#অজানা_পৃথিবী
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#অন্তিম_পর্ব
ফোনের শব্দে কুহেলীর ধ্যান ভাঙলো। ও ধীরগতিতে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো এটা ওর নিজের ফোন। হয়তো জুবায়ের রেখে গেছে। সবথেকে আচর্যের বিষয় হচ্ছে আবির ফোন করেছে। কুহেলী আর অপেক্ষা করলো না ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,
> আমাকে ভূলে গিয়ে নতুন করে সংসার করছো কিভাবে পারলে কুহু? আমার ভালোবাসার কি কোনো কমতি ছিল? নাকি আমি তোমার যোগ্য ছিলাম না? আমার জীবনটা তোমার জন্য নষ্ট হলো। জুবায়ের আর তোমার পরিবার আমার উপরে প্রচণ্ড অত্যাচার করেছে যেটা তুমি দেখেও দেখলে না।
> কি বলছো তুমি? উনি জানেন তোমার কথা? আর তুমি এখন কোথায় আছো? সেদিন কফি হাউজে এসেছিলে তারপর নিখোঁজ।
> কোথায় নিখোঁজ? জুবায়ের তোমার আর আমার মধ্যে দেওয়াল তৈরি করে দিয়েছে। ও তোমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে আমার থেকে তোমাকে দূরে করতে চাই বুঝতে পারোনা তুমি?
> বিয়ের দিন আসলেন না কেনো? সবাই ভাবছে আমি মিথ্যা বলছি আবির নামে কেউ নেই।
> বললেই তুমি বিশ্বাস করবে? আমাদের তিন বছরের সম্পর্ক সামান্য মানুষের কথায় মিথ্যা হয়ে যাবে। আর তুমি মেনে নিবা?
> কিছু মানিনা আমি। তুমি কথায় বলো আমাকে। এখুনি চলে আসছি।
> রয়েল হাউজে আসো। তবে এখন না রাতে চুপিচুপি আসবা। আমি অপেক্ষা করব।
> ওটাতো পরিত্যক্ত বাড়ি। শুনেছি ওখানে রাতের বেলায় ভুত থাকে তুমি ওখানে কি করছো?
> আর ভূত বলে কিছু আছে নাকি? সবাই ভয় পাই এখানে আসতে তাই আমরা এখানেই দেখা করবো। তারপর দুজনের হারিয়ে যাবো অজানা পৃথিবীতে। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। আমাদের মধ্যে কোনো বাধা থাকবে না।
> আমি আসবো আবির। অবশ্যই আসবো,আমার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে আমার করে নিতে আসবো।
> খুব ভালোবাসি তোমাই।
> তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসি।
> এখান রাখছি পরে কথা হবে।
> আচ্ছা বাই।
কুহেলী ফোনটা হাতে নিয়ে জানালার গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখে তৃপ্তির হাসি। শেষমেশ আবির আসছে ওকে নিতে। লোকটাকে নিজের করে পাবার জন্য এতো আকুলতা ছিল তার অবসান হতে চলেছে। ভালোবাসা বুঝি এমনিই হয়। ঝকঝকে মেঘমুক্ত নীল আকাশটা যেনো ওর খুশীর শামিল হয়ে হাসছে। দক্ষিণা বাতাসে কিসের একটা সুগন্ধি ভাসছে। হয়তো এটা প্রেমেরি হাওয়া। কুহুর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দিচ্ছে। এতোটা খুশী আগে কখনও লাগেনি। আবির আসছে ওকে নিতে এর থেকে ভালো আর কিবা আছে। ওর এসব ভাবতে ভাবতেই দুপুরের আজান হয়ে গেলো। জুবায়ের সকালবেলায় এসেছি আর আসেনি হয়তো কাজে আছে। অবশ্য ওসব জেনে কুহুর কী লাভ। যেখানে ও শুধু কয়েক মূহুর্ত্তের অতিথি মাত্র।কুহু দুপুরে গোসল করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।গোসলের পরে ওর ক্ষুধা পাই কিন্তু আজ পাচ্ছে না। নিচথেকে ডাকতে এসেছিল ও যায়নি। বলেছে ক্ষুধা নেই রাতে খাবে। বাড়িতে একটু কথা বললে ভালো হতো। শেষ কথা বলা যায়। তবে ওকে ঠকানো হয়েছে তাই ও নিজেও সবাইকে ঠকাবে। প্রতিশোধ নিবে ওর সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য। এসব ভেবে কুহেলী ফোন না করে আলমারির থেকে শাড়ি পছন্দ করতে শুরু করলো। আজ একদম আবিরের মনের মত করে সাজবে। ও বেশ কিছু শাড়ির থেকে পছন্দসই শাড়িটা সরিয়ে রাখলো। এভাবেই দিনটা শেষ হলো।রাতে যে যার মতো খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে সেই সময় কুহু সুন্দর করে পরিপাটি করে সেজেগুজে রয়েল হাউজের দিকে পা বাড়ালো। অনেক বছর আগে সেখানে একটা অগ্নিসংযো ঘটে ফলে বাড়ির সবাই মারা যায়। এখন পরিত্যক্তভাবে পড়ে আছে মেরামত করা হয়নি। কুহেলী শাড়ির লম্বা আচলটা ঘুরিয়ে কাধের উপরে নিয়েছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। রাস্তায় থেমে থেমে গাড়ি যাওয়া আসা করছে। ল্যামপোস্টের আলোতে চলতে ওর তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। হাটতে হাটতে ও নিজের গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। আসার সময় জুবায়ের ঘুমিয়ে ছিল বলে বলে আসা হয়নি ভেবে কুহুর একটু মন খারাপ হলো যদিও কোনো প্রতারকের জন্য করা উচিত না তবুও হচ্ছে। কুহু প্রধান গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ওর গা ছমছম করছে সতর্কতার সঙ্গে ও ভেতরে গেলো। ডাইনিং রুমের সোফায় বেশ কিছুমানুষ বসে আছে দেখে কুহেলী অবাক হলো।বাড়িটা আগে যেমন দেখেছিল তেমন নেই। এটা মোটেও পরিত্যক্ত বাড়ির মতোআর নেই। সাজানো গোছানো কোথাও কোনো কাঠ কয়লার চিহ্ন নেই। ওর ভাবনার অবসান হলো সিড়ি দিয়ে ঠকঠক শব্দ করে কারো নেমে আসার আওয়াজ শুনে। কুহেলী পেছনে ঘুরে তাকালো আবির আসছে কিন্তু সঙ্গে সেই মেয়েটা আছে। কুহেলী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। ডাইনিং রুমের মানুষগুলোকে দেখে কেমন পুতুলের মতো লাগছে যাদের চোখের পলক পড়ছেনা। কুহেলী এগিয়ে গেলো আবিরের দিকে। ছেলেটা হাসিমুখে বলল,
> স্বাগতম মিসেস কুহেলীকা ইসলাম কুহু।
আবিরে কথাগুলো কুহুর কাছে কেমন লাগলো। কুহু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> চলে এসেছি তোমার কাছে।
> ইচ্ছে করলেও আর যেতে পারবেনা। আমি তোমাকে মেরে আমার প্রতিশোধ নিবো।
> মানে?
আবির ওর কথার উত্তর না করে ওর দিকে তেড়ে আসলো কিন্তু ততক্ষণে কেউ ওকে সরিয়ে নিলো। চোখের নিমিষেই সব ঘটে গেলো। কুহু কারো বুকের মধ্যে লুকিয়ে আছে। চারদিকে প্রচণ্ড হৈচৈ আর আগুনের ধোয়ায় ছেয়ে গেলো। কুহূকে লোকটা কোনোরকমে বাইরে নিয়ে আসলো।বাড়ির চারদিকে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কুহু লক্ষ্য করলো পাশে জুবায়ের ওর হাত ধরে আছে। সবার দৃষ্টি বাড়িটার দিকে। কুহেলী ভয় পাচ্ছে কারণ ভেতরে আবির আছে। ও জুবায়েরের হাত ছাড়িয়ে ভেতরে যেতে চাইল ঠিক তখনই ওর মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো আর ও জ্ঞান হারালো। জুবায়েরর দাদু ওকে ইশারা করলো কুহুকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসতে। বাকিটা উনারা বুঝে নিবেন। জুবায়ের কুহুকে কোলে তুলে গাড়িতে গিয়ে বসলো। এখানে কিছুক্ষণ থাকলে ভালো হতো কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়েটার উপরে অনেক ধকল গেছে। বিনা অপরাধে ভুগতে হয়েছে। দশ মিনিটের মধ্যেই ওরা বাড়িতে পৌঁছে গেলো। জুবায়েরকে দেখে বাড়ির লোকেরা এগিয়ে আসলো। সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভীষন ভয় পাচ্ছে। কুহুকে বিছানায় রাখতেই জুবায়েরের মা রুমে প্রবেশে করলো। জুবায়েরের একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল,
> ভাইয়া ফিরে এসেছে তুমি জানতে তাইনা?
> আমি জানতাম ও এসেছে কিন্তু কুহুর সঙ্গে এমন করবে বুঝতে পারিনি।
> ভাইয়ার নামটা পযর্ন্ত বাড়িতে উচ্চারণ করতে মানা ছিল কুহু বারবার আবির আবির বলে গুঞ্জন করেছে আমরা বুঝতে পারিনি। আর ওই ঘরটা ভাইয়ার ছিল?
> তোর জন্মের আগের ঘটনা তখন আবির সবে কলেজ ভর্তি হয়েছে।একটা মাত্র সন্তান ছিল বিধায় প্রচণ্ড ভালোবাসতাম কখনও কিছুতেই মানা করতাম না। ছেলেটাও প্রচণ্ড জেদি ছিল।। অনেক বন্ধু বান্ধবী ছিল ওর। হঠাৎ ওদের কলেজে একটা মেয়ে আসে। মেয়েটার প্রেমে পড়ে ছেলেটা আমার কেমন একটা হয়ে যায়। ওদের পরিবার আমাদের পরিবারের সঙ্গে পূর্ব শত্রুতা ছিল সেই সুত্রে কেউ ওদের সম্পর্ক মানতে নারাজ বিশেষ করে ওরা। একদিন প্রচণ্ড রেগে মেয়েটার সঙ্গে নিয়ে আবির ওদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটাই। সেই আগুনে আবির,মেয়েটা আর ওদের পরিবারের লোকজনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরেও আবিরের আত্না আমাদের বিরক্ত করতে থাকে র্তি তোর দাদু ওদের অতৃপ্ত আত্নাকে ওই বাড়িতে বন্দি করে রেখেছিল ছিল কিন্তু হঠাৎ মুক্তি পেয়ে গেছে। যখন তোর আর কুহুর বিয়ে ঠিক হল তখনই আবির কুহুকে নিজের বশে নিয়ে নেই আর ওর মস্তিষ্কে এসব অদ্ভুত বিষয়গুলো ঢুকিয়ে দেই। কুহুর মস্তিষ্ক বিষয়গুলিকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে তাই জন্য ও এমন আচরণ করেছে
> তুমি সব জানতে তবুও চুপচাপ থেকেছো? কুহুকে মেরে সে কিসের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল শুনি? আমি কি ক্ষতি করেছি তার?
> ও চেয়েছিল বাড়িতে ওর ঘটনা পূনরায় ঘটুক। সবাই আফসোস করুক। চিন্তা করিস না বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে। ও বাড়িতে যারা আছে সবাইকে আজ চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিবে।
> আম্মু তুমি যাও এখন।
> আচ্ছা।
কথাগুলো বলে জুবায়েরের মা চলে গেলো। ও কুহুর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। মেয়েটা বিনা অপরাধে মরতে বসেছিল। সকালবেলায় দরজার আড়ালে থেকে ও সব কথায় শুনেছিল আর ওর মা আজ সব বলেছে বিধায় ও কুহুর পেছনে পেছনে লোকজন নিয়ে ওখানে উপস্থিত হয়েছিল । ভাবতে ভাবতে জুবায়ের চোখ বন্ধ হয়ে আসলো ভোর রাতে কুহুর জ্ঞান ফিরলো। ও আস্তে করে উঠে বসলো। মাথাটা কেমন ভারি হয়ে উঠেছে। ও উঠে দেখলো পাশে একজন ভদ্রলোক হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। লোকটাকে এভাবে ঘুমাতে দেখে কুহু অবাক হলো। তারথেকেও অবাক হলো ঘরটাকে দেখে। যখন ও এই ঘরে এসেছিল তখন ঘরটা ফুলেফুলে সাজানো ছিল। লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। এর মধ্যেই সব চেঞ্জ করে ফেলেছে। লোকটা ওকে দেখে রেগে এগুলো করেনিতো? ও ভয়ে ভয়ে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে আবারও নিজের দিকে তাকালো। বিয়ের গহনা শাড়ি কিছুই যে নেই । এগুলো সব চেঞ্জ করেছে কে? এটা ভেবেই ও জুবায়েরের গায়ে ধাক্কা দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে জুবায়ের চোখ খুলে হন্তদন্ত হয়ে জিঙ্গাসা করলো,
> শরীর ঠিক আছে?
> জ্বী ভালো। আপনি আমাকে না জাগিয়ে কাপড় চেঞ্জ করেছেন কেনো?
> চেঞ্জ করাবো কেনো? নিজেই তো সাজুগুজু করে রওনা দিয়েছিলে। সময় মতো না গেলে এতক্ষণে বুঝতে।
> ঠিক বুঝতে পারলাম না। বিয়ের রাতে বাসর ঘরে বসে আপনি কি সব বলছেন? আচ্ছা ফুলগুলো খুলেছেন কেনো?
> মানে?
> মানে আবার কি আপনি সব খুলে ফেলছেন আমি একটু দেখতেও পারিনি ভালো করে।
কুহেলীর কথা শুনে জুবায়ের অবাক হলো না। কয়েকদিনের সব ঘটনা ও ভুলে গেছে। ও এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। ওর মনে আর আবির বলে কেউ নেই। কথাটা ভেবে জুবায়েরের ঠোঁটে হাসি ফুঠে উঠলো। ও হাসিমুখে বলল,
> আসলে আমার এজমা আছে ফুলে তাই এগুলো খূলে ফেলছি। চিন্তা করোনা আগামীকাল আবারও সাজিয়ে দিবো তখন দেখবা। আর এতো ভারি গহনা শাড়ি পড়ে তোমার ঘুমাতে অসুবিধা হতো তাই খুলে দিয়েছি বুঝলে? কি কপাল আমার বউয়ের সঙ্গে একটু আলাপচারিতার করবো কিন্তু সে নাক ডেকে ঘুমিয়ে কাটালো।
> এখনো কি সকাল হয়েছে চলুন বাইরে গিয়ে জোছনা দেখি আর কথা বলি।
> রাতে বাইরে যাইতে হবে না চলো বেলকনিতে গিয়ে বসি।
> আচ্ছা চলুন।
জুবায়ের ওকে নিয়ে বেলকনির দোলায় গিয়ে বসলো। কুহু লজ্জা পাচ্ছে কথা বলতে কিন্তু জুবায়ের ওকে একেরপর এক কথা বলে ব্যস্ত রাখছে। এভাবে ওদের অনেক সময় অতিবাহিত হলো। এতক্ষণে কুহু কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে জুবায়েরকে ওর বেশ পছন্দ হয়েছে । ওর সঙ্গে বাকিটা জীবন ও সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিবে। লোকটাকে ও ভীষণ ভালোবাসবে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর দৃষ্টি রাস্তা উপরে গেলো। দেখলো রাস্তায় একটা ছেলে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে কুহুর চোখ পড়তেই ছেলেটা হেসে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কুহু জুবায়েরকে রাস্তার দিকে ইশারা করলো কিন্তু ও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কুহুর কোলের উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ওসবে নজর দিয়ে নিজেদের ভালো মূহুর্ত নষ্ট করতে জুবায়ের নারাজ। ওদের জীবনে আবির নামের ছায়াটা আর কখনও ফিরবে না।
সমাপ্ত