অচিত্তাকর্ষক পর্ব -০২

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২|

রাতে গাড়ি নিয়ে সবাই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির কর্তা মজুমদার আহমেদ, তার ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে ছুটলেন বড়ো ছেলেকে আনতে। আর বাকি মহিলারা সব বাড়িতেই রইল। নিধি মাঝে একবার বলেছিল সে যাবে, কিন্তু পরে ভাবলো সারারাত এত জার্নি করলে সকালে দেখবে চোখ মুখ বসে গিয়েছে। আর ঐ মুখ নিয়ে সে কোনোভাবেই জুভানের সম্মুখে যেতে পারবে না। তাই সে পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত টা বাতিল করে।

পুরো টা দিন অনেক খেটেছে স্মৃতি। শরীর এখন আর চলছে না তার। প্রচন্ড ক্লান্তি আর ঘুমে চোখ বুজে আসছে। সেই মুহূর্তে এসেও বাড়ির মেয়েরা বললো, তারা সবাই নাকি এখন কফি খাবে। নিধিও তাল মেলাল। স্মৃতির কাছে এসে হুকুমের সুরে বললো,

‘যাও তো, সবার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসো।’

স্মৃতি ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর সে রান্নাঘরে চলে গেল সকলের আর্জি মানতে। সবাই বেশ আহ্লাদিত হয়ে গল্পে মজে উঠল। জারা উঠে গেল সেই আসর থেকে। সে রান্নাঘরে গিয়ে স্মৃতি কে বললো,

‘ভাবি, তুমি রুমে যাও। আমি কফি বানাচ্ছি।’

স্মৃতি মৃদু হেসে বললো,

‘তুমি কেন এখানে এসেছো জারা? যাও, সবার সাথে গিয়ে আড্ডা দাও। আমি কফি নিয়ে আসছি।’

জারা জায়গা থেকে নড়ল না। সে বুঝে উঠতে পারে না, এই মানুষ টা কিসের জন্য এত কিছু সহ্য করছে। সে চাইলেই এখান থেকে চলে যেতে পারে। কিন্তু না, সে যাবে না। কিসের মায়ায় সে এখানে পড়ে আছে? এত অবহেলা কি সহ্য করা যায়? মেয়েটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত!

জারা কে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্মৃতি বললো,

‘কী ব্যাপার, এখনও দাঁড়িয়ে আছো যে?’

জারা গভীর ভাবে তার দিকে তাকাল। বললো,

‘এত কষ্ট সহ্য করেও কেন তুমি এখানে পড়ে আছো ভাবি?’

স্মৃতি তার দিকে এক পলক তাকাল; বললো,

‘বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন তোমার ভাই মিটাচ্ছেন। যখন এই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তখন চলে যাবো।’

‘শুধুই কি টাকার প্রয়োজনে তুমি এই বাড়িতে পড়ে আছো?’

জারা তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল। স্মৃতি হাসল। বললো,

‘তা নয়তো কী? এই বাড়িতে পড়ে থাকার আমার আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, বলো?’

‘কী জানি। তোমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। একেক সময় একেক আচরণ করো। তুমি চাইলেই ভাইয়ার বিয়েটা আটকাতে পারতে, কিন্তু…’

‘বাচ্চা মেয়ে, এত কিছু বুঝবে না।’

স্মৃতি জারার থুতনি নাড়িয়ে বললো। জারা সত্যিই কিছু বুঝে না। তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা কে নিয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ হয়। তার ব্যবহার বরাবরই জারার কাছে সংশয়জনক। কিন্তু সে ঠিক টা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না।

কফি নিয়ে স্মৃতি লিভিং রুমে গেল। মেয়েদের লেইট নাইট আড্ডা বেশ জমে উঠেছে বোঝা যাচ্ছে। হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাদের এক কোণে বসে নিধি নেইলপলিশ পরছে। স্মৃতি সবাইকে কফি দিল। নিধির কাছে কফি নিতে সে রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

‘দেখছো না কাজ করছি, রাখো এখানে।’

স্মৃতি টি টেবিলের উপর কফির কাপ টা রেখে স্ট্রে নিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। সেখানের টুকিটাকি সব কাজ সেরে সে উপরে তার রুমে গেল।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ফোন টা হাতে নিল স্মৃতি। স্ক্রিনের উপর জুভানের ম্যাসেজ দেখে মুচকি হাসল। উত্তর না দিয়েই আয়ানার সামনের গিয়ে দাঁড়াল সে। দর্পণে ফুটে উঠা নিজ প্রতিবিম্ব টা দেখে আবারো হাসল সে। কত পরিবর্তন তাই না? পাঁচ বছর অনেক টা সময়। এই এতগুলো অব্দ যার অপেক্ষায় সে বিসর্জন করেছে অবশেষে সে আসছে। হয়তো এবার সময় এসেছে, সমস্ত হিসেব চুকানোর, সময় এসেছে আরেক দফা বোঝা পড়ার। এইবার এই ফুরসতে সে চুপ থাকবে না। তার নিরবতা কে পুঁজি বানিয়ে যারা উঁচুতে উঠছে তাদের যে ডানা ছাঁটবে এবার।

ভোর ঠিক ছয়টায় স্মৃতির ঘুম ভাঙে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টাইম বোঝার চেষ্টা করে। তারপর উঠে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে নামে। বাড়ির সবাই এখনও ঘুমাচ্ছে। রান্নাঘরে গিয়ে একটা পাতিলে পানি বসিয়ে লিভিং রুমে যায় সে। কালকে রাতে মেয়েগুলো রুম টা কে খুব অপরিষ্কার করে ফেলেছে। স্মৃতি সবকিছু গুছিয়ে রাখে। আর সব গুছাতে গিয়েই সে সেখান থেকে নিধির নেইলপলিশ টা পায়। স্মৃতি খুশি হয় তাতে। এটা নিধির ফেইভরেট নেইলপলিশ। সে নেইলপলিশ টা নিয়ে তার রুমে যায়। তারপর আলমারি খুলে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা বের করে। সাদা রঙের স্টেরয়েড জাতীয় একটা পদার্থ সে খুব অল্প পরিমাণে সেই নেইলপলিশে দেয়। তারপর সেটা খুব ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে মিশিয়ে নেয়। বাহ, কেউই বুঝবেই না এখানে কী আছে। নেইলপলিশ টা সে তার ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয়। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময়ই তার ফোন টা বেজে উঠে। হাতে নিয়ে দেখে জুভান কল দিচ্ছে। সে মুচকি হেসে কল টা রিসিভ করে।

‘আমি মাত্রই এয়ারপোর্টে নেমেছি স্মৃতি। আর বেশিক্ষণ নেই। কিছু সময়ের অপেক্ষা কেবল, তারপরই তোমার সাথে দেখা হবে।’

জুভানের উচ্ছাসিত কন্ঠ শুনে স্মৃতি বললো,

‘আমি অপেক্ষায় আছি। আর সাথে নিধিও।’

ওপাশ থেকে জুভানের হাবভাব টা ঠিক বুঝলো না স্মৃতি। জুভান বললো,

‘আচ্ছা, আমি বের হয়ে আবার কল দিব। এখন রাখছি।’

স্মৃতি কল কেটে দিয়ে মনে মনে ভাবে,

“যার নামও সহ্য করতে পারেন না; তাকে বিয়ে কেন করলেন, জুভান আহমেদ?”

জুভান কে নিয়ে মজুমদার সাহেব রওনা দিয়ে দিয়েছেন। খবর টা শোনা মাত্রই নিধি ব্যস্ত হয়ে তার রুমে ছুটল। অনেক কিছু করা বাকি তার। খুব সুন্দর করে সাজতে হবে। জুভান যেন একবার তাকালে আর পলক ফেলতে না পারে, সেইরকম সাজ দিতে হবে। আর দেরি করলো না সে, আটঘাট বেঁধে এবার সাজতে বসলো।

ঐদিকে রান্নার চাপে স্মৃতি শাড়ি পাল্টাতেও ভুলে গেল। গায়ে জড়ানো শাড়ির রং টা আবার জুভানের বড্ড অপছন্দের। কিন্তু কাজের চাপে একটু উপরে গিয়ে যে এই অপছন্দের রং টা কে ছাড়বে সেই ফুরসতও নেই।

সময় গড়িয়ে ঘড়ির কাটা দশ টার বরাবর গিয়ে থামল। স্মৃতি ভাবল, এবার রুমে যাওয়া দরকার। সে চুলা টা বন্ধ করে রান্নাঘরের বাইরে পা রাখতেই তার শাশুড়ি মা এলেন। বললেন,

‘এখনই যাচ্ছিস কোথায়? চিংড়ি মাছ টা তো এখনও রান্না হয়নি। কবে রাঁধবি, জামাইকে বসিয়ে রেখে?’

স্মৃতি আমতা আমতা করে বললো,

‘ম-মা, আসলে একটু শাড়ি টা চেঞ্জ করতে যাচ্ছিলাম। আমি এসেই আবার রাঁধবো।’

‘কেন রে, শাড়ি চেঞ্জ করতে হবে কেন? তোর দিকে আমার ছেলে ঘুরেও তাকাবে না। নিধির রূপ দেখেছিস, আমার ছেলের মনকে বিষিয়ে দেওয়ার জন্য ঐ রূপ’ই যথেষ্ট। তোর রূপের প্রয়োজন নেই। চুপচাপ কাজ কর। রান্নাঘর থেকে বেরুতে দেখলেই খবর আছে।’

স্মৃতি টলমল চোখে আবার রান্নার কাজে হাত লাগাল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, “একদিন ঐ সুন্দর রূপটাকেই সে নিজের হাতে ঝলসে দিবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here