অচিত্তাকর্ষক পর্ব -১১

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১১|

স্মৃতি কফি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই জুভান তার ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে মারল। স্মৃতি অবাক হলো তাতে। জুভান তিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘এটা কার নাম্বার, স্মৃতি?’

স্মৃতি ভয় পেয়ে গেল তখন। ঐ নাম্বার থেকে আবার কল আসছে না তো? সে কফির গ্লাস টা সাইডে টেবিলে রেখে তার ফোনটা হাতে তুলে নেয়। লক স্ক্রিনে সেই নাম্বার টা দেখেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে তার। ইশ, কী বিচ্ছিরি ভাগ্য তার। সারাদিন একটাও কল এলো না অথচ এখনই কলটা আসতে হলো। এখন সে জুভান কে কী জবাব দিবে?

জুভানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। স্মৃতির হাতে টান দিয়ে বলে,

‘কী হলো, চুপ করে আছো কেন? বলো কার নাম্বার এটা?’

স্মৃতি নিরব। চোখ মুখ নিমজ্জিত। কথা বলার সাহস বা শক্তিই কিছুই এই মুহূর্তে পাচ্ছে না সে। কী জবাব দিবে? আবারও কি একটা মিথ্যা বলা ঠিক হবে? কিংবা আগের মতো এখনও কি সেই মিথ্যা জুভান বিশ্বাস করবে? স্মৃতি ভেবে পায় না। জুভান স্মৃতির হাতের পেশিতে তার সুঠাম হাতের শক্তি প্রয়োগ করতেই স্মৃতি চোখ মুখ খিঁচে ধরে। করুন চোখে তাকায় জুভানের দিকে। জুভানের মায়া হয় না, তার শক্ত হাতের মুঠো নরম হয় না। স্মৃতি এবার মৃদু সুরে বলে,

‘এটা জিহাদের নাম্বার।’

জুভানের শক্ত অক্ষিযুগল ক্রমশ আরো শক্ত হয়। সেই কঠিন নির্মম চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস স্মৃতির নেই। তাই সে চোখ নামিয়ে ফেলে। কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বলে,

‘আমাকে ভুল বুঝবেন না, জুভান। ঐ লোকটাকে আমি আরো আগে থেকেই চিনি। বলেছিলাম না আমার বাবার সাথে কাজ করেছে। উনাকে এখন আমার একটু প্রয়োজন ছিল। সেই জন্যই আমি উনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। তাছাড়া আর কিছু না, বিশ্বাস করুন।’

জুভানের হাতের বাঁধন কিছুটা আলগা হলো। তবে চোখ মুখের কঠোরতা এইটুকুও কমলো না। সে ঠান্ডা গলায় স্মৃতি কে বলল,

‘আজকাল তোমার কর্মকান্ডে না চাইতে তোমার উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে, স্মৃতি। তুমি আসলে কী করতে চাইছো সেটা আমার জানা নেই। তবে আমার সংসার ব্যতীত অন্য কিছু নিয়ে না ভাবাই তোমার জন্য শ্রেয়। নয়তো আবার হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাই বি কেয়ারফুল।’

তার এই নরম শীতল সুর স্মৃতির শরীরে ঘাম ছুটানোর জন্য যথেষ্ট। সে ঢোক গিলল। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলল না। জুভান তার কফি নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। স্মৃতি তখন ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিভিং রুমে গিয়ে বসে সে। মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে হচ্ছে। মন অসুস্থ মানে শরীরও অসুস্থ। মা’র চিন্তায় আজকাল তার বড্ড অস্থির লাগছে। অন্যদিকে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলোও তাকে শান্তি দিচ্ছে না। এত অশান্তি নিয়ে কেউ কীভাবে ভালো থাকবে। স্মৃতি চোখ বুঁজে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। মনে মনে ভাবে তখন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসবের সমাধান তাকে করতে হবে। আর অশান্তি আর সহ্য করতে পারছে না সে। বাবার খুনি কে খুঁজে বের করে, তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিয়ে তবেই সে দম ফেলবে, তবেই এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে সে। এর আগে না।

স্মৃতি আর পরে রুমে যাওয়ার সাহস করল না। সে ঠাঁই নিচে সোফায় বসে রইল। কেউই তখন আর রুম থেকে বের হলো না। নয়টা বাজার পর সে উঠে রান্নাঘরে যায়। রাতের খাবার বানানোর প্রস্তুতি নেয়। তখন জুভান রান্নাঘরে আসে। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

‘রুমে যাচ্ছো না কেন?’

স্মৃতি চমকে পেছনে ফিরে। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘রান্না বসিয়েছি তাই।’

‘সেটা তো মাত্র বসিয়েছ। এতক্ষণ যাও নি কেন? ঝিম মেরে লিভিং রুমেই বসে ছিলে।’

‘আমি তো রান্না…’

‘স্মৃতি, তুমি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছো যে আমাদের লিভিং রুমে সি সি ক্যামেরা লাগানো। আর সেটা আমার ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করা, তাই এখন আর কথা ঘুরিও না।’

স্মৃতি নতমস্তিষ্কে বলল,

‘আসলে আপনি রেগে ছিলেন তাই..’

জুভান হাসল। স্মৃতির চোখে সেই হাসি পড়ল না। জুভান বলল,

‘তোমার উপর কি রেগে থাকা সম্ভব?যদিও তোমার এইসব আজগুবি কাজের জন্য মাঝে মাঝে একটু রাগ হয় তবে সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই পড়ে যায়। আচ্ছা যাকগে এসব, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি। কাল আমি নিধি কে ডিভোর্স দিচ্ছি, স্মৃতি।’

স্মৃতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জুভানের কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না। সে বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘এসব কী বলছেন জুভান? আপনি সত্যিই নিধি কে ডিভোর্স দিবেন?’

‘কেন, দিলে তুমি খুশি হবে না?’

‘আমার খুশি আর অখুশি তে কিছু আসে যায় না। আমার খুশির কথা ভাবলে তো শুরুতেই আপনি বিয়েটা করতেন না। অযথাই আপনি এই বিয়েটা করে আমাকে আর নিধি কে আমাদের দুজনকেই কষ্ট দিয়েছেন। এখন আবার বলছেন ডিভোর্স দিবেন। এত ঝামেলা না করলেও পারতেন, জুভান।’

জুভান স্মৃতির কথার বিপরীতে যেন প্রচন্ড অপ্রসন্ন হলো। চোখে মুখে ফুটে উঠল তার বৈরাগ্যপনা। সে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,

‘আমার যা ভালো মনে হয়েছে আমি তাই করেছি। আর ভবিষ্যতেও আমি তাই করব যেটা আমার কাছে ঠিক মনে হবে।’

স্মৃতি তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

‘হ্যাঁ, করতেই পারেন। আপনার জীবন, আপনার খুশি সেখানে আমি তো কেবল একটা পরগাছা। দেখা যাবে দুদিন পর নিজের ভালোর জন্য আবার আরেকটা বিয়ে করে চলে এলেন। তারপর যখন তার প্রয়োজন মিটে যাবে তখন তাকেও ছেড়ে দিবেন। আচ্ছা, আমার প্রয়োজন কবে ফুরাবে, জুভান?’

জুভান রেগে গেল এবার। গরম দেখিয়ে বলল,

‘বাজে বকো না তো। এসব কথা আর বলবে না, মাথা খুব গরম হয়ে যায়। তুমি সবসময়ই বেশি বেশি বুঝো, আর এত বুঝতে হবে না। বেশি বুঝলে মাথা কাজ করবে না। তাই যত কম বুঝবে ততই ভালো। এখন তাড়াতাড়ি কাজ সেরে রুমে এসো, আমার কিছু শার্ট আইরন করতে হবে।’

জুভান তার কথা শেষ করে বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে যায়। তার অনুপস্থিতে স্মৃতি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সময়ের সাথে সাথে লোকটাকে যেন আরো অন্যরকম লাগছে তার কাছে। সেই যখন তাদের প্রথম পরিচয়। একটা ছোট্ট কাপড়ের শো রুমে, যেখানে স্মৃতি পার্ট টাইম জব করত। বাবাকে হারিয়ে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তখন সে’ই নেয়। অসুস্থ মা, কলেজ পড়ুয়া ভাই, বাবার অস্বাভাবিক মৃত্যু সব মিলিয়ে তখন তার পাগল প্রায় অবস্থা। আর সেই মুহুর্তেই সে জানতে পেরেছিল তার বাবাকে শুধু খু/ন করা হয়নি তার শেষ সম্বল ছয় শতক জমিটাও সেই কালপ্রিট কেড়ে নিয়েছে। মূলত এই ছোট্ট একটা জমি আর এই জমির লোভে কেউ তার বাবাকে খু/ন করেছিল। কিন্তু স্মৃতি সেই লোককে এখনও খুঁজে পাইনি। যেই লোক এতসব চাল করেছে, তার বাবাকে বোকা বানিয়ে জমি হাতিয়ে নিয়েছে সেই জিহাদ এখনও পলাতক। তাকে খুঁজে বের করতে পারলেই সেই নির্দয় ব্যাক্তিটাকেও খুঁজে বের করতে পারতো। আর এই সবকিছুর মাঝে সবথেকে অদ্ভুত সত্য কথাটা হলো যে, তার বাবা তার শ্বশুরের কম্পানিতে এক সময়কার স্বল্প বেতনের কর্মচারী ছিলেন। অথচ স্মৃতি তার শ্বশুরের কাছে তার বাবার নাম বলায় তিনি তাকে চিনতে অস্বীকার করেন। তখন থেকেই স্মৃতি তার বাবার পুরো পরিচয় তাদের কাছে গোপন রাখে। তখন তাদের সাথে তার বাবা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় তারই বাবার এক কলিগ কে।

জুভানকেও বলেনি কিছু। স্মৃতি কে প্রথমবার সেই শপে দেখেই জুভান তাকে বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে উঠে। আর সে যখন জুভানের পুরো পরিচয় পায়, তখন সেও রাজি হয়ে যায়। তার মন বলছিল ঐ কম্পানি আর কম্পানির লোকেরাও তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কারণ তার বাবার মৃত্যুর আগে সেই কম্পানি থেকে মাঝে মধ্যেই তাদের বাড়িতে লোক আসতো। স্মৃতি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখত তাদের। তবে বুঝতো না তারা কেন আসে, বাবাও কিছু বলতো না তাকে। আর এসবের মাঝেই হুট করেই একদিন তার বাবা উধাও হয়ে যায়। পরদিন তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় শহরের খুব ভেতরে কোনো এক জঙ্গলে। সেই কী ভয়ানক মুহূর্ত, কী ভয়ানক কান্না। শোকে পাথর হয়ে যায় তার মা। ভাই কেঁদে কেটে অস্থির। স্মৃতি নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকে বাবার লাশের পাশে। আর সেদিনই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বাবার খু/নির শাস্তি সে নিজ হাতে দিবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here