অদ্ভুত সম্মোহনী পর্ব ৭

#অদ্ভুত_সম্মোহনী ♥
#PART_07
#FABIYAH_MOMO🍁

আমার রুমে কে এসে বারবার থ্রেড দিচ্ছে অনুমান করতে পারিনা। কিন্তু একটা ব্যাপারে সিউর, সে আমার কাছের কেউ একজন। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে হালকা সাজে সজ্জিত করে মেহেদি অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হলাম। গলায় ওড়না দিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য প্যানডেলের সামনে গিয়ে দাড়ালে এক সুদর্শন ছেলেকে দেখতে পাই যে কিনা এখনো হুড়োহুড়ি ব্যস্ততার সাথে কাজে জড়িয়ে আছে। কখনো প্যানডেলের ডেকোরেশন চেক করছে, কখনোবা দেখাশুনা করছে সাউন্ড বক্সের আইটেম। গাঢ় খয়েরী রঙের পান্জাবী পড়নে সাথে কালো প্যান্ট । দুহাতে পান্জাবীর হাতা কনুইয়ের কিছুটা আগে গুটানো। গুটানো অংশটা কালো। হাতে বাদামী চামড়ার বড় টাইটান ঘড়ি। মাথার চুলগুলো ব্রাশ করা, কপালে কিছুটা কুচকানো ভাবের ভেলকি। বাতাসে তার গাঢ় বাদামীর পাতলা চুলগুলো কপালের উপর ছিনিমিনি খেলছে। উড়ছে। উড়ন্ত অবস্থায় চোখ স্থির করে কতক্ষন ধ্যান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম জানি না, আপুর ডাকে ধ্যান ভাঙ্গলে ততক্ষণে টের পাই। নিবির ভাইয়া পান্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছেন স্টেজের দিকে আমাদের কাছে। নেভি ব্লু রঙের পান্জাবীতে ভালোই মানিয়েছে ভাইকে। শাকিল ভাইও কালো রঙের পান্জাবী পড়নে সাদ ভাইয়ার সাথে গান সিলেক্ট করছেন। রূপ আপু ওড়না মোচড়াচ্ছেন অনবরত। কিন্তু কেনো? মুখে তার অস্থিরতার ছোপ!!

আত্মীয়স্বজন সবাই নাইমার আপুর মেহেদি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে। পুরো উঠোন জুড়ে মানুষের ভীড়বাট্টা। আপুকে মেহেদির জন্য আর্টিস্টের কাছে বসানো হয়েছে। আমি আপুর পাশে বসে মেহেদি দেওয়া দেখছি। হঠাৎ কোত্থেকে উনার খালাতো বোন এসে আমার ও আপুর মাঝে ঠেলেঠুলে বসলো, অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,
— তুই? একা বসেছিস কেন? আমাকে ডাকলে কি হতো? আমি কি পর?
— কোথায় একা? এইযে মামাতো বোন পাশে।

নাইমা আপুর কাছে আমার পরিচয় শুনে আপুটা খুব বিরক্ত চোখে তাকালো আমার দিকে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে নাইমার আপুর কানের কাছে আলতো সুরে বলে উঠলো,
— তুই এই খ্যাতের সাথে বসেছিস কেন? এটা তোর বোন? আই কান্ট বিলিভ নাইমা! তোর মামাতো এমন খ্যাত হতে পারে! শহরে থাকে তবুও সাজগোজ নিয়ে লো টেস্ট? একটুও সাজ নেই মুখে! ইয়াক!

রাহা মাহিয়ার সম্পূর্ণ কথা না শুনলেও শেষের কথা শুনে মাথা নিচু করে দ্রুতপায়ে স্টেজের পেছনে চলে যায়। স্টেজের পেছনে খালি জায়গায় ঘাসের উপর বসে হাটুতে মাথা রেখে কাদঁতে থাকে। বারবার এমন নাকোচ খোটা আর সহ্য হয়না রাহার। আর কতো? মানুষ কেনো সাদাসিধে রূপটা দেখতে পায় না? কৃত্রিম সৌন্দর্যই কি সবকিছু? রাহা ভেবে পায় না। হাটুতে মুখ লুকিয়ে নিশব্দে কাদতে থাকে। গানের অতিরিক্ত ভলিউমে সবাই নাচানাচিতে তুখোড় মেতে উঠেছে। ব্যাপক শোরগোলে নাচছে সবাই। শাকিল সাদকে টেনে ভীড়ের মধ্যে নাচতে শুরু করে। সাদও সবার ফূর্তিতে নাচতে থাকে। সাদকে নাচতে দেখে রূপও এসে জড়িত হয় নাচের আমোদে। রূপ ইচ্ছে করে সাদের সাথে গা ঘেষে হাত ছড়িয়ে নাচছে।। একবার দুবার বিষয়টা সাদ খেয়াল করলেও সাদ অন্য দিকে চেপে যায়। রূপ আবারও সাদের দিকে চেপে নাচানাচি করলে সাদ নাচ থামিয়ে রূপের দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকায়। সাদের দিকে চোখ পড়তেই রূপের বুকটা ধক করে কেপে উঠলো। সাদের এমন লোমহর্ষক চাহনি আগে কখনো দেখেনি। সবসময় সাদকে হাসিখুশি দেখেছে সে। সাদ গটগট করে ভীড় ঠেলে প্রস্থান করলো নাচের মহল থকে।

আমার এখানে থাকাতেই ভুল হয়েছে। এই রূপের জন্য কোত্থাও গিয়ে শান্তি পাইনা। ফেসবুকেও শান্তি দেয়নি! চুইংগামের মতো লেগে থাকে ধ্যাৎ! রাহা কোথায় গেলো? নাইমা আপুর পাশেও দেখছি নেই। ও কোথায়? যাকে দেখতে চাই সে-ই নেই, অথচ পাড়াপড়শির ঘুম নেই। উফ ড্যাম! মাথা খারাপ হচ্ছে আমার। রূপ আরেকবার যদি সামনে আসে ঠাটিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দিবো! আস্তা একটা বেয়াদ্দপ মেয়ে! মুডটাই বিগড়ে দিলো ফালতু মেয়ে! আমি স্টেজের পাশ দিয়ে খাবারের টেবিলের কাছে যাচ্ছিলাম হঠাৎ কারোর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। দুমিনিট কান সোজা রেখে শোনার পর সিউর হতে পারি, স্টেজের পেছন থেকে কারোর কান্নার আওয়াজ আসছে। কিন্তু কাদবে কে? নাইমা আপুর কাদার কথা উল্টো সে মেহেদি হাতে হাসছে। পান্জাবীর হাতাটা আরেকটু উপরে তুলে স্টেজের পেছনে উকি দিতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। রাহা কাদঁছে! কর্দমাক্ত ঘাসের উপর হাটুতে মুখ লুকিয়ে কাদছে ও! আমি এই দৃশ্যবিবরণ দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না! একদৌড়ে ছুটে দিয়ে হাটু থুবড়ে বসে পড়ি ওর সামনে ।

— রাহা!! মাথা উঠাও !! কি হয়েছে বলো আমায়!! কাদছো কেনো?? কেউ কিছু বলেছে?? রাহা! তোমাকে আস্ক করা হচ্ছে আন্সার মি!!
রাহা মাথা উঠাচ্ছেনা। অনবরত কেদেই যাচ্ছে। কোলে তুলবো? নো নো! ইম্পসিব্যাল!বিয়ে বাড়িতে এতো মানুষের সামনে কোলে তুলে নিয়ে গেলে ওর সেল্ফ রিসপেক্টে আঘাত লাগবে! আই কান্ট ডু দিজ জব!
— রাহা জবাব দাও প্লিজ!
নাহ্ আর ধৈর্য ধরতে পারছিনা! এই মেয়ে নিজে কেদেঁ কেটে আমার অবস্থা নাজেহাল বানিয়ে দিচ্ছে। আমি উঠে দাড়িয়ে অন্যরাস্তা চিন্তা করছি। ভ্রুকুচকে স্টেজের পেছনে বামদিকটায় একটা রাস্তা খেয়াল করলাম। একমূহুর্ত সময় নষ্ট না করে, কান্নারত রাহাকে একচান্সে কোলে তুলে নেই। মেয়েটা নাকমুখ ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। ফুপিয়ে কাদছে এখনো। কোন্ বেয়াদ্দপ রাহাকে কাদিয়েছে তাকে আমি সিউর ছাড়বো না! ডায়ে-বামে রাস্তা ক্লিয়ার বুঝে দ্রুতবেগে ওখান থেকে সরে রাহার রুমে ঢুকে পড়ি। রাহা অনেকবার ছুটার জন্য ছুটাছুটি করলেও আমার কাছে ব্যর্থ হয়। আমি পা দিয়ে দরজা ঠেলে দরজার নবে লক টিপে দেই। রাহা দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাদছে। ওকে বিছানায় বসিয়ে আমি পাশে বসি। জোর করে মুখ থেকে দুইহাত শক্ত করে সরিয়ে ওর কাছে ঝুকে বলে উঠি,

— একশো বিশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি! কেনো কাদছো তাড়াতাড়ি বলো! না বললে একটা থাপ্পর মারবো!
রাহা হেচকি তুলে তোতলানো সুরে বলে উঠে,
— আআফরা আআপু আআমমাকে খখ্যাত বললেছে…
রাহার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হয়ে গেছি। ওকে মানুষ পেয়েছে কি! আমি রাহাকে শান্ত করতে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলাম। ও অর্ধেকটা খেয়ে গ্লাস রাখলো। এখনো হেচকি তুলছে রাহা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো?? নাহ্ কাজ হবেনা! বিছানায় বসা থেকে গা টা এলিয়ে দিয়ে মাথার নিচে দুহাতের তালু দিয়ে শুলাম।

— একটা টাস্ক করতে বলবো! করবা?
— ককি ককাজ?(হেচকি তোলা সুরে)
— পড়নের ড্রেসটা পাল্টে একটা কালো রঙের শাড়ি পড়ে এসো। কোনো হেনতেন না! যাও মানে যাও!(ঝাঝালো সুরে)

সাদ কথাগুলো ক্ষীপ্র গতিতে ছুড়ে ভাব গম্ভীর মুখে চোখ বন্ধ করে নিলো। রাহা সাদের ঝাঝ মাখানো কথার চোটে দ্রুত পা বাড়ালো আলমারি খুলে শাড়ি পড়তে। সাদ রাগের বেলায় ভয়ঙ্কর অবয়ব ধারন করতে পারে একবার ম্যাথ পরীক্ষায় ফেল করে সেটা প্রত্যক্ষ দেখতে চেয়েছে! তিনের জন্য ম্যাথে ফেল করাতে অনেক বকাবকি করেছিলো রাহাকে। রাহার সে দৃশ্য মনে উঠলে এখনো হার্টবিট ফাষ্ট হয়! একটা কালো রঙের শাড়ি ও ম্যাচিং ব্লাউজ খুজে রুমের মধ্যে কাচুমাচু করতে থাকে রাহা। সাদ রুমে উপস্থিত থাকলে শাড়ি পড়তে পারবেনা!! ‘আপনি বাইরে যান’– কথাটুকু বলার সাহস জুটাতে হিমশিম খাচ্ছে রাহা। হঠাৎ ভাব গম্ভীর গলায় চোখ বন্ধ রেখে সাদ বলে উঠে,

— আমি রুম থেকে যাবো না! আমাকে রুম থেকে যেতে বলবে না খবরদার! ওয়াশরুমে যাও!

রাহা বিষ্ময়চোখে শাড়ি হাতে সাদের কার্যকলাপ দেখলো। এই বেটা আমার ভেতরের কথা কিভাবে জানলো! কোলে তুলে কোনো ডিভাইস ফিট করে দিয়েছে নাকি! সাদ কি আদৌ চোখ বন্ধ করে আছে? নাকি রাহাকে সম্পূর্ণ পরোখ করছে? রাহা বোকার মতো ওয়াশরুমে ঢুকে ঠিক দশমিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরুলো। শাড়ি সে আগেও পড়েছে, তাই দেরি হয়নি শাড়ির আচঁল সামলে গুচ্ছাকারে কুচি করতে। রাহা দেখলো সাদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। চোখের পল্লব গাঢ় করে বোজা। মাথার নিচে দুহাত দিয়ে পান্জাবী পড়নে চোখ বন্ধ করে আছে সাদ। ঘুমন্ত চেহারার উপর আলাদা বৈশিষ্ট্যর মায়া ভীড় করেছে মানুষটার উপর! ফ্যানের বাতাসে উড়া চুলগুলো যেনো ছুটি কাটাচ্ছে কপালের উপর। নিশ্বাসের সাথে লালচে ঠোঁটের মাঝে মাঝে কেপে উঠা দৃশ্যপট… ঘোর নয়নে দেখছে রাহা। ভুবন গুলিয়ে সাদের প্রতিটা কথাই বাধ্য মেয়ের মতো মেনেছে রাহা, এখনো বুঝতে সক্ষম হয়নি। সে পারতো চিৎকার করে সবাইকে ডেকে সাদকে ধোলাই খাওয়ানোর!!

রাহা ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সাদের দিকে। সাদের সামনে যেয়ে ঘুমন্তাবস্থা মুখটা দেখে মুচকি হাসে রাহা। ছেলেটা এতো মাশাআল্লাহ কেনো!! উনি ঘুমিয়ে আছে তবুও যেনো মায়াজালের রশ্মি দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দিচ্ছে। টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে টুপ করে দুটো ছবি তুলে নিলো স্লিপিং সাদের। মিস্টার সাদ ইউ হরিব্যাল টাইপ হ্যান্ডসাম!! বলেই মিস্টি করে হাসলো। গত পাচঁটা দিন ধরে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা সাদ নামের সুন্দর মানুষটা খেটেখুটে ক্লান্তিকর দেহটা নিয়ে আমার রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। অদ্ভুত! আমাকে হুকুম দিয়ে কাজ সারিয়ে নিজেই ঘুমে নিমগ্ন হলেন?? কাজটা ঠিক করলেন!!

রাহা সাদের ঘুম দেখে পা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলো। সাদের ঘুমের যে মতিগতি!! এই গভীর ঘুম কাল দশটার আগে ভাঙ্গবেই না!! ভেবেই একগাল হাসলো রাহা। হাসি দিয়ে কথাগুলো জোরে জোরে বলে উঠলো, ‘দেখ বেটা! কেমন লাগে! আমার সাথে ধমকাধামকি করেছিলি না!! এক্কেবারে ঠিক হয়েছে!!’ রাহা পা বারিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে নেবে ওমনেই শাড়ির আচঁলে টান অনুভব করে উল্টো হয়ে হুমড়ি খেয়ে বেডের উপর পড়ে। চোখ খুলে আশপাশে তাকাতেই দেখে সাদ কাত হয়ে ওর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাহা বেক্কলের মতো তাকিয়ে থাকে। এই বেটা ঘুমায়নি! জেগে ঘুমের এক্টিং করেছে!! তাহলে আমি যা যা বললাম সবই শুনেছে?? ওহ মাই গড! আল্লাহ…মাবুদ!! আমি তাহলে শেষ!! ভেবেই শুকনো গলায় ঢোক গিলে গলা ভিজালো রাহা। না জানি সাদ এখন কি অবস্থা করে তার!! সাদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

— কেছা লাগা মেরা মাজাক! বাচ্চে!!

-চলবে

-ফাবিয়াহ্_মম♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here