অজানা পৃথিবী পর্ব -০২

#অজানা_পৃথিবী
#কলমে_লাবণ‍্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_২

কুহেলি ভয়ে ভয়ে তাঁকিয়ে আছে। লাশ রাখার পরে লোকগুলো একসঙ্গে জানালার দিকে তাঁকালো।ওর চোখে চোখ পড়তেই লোকগুলো মনে হলো হাসলো। কেমন শরীর শীতল করা সেই হাসি। লোকগুলো বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে তবুও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ওরা কুহেলীকে দেখছে আর জোরে হাঁসতে শুরু করলো। আবিরের জন্য ওর খুব চিন্তা হচ্ছে। ভাবলো এই লোকগুলো কি আবিরবে খুন করে ওর লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে? কুহেলীর ভাবনার অবসান হলো পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে। ও দ্রত পেছনে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই কিন্তু স্পষ্ট শব্দ শুনলো পেছনে কেউ হেঁটে আসলো। ও যখন পেছনে কাউকে পেলো না তখন আবার সামনে তাকালো। রাস্তায় কেউ নেই। পূর্ব আকাশে হয়তো সূর্যমামা উঁকি দিচ্ছে তাই অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। কুহেলীর কৌতূহল বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাস্তায় যারা ছিল তারা এক মূহুর্ত্তের মধ্যে কিভাবে চলে গেলো ওর মাথায় আসছে না। গাড়িটাও নেই মনে হচ্ছে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে নয়তো এখানে আগে থেকেই কিছু ছিল না। সবটা ওর মনের ভূল কিন্তু মনের ভূল কিভাবে হতে পারে? ও আর ভাবতে পারলো না। বিয়ের জন্য পড়া লেহেঙ্গা আর গহনার ভারীতে ওর নড়াচড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। এগুলো চেঞ্জ করতে পারলে একটু সুবিধা হতো। গোসল করা প্রয়োজন তাহলে মাথাটা একটু ঠান্ডা হবে। আবিরের নাম্বারে আবারও ট্রাই করতে পারলে ভালো হতো। ছেলেটা কোথায় আছে জানা অতি জরুরি। ভালো থাকলে সমস্যা নাই কিন্তু কিছু হলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। দোষী মনে হবে নিজেকে। কথাগুলো ভেবে ও তাড়াতাড়ি করে আলমারি খুলতে গেলো কিন্তু পারলো না। চাবি নেই সবখানে লক করা আছে। কুহেলীর বিরক্ত লাগছে। রুমে কোনো ব‍্যাগ নেই গতকাল বোনেরা খুব যত্ন করে ওর ব‍্যাগ গুছিয়ে দিয়েছিল। ওটা কোথায় আছে কে জানে। সমস্যা হয়েছে গতকাল ঘোমটার জন্য কিছুই দেখতে পারেনি। পাশের লোকটা যে অচেনা এটা পযর্ন্ত বুঝতে পারেনি। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে যতটা বোকা ও না। হঠাৎ ওর কাধে কেউএকজন হাত রাখলো আর ও চমকে উঠে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো রাতের সেই লোকটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মুখে অমায়িক হাসি। দেখতে খারাপ না বেশ সুদর্শন তবে লোকটার চোখ দুটো ওর একটুও পছন্দ হলো না। কেমন ভয়ংকর দৃষ্টি। ওর এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা এবার মুখ খুললো,

> কুহু ব‍্যাগে তোমার কাপড় গুলো রাখা আছে গতকাল তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই জাগানো হয়নি।

কূহেলী অবাক হলো লোকটার কথা শুনে। রাতে হুমকি আরও রাগারাগি করলো অথচ এখন রাগের লেশমাত্র নেই। মানুষ কিভাবে পারে এরকম গিরগিটির মতো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হতে? লোকটা কেমন হতে পারে রাতের মতো নাকি এখন যেমন দেখছে তেমন?

> কি হলো কথা না বলে কি এতো ভাবছো? সরি তুমি মনে হয় রাতের বিষয় নিয়ে ভাবছো আসলে হঠাৎ রাগের মাথায় কি না কি বলেছি বুঝতে পারিনি। তুমি ওসব নিয়ে পড়ে থেকোনা কেমন? যাও ফ্রেস হয়ে আসো।

কূহেলী মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়িয়ে ব‍্যাগ হাতে তুলে নিলো। খুব ইচ্ছা করছে আবিরের কথা জিঙ্গাসা করতে। লোকটার মন ভালো আছে এখন বললে হয়তো সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। কূহেলী ব‍্যাগ রেখে পেছনে তাকিয়ে আর কাউকে পেলো না। লোকটার এরকম নিঃশব্দে বিচরণটা কেমন অদ্ভুত লাগছে। কূহেলী ওসব না ভেবে কাপড় নিয়ে বাথরুম চলে গেলো। ও তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে লাল রঙের একটা শাড়িতে নিজের জড়িয়ে নিলো। আবিরের জন্য শাড়ি পড়াটা ও শিখে নিয়েছিল। কথা ছিল বিয়ের পর কুহেলী রোজ শাড়ি পড়বে। আবির দুচোখ ভোরে দেখবে। শাড়ি নিয়ে কতো খুনসুটিমাখা রঙিন স্বপ্নের জালবুনেছিল সেসব এখন বিষাক্ত অতীত। ভালোবাসা হারানো মানুষটাই বলতে পারবে ভালোবাসা হারানোর বেদনা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। কুহেলীর চোখ দুটো পানিতে ভিজে উঠেছে। ও চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মোটামুটি নিজেকে তৈরী করে নিয়েছে। চুলগুলো আচরে ও বাইরের বের হতেই লোকটা দরজা আটকে দাঁড়িয়ে পড়লো। কুহেলীর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এরপর ভুতের মতো আসা যাওয়ার মানে কি ভেবে ও দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল,

> যাত্রা নষ্ট করতে উস্তাদ দেখছি। রাস্তা ছাড়ুন আমি বাইরে যাবো।

> আমাকে কুফা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছো দেখছি। শুনো তোমাকে নিয়ে যেতে আমার চাচিআম্মা আসছেন তোমাকে একা যাইতে হবে না। আর এভাবে ছন্নছাড়া ভাবে নতুন বউকে দেখলে সবার পিলে চমকে যাবে। একটু পরিপাটি হলে ভালো হতো।

> আমি এভাবেই থাকতে পছন্দ করি। ভালো খারাপ বুঝিনা।

কুহেলী লোকটাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে আসলো বাইরে। বাইরের পরিবেশটা না দেখলে নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব না। ভাইয়া আসতে চেয়েছিল যদিও এখন সকাল কখন আসবে সঠিক সময় জানা নেই। কুহেলীর বেশিদূর একা আসতে হলো না একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওর দেখা হলো। ভদ্রমহিলার গায়ে সাদা রঙের আঁকিবুকি করা সুতির শাড়ি এটা ঠিক শাড়ি না কেমন বোরখা টাইপ লাগলো। কুহেলী অবাক হলো ভদ্রমহিলার রূপের স্নিগ্ধতা দেখে। উনি মাথা মুড়িয়ে রেখেছে ওড়না দিয়ে। মুখ আর হাতের কব্জিছাড়া কিছুই দেখার উপাই নেই। ফর্সা গায়ের রঙের সঙ্গে সাদা রঙটা বেশ ভয়ংকর সুন্দর মানিয়ছে। কুহেলীকে এভাবে ভাবতে দেখে ভদ্রমহিলা হেসে বললেন,

> তুমি এসে গেছো? ভীষণ মিষ্টি আমাদের বউমা। চলো সবাই অপেক্ষা করছে, পরিচিত হবে তো? আমি তোমার চাচি শাশুড়ি। চাচি আম্মা বলতে পারো খুশী হবো।

কুহেলীর উত্তরের অপেক্ষা না করে ভদ্রমহিলা ওর হাত ধরে নিয়ে চললো বাইরে। বিশাল বড় পুরাতন আমলের বাড়িটা তবে বেশ চকচকে ঝকঝকে। দেওয়ালের রঙটা আকাশী তবে জায়গাই জায়গাই কেমন ছোপছোপ দাগ। দাগটা কেমন পোড়া মাটির রঙের। ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ডাইনিং রুমে এসে থামলো। বাড়ির সদস্যরা সোফায় বসেআছে। এখানে বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে অথচ কেউ উঠে আসলো না। নির্জন কক্ষ, এতগুলো মানুষের উপস্থিতেতে এতক্ষণে হাট বসার কথা ছিল। কূহেলেকে নিয়ে ভদ্রমহিলা সবার সামনে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিল। কুহেলীর মনে হলো এরা কেউ মানুষ না রোবট। কোনো অনুভূতি নেই। হাসি কান্না দুঃখ এদের আশেপাশে ঘেঁষে না। কুহেলী কথাগুলো ভাবছিল ঠিক তখনই পাশ থেকে একজন গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” জুবায়ের ফারুকীর বউয়ের চিন্তা ভাবনা বেশ প্রখর ঠিক ওর মতোই।

কুহেলি বুঝতে পারলো না কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা উনি বলেলেন। তবে অনুমান করলো ওই লোকটার নাম হবে হয়তো। যাইহোক এসব নিয়ে ভাবলে হবে না। কারো সঙ্গে পরিচিত হলে খুব ভালো হতো। বিয়ে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন মনের কোনে ঘোরাফেরা করছে সেগুলোর সঠিক উত্তর চাই। ওর ভাবনার অবসান হলো কলিংবেলের আওয়াজ শুনে। কুহেলী দরজার চোখ রাখতেই দেখলো ওর বড় ভাই আলীম দাঁড়িয়ে আছে। কূহেলী আর এক মূহুর্তেও অপেক্ষা করলো না ছুটে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে চাপা কন্ঠে বলল,

>ভাইয়া তোমারা আমাকে কোথায় পাঠিয়েছো এখানে আবির নেই। তুমি না বলেছিলে আবিরের সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে? কোথায় আবির? আর তুমি জানো এরা মানুষ খুন করে?

> কি সব আবোলতাবোল বলছিস? আবিরটা আবার কে শুনি? আবির নামের কাউকে তো আমি চিনি না। আম্মা বললো তুই নাকি পাগলামী শুরু করেছিস? বোন এমন কেনো করছিস?

> তুমিও এমন করছো? আচ্ছা আবিরকে চিনতে হবে না।আমি বাড়িতে ফিরবো তুমি ব‍্যবস্থা করো প্লিজ। যদি আমাকে আজকে তুমি তোমার সঙ্গে না নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু আমি সুইসাইড করবো। আমার লাশ নিতে আসতে হবে তখন আফসোস করে লাভ হবে না।

> ছি কুহু এসব কি বলছিস? আমি দেখছি তুমি মাথা ঠান্ডা কর।

কুহেলীর চোখে পানি চিকচিক করছে। চিৎকার করলে কিছুটা হালকা লাগতো কিন্তু পারছে না। অচেনা পরিবেশ তারপর আবার লোকগুলো কেমন অদ্ভূত। আলিম বোনের এরকম পাগলি দেখে সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঙ্গে নেবার জন্য রাজি করালেন। বললেন নতুন পরিবেশকের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে ততদিন কুহেলি ও বাড়িতেই থাকবে। সবাইকে রাজি করে কুহেলী বাবার বাড়িতে চলল। তবে ও অনেক আশা নিয়ে বাবার বাড়িতে চলেছে। ভেবেছে সেখানে গেলেই বুঝি আবিরকে পাওয়া যাবে আসলেও কি তাকে পাওয়া যাবে? নাকি সেখানে ওর জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছে?

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here