অদ্ভুত আসক্তি পর্ব -০৯+১০

#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_৯ (কার লাশ?)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ (অনু)

“স্যার, তৃষ্ণা আদা জল খেয়ে ম্যামের খোঁজ পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”
রুদ্রের এই কথায় পুরো বাড়িতে এক থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আরহান চিন্তায় পড়ে গেলো। এর চেয়েও বেশি পড়েছে ভয়ে। তার শুকতারাকে হারানোর ভয়ে। আরহান যথেষ্ট ভয়ানক, হিংস্র। কিন্তু এর চেয়েও বেশি হিংস্রতা রয়েছে তৃষ্ণার মধ্যে। আরহান চাইলে, অনেক আগেই তৃষ্ণাকে শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু উদ্দেশ্য তার হারানোর। মেরে ফেলা নয়।
আর এদিকে আমি ভাবছি, আমাকে কেনো খুঁজছে? আর তৃষ্ণা নামটা শোনা শোনা লাগছে। কিন্তু কোথায় শুনেছি?
আরহান নিজের ভাবনার মাঝে একবার পেছনে ঘুরলেন। আমাকে এভাবে থম মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভীত হয়ে পড়লেন।
আমি উনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঠিক আরহানের সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন তুললাম,“কে তৃষ্ণা? কেনো খুঁজছে আমাকে?”
আরহান দুটো শ্বাস ফেললেন। হয়তো সবটা বলার জন্য নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিলেন। আমার চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করলেন,“সেদিন তোমার ভার্সিটিতে একটা ছেলে এসেছিলো না? সিঙ্গার! এই সেই তৃষ্ণা।”
তৎক্ষণাৎ আমার চোখে ভেসে এলো নীলাভ চক্ষুদ্বয়ের অধিকারী সুদর্শন সেই পুরুষটি। নেশাক্ত নয়নে কিভাবে যেনো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ইনি আমার খোঁজ কেনো করছেন?
আমার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান পুনরায় বলা শুরু করলেন,“তৃষ্ণা নারী আসক্ত। যাকে একবার চোখে ধরে, তাকেই ওর চাই। আর যে নারী একবার ওর চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে, সে নিজ থেকে ধরা দেয়। আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তৃষ্ণা। আর আমার দুর্বলতা তুমি। তৃষ্ণা আমাকে হারানোর জন্য যেকোনো পর্যায়ে নামতে পারে। আমার দুর্বলতায় আঘাত হানতে পারে। তাই যতোটা সম্ভব তোমাকে আমি গোপন রাখতাম। কিন্তু সেদিন ভার্সিটিতে সেই নজর তোমার উপর পড়ে গেলো। তাই তো নিয়ে এলাম তোমাকে। আর এজন্য আমি একটুও অনুতপ্ত নই।”
আরহান খুব কৌশলে উনার শত্রুতার আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে গেলেন। উনার কাজগুলো সে আমাকে জানাতে চায় না। হয়তো ভাবছেন, উনার শুকতারা এসব জেনে গেলে উনাকে আর মেনে নেবে না।
আমি স্তব্ধ দাড়িয়ে কথা শুনছি। এর মাঝে রুদ্র তার স্যারকে বলে বিদায় নিলো। আরহান আমাকে বললেন,“এবাড়িতে আর থাকা যাবে না। আমি সারাদিন থাকি না। আর বাড়িতে সার্ভেন্ট ছাড়া কেউ নেই ও। তৃষ্ণা যেকোনো সীমায় পৌঁছে যেতে পারে। কাল বিকেলেই বাড়ি যাবো আমরা। তোমার শ্বশুর বাড়ি।”
আরহান আমার হাতে, তার হাতের ব্যাগটি দিয়ে বললেন,“ভেবেছিলাম এখানে থাকবো বেশ কয়েকদিন। তাই এগুলো আনিয়েছিলাম। কোথাও মেয়েলি কিছু পছন্দ হলেই তোমার জন্য নিয়ে নিতাম। ভাবতাম,এই জিনিসটার আসল সৌন্দর্য তখনই আসবে, যখন আমার শুকতারার গায়ে জড়াবে।”
চলে গেলেন আরহান। আমি উনার ভালোবাসায় মুগ্ধ। এতটা ভালোবাসা আমার জন্য ছিলো? পরক্ষণেই আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। বেশ গম্ভীর হয়ে ভেবে চলেছি,“দুনিয়াতে কি মেয়ে মানুষের অভাব পড়েছিলো?”
হাতের ব্যাগের দিকে একপলক তাকালাম। গিয়ে সোফায় বসে এটা খুললাম। ভেতরে আরো কয়েকটা বক্স আছে। এগুলোও খুললাম। একটাতে কিছু জোড়া নূপুর। একটাতে কাঁচের চুড়ি অনেক কালারের। একটাতে বেশ কয়েক রকমের ঝুমকা। মানে সাজ-সজ্জার প্রায় সবই আছে এখানে। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে অজান্তেই হাসি চলে এলো।

_________________________
“কে আপনি? আর এখানে কাকে চাই?”
বাবা, তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বললেন। তৃষ্ণা বাঁকা হাসলো। ড্রয়িং রুমের সিঙ্গেল সোফায়, পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে বাবার মুখোমুখি বসে আছে। ঠিক সামনে বাবার পাশে ছোট মা ও মীরা আপুও বসে আছে।
তৃষ্ণা রসাত্মক গলায় বললো,“আরে শ্বশুর আব্বা! জামাই প্রথম বার বাড়িতে এসেছে, আর আপনি অ্যাপায়ন না করে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন! নট ফেয়ার শ্বশুর আব্বা।”
বাড়ির সকলের চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। তৃষ্ণার কথার আগা গোড়া, মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সবার। ছোটমা আর বাবা এবার মীরা আপুর দিকে তাকালো। আপু দুজনের এভাবে তাকানো দেখেই ফটাফট বলে দিলো,“আমি চিনি না। সত্যি বলছি। চিনি না।”
তৃষ্ণা হেসে দিয়ে বললো,“আরে বড়টা না। ছোট মেয়ের জামাই আমি।”
সঙ্গে সঙ্গে বাবা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছোটমার পুরনো কিছু মনে পড়তেই শুকনো ঢোক গিললেন। একই অবস্থা মীরা আপুরও।
সবার এমন অবস্থা দেখে তৃষ্ণা আন্দাজ করতে পারলো না ব্যাপারটা কি। ভ্রু কুচকে নিলো।
বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বললো,“হবু। হইনি এখনও।”
বাবা ফুস করে আটকিয়ে রাখা শ্বাস ছাড়লেন। বড়জোর বাঁচলেন। তবুও মনের মাঝে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করে ফেললো,“সম্পর্কে ছিলো ও আপনার সাথে?”
তৃষ্ণা মৃদু আওয়াজে বললো,“না, ওকে আমার ভালো লেগেছে। এজন্য বিয়ে করতে চাই। আর আমি যা চাই, তা না পেলে ছিনিয়ে নেই। এখন ভালোয় ভালোয় বলে দিন ও কোথায়। নয়তো আপনাদের সাথে কি করবো ভাবতেই পারছেন!”
শেষোক্ত কথাটি বলার সময় হাতের গানটি দিয়ে নিজের অন্য হাতে স্লাইড করলো তৃষ্ণা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে সবার। ছোটমা মনে মনে বলছে,“কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! নাগর যুটিয়েছেও এমন। একজন ছাদ থেকে ফেলে দেয়, কিডন্যাপ করে আটকিয়ে রেখে বিয়ে করে নেয়। তো অন্যজন সোজা মারার হুমকি দেয়।”
বাবা খানিকটা কেশে সোজা গলায় বলে দিলেন,“ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
তৃষ্ণা দাড়িয়ে পড়লো। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে আওড়ালো, “হোয়াট!”

___________________
রুশী তৈরি হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো। সময়টা সন্ধ্যে। মাথাটা বা দিকে ঘুরিয়ে জানালার বাইরের পশ্চিমাকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,“তোর নামে আমার আঙিনায় সহস্র সন্ধ্যে নামুক। যেখানে থাকবি তুই, থাকবো আমি। থাকবে আমাদের খুনসুঁটি। থাকবে তোর যত্ন। থাকবে আমার খামখেয়ালিপনা। থাকবে কিছু ভালোলাগা। আর থাকবে ভালোবা… নাহ্! আর কিছু না। আমার শুধু তুই থাকলেই চলবে।”
মুচকি হাসি দিয়ে পুনরায় নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো। কল্পনায় আঁকলো অয়নকে নিয়ে কিছু প্রতিচ্ছবি। প্রায়শই করে এটা। এই যে, এখন ভাবছে, রুশী এখানে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে। পাশে দাঁড়িয়ে অয়ন, মুগ্ধ নজরে রুশীকে দেখে যাচ্ছে। অয়নের সে কি চাহনি! চোখের মধ্যে কি আছে ওর? ভাবতেই লজ্জায় রুশীর ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে এলো।
তখনই রুমে ঢুকলো রুশীর মা। রুশীকে উদ্দেশ্য করে বললো,“তৈরি হয়ে নিয়েছিস?”
রুশী মৃদু হেসে “হুঁ” বললো।
রুশীর মা একবার রুশীকে ভালো করে দেখে নিলো। মনে মনে বললো,“আমার মেয়েটা এতো সুন্দর! মায়ের নজর লেগে যাবে না তো আবার!”
নিজের চোখের নিচ থেকে একটা আঙ্গুলে কাজল ভরিয়ে নিয়ে রুশীর কানের পিছে লাগিয়ে দিলো। রুশী তার মায়ের এমন কাজে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। রুশীর মা পুনরায় মুগ্ধ নজরে নিজের মেয়েকে দেখলো।
খানিকক্ষণ বাদে বলে উঠলো,“নিচে আয় এখন।”
রুশী “আচ্ছা” বলে নিচে এলো ওর মায়ের সাথেই। এসেই সোফায় বসে থাকা দুজন বয়স্ক পুরুষ আর মহিলার সাথে একটা মেয়ে ও একটা ছেলে দেখলো। আন্দাজ করে নিলো, এই বয়স্ক মানুষ দুটি রুশীর বাবার বন্ধু ও বন্ধুর বউ আর এরা তাদের ছেলে মেয়ে। মেয়েটি রুশীর ছোট হবে।
রুশী ভদ্রতার খাতিরে হালকা হেসে সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব দিয়ে উঠে এসে রুশীর পাশে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে রুশীর থুতনিতে হাত রেখে বললো, “মাশাআল্লাহ! মেয়েতো ভারী মিষ্টি। আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”

_____________________
রাত অনেকটা বেজে গিয়েছে। খেয়ে দেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি ছোট থেকেই কাজের মধ্যে থেকেই এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আর কিছুই করতে পারছি না। না আছে ভার্সিটি, আছে পড়ালেখা আর না আছে বাড়ির কাজ। ভীষন বোরিং লাগছে। হয়তো কাল ওবাড়িতে যাবার পর আর এমন লাগবে না।
আরহান রুমে আছে। অফিসে না গিয়ে বাড়িতে বসেই কাজগুলো করছে। এদিকে এখন আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করলাম।
পুরো বাড়ি পিনপতন নীরবতা পালন করছে। তার মধ্যে আমার হাঁটার শব্দে আমি নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছি। শব্দটা বেশ জোরালো ঠেকছে।
রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম, দরজা হালকা খোলা। ধাক্কা দিতেই একটু শব্দ করে পুরোপুরি খুলে গেলো। আর সামনে মেঝের দিকে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বড়সড় হয়ে গেলো। ভয়ে থরথর করে শরীর কাঁপছে। মুহূর্তেই ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছি। অস্ফুট স্বরে “মা! মা!” বুলি আওড়াচ্ছি।
আমার চোখের সামনে একটা লাশ উবু হয়ে পড়ে আছে। আর চারিপাশে রক্তের বন্যা। মিনিট দুয়েক যেতেই, শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি খরচ করে চিৎকার করে উঠলাম। সেখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলাম আমি।
#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_১০ (গিফট বক্স)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ (অনু)

রুশী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে নিজের রুমে। মাথা নিচু। চাহনি ফ্লোরে। মস্তিষ্কে কিছু মানুষের স্বার্থপরতা আর মনে রয়েছে ভালোবাসার উপলব্ধির আগেই ইতি বিষয়ক যন্ত্রণা। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে রুশীর।
সামনে দাড়িয়ে আছে রুশীর মা ও বাবা। চাহনি স্থির তাদের। কোনো আফসোস নেই। যেনো তারা কোনো অন্যায় করেনি। তবুও নিজেকে এক্সপ্লেইন করার জন্য রুশীর বাবা বলে উঠলেন,“আমরা কি তোর খারাপ চাই মা? যা করছি এতে তো তোর ভালোই হবে।”
রুশী ছলছল নয়নে তার বাবার পানে তাকালো। চোখ দুটো ভয়ঙ্কর রকমের লাল হয়ে আছে। ইতিমধ্যে রুশীর সমস্ত মুখশ্রী লাল হয়ে গিয়েছে। চুল গুলো এলোমেলো। এ যেনো রুশীর বিধ্বস্ত এক রূপ।
মেয়ের এমন অবস্থা দেখেও তাদের খুব একটা সমস্যা হলো না। ভাবলো, হয়তো তাদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য মন কেমন করছে রুশীর। ব্যাপারটা এই পর্যন্তই রাখলো তারা।
“আমাকে নিয়ে ড’ডিল করলে তোমরা? তোমাদের বন্ধুত্বের জন্য আ’আমাকে নিয়ে ডিল করে ফেললে? আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না? আ’আমি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছি, ন’না?”
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে রুশীর চোখের বাঁধ ভেঙে নোনা পানি গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে।
রুশীর মা এতে একটু রেগে গিয়েই বললো,“এতো রিয়েক্ট করার কি আছে রুশী? বিয়ে কি কেউ করে না নাকি?”
“তাই বলে আমাকে জানাবেই না?”
রুশীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে ওর বাবা মা। রুশীর বাবা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওর মা ওর বাবাকে থামিয়ে বলে উঠলো,“এতো কষ্ট করে মানুষ করেছি তোকে আমরা। এইটুকু অধিকার নেই তোর উপর?”
হুট করেই রুশী থমকে গেলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার ওর বাবা মাকে দেখে নিলো। এতোটা আশা করেনি।
রুশীর মা পুনরায় বললো,“দেখ! ছেলে আর ছেলের পরিবার সব দিক থেকেই ভালো। টাকা পয়সায়ও কমতি নেই।”
রুশী হাসলো। তাচ্ছিল্যের এক হাসি হাসলো। পুনরায় ফ্লোরে তাকালো। বাবা মা তার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছে। দিয়ে দেবে কি? নাকি নিজের সুখটা বেছে নেবে? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে রুশী। বুকে কেমন যেনো এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কিছু পাবার আগেই হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা বড্ড পোড়ায়। রুশীর স্থির দৃষ্টি ফ্লোরে সীমাবদ্ধ রেখেই বললো,“আমি রাজি।”
রুশীর বাবা মা খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কথাটা রুশীর জন্য বলা এতোটা সহজ ছিলো না। কিন্তু, বাবা মায়ের উপর বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি রুশী। তাই তো নিজেকে বলি দিলো।
রুশীর বাবা মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত রেখে বললো, “ভুল বুঝিস না রে মা। বাবা মা তাদের সন্তানের খারাপ কোনোদিনও চায় না। একদিন এই সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে বেশি তুই’ই খুশি হবি।”
রুশী নিরুত্তর হয়ে বসে আছে। যেনো এক পাথর হয়ে গিয়েছে। রুশীর মা মুখে হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললো,“তাহলে মারুফ ভাইকে কল দিয়ে বলে দাও, তাড়াতাড়ি বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে।”
রুশীর বাবাও খুশি মনে হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরোলো, তার কলেজ জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে খবর দিতে। সাথে রুশীর মা ও গেলো।
যাবার সময় রুশীর মা দরজাটা টেনে দিয়ে গেলো। সেই শব্দ হবার সাথে সাথেই রুশী চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। কার্নিশ বেয়ে পুনরায় অশ্রুধারা বইছে। রুশী বাকরুদ্ধ। কি বলবে এখন? কি’ই বা বলার আছে? কি’ই বা করার আছে? ধপ করে বেড থেকে ফ্লোরে বসে পড়লো। বন্ধরত নয়ন এখন তার মুখ বিচরণ করছে, যাকে দেখলে রুশীর সুখ লাগতো। ধন্য হতো চক্ষুদ্বয়। ভাবনায় পুরনো দিনের সেসকল কথা ভেসে আসছে, যা ছিলো রুশীর একান্ত প্রিয়জনকে ঘিরে।
অয়ন! ছেলেটা কখনো বলেনি, কতোটা ভালোবেসেছে। চুপ থেকেই ভালোবাসার সহস্র রঙের সাথে পরিচয় করিয়েছে। ভালোবাসতে শিখিয়েছে। একদম গোপনে।
আবারো খানিকটা হাসলো রুশী। ছেলেটা পাগল ছিলো রুশীর জন্য। ওকে ছাড়াতো অয়ন থাকতেই পারতো না। রুশীর সামান্য কষ্টও সহ্য করার ক্ষমতা ছিলো না। একটু কিছুতেই কি রিয়েক্টই না করে ফেলতো। সেখানে…
ফট করে চোখ মেললো রুশী। অয়ন যদি এসব জেনে যায়? ও তো খুন করে ফেলবে সবাইকে। বা দিকে তাকাতেই, আয়নায় নিজের এই বিধ্বস্ত রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেলো। তার অয়ন তো তার তিল পরিমাণ কষ্টও সহ্য করতে পারে না। এভাবে দেখলে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাবে অয়ন। তড়িঘড়ি করে শাড়ির আঁচলের শেষাংশ দিয়ে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে ফেললো। এলো মেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গোছানোর চেষ্টা করলো। পুরোপুরি না হলেও খানিকটা সফল হলো। অশ্রুভেজা চোখে নিজেকে আয়নায় দেখে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি আনার চেষ্টা করলো। হাসলো। তৎক্ষণাৎ হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।
কান্না মিশ্রিত কন্ঠে উচ্চারণ করলো,“তোকে খুব ভালোবাসি অয়ন। খুব ভালোবাসি।”
কিছুক্ষণ কান্না করতে করতে হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হলো রুশীর। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“যাকে ঘিরে আমার পুরো পৃথিবী ছিলো, আজ এই পৃথিবীতে সে আমার জন্য নিষিদ্ধ হলো।”

____________________
পিটপিট করে চোখ মেললাম। রুমে লাইট অন করা। রাত্রির শেষ প্রহর চলছে। চক্ষুদ্বয় সিলিংয়ে নিবদ্ধ থাকতেই চোখের সামনে গতকাল রাতের সেই দৃশ্য ভেসে এলো। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালাম। পুরো শরীর ঘেমে যাচ্ছে। পুনরায় কালকের ঘটনা ভাবনায় আসতেই, সর্বাঙ্গে ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার জন্ম নিলো।
মুহূর্তেই আরহান এর কথা মাথায় এলো। আরহান কোথায়? ঠিক আছেন তো উনি? এতো কষ্ট সহ্য করে অবশেষে ভালোবাসার সুখ পেয়েছি। তাও আবার অসীম ভালোবাসা। আরহানকে না চাইতেও মনের কোঠায় স্থান দিয়ে দিয়েছি। আমাদের মতো মানুষদের জন্য যদি কেউ সামান্য কিছু করে, আমরা তাদের জন্য জান দিয়ে দেই। এখানে তো আরহান ভালো বেসেছে আমাকে। উনাকে কি দেওয়া যায়? এই চিন্তা করাটা সামান্য ব্যাপার এখানে।
তখনই ওয়াশরুম থেকে আরহান বেরোলেন। উনাকে সুস্থ থাকতে দেখে দৌঁড়ে ছুটে গেলাম উনার কাছে। জড়িয়ে ধরলাম।
ঘটনার আকস্মিকতায় আরহান কিছুটা পিছিয়ে গেলেন। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিনিট খানেক সময় লাগলো এই ঘটনা বুঝতে। বুঝতে পারতেই খেয়াল করলেন আমি কাঁপছি। শরীর আমার অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। আরহান আমাকে আলিঙ্গন করে নিলেন। ডান হাত আমার মাথার পেছনের চুলে হাত বুলোচ্ছে। মিহি কণ্ঠে বললেন, “কাঁপছো কেনো শুকতারা? কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে তো।”
উনার এমন আদরমাখা কন্ঠে আমি আবেগী হয়ে বেশ জোরেশোরেই কেঁদে দিলাম। অস্থির হয়ে পড়লেন আরহান। ইতিমধ্যে আমার চুলের পেছনে উনার হাতের বিচরণ থেমে গিয়েছে। আমাকে নিজের বুকে থেকে উঠিয়ে আমার দুই গালে হাত রাখলেন। ব্যাস্ত ভঙ্গীতে বললেন,“হুশ! হুশ! কাঁদে না। আমি আছি তো।”
কথাটি শেষ করেই আরহান আমার কপালে চুমু খেলেন। আবেশে চোখ বুজে নিলাম। আরহান পুনরায় জড়িয়ে নিলেন আমাকে। আমি উনার বুকে মুখ গুজে অস্ফুট স্বরে বললাম,“আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে কেউ উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলেছে। আমার তো আপনি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু ঐ লাশ…!”
হঠাৎ ঐ লাশের কথা মনে পড়তেই আমি বুকে থেকে মুখ তুলে তাকালাম আরহানের পানে। শুধালাম,“ঐটা কে ছিলো? কার লাশ? কে খুন করলো? আর এখানে! এখানে তো রক্ত ছিলো।”
শেষ কথাটি, তর্জনী আঙ্গুল ফ্লোরের দিকে ইশারা করে বলেছি।
আরহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,“কিসের রক্ত?”
“এখানেই তো ছিলো, দেখেন নি?”
“আমিতো কোনো রক্ত দেখতে পেলাম না। আমি এখানেই বেডে শুয়ে ছিলাম। তোমার চিৎকার শুনে এদিকে তাকিয়ে দেখি, তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছো।”
আমি অবাক। শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লাম,“কেউ ছিলো না! সত্যি?”
“হয়তো অনেক চিন্তিত তুমি। এজন্যই এমনটা হচ্ছে তোমার সাথে। এতো টেনশন করো না। আমি আছি তো। চলো, ঘুমোবে।”
আমি আসলেই চিন্তিত। আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।

বিছানায়, উল্টা দিকে ঘুরে শুয়ে আছি। শুয়েছি ঘণ্টা খানেক হবে হয়তো। ঘুম আসছে না। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পেছনে ঘুরতেই, ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় আরহানকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে লক্ষ্য করলাম। চাহনি স্থির। আমি চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমোননি?”
“নাহ্! আসছে না।”
“আমারও না।”
“একটা কথা বলি শুকতারা?”
উনার, আমাকে এই শুকতারা বলে ডাকাটা এতো ভালো লাগে! বলে বোঝাতে পারবো না। উনাকে কথাটা বলার সুযোগ দিতে আমি “হুঁ” বললাম।
“ক্যান আই হাগ ইউ?”
আরহানের নিঃসংকোচে করা এমন আবদারে আমি থম মেরে গেলাম। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলেন। উনার উষ্ণ আলিঙ্গনে আমিও গুটিশুটি মেরে রইলাম। আরহান আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভীষণ ভালোবাসি শুকতারা।”

_____________________
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেটের প্যাকেট খালি করে যাচ্ছে তৃষ্ণা। এই নিয়ে তৃতীয় প্যাকেটটা খুলতেই সেখানে আশিকের আগমন।
“স্যার! আপনের নামে পার্সেল আইসে।”
তৃষ্ণা একবার আশিকের দিকে তাকালো। তারপর আগের মতো আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“পাঠিয়ে দাও রুমে।”
আশিক চলে গেলো। মিনিট পাঁচেক পর, বিশাল আকৃতির একটা বক্স নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তৃষ্ণা এতো বড় বক্স দেখতেই কপাল কুঁচকে ফেললো।
আনবক্স করতেই সেখানে আশিক চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো।

চলবে…!

(পারমিশন ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here