#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -(৭এবং ৮)
_____
(১৮)
আদ্রিনের তুলে দেওয়া ওড়নার অংশটুকু আঁকড়ে বসে রইলো তৃপ্তি।রাস্তায় প্রচুর ট্র্যাফিক।সাথে ট্র্যাফিক পুলিশের চেঁচামেচি এবং বাঁশির সুর।আদ্রিনের বলা শেষ কথাটুকুর গভীরতা জিজ্ঞাসা করার পূর্বে ছেলেটা চোখের ইশারায় অভয় দেখিয়ে বিদায় জানিয়েছিল তৃপ্তিকে।মাঝে মাঝে তার এমন হুটহাট কথার ছল বড্ড ভাবায় তাকে।এইভাবে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা করাটাও রুচিতে বাঁধে তার।যদি হিতের বিপরীত হয়?লোকটা যদি দূরত্ব তৈরি করে তাদের মধ্যিখানে?ভয় হয় তৃপ্তির।মনের অভ্যন্তরে আদ্রিন নামক মানুষটা পূর্ব হতেই ব’ন্ধী।তার আশেপাশে থাকলে কেমন এক প্রশান্তি অনুভব করে সে।আচ্ছা,তার মাও কি এমন প্রশান্তির খোঁজ পেয়ে জাত,ধর্ম ভুলে তার বাবাকে ভালোবেসেছিলো?হ্যাঁ,এটাই তো উত্তর।তবে,তাদের
ভালোবাসার শেষটা সুন্দর হয়নি কেনো?কেনো তার মাকে এই পার্থিব জগৎ ছাড়তে হলো?কেনো বাবা মায়ের মাঝে সেই ভালোবাসা ফিঁকে পড়েছিলো?যুগলদের ভালোবাসা কেবল বাড়ার কথা,তাহলে নিঃশেষ হলো কেনো?তৃপ্তির মস্তিষ্কের কাজ স্থগিত।আদ্রিনের ব্যাপারে সামান্য গভীরতম ভাবনা তার মনকে পাহাড় সমান প্রশ্নে হারিয়ে যেতে বাধ্য করে।মেয়েটার মন উদ্বিগ্ন আবার বিষন্ন।আদ্রিনের উপস্থিতি তাকে রঙিন দুনিয়ার ইঙ্গিত দিলেও মনের গভীরে সেই রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তোলার দুঃসাধ্য তৃপ্তির হবে কিনা,জানেনা মেয়েটা।আর না জানে আদ্রিন ঠিক কি অনুভব করে তার প্রতি।সবটা কেমন ধোঁয়াশা।অস্থিরতায় বুদ হয় তৃপ্তি।পরক্ষণে আঁখিতে ভাসলো আদ্রিনের বাঁকা হাসির চিলিক পরপর ভাসলো তার মায়ের মৃ’ত চেহারা।বুকে ধ্বং’সযজ্ঞ চালু হলো মুহূর্তেই।পরপর তার কানে মায়ের মৃত্যুদিনের নিজস্ব আর্তনাদ ভেসে এলো।রিক্সার হুড শক্ত করে ধরলো মেয়েটা।এই শব্দ তার সহ্য হয় না।
মাথায় তীব্র যন্ত্রণার আগমন ঘটলে তৃপ্তি বাজারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলালো।ইতিমধ্যে হাত শরীর টলমলে।কেবল বাড়ি ফিরে চোখ বুজে শুয়ে থাকার অপেক্ষায় সে।রিক্সা থামলো নির্দিষ্ট বিল্ডিংয়ের সম্মুখে।ভোলা মনের তৃপ্তি ব্যাগ হতে প্রাপ্য ভাড়া রিক্সা চালকের সামনে ধরলেই সরল হাসলো বৃদ্ধলোক,
–“ঐ বাবাটা ভাড়া আগেই দিছে,মা।”
তৃপ্তি দৃষ্টি উপরে তুললো।তার অন্যমনস্কতায় সে ভুলেই বসলো আদ্রিন ভাড়াটা মিটিয়েছে পূর্বেই।তৃপ্তি ভাড়াটা ব্যাগে পুরলো,
–“ভুলেই গিয়েছিলাম চাচা।”
রিক্সা চালক কেবল হাসলো বিনা বাক্যে।
গেইটে ঢুকতেই তার সাথে সাক্ষাৎ হলো তার কাকা এবং কাকাতো ভাই অর্কের।কাকা অনির্বাণ হেসে কুশল বিনিময় করলো তৃপ্তি সমেত,
–“ক্লান্ত লাগছে কেনো আমার তৃপকে?”
–“ট্র্যাফিক,কাকা।”
ক্লান্ত সুর তৃপ্তির।
–“যা উপরে।দাদা তোর জন্যে লাচ্ছি এনেছি। মা তোর জন্যে খাবার নিয়ে এসেছে।”
অর্ক তৃপ্তির মাথায় স্নেহের মায়ায় হাত রাখলো।
–“প্রাণ জুড়াবে এইবার,দাদা।তোমরা খেয়ে যাচ্ছো না?”
তৃপ্তি হাসিমুখে প্রশ্ন করলো।
–“খেয়ে নিয়েছি।দোকানে ফেরা লাগবে।দাদা একা সেথায়।”
অনির্বাণ চলে যাচ্ছে।অর্ক তার পিছে।তৃপ্তির ব্যথিত হৃদয় বড্ড জানতে চেয়েছে,”বাবা খেয়েছে তো?”
ক্রো’ধের দা’বানলে সেই কথা অন্তরের গভীরতায় পিষলো মুহূর্তেই।অনুভূতিহীন মুখশ্রী ব্যক্ত রেখে সে উপরে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হলো।
খাওয়ার পর্ব শেষে সকলেই আলাপ জুড়িয়েছে।তবে তৃপ্তি ঘুমে।মেয়েটা ভীত এবং মনের পীড়ায় পীড়িত। রিক্সায় অবস্থানকালীন অস্থিরতার কারণে কোনমতে খাবার পর্ব চুকে সকল অস্থিরতা মস্তিষ্ক হতে বিদায় জানাতে মেয়েটার এমন কাজ।উপস্থিত সকলে তৃপ্তির আরামদায়ক তন্দ্রা দেখে মুচকি হাসে।অথচ কেউ জানেই না,সকলের সম্মুখে উপস্থিত এই হাসিখুশি তৃপ্তির মনের অবস্থা কতোটা উত্তাল!তৃপ্তি কাউকে বুঝতেই দেয় না।
.
হঠাৎই প্রেজেন্টেশনের খবরে চমকালো তৃপ্তি।ঘুমঘুম অবস্থায় এহেন খবর তার সহ্য হলো না।এলার্মের পূর্বে আলেয়ার ফোনেই তার তন্দ্রা ছুটেছে সুদূরে।প্রেজেন্টেশনের কথা শুনেই মাথায় যেনো বাজ পড়লো দুজনার।তৃপ্তি ক্ষিপ্ত কণ্ঠে আওড়ালো,
–“ভেবেছিলাম তোর বাসায় এসে পেইজের কাজটা ঠিক করবো।সেলের হিসাব নিকাশ শেষে দুই বান্ধুবি মিলে নিজেদের জন্যে ভালো কিছু কেনাকা’টা করবো।কিন্তু সব মাটি হলো।”
আলেয়ার মনটাও কেমন বিষিয়ে,
–“আর বলিস না। ফেসবুকে হুট করে নোটিশ দেখেই তোকে জানালাম।আজকের জন্যে সকল অর্ডার স্থগিত করার নির্দেশনা দে পেইজে।কালকের প্রেজেন্টেশনের নাম্বার যোগ হবে ফাইনাল পরীক্ষায়।”
–“হুম বুঝেছি।উফ, কাল আবারও শাড়ি!”
তৃপ্তি বড্ড বিরক্ত।
–“জ্বী,তৃপ।এটা ইয়াকুব স্যার।উনার প্রেজেন্টেশনের জন্যে ড্রেসিং সেন্স পুরো ভার্সিটির জানা।”
–“অসহ্যকর।কাল জলদি আসিস তবে।রাখছি।”
কথার সমাপ্তি ঘটলে তৃপ্তি পেইজে জানিয়ে দেয়,”আজকের জন্যে সকল অর্ডার স্থগিত। কাল সন্ধ্যা হতে পুনরায় অর্ডার কার্য পরিচালনা করা হবে।”
তিরিক্ষি মেজাজে তৃপ্তি ল্যাপটপ চালু করে কাঙ্খিত প্রেজেন্টেশনের কর্ম সাধনে ব্যস্ত করলো নিজেকে।
(১৮)
আশিকের গ্রেফ’তারের খবর চ্যানেল জুড়ে।তাকে গ্রেফ’তারে আদ্রিনের সহযোগিতাকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এতে অবশ্য ইনায়ার পাওয়ার মুখ্য।ইতোমধ্যে ইনায়া ছেলের গুণগান গেয়ে ছেলেকে মিডিয়ার সামনে প্রশংসার পঞ্চমুখ করতে একটুও পিছপা হোননি।তাদের বাড়ির নিচেও প্রেসের ছড়াছড়ি।রাজনীতিতে যোগ না দিয়েও আদ্রিন তার পারিবারিক রাজনৈতিক সম্মানীর উন্নতি করলো নিজেরই অজানায়।তবে এতে ইনায়া খুশি।বরংচ বড্ড খুশি সে।এক ঢিলে তার দুই পাখি মা’রার কাজটা শেষ পর্যন্ত সফল হলো।আশিক জৈনের খবরটা আদ্রিনের কানে পৌঁছিয়েছিল স্বয়ং ইনায়া।আশিকের চক্রান্ত ফাঁস করার মতো দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারবে না বলে,ছেলেকে একপ্রকার চ্যালেঞ্জ করেছিল সে।তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আদ্রিন ঠিকই চ্যালেঞ্জে নেমে পড়বে এবং তার চ্যালেঞ্জ জিততে সর্ব পথ অতিক্রম করতে পিছপা হবে না। হলোও সেটা।এর দরুণ আজ তাদের রাজনৈতিক এবং পারিবারিক প্রশংসায় খবর এখন দেশ জুড়ে।এমনকি ভারতেও আদ্রিনের সাহসিকতার নাম ডাক ভালোই প্রাধান্য পাচ্ছে।
ইনায়া কনফারেন্সের ইতি টেনে বাড়ির ভেতরে চললো।মাথায় দেওয়া সাদা শাড়ির ঘোমটার পিন খুললো সে।সকলের সম্মুখে মিথ্যে হাসির দরুণ তার গালের ব্যায়াম করতে ভুলছেন না মহিলা।সোফায় গা এলিয়ে বসতেই মিনা ভীত চেহারায় এগিয়ে এলো।
–“কি হলো মিনা? এতো ভীত যে?”
ইতস্তত বোধ করছে মিনা।সে কিভাবে বলবে,স্পর্শিয়া আদ্রিনের কারণে নিজের শরীরে আঘাত করেছে!ইনায়া পূর্বে স্পর্শিয়াকে আদ্রিনের জন্যে কল্পনা করলেও,স্পর্শিয়ার খবরাখবর নিয়ে সব কল্পনা গুড়িয়ে দিলো ইনায়া।যেই মেয়ে রাতবিরাতে ছেলের সমেত কা’টায়,এমন ছেলেকে ইনায়া নিজের ছেলের বউ করবে?কস্মিনকালে নয়। এই ঘটনার দরুণ মিনাকেও কম অপদস্ত করেনি ইনায়া।
পুনরায় ইনায়ার ভ্রু কুঁচকে তাকানো লক্ষ্য করতেই মিনা এইবার মুখ খুললো,
–“আসলে,স্পর্শিয়া নিজের ক্ষতি করেছে।তার জন্যে আদ্রিনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া সে সহ্য করতে পারেনি।”
চোখ-মুখ শক্ত ইনায়ার পরপর কিছু বলতে নিলে সেথায় আদ্রিনের আগমন ঘটে।
–“কি হলো আম্মি?প্রস্তাব ‘না’ করে দিয়েছো কেনো?”
তির্যক হাসে আদ্রিন।এই প্রথম হয়তো তার মা মানুষ চিনতে ভুল করেছে।স্পর্শিয়ার কারণে মা ছেলের পূর্ব যুদ্ধ হলেও,প্রস্তাব ঠুকে যাওয়ায় আদ্রিন এই যুদ্ধে জিতলো।
–“তোমার বিয়ে আমার পছন্দ অনুসারে হবে আদ্রিন।ভুলে যেও না আমার একমাত্র ছেলে তুমি।”
ইনায়া কপট রাগী।
–“মায়ের আদরের অভাবে যখন ভুগেছি,তখন ছিলে না,আম্মি।আমার লাইফ,তাই সবকিছুর সিদ্ধান্ত আমিই নিবো।আফসোস হয়,যদি আমি জেদী না হতাম?কিন্তু তোমার কারণেই আমি জেদী।ভ’য়ংকর জেদী।আর আমার অন্যতম জিদ হলো তৃপ্তি।তাকেই আমি চাই।আগে থেকেই তো জানো,আম্মি।অ্যান্ড আই লাভ হার।”
সোফায় মায়ের মুখোমুখি বসলো আদ্রিন।ইনায়ার মুখশ্রীর রঙ বদলেছে।পরপর তার আঁখিতে ভাসলো পান্নার মুখশ্রী।নির্দ্বিধায় তৃপ্তির নাম পান্নার চেহারা মনে করতে বাধ্য করে ইনায়াকে।ক্ষিপ্ত হয় ইনায়া,
–“এটা সম্ভব না!কখনোই না।”
–“আমার জন্যে সব সম্ভব। আই লাভ তৃপ্তি।তাকে আমি আমার করেই দম নিবো।তুমি জানো,তোমার ছেলে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে।সো,চ্যালেঞ্জ একসেপ্টটেড আম্মি।”
ইনায়া কিছু বলতে নিলে সেথায় উপস্থিত হয় রাফি।হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে সে মোবাইল এগিয়ে দিলো মায়ের পানে,
–“দেখো,এটাই তৃপ্তি। আই মিন ভাইয়ার পছন্দ।”
মিনা মোবাইল হাতে নেয়।মেয়েটা বড্ড মায়াবী।হলদেটে শুভ্র গায়ের রঙে কালো রঙের কামিজে মেয়েটার সৌন্দর্যের খাঁজ ফুটে উঠেছে। নিঃসন্দেহে স্পর্শিয়া হতে মনোরম তৃপ্তি।সহজ সরল মিনা হাসলো,
–“মেয়ে তো সুন্দর।ভাবী একটু…”
মিনাকে মাঝ পথে থামলো আদ্রিন,
–“আমি চাই না তৃপ্তিকে নিয়ে খারাপ কিছু বলুক আম্মি।তাকে পছন্দ না করাটা আম্মির পার্সোনাল ব্যাপার।”
–“আদ্রিন তুমি!”
ইনায়া কথাটা পূর্ণ করলো না।তার দেবর আজম শেখ এসেছে,
–“ভাবী পাঁচ মিনিটে মিটিং শুরু হবে। দুইতলার স্টাডি রুমে আসো।”
গটগট পায়ে যেইভাবে আগমন হয়েছিল তার সেইভাবেই প্রস্থান ঘটলো আজমের।ইনায়া নিজেই উঠলো বিরক্তি নিয়ে।
মিনাও দৌড় লাগালো।ছোট জা নেই।মিটিংয়ের সকল খাবারের ব্যাবস্থা এখন তার দায়িত্বে।সকল নির্দেশনা সেই দিবে।
–“তৃপ্তির খবর নেওয়ার দরকার কি তোমার?”
আদ্রিনের কণ্ঠে গভীরতা।
–“ভাবী হবে।খবর নিবো না?”
রাফি হাসলো।
–“বেদরকারি কাজ আর যেনো না হয়।”
আদ্রিন নিজ কলার ঠিক করলো। রাফি হচকালো,
আদ্রিন কি তার কাজে রেগে?
–“ভাই,তুমি কি রেগে?আসলে আমি খবর নিয়েছি এমনটা নয়।রুদ্র বলেছে।আর ছবিটা সেই দেখিয়েছে।আমরা তোমার জন্যে হ্যাপি।অনেক অনেক হ্যাপি।”
রাফি নিজের মিথ্যেটা ঢেকে সত্যিটা প্রকাশ করলো।
–“রুদ্র!”
অবাক হলো আদ্রিন।
–“হুম হুম,রুদ্রের কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে ভাবীর প্রতি নজর রাখার কথাটাও ফাঁস করেছে সে।”
–“এই ছেলে এতো বাঁচাল!মেয়েরাও হয়তো এইভাবে পেটের কথা উগলিয়ে ফেলে না।”
আদ্রিন শার্টের স্লিভ টানলো।
–“বড়মা ভাবীকে মেনে না নেওয়ার কারণ কি, ভাই?”
আদ্রিন সোজা হয়ে বসলো।সম্মুখে খানিক ঝুঁকে বললো,
–“স্টপ রাফি!এটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আম্মির ছেলে বিয়ে করবে,আম্মি ছেলের বউ দেখবে।দেটস ইট!ইচ্ছাকৃত চাইলেও আমার মন থেকে তৃপ্তির নাম মুছে ফেলা ইমপসিবল।সে কেবল আমার এবং আমারই থাকবে।”
(১৯)
প্রেজেন্টেশনের বিরক্তিকর অধ্যায় শেষে তৃপ্তি কমন রুমে ফিরলো।হাত-খোঁপার বেহাল দশা।আয়নায় নিজের অবয়ব পরখ করলো।কাজল খানিকটা নিচে নেমেছে। টিস্যু সমেত কাজল ঠিক করলো সে।লিপস্টিকের আবরনে অধর রাঙালো পুনরায়।আলেয়া তার কাজকর্ম লক্ষ্য করে বললো,
–“কোথাও যাবি আবার? দেখা করবি কি কারো সাথে?”
–“হুম,পরিচিত একজনের সাথে।”
তৃপ্তি আলগোছে শাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত।
–“স্পেশাল কেউ?”
হাত থামলো তৃপ্তির।খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো,”হ্যাঁ,সবচেয়ে স্পেশাল সে।”
তবে পাষাণ মেয়েটা এমন কিছুই বলেনি।শক্ত ভঙ্গিতে কেবল আওড়ালো,
–” কিছুই না তেমন। শুধু পরিচিত।”
–“ওকে ওকে।তুই তাহলে ঠিকভাবে বাসায় ফিরবি।আমি লাইভ সামলে নিবো।অর্ডারের ব্যাপারে মডারেটরদের সাথে আলাপ করে নিবো,তুই শুধু ক্যাশ রিসিভ করবি।এই শীতের শেষে আবার বৃষ্টি আসছে কেনো কিজানি?আমি যাচ্ছি।”
মাথা দোলালো তৃপ্তি,
–“সাবধানে যা।”
আলিঙ্গন করলো দুজনে।আলেয়া রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মহিলা কমন রুম হওয়ায় এইখানে বাড়তি কোনো চাপ নেই।নির্দ্বিধায় সে নিজেকে পরিপাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেও এরমধ্যে তার নিকট ফোন আসে আদ্রিনের।
তৃপ্তি অগোছালো চুলে আঙুল চালিয়ে বেরিয়ে পড়লো।ভেবেছিল কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবে।তবে তা আর হলো কই!সিএনজি নেওয়ার পূর্বেই বৃষ্টির আগমন।ভিজে যাচ্ছে তৃপ্তির সত্তা। অস্ফূট কণ্ঠে “চ” উচ্চারণ করলো সে।এমন লম্বালম্বি যানবাহনের বেড়াজালে সে আটকে।আদ্রিন রেস্টুরেন্টে অপেক্ষারত।যদিও সে চেয়েছিল তৃপ্তিকে উঠিয়ে নিতে।তবে সেটা একেবারে বেকায়দা হওয়ায় তৃপ্তি বারণ করলো।
ভিড়ের মাঝে তৃপ্তি সিএনজি পেলো বহুকষ্টে। আঁচল সমেত মুখের পানিটুকু পুছলো সন্তপর্নে। শীতের শেষভাগে শীতের প্রকট হ্রাস পেলেও এই বর্ষণে হুট করেই সেটা বাড়ছে ক্রমাগত।ভেজা শাড়ির আঁচল অপর কাধেঁর অংশ ঢাকলো তৃপ্তি।ঠকঠক কাপছে তার অধর জোড়া।
মিনিট পাঁচেক পর পুনরায় আদ্রিনের ফোন আসলে তৃপ্তি কিছু বলার পূর্বেই অস্থিরতায় জর্জরিত আদ্রিনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
–“সিএনজি পেয়েছো কি?আমি আসবো?”
–“পেয়েছি।আমি আসছি।”
তৃপ্তির শীতল স্বর।
–“আসো।আমি নিচেই দাঁড়িয়ে,তোমার অপেক্ষায়।”
.
সিএনজি থামলো।ভাড়া মিটিয়ে তৃপ্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করলো রঙিন আলোয় ঝলমলে দুইতলা বিশিষ্ট রেস্তোরা।নিচের তলায় সোনালী রঙের আলোর নিচে সটান দাঁড়িয়ে আদ্রিন।চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।বাহিরে এখনো তুমুল বর্ষণ।আদ্রিন তাকে লক্ষ্য করেনি।একটা ছোটখাটো জ্যাম সৃষ্টি হলো রেস্টুরেন্টের উন্মুক্ত পার্কিং লটে।ব্যাগ মাথার উপর ধরে বৃষ্টি আগলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তৃপ্তি।
সে খানিক সামনে যেতেই আদ্রিনের দৃষ্টি আটকিয়েছে তার মেহেবুবার অবয়বে।মেয়েটা ভিজে জুবুতুবু।শাড়িটা কেমন লেপ্টে রইলো তার তনুয়।অদ্ভুত শিহরণ জাগলো আদ্রিনের সত্তায়।শাড়িতে তার মেহেবুবাকে বড্ড মোহনীয় লাগছে।কেমন এক অজানা নে’শায় মেতে উঠলো তৃপ্তি দ্বারা বি’ক্ষি’প্ত আদ্রিনের হৃদয়।
তবে,আদ্রিনের হুঁশ ফিরলো।ভেজা শরীরে তার মেহেবুবার উপর সে ছাড়াও আরো কিছু পুরুষের দৃষ্টি।হাত মুঠো হয় তার।তৃপ্তি গাড়ি ডিঙিয়ে আসতে সময় নিচ্ছে।সাথে তার অবয়বে ঝপঝপ বৃষ্টির বর্ষণের স্পর্শ।শক্তহাতে কাঁচের দরজা ঠেলে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লো আদ্রিন।চতুর দৃষ্টিতে গাড়ি ডিঙিয়ে সে মিনিটেই পৌঁছালো তৃপ্তির নিকট।আগলে নিলো তাকে। কাঁধে হাত দিয়ে আড়াল করলো তৃপ্তির আদ্র তনু।আদ্রিনের বিশাল দেহের আড়ালে তৃপ্তির তনু মুহূর্তেই নিরাপদে ঠাঁই পেলো।আদ্রিনের মুখশ্রী শক্ত।চারিদিকে রক্তিম আভাযুক্ত নয়ন বুলাতেই কাঙ্খিত মানুষগুলো নিজেদের দৃষ্টির হেফাজত করলো।
–“আদ্রিন!কি হলো?কই যাচ্ছি আমরা?”
আতঙ্কিত তৃপ্তি অবাকের অন্তিম পর্যায়ে।আদ্রিনের বুকে তার গাল লেপ্টে।ছেলেটা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও।এই ভরা বর্ষণে তৃপ্তির মিনিমিন কণ্ঠ আদ্রিনের কর্ণ গভীরে প্রবেশ করলো না। নির্দিষ্ট দূরত্ব হতে সুইচ চাপ দিলেই গাড়ি আনলকের শব্দের পাশাপাশি হেড লাইট জ্বলে উঠলো।
তৃপ্তিকে বসিয়ে আদ্রিন নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো।সে এখনো নিশ্চুপ।তৃপ্তি এখন আর মৌন রইলো না।বেশ কড়া সুরে বললো,
–“আমরা এইখানে কেনো?”
আদ্রিন এখনো মৌন।তবে তৃপ্তি খেয়াল করলো স্টিয়ারিংয়ে রাখা তার হাত মুঠ।আদ্রিন লুকিং গ্লাসের পানে চেয়ে।পেছনের গাড়িগুলো সরে যাচ্ছে।মিনিট দুয়েক পরেই আদ্রিনের গাড়ি নির্দ্বিধায় বেরুতে সক্ষম হবে।
–“আদ্রিন?”
আদ্রিনের কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিলো তৃপ্তি।এইবার আদ্রিন নিজের ক্রো’ধ দমাতে পারলো না।বেশ গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলো,
–“বৃষ্টিতে ভেজা কি খুবই দরকার ছিলো?”
এই যেনো অন্য আদ্রিন।তার চেহারার পরিবর্তন খুব করে লক্ষ্য করছে তৃপ্তি।রাগলে ছেলেটাকে দেখতে এতটাই মারাত্মক লাগে?রক্তিম আঁখি, গালের চাপা রীতিমত স্তব্ধ।এলোমেলো ভিজে যাওয়া চুল অযথায় স্পর্শ করছে আদ্রিন।
–“কিছু করার ছিল না।সিএনজি পেতে সময় লেগেছে।”
তৃপ্তি সরল ভাষায় জবাব দিলো।
–“আমাকে ফোন করা যেতো না?তোমাকে এমন ভেজা অবস্থায় কতজন দেখেছে ধারণা আছে তোমার!হুয়াই?কেনো তুমি এমনটা করলে?তুমি বৃষ্টিতে ভিজবে না।আর কখনো যেনো তোমার এমন রূপ বাহিরের কারো সামনে প্রকাশিত না হয়।আমার ভয়ং’কর রূপ ঠেলার ক্ষমতা নেই তোমার,মেহেবুবা।”
বোকা বনলো তৃপ্তি।কি তীক্ষ্ণ হু’মকি।তৃপ্তির গলার স্বর ফুরিয়েছে।আদ্রিনের স্থলে অন্য ছেলে হলে নিশ্চয় চুপ করে থাকতে পারতো না সে।কিন্তু কি হলো তার!আদ্রিনের সাথে তর্ক করার সাহস আজ কই?
২০.
–“আপনি আমাকে বকছেন?”
তৃপ্তি অসহায় ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো।
–“নাহ।”
আদ্রিনের শান্ত সুর।রাগ কমেছে তার।তৃপ্তির শুষ্ক মুখপানে চেয়ে রাগটা ঠেলতে পারলো না নামবিহীন প্রেমিকের মন।পুনরায় সে বললো,
–“আজ শাড়ি পড়লে হঠাৎ?”
–“প্রেজেন্টেশন ছিলো।”
–“শীত লাগছে?”
–“হ্যাঁ।”
–“পেছনের সিটে কোট আছে আমার।নাও।”
বাক্য ছুঁড়ে আদ্রিন নিজের প্রাইভেট কার স্টার্ট দিলো।পেছনে গাড়ির ভেজাল পরিষ্কার।পেছনের সিটে বাঁক ফেরার পূর্বে তৃপ্তি নিজের শাড়ি ঠিক করলো, ভেজা শাড়ি এবং চুল হতে পানি ছাড়ালো।নিজেকে সামলে পেছনে বাঁক ফিরে কোটের নাগাল না পেলে সে খানিকটা ঝুঁকলো সেথায়। যার দরুণ কোমরের দিকে লাগানো পিন ছুটে উন্মুক্ত হলো তার হলদেটে শুভ্র পিঠ এবং কোমরের কিছু অংশ।তৃপ্তির পানে ফিরতেই ভুল’বশত আদ্রিনের দৃষ্টি সেই নি’ষিদ্ধ স্থানে আটকালো।দৃষ্টি সংযত করলো আদ্রিন।ঠান্ডা ভাবখানার বদলে শরীরে ভর করলো উষ্ণতা।মুহূর্তেই নোনা ঘামের দেখা মিললো তার ললাটে।মেয়েটা আজ কেমন বেসমাল করছে তাকে।তবে মনের অবস্থা ব্যক্ত করার মতো সময় হয়নি এখনো।তৃপ্তিকে নিজের প্রতি দূর্বল হতে সে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। আড় চোখে তৃপ্তির পানে পুনরায় দৃষ্টি আবদ্ধ হলো আদ্রিনের। কোট পড়তে গিয়ে মেয়েটা আবারও অগোছালো হচ্ছে।শাড়ি সরে উদরের নিষিদ্ধ স্থান দৃশ্যমান হওয়ার পূর্বেই আদ্রিন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–“তুমি বড্ড অগোছালো।”
তৃপ্তি ইঙ্গিত বুঝলো কিনা তার বোধগম্য হলো না।সে দুই হাতে গলিয়ে কোট দ্বারা আবৃত করলো নিজেকে,
–“আমি কি করেছি?”
–“তুমি কিছু না করেই আমাকে বেসামাল করছো।আর কিছু করলে তো তোমারই বিপদ।”
কথাগুলো মনে মনে আওড়ালেও মুখে সে বললো,
–“ভার্সিটিতে শাড়ি পড়ে সাবধানে থাকো তো?”
–“হুম।সাবধানে থাকি।এইসব খোলামেলা আমার নিজেরই অপছন্দ। লাভি আমাকে ঠিকভাবেই শাড়ি পড়িয়ে দেয় সর্বদা।”
–“সাবধানে থাকায় ভালো।নাহলে তোমার কারণে অন্যর প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে।”
আদ্রিনের কথার সুর অন্যরকম।খুবই রহস্যময়ী গম্ভীরতা বিদ্যমান এই সুরে।অথচ কিয়ৎ পূর্বেই কতো না সুরেলা ছিলো এই কণ্ঠস্বর।
–“কার প্রাণ?”
উৎসুক তৃপ্তির মন।
–“তোমার পানে যার কুদৃষ্টি পড়বে তার।”
কথা শেষে হাসলো আদ্রিন।তার কথা ছলনা হিসেবে গ্রহণ করলো তৃপ্তি।সে একটাবার আদ্রিনের কথার গভীরতা আন্দাজ করতে সক্ষম হলো না।ভেজা শার্টে আঁটসাঁট আদ্রিনের বাহু পানে সে চেয়ে।লোকটা ব্যাপক আকর্ষণীয়।নিজের মনের নিষিদ্ধ কল্পনা জোর করে বন্ধ করলো তৃপ্তি।তার জীবনে সুপ্ত অনুভূতির কোনো মূল্য দিতে না চাইলেও বেহায়া মন বারংবার সেই লোভ সামলাতে পারে না।
বাহিরের দিকে দৃষ্টিবদ্ধ রেখে সে আদ্রিনকে প্রশ্ন করলো,
–“কোথায় যাবো আমরা?”
–“আজ কোথাও যাওয়া হবে না।আমি খাবার কিনবো, প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করে গাড়িতেই লাঞ্চ সারবো।”
আদ্রিন ভেজা সড়কে সাবধানতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত।
–“কেনো?আজ কিন্তু আমি পেমেন্ট..”
–“তোমার সাথে আমি আর্থিক লেনদেনে ইন্টারেস্টেড না।আমি সাথে থাকলে সব খরচের দায়িত্ব আমার।”
তৃপ্তির কথার পিঠে বললো সে।
–“কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেনো না?আমাকেও তো সুযোগ দিন!”
–“তোমার সাথে টাকার লেনদেন আমার পক্ষে অসম্ভব।অন্য কোনোভাবে যদি তুমি আমাকে ট্রিট দাও,সেটা তোমার ব্যাপার।”
আদ্রিন হাসলো।সাথে হাসলো তৃপ্তিও,
–“আচ্ছা।বুঝলাম।সময় করে বাসায় আসবেন একদিন।”
–“দেখি।”
আদ্রিন ছোট্ট সুরে বললো।
গাড়ি থামলো কে.এফ.সি’র পার্কিং লটে।পূর্ব রেস্তোরায় আদ্রিনের মেজাজ বিগড়ে থাকার কারণে সে আর খাবার কিনেনি অত্র রেস্তোরা হতে।সুদূরে এই রেস্তোরাকে বেছে নিলো দুপুরের খাবারের পর্ব চুকাতে।তৃপ্তিকে বসার নির্দেশনা দিয়ে সে নামতে গেলে তৃপ্তি হঠাৎ বললো,
–“আমিও যাবো!”
আদ্রিন থামলো। তার সূচালো দৃষ্টি মিললো তৃপ্তির উৎসুক দৃষ্টির অন্তরালে।মেয়েটার গায়ে তার পড়নের কোট সাইজে বিশাল।বড্ড আদুরে লাগছে তৃপ্তির অবয়ব।আবার কোট খুললে তৃপ্তির অবস্থা হবে শোচনীয়,খুবই দৃ’ষ্টিকটু।তবে অবাকের বিষয় হলো,এই দুই অবস্থাতেই আদ্রিনের হৃদয় চঞ্চল,অন্তর বি’ক্ষি’প্ত।তার মেহেবুবাকে এই অবস্থায় বাহিরের মানুষ দেখবে?নাহ! কস্মিককালে না।
–“উহু,আমি যাবো।তুমি বসো।”
–“যায় না প্লিজ!আর আপনি আমার সাথে এমন ভঙ্গিতে কথা বলবেন না।মায়া হয় আমার।তবে জানেন তো!আমার মনে এইসব মায়ার আগমন নি’ষি’দ্ধ।”
–“এই নি’ষি’দ্ধতা একদিন আদ্রিনের কারণে পরিশুদ্ধতা খুঁজে পাবে।”
আদ্রিন খানিকটা ঝুঁকে বললো।
–“উহু,পাবে না।”
ডাহা মিথ্যে বললো তৃপ্তি। সে ইতিমধ্যে আদ্রিনের আচার আচরণে হারিয়েছে নিজেকে।পরপর নিজেকে ধাতস্থ করতে বললো,
–“আমি যাচ্ছি আপনার সাথে।”
তৃপ্তির পড়নে কোটের হাতা টেনে ধরলো আদ্রিন।
ধীর কণ্ঠে শুধালো,
–“মানা করেছি না?অন্য কারো বিষাক্ত নজরের ছোঁয়া তোমার অবয়ব ভেদ করা বারণ।”
চলবে…..
কপি করা বারণ।সকলের সুন্দর মতামতের আশায়।গল্পটা পুরোই আমার মনের কল্পনার সংমিশ্রনে লিখা। কারো ধর্ম,জাতিকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনা।গল্পকে কেবল গল্প হিসেবে নিবেন,অন্য কিছুর সাথে মেলাবেন না।সকল ধর্মের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রয়েছে।
সবচেয়ে সেরা কমেন্ট আমার গ্রুপে পোস্ট করা হবে তাদের আইডিসহ।একের অধিক বিজয়ী গ্রহণযোগ্য।
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।