অদ্ভুত মুগ্ধতা-২
পর্ব ৫
মিশু মনি
.
বুকের কাছে একটু উঞ্চতা অনুভব করলো মৈত্রী।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মিশু ওর বুকের সাথে মিশে গিয়ে ওকে জাপটে ধরে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে।
বুকটা ধক করে উঠলো মৈত্রীর। মিশু তো পাশের রুমে শুয়েছিলো, তাহলে কখন এই রুমে এসেছে আর ওর পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুই বুঝতে পারেনি ও। কি সুন্দর মায়াবী দেখাচ্ছে মিশুকে! মিশুর ঘুমঘুম চেহারা টা দেখলেই মনটা কেমন কেমন যেন করে! বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে! আজ সেই ঘুমন্ত মেয়েটাই এভাবে বুকের উপর শুয়ে আছে!
হা করে চেয়ে রইলো মৈত্রী। মেয়েটা সত্যিই খুব রূপবতী! ওর হাসি, ওর কথা বলার স্টাইল, ওর আচরণ সবকিছুই অনেক সুন্দর। যদিও এসব দেখে মৈত্রী ওকে ভালোবাসেনি। মিশুর ইনোসেন্স স্বভাব টাই পাগল করে দিয়েছে ওকে। কতটা ইনোসেন্স হলে এভাবে বৃষ্টির রাতে পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়া যায়? এরকম সুন্দরী একটা মেয়েকে এরকম পরিবেশে পেলে কত অঘটন ই ঘটে যেতে পারে। সেসব কি কখনোই ওর মাথায় আসেনা? আসলে নিশ্চয়ই এই কাজটা করতো না।
মৈত্রীর ইচ্ছে করছে মিশুকেও দুহাতে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু মেয়েটা যে অনেক বিশ্বাস করে এখানে এসে শুয়ে পড়েছে। যদি ঘুম ভাংলে দেখে মৈত্রী ওকে এভাবে ধরে আছে, তাহলে কষ্ট পাবে হয়ত। আর মিশুর এই জিনিস টার ব্যাপারে মৈত্রী অনেক সাবধান।
তাই ধরতে গিয়েও আর ওকে ধরলো না। কিন্তু একবার কাছে কোথাও বাজ পড়তেই মিশু নিজেই আরো শক্ত করে ধরে ফেললো মৈত্রীকে। এবার অজান্তেই মৈত্রীও ধরে ফেললো ওকে। কিন্তু আর কিছুতেই ওর চোখের পাতা এক হতে চাইছে না। মিশু এভাবে বাচ্চাদের মত বুকে শুয়ে আছে, ওর গরম নিঃশ্বাস পড়ছে গলার নিচটাতে। কিভাবে ঘুম আসে?
এত কাছে মৈত্রী কখনোই পায়নি মিশুকে। বুকের ভিতর টা কেমন কেমন যেন করছে! কিন্তু মাথায় অন্য কোনো চিন্তার স্থানও দিতে রাজী নয় ও। তাইকোনো চিন্তায় মাথাটাকে ব্যস্ত করতে চাচ্ছে। ভাবার মত সেরকম কিছুই আসছে না মাথায়। শুধুই মিশুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কি লোভনীয় দৃশ্য!
মৈত্রী চুপচাপ অপলক ভাবে চেয়ে রইলো মিশুর মুখের দিকে। পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছেনা। শুধু কপাল, নাক আর গালের উপরের দিকটা দেখা যাচ্ছে। মনটাকে অস্থির করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। হা করে চেয়ে রইলো মৈত্রী!
এমন সময় হঠাৎ মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো। প্রথমে ও বুঝতে পারেনি এভাবে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ মিটমিট করে তাকাল। ঘুমের ঘোরে ওর মনে হচ্ছিলো ও নিজের রুমেই কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু বালিশ এত উঞ্চ হলো কিভাবে? জেনারালি কোলবালিশ নরম তুলতুলে আর ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। এতো একেবারে শক্ত হাড্ডির মত।
মিশু এতক্ষণে ভালোকরে চোখ মেললো। মৈত্রীকে জড়িয়ে এভাবে শুয়ে আছে বুঝতে পেরে লজ্জায় একেবারে নীল হয়ে উঠল। এতটা লজ্জা ও বোধহয় কখনোই পায়নি। ইভেন মৈত্রীকে ভালোবাসি বলার সময় ও না। তাহলে এত লজ্জা লাগছে কেন এখন?
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিশু চোখ পিটপিট করে তাকালো। মৈত্রীর চোখের এত কাছ থেকে কখনোই চোখাচোখি হয়নি ওর। বুকের ভিতরে যেন হঠাৎ ই বাইরের মতই ঝড় শুরু হয়ে গেলো। ও লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
মৈত্রী মিশুর চোখ মেলার সাথে সাথেই ওকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তবুও মিশু ওর বুক থেকে একটু ও নড়লো না। আবেশে চোখ বুজে রইলো অনেক্ষণ। অন্য কোনো সময় হলে এই ব্যাপার টার জন্য হয়ত মিশুর রাগ হতো। কিন্তু এইমুহুর্তে এতটা ভালো লাগছে যা ওকে নিমেষেই সুখের অন্য কোনো রাজ্যে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে। এত ভালো কখনো লাগেনি ওর। কখনো ঘুমিয়ে এত আরাম পায়নি।
মৈত্রী ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। কখন যে মেয়েটা রেগে যায়! যদি মনে আঘাত পায়? কিন্তু এতে তো ওর কোনো দোষ নেই। মিশু কখন এসে শুয়ে পড়েছে মৈত্রী নিজেও জানেনা। তবুও মনে মনে ভয় হতে লাগলো। মৈত্রীকে অবাক করে দিয়ে মিশু বললো, “আমাদের বিয়ে হবে কবে?”
প্রশ্ন শুনে একদম অবাক হয়ে গেছে মৈত্রী। বললো, “তুমি যখন চাইবে।”
– “তাহলে কালই আব্বুকে বলুন না আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে চাই।”
এবারে মৈত্রী আরো অবাক হলো। বিস্ময়ের ঘোরে ডুবতে ডুবতে জিজ্ঞেস করলো, “হঠাৎ এই ইচ্ছে?”
– “আমিতো তোমাকে বিয়ে করতেই চেয়েছি। চাইনি? ”
– “হ্যা, কিন্তু এক্ষুনি করার ইচ্ছে জাগলো যে?”
মিশু বললো, “এভাবে রোজ রাতে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো।”
কার মুখে কি কথা! একি সত্যিই মিশু? মৈত্রী হা করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এতটা রোমান্টিক হওয়ার মত যোগ্য তো ও ছিলোনা। কেন যেন মনে হচ্ছে আজ রাতে হঠাৎ করেই মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। আর শাড়ি পড়ার কারণে ওকে আরো বড় বড় লাগছে। ওর শুধুই অবাক হওয়ার পালা।
মিশু বললো,” এভাবে চেয়ে আছো যে? বলোনা কালকেই আব্বুকে বলবে এই সপ্তাহেই আমাদের বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করতে? আমার না খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে আজকেই এক্ষুনি বিয়ে করে ফেলতে। তোমার বুকে অনেক শান্তি। আমার একদম ই কোনো টেনশন হচ্ছেনা।”
মৈত্রী মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। মিশুকে ভালো রাখার জন্যই তো এতদূর আসা। মিশু যখন বুঝে গেছে ও ভালো আছে আর তো কোনো চিন্তাই রইলো না। এবারে মিশুর কথামত বিয়েটা ঠিক করে ফেলতে হবে।
মিশু আরো শক্ত করে ধরতে লাগলো মৈত্রীকে। মৈত্রী হাত দুটো মিশুর পিঠের উপর রেখে শান্ত হয়ে ভাবতে লাগল বউ সাজলে মিশুকে কেমন দেখাবে? নিশ্চয়ই বাচ্চাবাচ্চা বউ লাগবে। মনে হবে বউ জামাই খেলা হচ্ছে!
★
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প লিখছেন।
গল্পের থিমটা দারুণ! একটি মেয়ে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। মেয়েটির নাম মিমিয়া। পালিয়ে গিয়ে শহরে চাকরী খোঁজে। ছোটখাটো চাকরী করতে করতে মেয়েটি পড়াশোনাও চালিয়ে যায়। আস্তে আস্তে মেয়েটির জীবন বদলে যেতে শুরু করে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ওর স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে। তাই মিমিয়া ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। একসময় মিমিয়া অনেক বড় হয়। খুবই সংগ্রামী একটা জীবনের গল্প।
লিখতে লিখতে অনেক রাত হয়ে গেলো। সাফায়েত উল্লাহ সাহেব উঠে এসে বিছানায় বসলেন। বিছানায় ওনার স্ত্রী তিন্নি ঘুমাচ্ছেন। বাইরে খুবই জোরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। এত সুন্দর একটা রাতে ঘুমানো যায়? বিয়ের প্রথম দিকের বর্ষাগুলোতে ওনারা একটা রাতও ঘুমান নি। সারারাত গল্প, কবিতা আবৃত্তি, গান কতকিছুই না করেছিলেন! ভাবতেই ওনার মনটা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। সেই কত বছর আগের কথা! এখনো স্পষ্ট হয়ে স্মৃতিতে ভাসছে। তিন্নি খুবই চটপটে আর হাসুনী মেয়ে ছিলো। কিছু বললেই হাসিতে গড়াগড়ি খেতো। সাফায়েত উল্লাহ সাহবকে ও আদর করে সিফু বলে ডাকতো। কত সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলি!
অজান্তেই চোখের কোণে জল এসে গেলো। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। সব ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। দিনগুলো জীবন থেকে ফুরিয়ে যাচ্ছে। নিজে অনেক কষ্ট করেও ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেননি কোনো অভাব।মানুষের মত মানুষ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন উনি আর ওনার স্ত্রী। সবসময় সঠিক টাই শিক্ষা দিয়েছেন। উনি বিশ্বাস করেন, সবাই পরিবার থেকেই শিক্ষাটা পায়। পরিবারের শিক্ষার গুণেই ছেলেমেয়েরা সেভাবে বড় হয়ে উঠে। একজন আদর্শ বাবার ছেলেও আদর্শ হতে বাধ্য। যদি না হয়, সে তো বাবাই নয়!
এসব ভাবতে ভাবতে তিন্নির মুখের দিকে তাকালেন উনি। মেয়েটা এখনো অনেক ভালোবাসে ওনাকে। এখনো দুইটা দিনের জন্য কোথাও যেতে চাইলে তিন্নিও ব্যাগ গুছিয়ে আগেভাগেই রেডি হয়ে থাকে। এত বছর পরেও এই বৃদ্ধ বয়সেও যেন সম্পর্ক টা সেই বিয়ের প্রথম দিনগুলোর মতই আছে। বিয়ের আগেও প্রেমটা যেমন ছিল, বিয়ের পরেও ঠিক তেমনি আছে। এমনকি এত বছর পরেও ঠিক তেমনি আছে। সত্যিকার ভালোবাসা বুঝি এমন ই হয়!
চলবে…