অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -২৯+৩০

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব – ২৯
_________________
৬৪.
–“আদ্রিন ছেলেটা আর কতো শর্ত দিবে?এটা কি বিয়ে নাকি শর্তের খেলা আমি কিছুই বুঝলাম না।”
অরিত্রনের চিন্তাযুক্ত বাক্যটা সকলের নিকট হাস্যকর ঠেকায়।হুহু করে হাসলো একদল।তৃপ্তিও তার মাঝে অন্যতম।রূপম ফ্লোরে বসেই হাসতে হাসতে কুপোকাত।প্রিয় কিছু বুঝেনি তাও হাসছে।সবার হাসি দেখে মেয়েটা নিজের হাসি বন্ধ করতে পারছে না।অরিত্রন রেগে যায়।কপট রাগ দেখায়,
–“সবগুলো আদ্রিনের দল মনে হচ্ছে।কি খাইয়েছে ছেলেটা তোদের?”
অরিত্রনের কথায় রূপম হাসি থামায়। পেটে হাত রেখে বলে,
–“আদ্রিন ভাইয়া হয়তো চায় না এই বিয়েতে এক চুল ঝামেলা হোক।আমি তোমার মেয়েকে পাত্তা দিই না এক বিন্দু।কিন্তু, ঐ ভাইয়ার জন্যে তোমার মেয়ে তার জান।ভাবতেই অবাক লাগে।”
পরক্ষণে সে তৃপ্তির নিকট দৃষ্টি দেয়,মাথা চুলকিয়ে বলে,
–“তোর মাঝে কি আছে রে?আদ্রিন ভাইয়া তোর জন্যে এত পাগল কেনো?মাঝে মাঝে আমার মনে হয় উনি তোর জন্যে উন্মাদ।”
তৃপ্তি খানিকটা অবাক হয়।হাসি থামে তার।কেমনটা লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে।গালদুটো জ্বলছে,দু ঠোঁট এক করে ফ্যালফ্যাল নজরে ভাইয়ের পানে চেয়েই রয় সে।কথার বিষয়বস্তু কি হতে কি হয়ে গেলো!তৃপ্তিকে অবাক করে দিয়ে এইবার তার বাবা হেসে উঠে।সাথে পুরো পরিবার একসাথে।লাজে তৃপ্তির মাথা ঝুঁকে।তবে সে প্রকাশ করে না।
অরিত্রন মুখে হাত রেখে বলে,
–“নির্দ্বিধায় আমি আমার মেয়ে জন্যে এমন যত্নশীল ছেলে চেয়েছিলাম।কিন্তু,আদ্রিন একটু অতিরিক্ত যত্নশীল।”

চামেলী অরিত্রনের কথার জবাবে বলে,
–“সব তো বুঝেছেন দাদা।এখন এটাও বুঝছেন নিশ্চয় ছেলেটা কেনো বিয়েতে কোনো বাহিরের মানুষ চায় না।তার শত্রুর অভাব নেই।তার মাও বেশ নামকরা একজন।আর এইসব অনুষ্ঠানে দুর্ঘটনা ঘটানোর ইঙ্গিত থাকে বেশিরভাগ।আদ্রিন ছেলেটা মাত্রারিক্ত চালাক।যেটা আমরা বুঝিনা,সেটা তার মাথায় খেলে।”
অর্ক সম্মতি জানায় চামেলীর সাথে,
–“একদম।আমি ওকে অনেক আগে থেকে চিনি।সাধারণ ভাবনা যেটা আমাদের মাথায় আসে না,এটার গন্ধ আগেই পেয়ে যায় আদ্রিন।তাই, ও যা ভাবছে, করতে চাচ্ছে তাই হোক।আমাদের বোনকে স্বাভাবিকভাবেই বউ রূপে দান করতে পারলেই হলো।যাক,উঠি সবাই। কাল হলুদ।কাজ অনেক।”

রুপম দাঁতের সাহায্যে নখ কাটে।স্থির দৃষ্টি তার নিশানাহীন।হঠাৎই সে বললো,
–“মনে হচ্ছে, কাল কিছু একটা হবে।”
দিদা পেছনে বসায় ছিলো।অমঙ্গলের কথা শুনে মহিলা দুশ্চিন্তায় তাজ্জব বনে।বিস্ফোরিত নয়নে শুধায়,
–“অমঙ্গল কথা বলিস না।উল্টোপাল্টা কিছু হলে, রামধোলায় দিবো তোকে।”

–“হবে না হবে না। সব ভালোই হবে।তৃপ্তি আসো হলুদের আগে তোমাকে আজ মেহেদী দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কাল ভীষণ তাড়াহুড়োয় সময় যাবে।মেহেদী পড়ার ফুরসৎ মিলবে বলে মনে হয় না।”
অর্কের বউয়ের কথায় তৃপ্তি,আলেয়া আরো কয়েকজন বোনেরা উঠলো।

তৃপ্তিকে সবাই তার কামরায় নিয়ে যায়।পড়ানো হয় কলাপাতা রঙের শাড়ি।চুলের বেণী পিঠের উপর শায়িত।এলোমেলো কিছু ছোট চুল অবাধ্য হয়ে দুলছে গালের উপরেই। কড়া লাল রঙের লিপস্টিকেই মেয়েটার সাজ পরিপূর্ণ।বিয়ের আগে মেয়েদের সৌন্দর্যতা বাড়ার ব্যাপারটা তৃপ্তির বেলায়ও পিছপা হয়নি।অন্যান্য দিনের তুলনায় মেয়েটাকে আরো বেশি নজরে লাগছে।কেমন রশ্মি ছড়াচ্ছে যেনো!
ছাদের চিলেকোঠায় রঙিন পর্দায় আবৃত করা হয় দেওয়াল।সাথে কিছু রঙিন বাতি।বসার জন্যে ছোট সাইজের গদি বিছানো হলো।মেয়েটা সেখানেই বসে।পরপর সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে তাকে।দুইজন শুরু করলো মেহেদী দেওয়ানো।হাতের তালুর মাঝে লিখা হলো তার প্রেমিক পুরুষের নাম।তার হাতের তালুতে গোটা অক্ষরে শোভিত হচ্ছে, আদ্রিনের নামখানা। নামটাতে কেমন আকর্ষণ টের পাচ্ছে মেয়েটা।ছেলেটা তার জীবনের সাথে সারাজীবনের জন্যে জুড়ে যাবে বলে তাই!
হঠাৎই মনে আসে,আদ্রিনের বেপরোয়া সব কথাবার্তা।কিছুদিন ধরেই ছেলেটা কেমন এলোমেলো কথা বলে তৃপ্তিকে। সবই ছেলেটার পরিকল্পনা।সেইসব কথা শুনতেই তৃপ্তি স্থির থাকতে পারে না।তার লাজের পাল্লা ভারী হয়।অস্থিরতা কাজ করে অন্তরে।লজ্জায় কতবার ফোন কেটেছে জানা নেই তৃপ্তির।আদ্রিন তাও থেমে থাকেনি কোনোদিন। তৃপ্তিকে একে একে তার মনের সকল আবদার বলে। তৃপ্তির নিকট সেইসব রোমান্টিকতা বিষাক্ত ঠেকে।তবে,মধুময় বিষাক্ত।যেটার স্বাদ নিতে সে নিজেও রাজি,কেবল কিঞ্চিৎ দ্বিধা। লাজ ভারী মেয়েটার। এইসব কথা মনে আসতেই,তৃপ্তির মনটা কেমন নেতিয়ে পড়ে।ইচ্ছে করে এই মুহুর্তেই যেনো আদ্রিন আসে আর তৃপ্তি তাকে মন ভরে দেখুক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।কারণ,দিদার মানা।আদ্রিনের স্পর্শ করা হলুদ তার শরীরে ছোয়ার পূর্বে তাদের দেখা করা নিষিদ্ধ।তাই তো রেগে আছে আদ্রিন।সে এক মুহূর্তও রাজি না,তার মেহেবুবাকে ছাড়া থাকতে।অগত্য রাগ করে বিয়ের দিনেই দেখা করার কথা জানায় সে তৃপ্তিতে। ভাবুক তৃপ্তি খুব করে চায়,তার মহারাজার রাগটা জলদি ভাঙুক।দেখা না হোক,অন্তত একটা ফোন দিক।মনের মাধুরী মিশিয়ে ছেলেটার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলুক!
.
হলুদের সন্ধ্যায় ব্যাপক আয়োজন করা হয়।তৃপ্তির বাড়ির সম্মুখেই বড় উঠানে বিশাল প্যান্ডেল করা হলো।বাহারি রঙের লাইটে ঝলঝল করছে গোটা বাড়ি।তৃপ্তি তৈরি।সাজগোজ বেশ সাধারণ।তবে মেয়েটা বরাবরের মতোই অসাধারণ।হালকা হলুদ তার পড়নের শাড়ি। হাতে,গলায়,মাথায় প্রাকৃতিক ফুলের অলংকার।আত্মীয় স্বজনদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তৃপ্তি আঁখি মেলাতে পারছে না কারো সহিত। কুঁকড়ে উঠছে অভ্যন্তরে।তাও সকলের সাথে তাল মেলাচ্ছে সে।অনুষ্ঠানকে পরিপূর্ণ করতে উদ্যত মেয়েটা।হাতের মেহেদীর রঙটা বেশ গাঢ়।অনেকে তো মুখ ফুটে বলেই দিলো,
–“তৃপ্তির হবু স্বামী,তাকে বুঝি খুব ভালোবাসে!”

একটু শক্ত,আর লাজুক মেয়েটা উত্তর দেয়নি কাউকে।সৌজন্যমূলক হাসলো কেবল।তৃপ্তি সবার সামনে নিজের লজ্জা বা লাজুক ভঙ্গি প্রকাশে দূর্বল।সে একটু অন্যরকম।তৃপ্তির সকল লজ্জা আর নরম অনুভূতি কেবল বিশেষ কিছু মানুষ আর একান্তই তার আদ্রিনের জন্যেই।
অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত করে।ভাইয়েরা শেষ সময়ে মেয়েদের বাহিরে থাকতে দেয়নি।তাদের বিশেষ পানীয় পান করতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া। উঠোনের সামনেই সব ভাইয়েরা ব্যস্ত তাদের অমৃত খেতে।

৬৫.
হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে রইলো তৃপ্তি।দৃষ্টি মোবাইলে আবদ্ধ।এই বুঝি আদ্রিন ফোন দিয়েছে।কিন্তু না,ফোন আসছে না।আজ তার শাড়ি খুলতে ইচ্ছে করছে না।অপলক দৃষ্টিতে সে মোবাইলের দিকেই চেয়ে রইলো।ভাবুক মনে খুশির সঞ্চার হয়।মেসেজ আসে এক প্রাইভেট নাম্বার হতে।নাম দেখা যাচ্ছে না,নাম্বারও না।কেবল প্রাইভেট নাম্বার লিখিত।মেসেজ চালু করতে জ্বলজ্বল করলো অক্ষরগুলো,
–“বাহিরে গাড়ি রাখা আছে,মেহেবুবা।তোমাকে দেখতে চাই আমি।তুমি আমার আবদার পূরণ করতে বাধ্য।যদি না আসো,আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।
~ আদ্রিন।”

হুট করে শোয়া থেকে উঠে সে।আলেয়াকে ডাকতে চায়।সে ঘড়ির সময় দেখে।রাত দুটো ছুঁই ছুঁই।আলেয়াও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।একা যাওয়াটাই বেশ হবে।কেউ জানবে না।আদ্রিন তো গাড়ি পাঠিয়েছে।যেভাবে ছিলো তৃপ্তি,সেভাবেই বেরিয়ে পড়লো কক্ষ হতে। হাতে মোবাইল নিতে ভুলেনি।গুটি গুটি পদক্ষেপ সম্মুখে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।বাসা জনমানবহীন।ভাইয়েরাও বুঝি যারযার কামরায়। এইভাবেও সকলে বেশ ক্লান্ত।ঘুমিয়ে থাকাটা স্বাভাবিক।

তৃপ্তি প্রধান ফটকের দিকে গেলো না।পিছনের দরজা উত্তম ভাবলো।ধীরে বিনা শব্দে পেছনের দরজার নব ঘুরায়।দরজা খুলে।সে বেরিয়ে আবারও দরজা দিয়ে দেয়,তবে লক করলো না।আবারও ফিরতে হবে তাকে।এতো রাতে কেউ দরজা খুলতে বসে নেই তার জন্যে।সামান্য উঁকিঝুঁকি দিতেই গাড়ি দেখতে পায় সে।ওদের এলাকায় যারযার গাড়ি তাদের বাড়ির ভেতরে থাকে।তাই নির্দ্বিধায় সে গাড়িটির দিকে চললো।লুকিয়ে বড্ড কৌশলে।

গাড়ির নিকট গেলে আপনাআপনি দরজা খুলে যায়।তৃপ্তিও সাতপাঁচ ভাবে না উঠে পড়ে।ড্রাইভারের দিকে একবার নজর দেয়,চেহারা বুঝেনি সে।এতটা ভাবেওনি এই ব্যাপারে।

গাড়ি থামে,এক প্রকার প্রশাসনিক ভবনের সামনে।
ভ্রু কুঁচকে যায় তৃপ্তির।এইখানে আদ্রিন ডেকেছে তাকে!সহসা গাড়ি থেকে নেমে গেইটের কাছে যেতেই তাকে গার্ড প্রশ্ন করে কিছু।তৃপ্তি তার মেসেজটা দেখায় তাদের,অনুরোধের কণ্ঠে বলে,
–“বিশ্বাস না হলে,আপনি আদ্রিনকে ফোন করুন।”
পেছনের গার্ড সতর্ক করে সামনের গার্ডকে,
–“স্যাররা জরুরী থেরাপির রুমে।ডিস্টার্ব করলে চাকরি যাবে।উনি হয়তো ডিবির কর্মী।কোনো পাস কোড ব্যবহার করছেন। আশে পাশে সন্দেজনক কেউ আছে হয়তো!”
প্রথম গার্ড তাই তৃপ্তিকে ভেতরের আসার নির্দেশ দিয়ে বলে,
–“গাড়িতে বসুন,ম্যাম।গাড়ি নিয়ে ভেতরে যেতে পারবেন।”

তৃপ্তি মাথা নাড়ে।পেছনে ফিরতেই দেখে,একটু দূরে দাঁড়ানো গাড়িটা নেই।গার্ডের সন্দেহ হলে আবারও ঝামেলা বাজতে পারে, তাই নির্বিকার ভঙ্গিতে সে বললো,
–“লাগবে না গাড়ি।আমি হেঁটে যাই।”
গার্ডরা আর প্রশ্ন করেনি তাকে।এমন মহিলাদের প্যাচে পড়ে চাকরি খুয়ানোর ইচ্ছে নেই তাদের।

ভেতরে প্রবেশ করতেই অবাক হচ্ছে সে ক্ষণে ক্ষণে।নারী পুরুষ মিলে বেশ ভালোই উপস্থিতি সকলের।তৃপ্তি যতটুক বুঝলো,গোপনে ধরা পড়া আসামীদের এইখানে শায়েস্তা করা হয়।তৃপ্তির বেশভূষা তাকে নববধূ মনে হলেও,তাকে পাত্তা দেওয়ার সময় কই!স্বাভাবিক ভাবে গোয়েন্দারা নানান রূপ ধারণ করে অপরাধীকে ধরতে।

আদ্রিনের খোঁজ নেওয়ার পূর্বেই তন্ময়কে দেখলো তৃপ্তি।দ্বিতীয় ফ্লোরে।দুবার ডাকলো।শুনলো না তন্ময়।তৃপ্তি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তন্ময় লিফটে ঢুকে পড়লো।তৃপ্তি তো জানেনা,তন্ময় আর আদ্রিন জরুরি তলবে এসেছে এইখানে।তাই তন্ময়ের এমন চঞ্চলতা।

তব্দা বনে যায় তৃপ্তি।বিরক্তিতে গা ভার হয়।অর্ধেক সিঁড়ি হতে ফিরতেই বিকট শব্দ হয়।ধোঁয়া চারিদিক।ছুটতে শুরু করে সকলে।একে একে সে দেখে,সাধারণ মানুষগুলোর অসাধারণ রুপ।সকলের নিকট বন্দুক।তীব্র ছোটাছুটি।মুখে গামছা বাঁধা কিছু লোককে লক্ষ্য করতেই পিলে চমকে উঠে তৃপ্তির।
সন্ত্রাসী? দিশেহারা হয়ে সকলের মতো উপরে উঠে দৌড়ানো শুরু করে তৃপ্তি।যে যেদিকে পারছে ছুটছে।

তার তলায় বিল্ডিংয়ের পরিপূর্ণ ভাব শেষ। পাঁচ – ছয় তলায় কাজ চলছে।উপরের দিকে তাই কেমন অগোছালো।
তিনতলা হতে তৃপ্তির দৃষ্টি উপরেই গেলো।সে ভাবলো সেখানে লুকাবে আদ্রিনকে ফোন করবে।সেটা আর হলো কই!তৃপ্তির হাতে মোবাইল নেই। ছুটতে গিয়ে কবে কোথায় ফেলেছে মনে নেই তার। মুখে গামছা আবৃত কিছু লোক উপরে আসতে লক্ষ্য করলে তৃপ্তির আঁখি ভার হয়।চোখ জুড়ে কান্নার রোল।কি হবে আজ তার সাথে!
প্রাণপণে ছুটতে নিলে হঠাৎই তন্ময়ের নজর আটকে যায় তৃপ্তিতে।পাশে উপস্থিত আদ্রিনকে গার্ড দিচ্ছিলো সে।মূলত এইখান থেকে বেরুনোর জন্যেই প্রস্তুত তারা।
তৃপ্তির অবয়ব পেছন হতেই পরিচিত আদ্রিনের।তন্ময় তার মুখ দেখেছিল স্পষ্ট।

রাগে, ক্ষোভে,অন্ধ বনে আদ্রিন।হিংস্রতায় গা ছমছম তার। কি করবে সে এই মেয়েকে আজ!আর কি বা করবে ঐ সন্ত্রাসীদের!
হুংকার ছাড়ে সে,
–“তন্ময়,আই ওয়ান্ট ব্যাকআপ!”
–“স্যার,এটা রিস্ক।”
তন্ময়ের কথা শোনার সময় নেই আদ্রিনের। ছুটে যাচ্ছে।সামনে যে বা যারা আক্রমন করছে সবাইকে আহত করছে ছেলেটা।এতক্ষণ বাদে নিজের কোমরে গুঁজে থাকা লাইসেন্সপ্রাপ্ত পিস্তলকে কাজে লাগানো শুরু করেছে আদ্রিন।

উপরে উঠতেই আদ্রিন অবাক,কিংকর্তব্যবিমূঢ়।লোকগুলো নেই।সতর্ক হয় সে। জানটা তার শুকিয়ে যাচ্ছে।তৃপ্তিকে দেখার জন্যে তার মনটা বুঝি এখনই শহীদ হবে। এই প্রথম আদ্রিন টের পাচ্ছে,তার মনেও ভয় আছে।অথচ,আগে কখনো এমন ভোঁতা ভাব আসেনি তার অন্তরে মস্তিষ্কে।মেয়েটা যদি কখনোই তৃপ্তি না হতো,আদ্রিন ইহকালে তার জীবনে ভয়ের আবির্ভাব টের পেতো না।
উপরে পদস্থলের শব্দ।পানিতে হাঁটলে যেমন জবজব শব্দ হয় তেমন।সেই শব্দ লক্ষ্য করে আদ্রিনও উপরে উঠছে।পুলিশের মাইকিং হচ্ছে।পরিস্থিতি নিচে নিয়ন্ত্রণে। তন্ময়ও ছুটছে তাদের ব্যাকআপ দল নিয়ে।উপরের দিকটা একটু হযবরল।
——
তৃপ্তি ড্রামের পেছনে লুকিয়ে।এইখানে তিনটা লাইট।কম পাওয়ারের। কেঁদে কুটে ভয়ে অস্থির সে।মনটা এখনো আদ্রিনের নাম জবছে।হঠাৎই আওয়াজ হয়।পেছন হতে সরে যায় ড্রাম। কেঁপে উঠে তৃপ্তি।তার চুল ধরেই টেনে তুলে একজন।লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না।গামছায় আবৃত। হাতের বন্দুক গলার সাথে ঝুলানো।
লোকটা তাকে ধরতেই পেছনের জন হেসে বলে,
–“ডিবি,গোয়েন্দারা এতো সুন্দরী অফিসার নিয়োগ দেয় তাদের মনোরঞ্জনের জন্যে?”
–“হ।দেখ না।কেমন সুন্দর! হাতে মেহেন্দি। এটারে ডিবি মনে হয় না।”
–“না হউক।এর মাইদ্ধমে আমরা বাইর হমু। পাশা ভাইরে খুঁজার জন্যে আমরা সকলে আইছিলাম রাঁধুনী হইয়া।তবে জানলাম তারে মাইরা ফেলাইসে বহুত আগে।”

লোকটার কথা শেষেই সাথে সাথে গুলির শব্দ হয়।লোকটা বসে পড়ে হাঁটু গেরে।সাথে তৃপ্তিও।মেয়েটার চুল ছাড়েনি সে এখনো। আধ বোঁজা চোখে সে দেখতে পায়,আলোর নিচ বরাবর আদ্রিনের অবয়ব।কালো পাঞ্জাবিতে আচ্ছাদিত সে।মুখশ্রী ভয়ংকর।এমন রূপ তৃপ্তি ইহকালে দেখেনি। অপর লোক হামলা করতে গেলে আদ্রিন তাকে লাথি দেয়।ফলস্বরূপ সে পড়ে যায় এর নিচের তলায়।
সামনের দিকে আসা অবস্থায় লোকটা তার দিকে বন্দুক তাক করতে নিলে আদ্রিন দ্রুত এসে তার হাতের উপর উঠে দাঁড়ায়।পায়ের এবং হাতের ব্যাথায় লোকটা জর্জরিত।তৃপ্তি উঠে দাঁড়াতে চায়।কিন্তু,হুট করে পড়ার কারণে কোমরে হাল্কা ব্যথা অনুভব করে। পা’টাও অসাড় হয়।
তন্ময় এসে পেছন হতে হাঁক ছাড়ে,
–“স্যার!”
লোকটার মুখ চেপে ধরে আদ্রিন তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বলে,
–“লেট মি হ্যান্ডেল হিম।”(ওকে সামলাতে দাও আমাকে)।

তৃপ্তির ব্যথা কাতুরে মুখ দেখে আদ্রিন আঁখি বুঁজে। পরক্ষণে লোকটার মুখে জোরে লাথি দেয়।নাকমুখ ফেটে রক্তাক্ত হয় লোকটা।কেমন বিভৎস সে আর্তনাদ!আদ্রিনের কপালের রগের অবস্থা দেখে তৃপ্তির বেহাল দশা।লোকটা সর্বদা বলতো তার ভয়ংকর রূপ কখনো তৃপ্তি দেখলে সে সামলাতে পারবে না। হচ্ছেও তা,তৃপ্তির ভয় করছে তার স্নেহময় আদ্রিনকে।

আঘাতরত আদ্রিন একপর্যায়ে ক্ষান্ত হয় যখন লোকটা জ্ঞান হারায়।তন্ময়কে সে নির্দেশের সুরে বলে,
–“সবাইকে নিয়ে যাও।আমি আসছি।”
তন্ময় কিছু বলে না।চুপচাপ লোকটাকে বাকিদের ইশারা করে নিয়ে যেতে।পরপর সবাই নেমে পড়ে।

আদ্রিন হাঁটে ধীর পায়ে। আন্তঙ্কিত তৃপ্তির সামনে বসে। তৃপ্তির অবস্থা বেসামাল,টলমলে।তৃপ্তির বেশভূষা, হাতে মেহেদী সবকিছু যেনো তার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে না আজ।তৃপ্তি নিজেও কি জানে সে কোন জায়গায় এসেছে?তর্জনীর সাহায্যে আদ্রিন টোকা দেয় তৃপ্তির কপালে,
–“এটা কোন জায়গা?কেনো এসেছিস এইখানে?কে আসতে বলেছে?তোর তো এখন বাসায় ঘুমানোর কথা।”

তৃপ্তি কেঁপে উঠে।আদ্রিনের কণ্ঠ বড্ড ঠান্ডা। কাঁটা দিয়ে উঠে তৃপ্তির নরম শরীর।কম্পিত সুরে সে জবাব দেয়,
–“আপ..আপনার নামে মেসেজ এসেছিল।”
–“সিরিয়াসলি?সামান্য মেসেজ দেখে এই নরকে এসেছিস?তোর কিছু হলে আমি বাঁচতাম?বল বাঁচতাম?এতদিন দেখা না করে সহ্য করেছি তো।বিয়ের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবো বলিনি?তাহলে,কেনো!উফ,মাথা বিগড়ছে আমার।তোর কিছু হলে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো?”
আদ্রিন চিল্লিয়ে উঠলে তৃপ্তি দু হাতে মুখে ঢেকে কেঁদে দেয়।এই আদ্রিন তার বড্ড অপরিচিত।আসল উন্মাদের রুপ কি তাহলে এমন হয়!

আদ্রিন তৃপ্তিকে ধরতে গেলে সে দূরে সরে যায়,
–“আমি বাসায় যাবো।”
আর এটাই ছিলো আদ্রিনের মেজাজকে আরো বিগড়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।জোরে হুংকার ছাড়ে আদ্রিন,
প্রতিধ্বনিত হয় চারপাশ,
–“বাসায় ছিলি,এইখানে এসেছিস কেনো?আমার রূপ দেখতে?দেখেছিস?আমি এমন।ভয়ংকর আমি।আমার জান বা আমার কাজে যে হাত দিবে আমি তার জন্যে ভয়ংকর।”

তৃপ্তি কিছুই শুনছে না।বারংবার বলছে,
–“আমি বাসায় যাবো।”
পরক্ষণে আদ্রিন তাকে ছুঁতে নিলে তৃপ্তি আদ্রিনকে নিভু স্বরে বলে,
–“ছুঁবেন না।ভয় করছে।”

ক্রোধের দাবানলে আদ্রিনের শিরা উপশিরা টগবগে। বাঁকা হাসে সে,
–“কাল ছোঁয়ার কথা হলেও,আজ ছুঁয়ে দিই কেমন?”
তৃপ্তি ভীত দৃষ্টিতে তাকাতেই তাকে কোলে তুলে নেয় আদ্রিন।চিরচেনা সে গায়ের সুভাস নাকে এলে মন কিঞ্চিৎ শান্ত হয় তৃপ্তির।তাও,ভয়ে আড়ষ্ট সে।কি বললো আদ্রিন! লোকটা কি করতে চাইছে? রেগে যাওয়া স্বাভাবিক তার। কিন্তু পরিস্থিতি কি বুঝবে না এই লোক? তৃপ্তি ছুটতে চাইলে আদ্রিন জোরে ধমক দেয়,
–“সমস্যা কি?”
–“নামান আমাকে।বাড়ি যাবো!”
তৃপ্তি কথাটা বলতে বলতেই চারদিক তাকায়।সবদিকে পুলিশ আর কালো পোশাকের কিছু লোক।সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
আদ্রিন শক্তমুখে নিজের অধর তৃপ্তির কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“নামবে তো।আমার বাড়িতে,আমার বেডে।এরপর দেখি কিভাবে আমাকে ছুঁতে নিষেধ করো!”
–“প্লিজ নামান আমাকে।এইসব কি বলছেন?কালকেই বিয়ে।আর আজ!”

–“বিয়ে কাল না,আজ। আমাকে ভয় পাচ্ছো, কথাটা শুনে আমার বুকটা শেষ।বুকের ভেতরে ফাঁকা।তোমার এইখানে আসার ষড়যন্ত্র কে করেছে সব দেখে ছাড়বো আমি।আগে তোমার আর আমার বিয়ে হবে। ছুঁতে নিষেধ করে বড্ড ভুল করেছো,মেহেবুবা।”
কথার পরপর আদ্রিন তন্ময়কে ইশারা করে গাড়ির দরজা খুলতে।

চলবে…..
কপি করা বারণ।সকলের সুন্দর মতামতের আশায়।#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব – ৩০
__________________
৬৬.
–“গাড়ি সোজা বাড়ি যাবে,তন্ময়।”
আদ্রিনের কণ্ঠ বড্ড ঠান্ডা।এই কণ্ঠের সাথে যেনো আদ্রিনের ব্যক্তিত্বের মিল খুঁজে পায় না তৃপ্তি।সে লেপ্টে রইলো আদ্রিনের বুক গহ্বরে।চেয়েও সমান্তরাল হতে পারছে না।আদ্রিন তার কোমর শক্ত হাতে আকড়ে রইলো।সেই স্পর্শে তৃপ্তি তীব্র ক্ষোভের আভাস পাচ্ছে।
–“ওকে স্যার।কিন্তু,একটা কথা বুঝলাম না ম্যাডামের আইডি কার্ড ছাড়া কিভাবে গার্ডরা এন্ট্রি করতে দিলো?”
স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে তন্ময়।তার প্রশ্নে চিন্তার ভাঁজ পড়ে আদ্রিনের কপালে,
–“তারা সবাই একজোট ছিলো। রাঁধুনীর রূপ ধারণ করা সন্ত্রাসীদের সাথেই হাত তাদের।ওদের উদ্দেশ্যই ছিলো একাধারে সবাইকে হত্যা করা বা জিম্মি করা।তাই আইডি কার্ড নাকি অন্যকিছু দেখার তর সয়নি ওদের।ওদের দরকার ছিল মানুষ,যাদের তারা জিম্মি করতে পারবে বা মেরে ফেলতে পারবে।”

–“আমি দেখেছিলাম স্যার,বেরুনোর সময় গেইট ফাঁকা ছিলো।আমার মনে হয়,আপনার কথাটাই সঠিক।”
তন্ময় একমত হয় আদ্রিনের সমেত।
–“একটু সাবধানে চালাও গাড়ি। শর্টকাটের এই রাস্তাটা নড়বড়ে।”
আদ্রিন কথাটা বলে থামে।হৃদ মাঝারে আটকে থাকা প্রেয়সীর দিকে নজর দেয়।মেয়েটা তার বুকেই মুখ গুঁজে আছে।নিশ্চয় আদ্রিনের চোখে চোখ রাখার সাহস বা সুযোগ কিছুই পাচ্ছে না মেয়েটা!

আদ্রিন তার হাতের স্পর্শ দৃঢ় করলে তৃপ্তির সত্তা কাঁপে।সে আরো মিইয়ে যায় আদ্রিনের অভ্যন্তরে।

গাড়িকে তন্ময় দক্ষতার সাথে কন্ট্রোল করার চেষ্টায়। রাস্তাটা সরু এবং গর্তে ভরপুর।গাড়ির ঝাঁকুনির কারণে তৃপ্তির অস্বস্তি হয়।ব্যথা পাওয়া স্থানে আদ্রিনের হাত লাগতেই কুঁকিয়ে উঠে মেয়েটা,
–“আদ্রিন,ব্যথা পাচ্ছি কোমরে। পায়েও ব্যথা হচ্ছে।”
কান গরম হয়ে আসে আদ্রিনের। মুহূর্তেই মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে।গাড়ির ভেতরকার অ্যাটাচ লাইট জ্বালায় সে।বুক হতে তৃপ্তির মুখ উঠাতেই দেখে মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।আদ্রিনের রাগ কমলো না বৈকি বাড়লো। আলতো হাতে তৃপ্তিকে তার কোলে উঠিয়ে বসায়।সাবধানে,অতি যত্নে। ব্যথায় তৃপ্তি খাঁমচে ধরে আদ্রিনের বাহু।

–“পা আমার উরুর উপর রেখে বসো।”
আদ্রিনের সুরে তৃপ্তির বেশ কষ্ট হয়।লোকটা রেগে তার সাথে।অথচ তার রাগ ভাঙাতেই এই মেয়ে মধ্যরাতে একাই বাসা থেকে বেরিয়েছিল।আর এটাই তার বড় ভুল।মহৎ ভুল।তৃপ্তি জানতো না হিতের বিপরীত এতটা বাজে হবে।
আদ্রিনের কথা মতো তৃপ্তি পা রাখতে চায়।কিন্তু, পারে না। ডান পা অসাড়।মলিন কণ্ঠে মেয়েটা আওড়ায়,
–“পারছি না।পা ভার লাগছে।”

চোখ বুঁজে আবারও চোখ খুলে আদ্রিন।যে মেয়েকে সে নিজেই কোনোদিন আঘাত করার কথা ভুলেও ভাবেনি,সেই মেয়েকে নিজ দৃষ্টির সম্মুখে আঘাত পেতে দেখার মতো যন্ত্রণা আদ্রিন কখনো অনুভব করতে চায়নি।তবে,তাও সম্ভব হলো কেবল তারই মনের রাণীর জন্যে।এই তৃপ্তি নামের মেয়েটার জন্যে।বাম হাতটা এগিয়ে তৃপ্তির পা আগলে বেশ যত্নসহকারে নিজ উরুর উপর রাখলো আদ্রিন।

তৃপ্তির দৃষ্টি নিরুত্তর।খুব করে দোয়া করছে,আদ্রিন যেনো তাকে বাড়িতে রেখে আসে।যদিও জানে,আদ্রিন আর তাকে এখন বাড়ির কেউ একসাথে দেখলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।তাও,সমস্যা নেই।আদ্রিন যে তার হয়ে যাবে কাল সারাজীবনের জন্যে।

মিনিট তিনেক পরে তৃপ্তির ভ্রম ভাঙ্গে।তার মাথায় খেলে যায় আদ্রিনের সকল কথাবার্তা।ছেলেটা বলেছে তাদের বিয়ে আজ।তাহলে সত্যিই কি আদ্রিন তার কথা রাখবে?বাবা খুব কষ্ট পাবে।কাঁদবেও হয়তো!
নিজ বাড়ির রাস্তার মোড় চিনতে ভুল হয়নি তৃপ্তির।সে সহসা ছটফটিয়ে উঠে,
–“আমি বাড়ি যাবো,আদ্রিন!”
–“বাড়িই যাচ্ছি।তন্ময়,রাফিকে ফোন করেছিলে?”
আদ্রিন কেমন উপেক্ষা করলো তৃপ্তিকে।তাচ্ছিল্যের আভাস স্পষ্ট।

–“তখন নেটওয়ার্ক ছিলো না।ফোন যায়নি।টেক্সট দিয়েছিলাম।রিপ্লাই এসেছে।সবকিছুর এরেঞ্জমেন্ট শেষ।”
তন্ময় হাসে।ছেলেটাকে খুশি মনে হচ্ছে।

তৃপ্তি আদ্রিনের কলার মুচড়ে ধরে।আঁখি ভেসে যাচ্ছে অশ্রুজলে,
–“বাবা কষ্ট পাবে।কালকের দিনটাই তো আদ্রিন।এমন করছেন কেনো?আমি ভুল করছি মানলাম।এর জন্যে এমন শাস্তি দিবেন না প্লিজ।আমার সহ্য হচ্ছে না।”
–“কান্না থামাও।মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে আমার।যে মেয়েকে আজ গভীর রাতে ঘর থেকে বের করতে পেরেছে,সেই মেয়েকে কাল আমি খুঁজে পাবো,এটার গ্যারান্টি আমি পাচ্ছি না।হয় তোমার ফ্যামিলির কেউ বা আমার ফ্যামিলির কেউ তোমাকে ইচ্ছাকৃত ক্ষতি করার জন্যে বা আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্যেই এমনটা করেছে। ভুল করেছো তুমি,ওদের ফাঁদে পা দিয়ে। সরি টু সে,আমি আমার জানের উপর আর রিস্ক নিতে পারবো না।”
রুঢ় কন্ঠটা তৃপ্তির শরীর অসাড় করে।বাবার কথা মনে আসতেই বুকটা কেমন পীড়া অনুভব করছে। তৃপ্তি ভাবতে পারছে না,আদ্রিনকে দেখার লোভটা অন্য কেউ বাজে ভাবে ব্যবহার করেছে তাদের আলাদা করার জন্যে!

শেষবারের মতো আকুতি করে সে আদ্রিনের গালে হাত রেখে,
–“আপনি এমন করছেন কেনো?আমার ভুল হয়েছে বুঝলাম।আপনি আমাকে বাসায় রেখে আসুন। কাল সব ঠিক হবে।সবাই খুশি আছে।আপনার এমন কাজে হয়তো পরিস্থিতির রূপ অন্যরকম হতে পারে।”
আদ্রিন নিজ গাল হতে তৃপ্তির হাত সরায়।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিচেল কণ্ঠে শুধায়,
–“সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি করেছো।ছুঁতে নিষেধ করেছো।এমন কষ্ট আমার জীবনে আমি অনুভব করিনি।যারা আমাকে কষ্ট দেয় তাদের আমি দ্বিগুণ কষ্ট দিই।আর তোমার দেওয়া কষ্টটা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিবো অন্যরকম ভাবে।”
–“বাবা কষ্ট পাবে।”
–“পাক।আমিও পেয়েছি।এখনো পাচ্ছি।ভুলতে পারছি না কিছু।”
–“আদ্রিন!”
–“কি?আরেকবার কথা বললে ভুলে যাবো গাড়িতে তন্ময় আছে।”
নিষিদ্ধ কিছু ইশারা বুঝতে পেয়ে নজর ঝুঁকায় তৃপ্তি।আদ্রিনের দিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র সাহস নেই তার।আর কিছুই হাতে নেই তৃপ্তির।কেনো সে ঐ সময়ে অহেতুক কথাটা বললো!ছেলেটার মেজাজ হুটহাট বিগড়ে যায় এটা অজানা ছিলো না তার।
বাকি রাস্তায় আর একটা শব্দ আওড়ায়নি তৃপ্তি।না কিছু বলেছে আদ্রিন।আবাসিক এলাকায় গাড়ি প্রবেশ করতেই আদ্রিন ফোন করে রিয়ানাকে।বলে,ঘরের দরজায় যেনো উপস্থিত থাকে রিয়ানা।
__________
গাড়ি থামলে তৃপ্তিকে সিটে বসিয়ে আদ্রিন নামে।তৃপ্তির নজরে ইনায়া এবং আদ্রিনের দাদী ছাড়া সকল মহিলার অবয়ব দৃশ্যমান।আদ্রিনের হলুদের অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারেই হয়েছিলো এবং শেষও হয়েছিলো অতিদ্রুত।স্বয়ং বর যখন অনুপস্থিত থাকে অনুষ্ঠানে,তাহলে সেই অনুষ্ঠান টেনে নেওয়ার মানে হয় না।তাই সকলে দ্রুত ফিরে এসেছিলো বাড়িতে।তৃপ্তিকে আদ্রিন আলগোছে নামালে,রিয়ানা এবং আদিবা এগিয়ে আসে।বাকি মহিলারা ভেতরে চলে যায়।তৃপ্তি দাঁড়াতে পারছে না।পায়ের গোড়ালি মচকেছে।কেমন অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে তার পায়ে।রিয়ানা আর আদিবা তাকে আগলে নিয়ে সম্মুখে হাঁটতেই আদ্রিন অনুভব করে তৃপ্তির কষ্টটা।হাঁটতে পারছে না মেয়েটা।তার উপর কোমর উন্মুক্ত মেয়েটার।শাড়ির পিন এতো ভেজালে নিশ্চয় টিকে থাকবে না!কোমরেও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট।ক্রোধে আঁখি জোড়া রক্তিম হয়।তৃপ্তির শুভ্র কোমরে কালসিটে চ্যাপ্টা দাগ।
আদ্রিন দ্রুত পায়ে এগোয়।কোমরের উপরে শাড়ি টেনে নিজেই তাকে কোলে তুলে নেয়।

আতঙ্কিত তৃপ্তি বললো না কিছুই।পায়ের গোড়ালিতে বড্ড পীড়া।আর না বললো রিয়ানা এবং আদিবা।আজ কারো মুখে হাসি নেই।সবাই জানে,আদ্রিনের মেজাজ ঠিক কতটা বিগড়ানো।নাহলে ছেলেটা এমন আজগুবি সিদ্ধান্ত নিতো না ইহকালে।

সোফায় তৃপ্তিকে বসানো হয়।রহস্যময়ভাবে তাদের বিয়েটাও হয়ে যায়।কাজী উপস্থিত ছিলেন পূর্ব হতে। ইনায়া বা দাদীও বলেনি কিছু।চুপ করে সবাই সবটা দেখলো কেবল।রাফি চুপিচুপি কিছু মুহূর্ত ফ্রেমবন্ধী করলো ক্যামেরায়।ইসলামী নিয়মে বিয়েটা আজ হলেও সিগনেচার হবে আগামীকাল।

কাজী যেতেই ইনায়া এইবার মুখ খুলে,
–“কি হয়েছে বলবে কিছু?”

আদ্রিনের নজর তৃপ্তিতে আটকে। ঘোমটা টানা তার প্রেয়সীর মুখটা ব্যথায় কাতর।প্রাথমিক চিকিৎসা দরকার।এর জন্যে আদ্রিনই যথেষ্ট।
আদ্রিনের নিরুত্তর থাকায় তার দাদী বলে উঠে,
–“কালই বিয়ে।আর আজ এতো নাটক করতে হলো?সবকিছু মেনে নিয়েছিল দুই পরিবার।তারপরও নাটক করতে হলো কেনো?”
–“নাটক আমি করিনি,না তৃপ্তি করেছে।একটা বড় ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।কালকের দিনটা হয়তো কোনো দিন আসতোই না আমাদের জীবনে!”
আদ্রিন থমথমে কণ্ঠে বলে।
–“মানে কি?”
ইনায়ার কণ্ঠে ভয় স্পষ্ট।
–“ও ব্যথা পেয়েছে।আমি একটু পর আসছি।স্টাডি রুমে থেকো দাদী আর আম্মি দুজনেই।রিয়ানা আপু,তুমি তৃপ্তির বাবাকে ফোন করবে। দুঃখিত বলে বলবে,’তৃপ্তিকে জরুরি কাজে তোমার সাথে এনেছো এই বাড়িতে।আমরা দুইজনই আলাদা থাকছি,দেখা হবে না দুজনের বিয়ের আগে।ওর দিদাকেও চিন্তিত হতে মানা করবে।যদি বলে কাউকে জানায়নি কেনো তবে বলবে..”
থামে আদ্রিন। বাঁকা দৃষ্টিতে তৃপ্তির পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
–“বাসায় সবাই ঘুম ছিলো?যখন বেরিয়েছিলে?”
তৃপ্তি উপর নিচ মাথা নাড়ে। যার অর্থ -“হ্যাঁ”।
আদ্রিন আবারও বলতে শুরু করে,
–“বলবে,সবাই ঘুম ছিলো তাই তৃপ্তি কাউকে জাগায়নি।আর বাকি কথা তুমি সামলে নিও।আমার অসহ্য লাগছে সব।”

–“ওকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকখানি ব্যথা পেয়েছে।ডাক্তার ডাকবো?”
ইনায়ার বাক্যে স্পষ্ট চিন্তার ভাঁজ।তার কথার পিঠে আদ্রিন জবাব দেয়,
–“প্রয়োজন হলে আমি ফোন করবো।”

কথা শেষে আদ্রিনের যেনো ব্যস্ততা বাড়ে।তৃপ্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে বলে,
–“দেখি,আসো।”

৬৭.
তৃপ্তি নিশ্চুপ।ডাগর দৃষ্টিতে রুমটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।রুমে এসে তৃপ্তির গোড়ালিতে ব্যথা নিষ্কাশনের স্প্রে করে আদ্রিন বিনা বাক্যে ট্রাউজার আর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।
এইদিকে তৃপ্তির কোমরের ব্যথাটা কিছুতেই কমছে না।কোমরের নিচে বালিশ দিয়ে শুতে গেলেও পীড়ায় ঝনঝন করে উঠে শরীর। মাত্রারিক্ত যন্ত্রণায় শরীরটা কেমন নেতিয়ে যাচ্ছে যেনো।একদিক দিয়ে সে চিন্তামুক্ত।তার বাবা এখন আর ভুল বুঝবে না তাকে।
রিয়ানার কথা বাবা নিশ্চয় বিশ্বাস করবে।আদ্রিন তার সাথে যতটা জিদ দেখাতে চায় ততটা সে পূরণ করেনি।ছেলেটা হাজার হলেও সবকিছুতে তৃপ্তির সুখটা আগে চিন্তা করে।এটা ভাবতেই তৃপ্তির মন প্রশান্তিতে ভরে যায়।
ওয়াশরুম হতে আদ্রিন বেরোয় গোমড়া মুখে। হাতে ভেজা টিশার্ট। হয়তো টিশার্ট ওয়াশরুমের মেঝেতে পড়েছে।উদোম শরীরের আদ্রিন এখন তৃপ্তির নিকট হালাল।এই ছেলের উপর অধিকার কেবল তৃপ্তির।বিস্ফোরিত নজরে মেয়েটা তার প্রেমিক পুরুষের অবয়বে চেয়ে রয়।
সুঠামদেহী তার সঙ্গীর সত্তাকে নিজ হাতে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছাটা হঠাৎই মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তৃপ্তির।
সে হাতের ইশারায় গলা জড়ানো কণ্ঠে ডেকে উঠলো আদ্রিনকে,
–“এইদিকে আসুন।আমার কোমরে যন্ত্রণা হচ্ছে।”

তাওয়ালের সাহায্যে আদ্রিন মাথা মুছে।চুলগুলো এলোমেলো।তাদের আবার নিজ আঙ্গুলের সাহায্যে সঠিক স্থানে বসিয়ে দেয় আদ্রিন। সহসা সে এগিয়ে যায় তৃপ্তির সম্মুখে।বিছানায় পড়ে থাকা তৃপ্তির আঁচল নিজ হাতে পেঁচিয়ে নেয়। এতে কিঞ্চিৎ শঙ্কিত হয় তৃপ্তি। হঠাৎই মনে আসে,আদ্রিনের কঠোর বাক্য।এখন কি ছেলেটা তার সাথে ঘনিষ্ট হবে?মানা করার সাহস নেই তৃপ্তির।আদ্রিন এইভাবেই বড্ড ক্রোধে আক্রান্ত আজকের ঘটনার জন্যে।

বিনা বাক্যে তৃপ্তির পাশে বসলো আদ্রিন। আঁচল টেনে আরো কাছে আনলো তার প্রেয়সীকে। দুইজনাই বেশ কাছাকাছি।পরপর আদ্রিনের অধর ছুঁয়ে দেয় তৃপ্তির গলার ভাঁজে।আবেশে আদ্রিনের পিঠে হাত রেখে,তৃপ্তি কাতর ভঙ্গিতে বলে,
–“শুনুন।”
–“শুনবো না।আমার রাগ কমেনি।”

দৃষ্টি মিলে দুজনের।পরক্ষণে আদ্রিনের অধর নিজ অবস্থান জারি করে তৃপ্তির অধরে।আবেশের নতুন সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে প্রেমিক যুগল।আদ্রিন বেসামাল হতে গিয়েও সামলালো নিজেকে।তৃপ্তিকে নিজ বুক মাঝারে আগলে নেয়,
–“তোমার কিছু হলে,আমার সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতাম জান।তুমি আমার সব।”
তৃপ্তি হাঁপিয়ে উঠলো।লোকটার পুরুষালি অধর তার নরম ফোলা অধরের কিনারা কাটতে সফল। তাও দ্বিধা করছে না তৃপ্তি।সত্যি বিরাট ভুল করেছে আজ সে।দুহাতে পিঠ আঁকড়ে ধরলো সে আদ্রিনের,
–“আপনার সাথে কথা না বলে আমি আর কোথাও যাবো না,আদ্রিন।সরি।অনেক বেশি সরি।”
তৃপ্তির মাথার তালুতে ভালোবাসাময় স্পর্শ দিতে ভুলেনি আদ্রিন,
–“কখনোই যেনো ভুলেও না বলো,তোমাকে টাচ না করতে।মাথায় রক্ত উঠে যায় আমার,মেহেবুবা।”

তৃপ্তি হাসে।আদুরে ভঙ্গিতে দুহাত রাখে লোকটার ট্রিমকরা দাড়ির উপরে,
–“বলবো না।”
আদ্রিনের নেশাক্ত দৃষ্টি আয়ত্বে আসলে তৃপ্তি খানেকটা ঘাবড়িয়ে যায়। আদ্রিন তার আঁচল হতে পিন সরালে আঁচল নেমে যায় সম্পূর্ণ।লজ্জায় নুয়ে পড়ে তৃপ্তি।নিষিদ্ধ সত্তায় আঁখি স্তব্দ হলেও নিজেকে সামলায় বেসামাল আদ্রিন।ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আর কোনো ক্ষত আছে কিনা!নেই।শুধু কোমরেই চ্যাপ্টা ক্ষত।নির্দেশের সুরে সে তৃপ্তিকে বলে,
–“শুয়ে পড়ো সাবধানে।কোমর দেখি।”

নিজের মনের ভুলে নিজেই আড়ষ্ট হয় তৃপ্তি।আদ্রিন তার ক্ষত দেখতে চায় আর তৃপ্তি কি ভাবলো!আদ্রিন যদি জানে নিশ্চয় হাসবে তার উপর! দৃষ্টি মেলানোর সাহস হয়নি তৃপ্তির। উবু হয়ে শুয়ে পড়ে।ক্ষত দেখে আদ্রিন।মূলত অয়েনমেন্ট লাগালেই সেরে যাবে।আদ্রিন উঠে,ফার্স্ট এইড বক্স হতে অয়েনমেন্ট এনে নিজ কাজ সারে,
–“ঘুমিয়ে পড়ো। কাল বিয়েটা ঠিকভাবে হউক এটাই চাই।”
–“ব্যথা না সারলে?”
–“সারবে জান।আজ ছাড় পাচ্ছো বলে ভেবো না সবসময় দূরে রাখবো আমার থেকে!এইযে তুমি আমার জন্যে হালাল কিন্তু তাও তোমাকে স্পর্শ করতে দ্বিধা।যদি শরীর খারাপ হয় তোমার!এইসব কষ্ট বুঝবে না তুমি।”
আদ্রিনের কণ্ঠে দুষ্টুমি ভরা অসহায়ত্ব।তৃপ্তি আবারও হাসলে আদ্রিন তার পানে চেয়ে রয়।বউ রূপে মেয়েটাকে কি একটু বেশি মনোরম লাগছে?
আদ্রিন বেশ নিকটে আসে তৃপ্তির।তার ঘন নিঃশ্বাসে ঘায়েল হচ্ছে তৃপ্তির ছোট্ট তনু।

–“এমন নেশাক্ত হওয়াটা কি খুব দরকার ছিল? নেশাক্ত হয়েও নেশায় মত্ত হতে দিলে না।পাষাণ মেয়ে।”
–“আমার আপত্তি ন…”
তৃপ্তির অধরে আঙ্গুল ঠেকায় আদ্রিন,
–“একটা শব্দও না।পারবে না সহ্য করতে।ঘুমাও।”
মাথা নাড়ে তৃপ্তি,
–“আপনি ঘুমাবেন না?”
–“আম্মির সাথে কথা বলবো আগে।”
অতঃপর তৃপ্তি তার প্রিয়তমের উদর জড়িয়ে ধরে।ব্যথানাশক ঔষধের জেরে এইভাবেই তার আঁখি ভার।আদ্রিন আলগোছে মাথায় হাত ছুঁয়ে দিতেই মেয়েটা নিদ্রায় শায়িত হয়।
পাতলা কম্বল টেনে ঠিকভাবে তৃপ্তির মাথা বালিশে রাখে আদ্রিন।আরেক নজর তৃপ্তির পানে চায় সে।মেয়েটা এইখানে ঘুমাচ্ছে,তার কাছেই আছে এতে যেনো তার সকল প্রশান্তি নিহীত।

পরক্ষণে আজকের ঘটনা মনে আসতেই গম্ভীরতা ভর করে আদ্রিনের মুখশ্রীতে।

স্টাডি রুমে গেলে তার মা এবং দাদীকে দেখতে পায়।আদ্রিনকে দেখে তার মা প্রশ্ন করে,
–“ঘুমিয়েছে?”

–“কে করেছো তৃপ্তির সাথে এমন?”
আদ্রিনের সরাসরি প্রশ্নে আঁতকে উঠে দুজনেই।

ইনায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
–“মেয়েটা তোমার জীবনে কি,সেটা আমি ভালো জানি।এই মেয়েকে আমি কেনো কষ্ট দিবো?”
আদ্রিন তার দাদীর পানে তাকালে মহিলা আমতা আমতা করে শুধায়,
–“আমার এই বয়সে এইসব ভাববো নাকি আমি?”

আদ্রিন বাঁকা হাসে।দুহাতে টেবিলে ভর দেয়।আক্রোশ ভরা কণ্ঠে গর্জন করে,
–“সে যেই হোক।অবশ্যই সে এই পরিবার নাহলে তৃপ্তির পরিবারের কেউ।বিলিভ মি,যেদিন আমি জানবো আমার মেহেবুবাকে যে আমার থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে,তাকে আমি নিঃশেষ করবো।একেবারে নয়।ধীরে ধীরে।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here