমাকে দশ লাখ টাকা দিলো৷ আমি মানা করলে জোর করে টাকা দিলো৷ আমি ভেবেই নিলাম, আপনার বন্ধুও আপনার মতোন বড় মনের মানুষ। আমার মায়ের অপারেশনের পর, আমি যখন বাড়ি ফিরলাম। সে বললো আমাকে তার হয়ে একটা কাজ করতে হবে। তা নাহলে, পাঁচ দিনের মাঝেই টাকা ফেরত দিতে হবে। আমার ঘাম ছুটে গেলো৷ পাঁচ দিনের মাঝে টাকা দেয়া কোনো ভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না তা ইভানান ভাইও জানে।
আমি বুঝলাম, বড় কোনো কাজ করাতেই সে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। কোনো উপায় না পেয়ে আমি সায় দিলাম। সে বললো ফোনে কাজ বুঝিয়ে দিবে। তার কয়েক দিন পরই আমাকে সকালে ফোন দিয়ে বললো আমি যেনো বলি প্রানেশা ভাবির আরেক জায়গায় সম্পর্ক আছে, আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। আমি তার হাত পায়ে ধরে অনুরোধ করে বলেছি এসব করতে পারবো না। কিন্তু, টাকার হুমকি দেয়ায় কাজটা করতে বাধ্য হলাম৷ যখন আপনাকে বললাম ভাবীর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে তখন সে বললো, মায়ামতী ঝিলের কথাটা বলতে ৷ বলার পরে যে আপনি এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসবেন আমি ভাবিনি ‘
কিছুটা থেমে তনিম আবারও রেয়ানের চেহারা সহ সবকিছু খুলে বললো৷

সুফিয়ান স্থির হয়ে সবকিছু শুনছে৷ এখনও বিশ্বাস করে ওঠতে পারছে না। যাকে এতোটা বিশ্বাস করলো সে কিভাবে এমন করবে! সুফিয়ান থমকে যাওয়া চোখে বললো-
‘ইভানান! ‘

তনিম সুফিয়ানের মুখপানে চেয়ে বুঝতে পারলো ধোঁকায় সুফিয়ান কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।
তনিমের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো-
‘তুমি এখন যাও তনিম ‘

তনিম নিঃশব্দে হেঁটে বাহিরে চলে গেলো৷ সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে দুই মিনিট ধাতস্থ হলো, চোখ খুলতেই বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে টুপ করে নিচে পড়লো। এই তাহলে মূল্য দিলো ইভানান তার বন্ধুত্বের। বাহ! চমৎকার। তনিম সবকিছু বললেও ইভানান কেনো এসব করেছে তা বলেনি৷ সুফিয়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । উঠে দাড়িয়ে রওনা হলো ইভানানের হোটেলের উদ্দেশ্যে।
ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে আধা ঘণ্টায় রাস্তা পাড় করে ফেললো৷ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইভানান যদি সত্যিই এসব করে তাহলে জান নিয়ে ছাড়বে ওর।
উপরে উঠতেই বিশাল রুমের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো৷ হাসতে হাসতে কেউ একজন বললো-

‘সারপ্রাইজ কেমন লাগলো বন্ধু? ‘

সুফিয়ান রেগে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান হাত
ভাজ করে খাটের উপর বসে আছে। সুফিয়ান ঠাস করে গালের উপর চড় বসিয়ে দিলো। ইভানানের ঠোঁটের হাসি মুছেনি৷ সে তার হাসি আরও বিস্তৃত করলো। সুফিয়ান মারতে মারতে হাঁপিয়ে উঠলো৷ দূরে সরে এসে বললো-

‘তোর এখনো লজ্জা করছে না? ‘

ইভানান হেসে বললো –
‘নাহ, কারণ এসব তো আমিই সাজিয়েছি। আমি না চাইলে তনিম এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতো না৷ আজ মা মরেছে বলে জানপ্রাণ নিয়ে ছুটে এলো ‘

‘এসব কেনো করলি তুই?’

‘এখনও বুঝিসনি? ‘

সুফিয়ান চিৎকার করার স্বরে বললো –
‘না বুঝিনি, এসব কেনো করলি?’

ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –
‘কারণ আমি চাই, তুইও বুঝিস যে আপন মানুষ থেকে দূরে থাকা ঠিক কতটা কঠিন সঙ্গে যখন নিজের বন্ধুর কারণেই হয় ‘

সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘ কেনো? ‘

‘কেনোনা তুই পাঁচ বছর আগে আমার সঙ্গেও এটাই করেছিলি, আমার ইনু শুধু মাত্র তোর কারণে মারা গেছে। তুই যদি আমার বোনকে কষ্ট না দিতি আত্মহত্যা কখনো করতো না ‘

‘ইনায়াকে আমি আত্মহত্যা করতে বলিনি ইভ!’

‘বলিসনি কিন্তু বাধ্য করেছিস, আমার সহজসরল বোনটাকে শেষ করেছিস। আর তাই তোর কাছে থেকে বদলাস্বরূপ আমি তোর ভালোবাসাকে সরিয়ে দিলাম তোর কাছে থেকে দূরে ‘

সুফিয়ান বুঝতে পারলো একে বলে কিছু লাভ নেই।
ইভানান যে বোনের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই ইভানানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো-
‘যাই করিস, এবার প্রানেশাকে আমি আমার কাছে আনবোই ‘

সুফিয়ান বের হওয়ার পর ইভানান উচ্চস্বরে বললো –
‘কী করে হয় আমি দেখবো সুফি ‘

সুফিয়ান সেদিকে কান না দিয়ে চলে গেলো। দুইদিন পরই বাংলাদেশে চলে গেলো৷ মা আর বাবাকে ইভানান, রেয়ানের কাজের কথা বললো। মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব অবাক হয়ে গেলেন৷ কারণ, রেয়ান চেহারা পাল্টে যে এই ভয়ংকর খেলায় মেতেছে। সুফিয়ান মিসেস অদিতিকে বললো প্রানেশার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে ৷ আর বিয়েতে যেনো সমস্যা না হয় তাই রেয়ানকে সিঙ্গাপুর পাঠালেন রাহাত সাহেব। তার আট দিন পরে হুলুস্থুল করে প্রানেশাকে বিয়ে করে নিলো।

বর্তমান –
সুফিয়ান ফুঁপানোর শব্দে পাশে ঘুরলো৷ প্রানেশা ঠোঁট চেপে কাঁদছে। সুফিয়ান অস্থির ভাব উঠলো। প্রানেশাকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। প্রানেশা সুফিয়ানের গলা জড়িয়ে কাঁধের একটু নিচে মাথা রেখে আদুরীর মতো বললো-

‘ভালোবাসি অঙ্গার’

চলবে…..

“অঙ্গারের নেশা”
পর্ব-২৭

আজ আনন্দরা দলবদ্ধ হয়ে যেনো ধরা দিয়েছে। কী সুন্দর অনুভূতি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর ঘটনা বুঝি এটিই?
নাহলে সুফিয়ানের চোখের কোণে জল জমবে কেনো?
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের ভিতর ভর করলো সজীবতা।
ক্লান্ত হয়ে ফিরে যে এত বড় সুসংবাদ পাবে ভাবতেই পারেনি সে৷ হাতে এখনো চিরকুট মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট কাঁপছে, চোখের জল গড়িয়ে পড়বে খানিক বাদে। সুফিয়ান কাঁপন ধরানো পায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দায়। প্রানেশার গায়ে কমলা রঙের সুতি শাড়ি। রেলিংএ হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। সুফিয়ান নিঃশব্দে প্রানেশাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সুফিয়ান কাঁধে থুঁতনি রেখে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো –
‘এটা কী সত্যি? ‘

প্রানেশা নির্লিপ্ত ভাবে বললো –
‘হু’

সুফিয়ান প্রানেশাকে নিজের দিকে ফেরালো। প্রানেশার উদাস হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘কিছু নিয়ে মন খারাপ প্রাণ? ‘

প্রানেশা হুট করে রেগে উঠলো। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো –
‘ডাক্তার হতে কে বলেছিলো আপনাকে?’

সুফিয়ান বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো-
‘এ্যা!’

‘এ্যা কী? কয়টায় আসার কথা ছিলো আজ? ‘

সুফিয়ান এবার অভিমানের কারণ বুঝলো। শুক্রবার থাকা সত্বেও হসপিটালের কাজে ব্যস্ত ছিলো আজ। প্রানেশা সকালে বলেছিলো একটু তাড়াতাড়ি আসতে। সুফিয়ান বলেছিলো ‘চেষ্টা করবো’। কারণ দ্রুত আসবো, এটা ডাক্তারী পেশায় যুক্ত হওয়ার পর আর বলা যায় না। দ্রুত আসার চেষ্টা করলেও পারেনি সুফিয়ান, কারণ প্যাশেন্ট বেশি ছিলো। সুফিয়ান অসহায় মুখ করে বললো –
‘সরি প্রাণ ‘

প্রানেশার অভিমানের কারণ আছে বটে। সে যে সন্ধ্যা থেকে সুফিয়ানের অপেক্ষা করছিলো৷ শাড়ি পড়ে এই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো। সুফিয়ানের উপর খুব অভিমান হলো তার। এই স্পেশাল একটা দিনেও কী কেউ দেরি করে!

প্রানেশার বিস্তর ভাবনার থেকে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সুফিয়ান প্রানেশাকে কোলে তুলে নিলো৷ প্রানেশা হকচকিয়ে হয়ে তাকিয়ে দেখলো সুফিয়ানের মুখের উজ্জ্বল প্রাণবন্ত হাসি। প্রানেশাকে কোলে তুলে চারপাক ঘুরলো সুফিয়ান। বিছানায় বসে সুফিয়ান প্রানেশাকে নরম হাতে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা অবাক হয়ে হেসে নিজেও বাহুতে জড়িয়ে নিলো৷ সুফিয়ানের শরীর কম্পমান। মৃদু মৃদু কেঁপে উঠছে৷ প্রানেশা বললো-
‘আপনি কী কাঁদছেন? ‘

সুফিয়ান ধাতস্থ হয়ে প্রানেশার কোলে মাথা রাখলো৷ উদরের আঁচল সরিয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। প্রানেশা আলতো হাতে সুফিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো৷ সুফিয়ান মাথা হালকা উঁচু করে বললো –

‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না প্রাণ! ‘

পরক্ষণেই প্রানেশার হাত নিজের হৃদপিণ্ডের জায়গাটায় রেখে বললো –

‘আজকে তুমি যা চাও তাই পাবে, বলো প্রাণ কী দিতে পারি আমি ‘

প্রানেশা খানিক নড়েচড়ে বসলো। যেনো খুব বড় কিছু চাইবে সে। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘সত্যি? যা চাইবো তাই দেবেন!’

‘একদমই তাই’

প্রানেশা সুফিয়ানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো-

‘তবে, এই পারিবারিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিন ‘

সুফিয়ানকে শান্ত দেখে আরেকটু সাহস জমিয়ে বললো-
‘ আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না, আপনার সন্তানও আপনার আর রেয়ানের মতোন একা একা বড় হোক। আপনার মা বাবা দুজনেই বেঁচে ছিলেন কিন্তু দ্বন্দ্ব, ধোঁকা এইসব কিছু সবার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে। আপনি ঠিক থাকতে পারলেও, রেয়ান পারেনি। ইভানানের প্রতিশোধের স্পৃহায় রেয়ানের একাকিত্বকেই ব্যবহার করেছে হাতিয়ার হিসেবে। ‘

কিছুটা থেমে বললো-
‘নিজেকেও তো কম কষ্ট দিচ্ছেন না! বাবার চোখেও আমি অনুতপ্ততা দেখেছি। আগে সে হয়তো একটা ভুল করেছে, টাকার লোভে আপনাদের ঠকিয়েছে। কিন্তু কম শাস্তি তো পায়নি৷ ওই সংসারে সন্তান ছিলো না, আপনাদের কাছে আসতে চেয়েও পারেনি। সেও কিন্তু তার ভাগের শাস্তি পেয়েই গেছেন। এখন যেহেতু সে অনুতপ্ত, আপনার উচিত এক কদম বাড়ানো। বাকিটা তার উপর ছেড়ে দিন ‘

সুফিয়ান মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ কথা শুনে বললো-

‘আমি চেষ্টা করবো, প্রাণ’

বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে। প্রানেশাও লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। এবার কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত। সুফিয়ান যেহেতু বলেছে চেষ্টা করবে তাহলে কিছুটা হলেও করবে৷ ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার কারণও প্রানেশা জানে। জীবনের কিছু মুহূর্তে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আমাদের নিতে হয়। তখন একাকী থাকাটা খুব প্রয়োজন।

গ্রীষ্মের টগবগে গরমকাল৷ আম,কাঁঠালের পদার্পণ ঘটেছে এরইমধ্যে। ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছিলেন মিসেস অদিতি। রাহাত সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। পায়েশ নানা রকম পিঠে দিয়ে ভরপুর টেবিল ৷ গ্রীষ্মের গরমে পিঠের আয়োজন অনেকটাই বেমানান। কিন্তু, প্রানেশার নাকি এসবই খাওয়ার স্বাদ জেগেছে। প্রেগ্ন্যাসিতে মেয়েরা টক ঝাল নাকি বেশি খায়। কিন্তু প্রানেশার শুরু থেকেই মিষ্টির প্রতি দারুণ আকর্ষণ। নিজের মা যখন আচার, টক ঝাল খাবার পাঠাতে চেয়েছিলো তখনও সে মিষ্টি পাঠাতে বলেছে। কয়েক দিন বাপের বাড়ি থেকেও এলো সে৷ সুফিয়ানও বউয়ের পিছনে পিছনে সেখানে থেকেছে। কী আর করবে, একরাত নিজের বাড়িতে কাটিয়ে নিজের বেহাল দশা করে ফেলেছিলো সে৷ প্রানেশার থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে অন্তত সম্ভব বলে মনে হয়না।
প্রানেশার আট মাস চলছে৷ আগের পাতলা ফড়িংয়ের মতো শরীরটা হালকা মুটিয়েছে৷ পেট অনেকটাই উঁচু হয়েছে। সুফিয়ানের কড়া নিরাপত্তা, মিসেস অদিতির আদর, রাহাত সাহেবের স্নেহে ভালোই দিন কাটছে প্রানেশার।
সুফিয়ান তখন হসপিটালের একটা অপারেশনে ব্যস্ত ছিলো৷ প্রানেশা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে মুখ মুচ্ছিলো৷ মোবাইলের টুংটাং আওয়াজে মুচকি হেসে উঠলো প্রানেশা। সুফিয়ান দশ মিনিট পরপরই কল করতে থাকে। হয়তো এখন মেসেজ পাঠিয়েছে ভেবেই মোবাইলটা হাতে নিলো। মেসেজ অপশন অন করতেই মাথা ঘুরে গেলো। প্রানেশার চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে টুপ করে পড়লো পায়ের আঙুলে। সুফিয়ানের সঙ্গে চার পাঁচটা মেয়ের বিছানায় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি। প্রানেশার দুর্বল শরীর আর নিতে না পেরে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে রইলো৷ দূর্ঘটনার হাত থেকে আর রেহাই পাওয়া গেলো না অবশেষে। প্রানেশার মাথাটা ড্রেসিং টেবিলের উপর বাড়ি খেয়ে রক্তের ফোঁটায় রঞ্জিত হয়ে গেলো ফ্লোর।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here