অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ২৫

অতিরিক্ত চাওয়া {২}

২৫.
জসিম ফোন রিসিভ করলো,
———— হ্যালো?
আবিরের শীতল কণ্ঠ,
———— আসসালামু আলাইকুম চাচা।
জসিম পান চাবানো বন্ধ করে দিলো,
———— আলাইকুম আসসালাম বাবা। চিনলাম না তো?
———— মিনিস্টার রয়ুশ রয় আবির। চেয়ারম্যান চৌধুরীর শালা। তৃষ্ণার মামা।
চিনেছেন নিশ্চয়ই?
বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো জসিম। আরেকবার ফোনের স্ক্রিনে চোখ বোলালো। মুখের চাবানো পান ফেলে দিলো। বেশ অপ্রস্তুত ভাবে তার জবাব,
———— জ্বি। জ্বি, জ্বি চিনেছি।
———— আলহামদুলিল্লাহ। কথা ছিলো আপনার সাথে। ভেবেছিলাম সামনাসামনি বসে বলব। কিন্তু আমার মিটিং আছে গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামে ফিরা একটু সমস্যাকর। তাই ফোনের মাধ্যমে বলছি।
———— জ্বি।
———— পুরো ব্যাপারটা তো জানেন। তাই আমি ডিরেক্ট কথা শেষ করছি। কারণ আমার পাঁচ মিনিটের মাঝে আরেকটি মিটিং আছে।
তৃষ্ণার কয়েকদিন আগে গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপাতত অনেকটা সুস্থ। তাও আমরা ওঁর ক্ষেত্রে রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। এ-ই সময় ওঁর মারামারি বা অহেতুক রাগারাগি করা সম্পুর্ন নিষেধাজ্ঞা ডাক্তার থেকে। এখন আপনাদের অহেতুক অন্যের মেয়েকে নিয়ে মাতামাতি ব্যাপারটা সম্পুর্ন রাগিয়ে দিচ্ছে ওঁকে। যেটা ওর শরীরের জন্য আপাতত একদমই ভালো না। তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি , আপনার মেয়েদের বিয়ে নিয়ে ভাবুন। আপাতত ওদের বিয়ের ঘটকালি করাটা প্রয়োজন আপনার। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা। বেলীর জন্য ভাবতে হবেনা। কারণ তারজন্য পাত্র ১০-১১ বছর আগের থেকেই রয়েছে। তাই অযথা এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবেনা। আপনি বুঝেছেন নিশ্চয়ই আমার কথাগুলো?
শান্ত আওয়াজে এমন ভয়াবহ থ্রেট জসিম তার বাপের জন্মে শুনেনি। হাত গুলো কাঁপছে। আসলে সে কখনও থ্রেট বা মারামারির আশপাশ ও যায়নি। তাই হঠাৎ এমন থ্রেট ঠিক হজম করতে পারলেন। ছোট ঢোক গিলে সে আশেপাশে আনন্দকে খুঁজতে ব্যস্ত। না পেয়ে হালকা আওয়াজে জবাব দিলো,
———— জ্বি।
———— আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।
এবং তৎক্ষণাৎ কল কেঁটে গেলো। জসিম নিজের চেয়ারে বসে পড়লো। ফোনের দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে কপালের ঘাম মুছল। প্রচন্ড ভীতু মনের এই জসিম জীবনে আগ বারিয়ে কারো সাথে কথা বলতেন না। নামীদামী ব্যক্তিদের থেকে দূরেই থাকতেন। ভাইদের দমিয়ে রাখলেও বাহিরে সে প্রচন্ড ভীতু গলা নিয়েই থাকতেন। তাই এমন ভয়ংকর আলোচনা সে ঠিক ভুলতে পারলো না। সেদিনই তার তীব্র জোরে শরীর নড়ে উঠলো।

আবিদ এ-ই নিয়ে ৩ প্যাকেট সিগারেট শেষ করলো। এখনও তার রাগ যাচ্ছে না। আবিদ সারাজীবন শান্ত মনের ছিলো। সে বেশিরভাগ সময়ই হাসিঠাট্টা করে কাটিয়েছে। আর তার সাথে যারা ছিলো তাদেরকেও হাসিয়ে ছেড়েছে। কখনও কোনো ম্যাটার সিরিয়াসলি নিতে একদমই পারেনি । কিন্তু এইবার? এইবার শুধু আরিকার কিছু কথা তাকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। কথাগুলো ছিলো,
‘ ভাই-আব্বু বলছে আমি নাকি পাগলামো করছি। তুমি, তোমরা আমাকে পছন্দ করোনি। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে সজ্জ করেছ। সত্যি তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি আবিদ? আসলে আমার মেয়েলী লাজুকলতা আসে না। তোমাকে ভালো লাগে। আর যেটা ভালো লাগে সেটা ছাড়তে পারিনা। তাই সোজাসুজি বলে দিয়েছিলাম। ‘
এগুলো বলার পর আবিদের কথা না শুনে কল কেটে দিয়েছে। চোখ কটমট করে আবিদ আবারও ডায়াল করল আরিকার নাম্বারে। ফোন স্যুইচডওফ। ফোনটা আছাড় দিতে গিয়েও থেমে গেলো। একদিনে তাকে পাগল করে দিয়ে এখন হাত ধুয়ে উঠতে চাচ্ছে। কয়েকটা শ্বাস নিয়্র নিজেকে শান্ত করলো। আগে এ-ই রিজয় ব্যাক্তি-কে হ্যান্ডেল করতে হবে। তারপরও গরম মাথা নিয়েই বেরোলো সে অভি, আয়ুশ কে নিয়ে!
বেলীর বিষয় শুনে জয়া তৃষ্ণার রুমেই বসে আছেন সকাল থেকে। সে তৃষ্ণাকে বলেই যাচ্ছেন,
———— বেরোবে না আব্বা। এখনও পা-টায় ব্যাথা।
———— মা,পা ঠিকাছে।
———— বেরোবি না মানে বেরোবি না।
অগ্যত তৃষ্ণা শুয়ে রইলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। রুমের দরজা লক করেই শ্বাস ফেলল জয়া। তারপর সবাইকে কড়া ভাবে বলল,
———— রুমের দরজা কেউ খুলবে না।
জয়া যেতেই তৃষ্ণা বিছানা ছাড়লো। ড্রেস পরিবর্তন করে ফেলল। এবং বেলকনি দিয়ে বেশ আরামসে নেমে গেলো। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ শুনে জয়া
‘ আব্বা ‘ বলে দৌড়ে গেলো মেইন দরজার দিক। কিন্তু তৃষ্ণা ততক্ষণে গাড়ি টান মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বেলী খাটে বসে আঁকুপাঁকু করছে। সেটা লক্ষ্য করে বড় চাচা জসিমের মেজো মেয়ে ময়না বলেই ফেলল,
———— বেলী?
ময়নার আওয়াজে হুঁশ ফিরল বেলীর,
———— হ্যাঁ? হ্যাঁ বলো।
———— কি হয়েছে? সবাই কথা বলছে। তুই এমন চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ?
———— না না। আমি ঠিকাছি ময়না আপু। ওইতো হালকা মাথা ব্যাথা।
মেজো চাচার মেয়ে বানু বাঁ চোখ টিপ মেরে বলল,
———— আমাদের দুলাভাই-র কথা ভাবছে যে। তাই আমাদের আলাপ ভালো লাগছে না। তাই না বেলী?
বেলী লজ্জা পেয়ে গেলো এবং ভীতু গলায় জবাব দিলো,
———— যাহ। তেমন কিছু না।
ময়না বলল,
———— তাহলে কেমন? আচ্ছা ভাইর ছবি দেখানা।
এইবার বেলী চোখ বড়সড় করে তাকাল,
———— মা..মানে?
বানুর বড় বোন বীনা বেলীর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
———— পাজি মেয়ে। এখনও লুকাচ্ছিস? আমরা সব জানি। ছবি দেখা এখন দুলাভাইর।
বেলী ভয়ভয়ে বিমানের দিক তাকালো। বিমান কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো,
———— ওঁকে জ্বালাস না। আমি দেখাচ্ছি।
বেলী চোখ ছোট করে বসে রইলো। চাচাতো ভাই-বোন সবগুলো উঁকি মেরে বিমানের থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে নিজেরা দেখতে লাগলো। বীনা সরল চোখে বিমানের দিক তাকালো,
———— এটা?
———— হ্যাঁ!
———— ব..নায়কদের মতো দেখাচ্ছে না? আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি আমাদের মডেলের ছবি দেখাচ্ছ?
ময়নার ফিসফিস আওয়াজ,
———— ল্যান্স পড়েছে হয়তো। ছেলেরা ল্যান্স পড়লে ভালো লাগে না। কিন্তু ল্যান্সটা চেহরার সাথে যাচ্ছে। তাই না?
বানুর জবাব,
———— হ্যাঁ। বসার স্টাইল টা জোস।
———— তাকানো টা-তো মারাত্মক।
বেলী খুকখুক কেশে উঠল। ময়না, বানু, রাকিব, মিতু, আকাশ সবাই এবার বিমানের দিক চোখ কুঁচকে তাকাল। বিমান নিজের ফোন কেঁড়ে নিয়ে বলল,
———— গাঁধার দল। এটাই তৃষ্ণা। আর চোখে সে ল্যান্স পড়ে নি।
এবার সবাই বেলীকে ঘিরে ফেলল,
———— এ-ই বেলী। তোর তো রাজকপাল বোন আমার। আচ্ছা ভাই নাকি তোকে ছোট থাকতে পছন্দ করত? আচ্ছা তোদের ব্যাপারটা কবে থেকে আগাইছে? বল না।
বেলী ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে যাচ্ছে,
———— ম..মাথা ধরেছে। ঘুমাই আমি।
বেলী ঝটপট সেখান থেকে কেটে পড়লো।
এদিজে শীতের প্রভাব প্রায় নেই নেই চাচাতো ভাই-বোনরা সকলেই এখনও বিছানায় শুয়ে-বসে আড্ডায় মেতে। বিমান লুকিয়ে-ফিরিয়ে বারবার ফোন নিয়ে অন্যদিক চলে যাচ্ছে কারণ তাঁকে সমানে ম্যাসেজ করে যাচ্ছে অভি। তারা প্রতিদিন রাত্রে-ই ফোনালাপ নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। কিন্তু আজ চাচাদের বাড়িতে এসে বিমান ফোনালাপ করতে পারছে না। চাচাতো ভাই-বোনরা বারবার তাঁকে টেনে সকলের উপস্থিত রুমে নিয়ে আসছে। কথা বলতে না পারায় রাগে ফুসফুস করছে অভি। এইবার অভির এক ভয়াবহ ম্যাসেজ দেখে বিমানের চোখ টলমল করছে। বিমান চোখে টলমল পানি আর রাগ নিয়ে রিপ্লাই দিল,
———— Dite hobe na massages, call. ami ki bolechi dite?
রিপ্লাই দিয়ে বিমান ফোনটা ওফ্ করে ফেলল।

রাত ১১:৫৬। জানালার সামনে বসে বেলী। তারা কাল ও এখানে থাকবে। বেলী ফোনের স্ক্রিনে একমনে তাকিয়ে। কি সাংঘাতিক ঘাড়ত্যাড়া লোক। একটা ম্যাসেজ ও দিলো না। হ্যাঁ বেলী মানছে তার ভুল হয়েছে। সে বলে আসেনি। তাই বলে এমন করবে তার সাথে? বেলী মনেমনে কিছুক্ষণ গালি দিলো। তৃষ্ণার চিন্তায় সে আজ সারাদিন কিছুই খায়নি। এখন খুদায় সে পেট ধরে আছে। সজ্জ করতে না পেরে মোবাইল বিছানার নিচে রেখে চলল খাবারের খোঁজে। খাবার খেয়ে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমন সময় ফোনের ভাইব্রেশনে বেলী কেঁপে উঠলো। ফোন নিয়ে দেখলো ১৪ টা মিসডকলস। তাও তৃষ্ণা থেকে। বেলী দ্রুত ফোন নিয়ে উঠানের পেছনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এবং তখনই আবারও কল আসলো। বেলী রিসিভ করে তৃষ্ণার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো।
———— বেলী!
তৃষ্ণার অদ্ভুত কন্ঠ আর ফোনের ওপাশের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বেলী শিউরে উঠলো,
———— কি হয়েছে আপনার? আ..আপনি কথায়? এতো আওয়াজ কেন আসছে?
ওপার থেকে তৃষ্ণার থমথমে গলা,
———— ইব্রিম, ম্যান! স্টপ দ্য ড্যাম মিউজিক।
প্রায় ততক্ষণাৎ গান বন্ধ হয়ে গেলো। একটা মেয়েলি ঢুলঢুলা কন্ঠ। শুব্দ গুলো পেঁচিয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটি হুঁশ এ নেই।
———— তৃষ। আম..আম্মা আসছে নিতে। আম গোয়িং। অ্যান্ড , আমি আবিদ কে ইনফর্ম করে দিয়েছে। হি’স কামিং টু পিক ইউ আপ। প্লিজ ডোন্ট ড্রাইভ ইওরস্যাল্ফ।
তৃষ্ণা হাত নাড়িয়ে দিল। ফোনের দিক তাকিয়ে আবারও বলল,
———— বেলী…
বেলীর আতংকিত আওয়াজ,
———— আপনি কোথায়? এ..এভাবে কথা বলছেন কেন?
———— কীভাবে? আমার আওয়াজ ভালো লাগছে না? প্রস্তাব আসছে বিয়ের। ওটাকে বিয়ে করবি? ওটার আওয়াজ আমার তে সুন্দর? সিরিয়াসলি? দেখা সাক্ষাৎ হইগেছে নাকি?
বেলী চারপাশে তাকিয়ে হালকা আওয়াজে বলল,
———— কি আবল_তাবল বকছেন। আ..আমি আবিদ ভাইকে কল করছি।
তৃষ্ণার ধমক,
———— ডোন্ট ইউ ড্যায়ার। কল কাটবি না। আদ্যারওয়াইজ, তোর ও-ই ফকিন্নি চাচার সামনে থেকে তুলে আনব। তারপর দেখব আমার কি বাল করতে পারে।
বেলী চোখ বড়সড় করে ফেলল,
———— এগুলো কি বলছেন? এভাবে কথা বলছেন কেন?
———— মা জন্মের সময় মধু খাওয়াতে ভুলে গেছে। তুই খাওয়া ঠিক হয়ে যাবে। জানিস তো কোন মধু?
কাঁপাকাঁপা গলা,
———— আ…আপনি ড্রাংক?
জবাব নেই। বরং তৃষ্ণা হঠাৎ ঢুলেঢুলে মিষ্টি আওয়াজে আগামাথা ছাড়া কথা বলতে লাগলো,
———— আই লাভ ইউ বেলী। অনেক অনেক। চল বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের পরদিন হানিমুন চলে যাব। হানিমুনে কোথায় যাবি? তুই যেখানে যেতে চাইবি সেখানেই যাব। লং একটা ট্যুরও দেব। এবং আমরা অনেকগুলো বাচ্চা নেব। আচ্ছা, মেয়ে নেব না ছেলে? থাক একটা হলেই হবে। এ-ই বেলী আই লাভ ইউ বলনা?
বেলী থম মেরে রইলো। তৃষ্ণা আবারও বলতে লাগলো,
———— তোকে মিস করছি। একটা চুমু দে না। ঠোঁটে দিবি? জানিস তোর ঠোঁটে চুমু খেয়ে আমি রাত্রে এখন একদমই ঘুমাতে পারি না। আহ। বেলীইইই। তোর শর..
স্তব্দ বেলী চিৎকার দিয়ে উঠলো,
———— প..প্লিজ। আ…আপনি থামুন না। আবিদ ভাই কোথায়?
———— আবিদ? ও একদম ভালো না। সব বাজে। তুই শুন। তোকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা? আরে, আমি তো ওখানেই চলে আসতে পারি। তুই আসবি তো।
———— আপনি, আপনি কোথায়?
———— রিমির বার্থডে ছিলো। জোর করে নিয়ে আসছে। ওঁরা একদমই বাজে। ওগুলো বাদ দে।
বেলী শ্বাস আটকে বসে। তৃষ্ণা আবারও বলতে শুরু করলো,
———— তোকে ওড়না ছাড়া কতটা হট লাগে জানিস? মাথা ধরে যাওয়ার মতো। একদম রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার মতো। আমার তো সেদিন আর ঘুম-ই আসেনি। তোকে নিয়ে জেগে জেগে কতকি করেছি। কি করেছি জানিস? শুন ‘ তোর পিঠের…
বেলী দ্রুত কল কেটে দিলো। নিজে নিজে বিড়বিড় করলো,
———— একদমই হুঁশে নেই। একদমই না।
কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে বেলী দ্রুত আবিদকে কল করলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here