অনাকাঙ্ক্ষিত_প্রেম পর্ব ১৮+১৯

#অনাকাঙ্ক্ষিত_প্রেম
#পর্ব-১৮
#লেখিকা–ইসরাত বিনতে ইসহাক

আজকে চার মাস হলো শরীফ সিলেট সেনানিবাসে ফিরে গেছে। কিছুদিন পরেই ছুটিতে আসবে, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবো না।

আমাকে দেখে শরীফ কি যে সারপ্রাইজ হবে, ভাবতেই পারছি না।

শরীফ যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে জানতে পারি আমি কনসিভ করেছি। আমার কথায় বাসার কেউ খবর টা জানায় নি শরীফ কে। আমি চাই শরীফ নিজের চোখে দেখে সারপ্রাইজ হবে। তখন উনার ফেইসের এক্সপ্রেশন কেমন হয় সেটা দেখতেই আমার এই প্লান।

সময় গুলো কিভাবে পার করছি আমিই জানি। তবে শরীফ সময় পেলেই আমাকে কল করে। উনি যতক্ষন আমার সাথে কথা বলেন ততক্ষণ খুব ভালো লাগে, তারপর আবার একা একা লাগে। মেহের আপুও পড়াশোনার জন্য ঢাকায় ব্যাক করেছেন।আর মরিয়ম আপুর মাসে একবার ও আসা হয় না।কল করলেই বলেন সংসারের অনেক কাজ সে জন্য আসতে পারেন না। আমি বুঝতে পারি না কি এমন কাজ আপুর।আর ভাইয়া দেশেই নেই। শুধু শ্বশুর শাশুড়ি আর আপু, তারপরেও এতো কাজ কোথায় পায় আপু বুঝিনা।

আমার এখন চার মাস চলছে,পেট এখনো তেমন বড় হয়নি, কিন্তু বুঝা যায় আমি যে প্রেগন্যান্ট।

শরীফ যখন ভিডিও কলে কথা বলে, তখন শুধু আমার ফেইস দেখাই। উনি এতেই বলেন আমি নাকি আগের থেকে মোটা হয়েছি। তখন আমার কি যে হাসি পায়,বলতেও পারি না আবার হাসি আটকাতে ও পারি না। উনি তখন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলেন কি ব্যাপার অন্য সময় হলে তো রেগে আমার অবস্থা খারাপ করে দিতে আর এখন হাসছো? আমি তখন বলি ওহ্ আচ্ছা তাহলে আমার রেগে যাওয়া উচিৎ ছিল? তাহলে রেগে যাই? না না এমনিতেই ঠিক আছে।রাগতে হবে না।

উনার কথা শুনলে আরো হাসি আসে তাই কল কেটে দেই।

গতকাল মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন শরীর ভালো যাচ্ছে না তাই।ডাক্তার টেষ্ট করে বললেন আমার নাকি রক্ত শূন্যতা রয়েছে। বেশি বেশি খাবার খেতে হবে। এটা শুনে মা বাসায় আসার পর থেকে ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে খাওয়াচ্ছে।

আমার শ্বাশুড়ি মায়ের ব্ল্যাকমেইল হলো, উনি যা যা খাবার আমাকে খেতে দেন সব খেতে হবে না হলে শরীফ কে আমার প্রেগন্যান্সির কথা জানিয়ে দিবে।আপনারাই বলুন এটা কোন কথা হলো? এতো কিছু খাওয়া যায়।

বলে দেওয়ার ভয়ে আমাকে সকালে ঘুম থেকে উঠে খাবার খাওয়া শুরু করতে হয় আর শেষ করতে হয় রাতে ঘুমানোর সময়। খেতে খেতে আমার জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে।

তবে আমার মতো ভাগ্যভতী খুব কম মেয়েরাই আছে। এতো ভালো একটা পরিবার পেয়েছি, আমার কষ্ট গুলো কখনো মনে করতেই দেয় না যেমন মা তেমনি বাবা। বাবা তো এখনি উনার নাতি নাতনির নাম ঠিক করে রেখেছেন।আর মেহের আপু ভিডিও কলে কিছুদিন আগে দেখালেন কত্ত ডল এবং ড্রেস কিনেছেন। আমার এদের এসব কান্ড দেখে মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে।এরা কি করে পারে আমাকে এতো ভালবাসা দিতে।

মাঝে মাঝে ভয় হয়, এতো সুখ স‌ইবে তো আমার। আমি এদের ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবো না,মরেই যাবো।

মা ডাকছে,,,
গিয়ে দেখি আবার কি খাবার তৈরি করেছেন।

মা ডাকছো ?
হ্যা শরীফা দেখ কি এনেছি। এগুলো তো ডিম মা, রোজ ই তো তিনটা করে খাওয়াও তাহলে এখন দেখার কি আছে?

আরে এগুলো হাঁসের ডিম।মা আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দাও, আমি কিছুতেই হাঁসের ডিম খাবো না। আমি ঠিক বুমি করে দিবো, হাঁসের ডিম খেলে।

আরে কিচ্ছু হবে না, হাঁসের ডিম খেলে বাচ্চাদের চোখ বড় বড় হয়। মা এসব আজগুবি কথা তুমি বিশ্বাস করো?এসব একদম সত্যি হয় না।

না না একদম সত্যি, মেহের আর সাইফ যখন আমার পেটে ছিল তখন আমি খেয়েছিলাম। তাই তো চোখ গুলো বেশ বড় বড় হয়েছে।

মা কিন্তু হাঁসের ডিম খেতে অনেক বাজে গন্ধ হয়।কে বলছে তোকে এসব? তুই একবার খেয়ে দেখ আমি বলছি খুব ভালো লাগবে খেতে।

কি আর করা খেতেই হবে, না খাইয়ে মা আমাকে ছাড়বেই না। এই খাওয়ার অত্যাচার চলতেই থাকবে তুই মায়ের কাছে না আসা পর্যন্ত।পেটে হাত দিয়ে কথা গুলো বলছি। তখন সাইফ এসে বলে ভাবীমনি তুমি কার সাথে কথা বলছো? আমি একটা পরীর সাথে কথা বলছি।

সাইফ বলে ভাবীমনি কোথায় পরী?
কিছুদিন অপেক্ষা কর তারপর দেখতে পাবি। তাহলে তুমি কি দেখতে পাচ্ছো এখন? আমি ওকে কল্পনায় দেখতে পাই। কিভাবে??সে তুই বুঝবি না, তোর বুঝার বয়স হয়নি।

তুমি বলো না?
আজকে পড়তে বসেছিস ? না। তাহলে এক্ষুনি গিয়ে পড়তে বসবি।আরো পরে বসি? না এক্ষুনি বসবি, সাইফ তুই না দিন দিন ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছিস।ভাবীমনি তুমি আমাকে পড়ানোর সময় এতো রাগি হয়ে যাও কেন বলো তো? তুই যাবি নাকি বাবা কে বলবো ??যাচ্ছি বলে সাইফ দৌড় দিল।

এই মুহূর্তে সাইফের প্রশ্ন থেকে বাঁচতে ওকে পড়তে পাঠালাম। সাইফ যেদিন থেকে আমার পেট বড় বুঝতে পারছে সেদিন থেকেই ও আমার পিছনে পরেছে। সারাক্ষণ জিজ্ঞাসা করে আমার পেট এতো বড় হলো কেন?

একদিন তো শরীফ কে ও বলে দিচ্ছিল, কোন রকমে আটকাই বলা থেকে।

এই সময় নাকি অনেক হাঁটাহাঁটি করতে হয়। তাই ছোট ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। শরীফ কে খুব মিস করি, উনার সাথে কাটানো সময় গুলো খুব সুন্দর ছিল ‌।

আর মা হাঁসের ডিমের মত এরকম অনেক কিছু এনে বলে এটা খেলে এই হবে সেই হবে,সব আমাকে খাওয়ানোর দান্ধা। বিভিন্ন রকম ফল এনে বলে এগুলো খেলে বাচ্চারা ফর্সা হয়, আমাকেও বাদ্য মেয়ের মত সব খেতে হয়।

শরীফ যদি আমার এই করুন অবস্থা দেখতো নির্ঘাত হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো। উনার বার্তা আমার জানা আছে। তবে বাবা ই ভালো আমাকে অনেক বিভিন্ন রকম আচার এনে দেয়। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ বসে বসে আচার খাই।সব কিছু থেকে আচার টাই বেশি ভালো লাগে।

বাবা মা মেহের আপু ও মরিয়ম আপু সবাই খুব খুশি, নতুন অতিথি আসছে বলে। শরীফ নিশ্চ‌ই খুব খুশি হবেন। শুধু আমার বয়স কম বলে নিষেধ করেছিলেন।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নিচ্ছি ঠিক সে সময় মায়ের ফোনে কল আসে। মা কল রিসিভ করলে আমাকে খুঁজে কলের ব্যাক্তি।কল টা অননোন বলে আমি কয়েক বার কেটে দেই। কিন্তু তারপরও কল আসা বন্ধ হয়নি। এরকম রিসিভ করছি না বলে শেষে মেসেজ আসে।

মেসেজ টা দেখে আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। কিন্তু এরকম খবর মিথ্যা হতে পারে না। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

কোন রকমে বোরকা পরে হিজাব টা পেঁচিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, গন্তব্য আমাদের গ্রাম। মা অনেক জিজ্ঞাসা করেন কোথায় যাচ্ছি আমি? কিন্তু আমি যে নিরুপায়, আমি যে কিছুই বলতে পারবো না।

জানি না আমার জীবনের মুর কি হতে চলেছে। মেসেজ টা ছিল, “আপনার বাবা বেঁচে আছে আর তাকে যদি আপনি জীবিত অবস্থায় দেখতে চান তাহলে আপনার গ্রামের বাড়ি চলে আসুন”।

আর কয়েক মিনিটের পথ বাঁকি, আমাদের বাড়িতে পৌঁছাতে। মনে হচ্ছে যতো এগুচ্ছি তত‌ই কিছু হাড়িয়ে ফেলছি। তবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে আমার আব্বু বেঁচে আছে।এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে।

কতো দিন পর আমার নিজের গ্রামে পা রাখলাম, সবকিছু যেন অন্য রকম লাগছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে বুঝা যাচ্ছে। বাড়িতে মানুষ জন না থাকলে কেমন যেন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, আমাদের বাড়িটার অবস্থা ও হয়েছে সে রকম। বাড়িতে এসে দরজা নক করতেই একটা ছেলে এসে দরজা খুলে দিল।

ভিতরে যেতেই, পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আঁতকে উঠলাম।

আমার সামনে রাশেদ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম আপনি এখানে? আব্বু কোথায়?

আস্তে বেবি এতো উত্তেজিত হলে চলে?তার উপর তুমি প্রেগন্যান্ট। তোমার তো এখন উত্তেজনা একদম ঠিক হবে না তাই না।

আব্বু কোথায় সেটা বলুন আপনি?
আব্বুর সাথে দেখা করতে পারবে তবে আমার কিছু সর্ত আছে।ক,,কি সর্ত?ভয় পেলে শরীফা? আমি তো জানতাম না শরীফা এতো ভিতু, আমি তো জানি শরীফা কতো সাহসী।

বলবেন আপনি আমার আব্বু কোথায়? খুব জোরে চেঁচিয়ে বললাম।

গলা নামিয়ে আমার সাথে কথা বলবি, কুত্তার মতো তোকে খুঁজে বেড়িয়েছি।আর তুই এখন আমাকে তেজ দেখাচ্ছিস?সাহস এতো বেড়ে গেছে। খুব পাখা গজিয়েছে না তুর , সেই পাখা আমি কেটে দিব।আর তোর আর্মি কে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে কয়েক মিনিট ও সময় লাগবে না আমার।

কি বলছেন আপনি এসব? রাশেদ ভাইয়ের কথা শুনে ভয়ে আমার শরীর ঘেমে একাকার। আমি তো জানি উনি কতটা ভয়ংকর লোক।

জানার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম,আপনি আমাকে কোথায় পেলেন?আর নাম্বার ই বা কোথায় পেলেন?

গতকাল হসপিটালে গিয়েছিল তাই না তোর বেবির চ্যাক‌আভ করতে। ভাগ্যিস আমিও গিয়েছিলাম হসপিটালে বাবা কে নিয়ে। সেখানেই তোকে দেখে চিনতে পারি আমি। তুই যত‌ই এসব মুখ ডেকে রাখিস না কেন আমি তোকে ঠিক চিনতে পারবো,আর তাই হলো।আর ডাক্তার কে ভয় দেখিয়ে তোর সমস্ত ইনফরমেশন জেনে নেই।

আমি মনে মনে ভাবছি তার মানে রাশেদ ভাই শরীফ আর উনার পরিবার সম্পর্কে সব কিছু জেনে গেছে।যে ভয় টা এতো দিন পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। জানি না রাশেদ ভাই প্রতিশোধ নিতে কি কি করেন।

শোন তুই তোর বাবা কে পেতে আমি যা যা বলবো, ঠিক তাই তাই করতে হবে।

আমি আব্বু কে দেখতে চাই,,, আচ্ছা তাহলে চল। আগে দেখে নে আমার কথা হয়তো তোর বিশ্বাস হচ্ছে না।

এই বলে রাশেদ ভাই, আমাদের একটা রুমে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি আব্বু বসে আছে, আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিনা। আব্বু বলে ডাক দিলাম।

আব্বু বললো কে?
আমি কাছে গিয়ে আব্বু কে জড়িয়ে ধরলাম। শরীফা? শরীফা তুই এসেছিস মা? আব্বু তুমি ঠিক আছো? কোথায় ছিলে এতদিন?
সেদিন রাশেদ আমাকে হসপিটালে নিয়ে ভর্তি করায়। দুই মাস পর আমি সুস্থ হয়ে ফিরে, রাশেদ ই সেই থেকে মানুষ রেখে আমার সেবা করছে। আব্বু তাহলে আম্মু আপুদের খবর দিল না কেন? আমি তো জানি না মা, তোরা ভালো আছিস ভেবে আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি ওকে।

আব্বুর সাথে আর কোন কথা বলতে দিলেন না রাশেদ ভাই। আমাকে অন্য রুমে নিয়ে আসে।

তারপর রাশেদ ভাই এর সর্ত শোনে,দুটানায় পরে গেলাম। একদিকে আমার আব্বু তো আরেক দিকে আমার অনাগত সন্তান। দু’জনেই যে আমার খুব আপন। কাকে বেছে নিব আমি??,,,,
#অনাকাঙ্ক্ষিত_প্রেম
#পর্ব-১৯
#লেখিকা–ইসরাত বিনতে ইসহাক

দু’জনেই যে আমার খুব আপন। কাকে বেছে নিব আমি??,,,,

রাশেদ ভাই আমাকে শর্ত দিয়েছেন, আমি যদি আব্বু কে পেতে চাই তাহলে আমার সন্তান কে এভোর্সন করতে হবে।আর তারপর উনাকে বিয়ে করতে হবে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।

আব্বু কে তো আমি আর হারাতে পারবো না। আবার আমার সন্তান তাকে ও না। কি করবো আমি?? আমাকে ভাবার জন্য দুই দিন সময় দেওয়া হয়েছে।

মানুষ কতোটা নিষ্ঠুর উনাকে না দেখলে বুঝতাম না। রাশেদ ভাই বলেন, তোর বাবা কে যেমন বাচিয়েছি ঠিক তেমনি আবার মারতে ও পারবো। এখন সিদ্ধান্ত তোর তুই কাকে চাষ তোর বাপ কে নাকি তোর সন্তান কে?

শরীফ কে ও জানাতে নিষেধ করেছে, আর আমার ফোন তো নিয়েই নিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এতোক্ষণে নিশ্চ‌ই বাসায় সবাই টেনশান করছে আমাকে নিয়ে।

আচ্ছা শরীফ কে কি জানিয়েছেন বাবা মা আমার এভাবে চলে আসার কথা??

খুব খিদে পেয়েছে, এতোক্ষণে মা কতো খাবার যে দিতো খাওয়ার জন্য। এখন বুঝতে পারছি খিদে, তখন মা একটু পর পর এটা ওটা দিতেন তাই খিদে টা বুঝতাম না।

ভাবতে পারছি না কিছু,,,
কি করবো আমি??ঐ দিন বাড়ি থেকে চলে গিয়ে ও মনে হয় এতোটা অসহায় লাগে নি যতোটা না আজকে লাগছে ‌। শরীফ আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না আমি জানি কিন্তু আমি কি করবো আমি যে নিরুপায়।

একদিন পার হয়ে গেল,
আমি ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারিনি। শরীফের সাথে কোন যোগাযোগ নেই জানিনা উনার কি অবস্থা।

আজকের দিনটা শুধু আমার হাতে সময় আছে। কি করবো আমি?? মা হয়ে সন্তান কে নিজ হাতে শেষ করে দিব?? আমি কি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো?

সকালে রাশেদ ভাইয়ের লোকেরা রুটি আর বাজি দিয়েছে খাওয়ার জন্য, খুব খিদে পেয়েছিল তাই খেয়ে নিলাম।

গতকাল থেকে জায়নামাজে বসে আছি,কান্না করে আল্লাহ তা’আলার কাছে বলে চলেছি।

আল্লাহ তা’আলার দয়া ছাড়া আমি এই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারবো না। আল্লাহ তা’আলা যা কিছু করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। হয়তো এখানেও আমাদের ভালো কিছু রয়েছে।যে কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা উপর ভরসা রাখতে হবে। হয়তো ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন তিনি।

_______

আমার দুদিনের সময় শেষ।
সিদ্ধান্ত আমার সন্তান, যে কিনা এখনো পৃথিবীর আলো দেখতেই পারলো না তাকে হত্যা করা। এ কেমন মা আমি??

পেটের উপর হাত বলছি, আমাকে পারলে মাফ করে দিস শোনা, তোর মা তোকে বাঁচাতে পারলো না।জানিস তো তোর মা খুব নিষ্ঠুর, তোর নানা ভাইয়া কে বাঁচাতে তোকে বলি দিচ্ছে। এই বলে খুব কান্না করছি, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আমার এই কান্না দেখার মতো কেউ নেই।

কিছুক্ষণ পরেই অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হবে।কান্না কিছুতেই থামাতে পারছিনা আমি। রাশেদ ভাই বার বার ধমক দিচ্ছেন আর বলছেন আমি যেন এসব নেকা কান্না না করি।

আমার সাথে যদি এখন কোন মিরাক্কেল হতো,কতোই না ভালো হতো,,,যদি শরীফ এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেত। শরীফ আপনি কোথায়?? আপনার সন্তান যে খুব বিপদে আছে। আপনি আসুন না প্লিজ। আমি জানি আপনি আসলে ঠিক আমাকে এই নরক থেকে বের করে নিয়ে যাবেন।

সময় হয়ে গেছে অপারেশন এর।যত এগুচ্ছি ততো পা আশাড় হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে পালিয়ে চলে যাই।

অপারেশন কেবিনে শোয়ানো হলো আমাকে। তারপর একটা ইনজেকশন পুশ করা হলো। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো,আর কিছু মনে নেই আমার।

_______

সন্ধ্যা হয়ে আসছে,
বাহিরের ক্ষিন আলো এসে পড়েছে রুমে। উঠে বসলাম আমি, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।সব কিছু মনে হতেই আপনা আপনি হাত টা পেটে চলে গেল। কিন্তু আমি এ কি দেখছি?? আমি কোন স্বপ্নের মধ্যে নেই তো? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার সন্তান আমার গর্ভেই আছে।

খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি আমি।
তারপর মনে হলো, কোথায় আছি আমি??সব কিছু অপরিচিত লাগছে। রাশেদ ভাই আবার কোন ফন্দি করেন নি তো? ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে।

হেঁটে হেঁটে দেখছি চারোপাশ সম্পূর্ণ অচেনা। এখানে কখনো আসিনি আমি সিউর। হাঁটতে হাঁটতে বেলকনিতে চলে এলাম। বাহিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম কিছু আর্মি কি সব কাজ করছেন। আমার বুঝতে বাকী নেই যে শরীফ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। খুশিতে আমি কেঁদে ওঠি।

এটা তাহলে শরীফের কোয়ার্টার, উনি কিভাবে আমার খোঁজ পেলেন?আর আমার আব্বু? আব্বু ঠিক আছে তো? আমাকে না পেলে তো রাশেদ ভাই আব্বুর ক্ষতি করে দিবেন।সব প্রশ্নের জবাব শরীফ দিতে পারবেন।

কখন আসবেন উনি? আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। উনি হয়তো ডিউটিতে আছেন।

আল্লাহ তা’আলার কাছে কুটি কুটি শুকরিয়া আলহামদুলিল্লাহ। এখন আর কোন ভয় নেই আমার। এখন আর কোন অশুভ শক্তি আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমার একমাত্র ভরসার স্থানে যে আমি পৌঁছে গেছি, এবার আমার আর কোন চিন্তা নেই।

দেখলি শোনা তোর পাপা তোকে কত্ত ভালোবাসে।

আন্তাজ করে সুইচ টিপে টিপে রুমে আলো জ্বালালাম । জানালা গুলো বন্ধ করে দিলাম। দেখলাম তিন টা রুম একটা ডাইনিং রুম আর দুইটা বেড রুম। সাথে এটাচ বাথরুম, রুম গুলো বেশি বড় নয়, তবে আমাদের বেশ চলে যাবে। কোয়ার্টার গুলো হয়তো এরকমই হয়।

খুব খিদে পেয়েছে, সেই সকাল বেলা একটু খেয়েছিলাম আর কিছু খাওয়া হয়নি। এখন খুব ঘন ঘন খিদে পায়। জগে পানি দেখতে পেয়ে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম, এখন একটু ভালো লাগছে। খুব পানি তৃষ্ণা পেয়েছিল। আমার শোনা বেবিটার ও হয়তো খুব খিদে পেয়েছে, আমি খেলে তবেই তো ও খেতে পাবে। একটু সহ্য করে নে শোনা তোর পাপা আমাদের জন্য কিছু না কিছু ঠিক নিয়ে আসবে।

দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখি ছয় টা পঁচিশ বাজে। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান হবে। তাই অজু করে এসে জোহর নামাযের কাজা আদায় করে নিলাম।আর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলাম আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায় করতে। আল্লাহ তা’আলা খুব বড় বিপদ থেকে আমার সন্তান কে হেফাজত করেছেন, সারাজীবন শুকরিয়া আদায় করলেও মনে হয় শেষ করতে পারবো না এই দয়া।

মাগরিবের আজান হতে, নামাজ পড়ে তারপর জায়নামাজ থেকে উঠলাম।

ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখছি। তেমন ফার্নিচার না থাকলে ও যা আছে তাতেই হবে।এক রুমে খাবার টেবিল আর একটা খাবার রাখার আলমারি।আরেক টাতে খাট আর একটা ছোট টেবিল, টেবিলের উপর একটা ল্যাপটপ। শরীফ মনে হয় এখানে অফিসের কাজ করেন, সাথে কিছু ফাইল আছে।

আরেক রুমে আছে খাট,ড্রেসিং টেবিল আর একটা কাপড় চোপড় রাখার আলমারি। বুঝতে পারলাম এই রুমেই শরীফ থাকেন। হঠাৎ শুনতে পেলাম দরজা খুলার শব্দ শুনা যাচ্ছে,নিশ্চ‌ই শরীফ আসছে।

দৌড়ে দরজার কাছে আসলাম। ঠিক তাই হলো শরীফ ডুকলেন দরজা খুলে। আমি আর থাকতে পারলাম না দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম শরীফ কে।

জরিয়ে ধরেই কেঁদে দিলাম, শরীফ আমাকে ধরে আবার হাত ছেড়ে দিলেন।আর বললেন, শরীফা আমাকে ছাড়ো ফ্রেস হতে হবে আমাকে। এতো দিন পর দেখা, তারপরও শরীফ এটা বলতে পারলেন?? আমি তবুও ছাড়ছি না উনাকে।

এবার একটু রুড ভাবেই বললেন শরীফা ছাড় বলছি, ভালো লাগছে না আমার। তাই আমি ছেড়ে দিলাম, উনাকে দেখে বুঝতে পারলাম খুব ক্লান্ত উনি। মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খায়নি।

আমি সরে আসতে উনি হাতের কিছু প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলেন।

আমি জানি উনি আমার উপর রেগে আছেন, সেই জন্য এরকম ব্যবহার করছেন।রাগ চলে গেল ঠিক আমার সাথে কথা বলবেন।

বসে বসে শরীফের বের হ‌ওয়ার অপেক্ষা করছি।
প্রায় বিশ মিনিট পর উনি বের হলেন, উনাকে দেখেই বুঝলাম শাওয়ার নিয়েছেন ‌।

বসা থেকে উঠে গিয়ে বললাম আমাকে মাফ করে দিন, আমি তখন কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। মাথায় কিছুই আসছিল না। উনি আমার কোন কথাই যেন শুনতে পাচ্ছেন না। উনি উনার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। কাপড় নিয়ে বেলকনির রশিতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারপর ফেসিং টেবিলে আয়নায় নিজেকে সেট করে আবার খাবার টেবিলে রাখা প্যাকেট গুলো খুলতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।

মশাই ভালো রাগ করেছেন আমার উপর। এই রাগ কিভাবে ভাঙ্গবো আমি??

পিজ্জা এনেছেন,
“প্লেটে নিয়ে, আমাকে বললেন, খাবার টা খেয়ে নাও সারাদিন কিছু খাওনি। তোমার জ্ঞান ছিল না বলে খাওয়াতে পারিনি”।

অন্য দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বললেন উনি। আমি বললাম আপনি আমার সাথে কথা না বললে আমি খাবো না। উনি বললেন মেজাজ গরম করবে না আমার। চুপচাপ খেয়ে নাও বলছি। আমি ও খাবো না বলে বায়না ধরতেই জোর করে খাইয়ে দিলেন উনি। আমাকে খাইয়ে উনি ও খেয়ে নিলেন।

খাবার খেয়ে গিয়ে উনি শুয়ে পরলেন। আমাকে একটু বললেন ও না। আমি আর বসে থেকে কি করবো তাই গিয়ে উনাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু উনি আমাকে ছাড়িয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়লেন। উনার এরকম ব্যবহারে কান্না করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখতে পেলাম শরীফ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছেন। আমার যে কি শান্তি লাগছে কি বলবো,,,

আমি জানি উনি আমার উপর রেগে আছেন বলেই এরকম করছেন।হাত দিয়ে উনার লোমশ বুকে আঁকিবুঁকি করছি, কিছুক্ষণ পরেই উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেলেন।

আমিও উঠে পড়লাম, সময় দেখলাম দশটা নয় বাজে এতো সময় ঘুমিয়ে ছিলাম,,,
এশারের আজান অনেক আগেই হয়ে গেছে। দেখলাম শরীফ বাথরুম থেকে এসে নামাজে দাঁড়িয়েছেন।এই দৃশ্য দেখে খুব ভালো লাগলো।

তারপর আমিও অজু করে এসে উনার পিছনে নামাজ পড়তে শুরু করলাম,,,,

#চলবে….
#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here