অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -২২+২৩

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাতাসের ঝাপটায় অবিন্যস্তভাবে দুলে উঠলো দুজনের চুল। নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য। তরী ভালোলাগা আর লজ্জার সংমিশ্রণে মাথা নিচু করে নিলো। গাল দুটো ক্রমশ ফুলে উঠছে। কান গরম হয়ে এলো তার। পলক ঝাপটাবার সাথে সাথে কেঁপে উঠছে কালো পাপড়ি। মাহমুদ তন্ময় হয়ে দেখলো। তার চোখদুটোতে তরীকে বুকে টে*নে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় মাহমুদ। এই চাওয়াটা পূরণ হয়ে গেলে তার মনে লো*ভ জন্মাবে। তরীকে সম্পূর্ণভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠবে। সে চায় সব সুষ্ঠুভাবে হোক। তরীর পরিবার তাদের মেনে নিক। বিনা বাঁধায় তরীকে বাহুডোরে বেঁধে নিতে চায়। মাহমুদ জানে তাদের প্রচুর কাঠখড় পোহাতে হবে তরীর পরিবারকে মানাতে। তবুও সে চায় এই যুদ্ধের সৈনিক হতে। যে জিনিস পেতে ভীষণ কষ্ট পোহাতে হয়, তার মূল্য তত বেশি হয়। তরী তার কাছে অমূল্য। তাকে পেতে এইটুকু কষ্ট অনায়াসে করে নিতে পারবে।

তরীর বাঁ হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজলো মাহমুদ। হাত দুটো লুকিয়ে পড়লো শাড়ির আঁচলের নিচে। তরীর ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে নিটোল হাসি। স্টপেজ এ এসে হাতে হাত রেখে আগেপিছে বাসে চড়লো। জানালার পাশটা বরাদ্দ হলো তরীর জন্য। চলমান গাড়ি আর বাতাসের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে তরীর ঢিলে হয়ে যাওয়া চুল দোল খাচ্ছে মাহমুদের চোখেমুখে। সে পরম আবেশে চোখ দু’টো বুজে আছে। মুখের কোথাও বিরক্তি বা ক্লান্তির চিহ্ন টুকু নেই। তরী নিজেই চুল টেনে শক্ত করে বেঁধে নিলো। মাহমুদ ভুরু কুঁচকে ফেললো। ঝট করেই চোখের পাতা খুলে ফেললো। মৃদুস্বরে শুধালো,
-“চুল বাঁধলে কেন?”

তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কিছু শব্দ বের করার জন্য উদ্ধত হওয়ার পূর্বেই চুলে টান পড়লো। ঝরঝরে করে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো কেশরাশি। তরী হতভম্ব হয়ে রইলো। মাহমুদ তরীর চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে নির্লিপ্ত রইলো। বাসের জানালায় মুখ আড়াল করার চেষ্টা করলো তরী। ঠোঁট টিপে হাসছে সে। মাহমুদের নজর এড়ালোনা। সেও হাসলো নিঃশব্দে। তরী আড়চোখে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল। মাহমুদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তরীর মিটিমিটি হাসি রূপ নিলো প্রাণখোলা হাসিতে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসির দমকে। তবে শব্দ হচ্ছে না। বাতাসের দাপটে এলো চুলের ঝাপটা মাহমুদের চোখেমুখে বাড়ি খাচ্ছে। প্রাণভরে শ্বাস নিলো সে। চুলের ভাঁজে ভাঁজে কি যেন এক সুগন্ধি খুঁজে পেল। অনায়াসে টে*নে নিলো সেই ঘ্রাণ।

তরীর গন্তব্য আসার পূর্ব স্টপেজ এ বাস থামলো। মাহমুদ তার হাত টে*নে নামিয়ে নিলো। তরীর চোখেমুখে প্রশ্ন জমা হলো। কৌতুহলী মন জিজ্ঞেস করলো,
-“এখানে কেন নামলাম, আমরা?”

মাহমুদ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,
-“আসো তো!”

হুট করে আজ এই তুমি তুমি ডাকটা কেমন চমকে দিল তরীকে। মায়া মায়া ডাক। এতে জমে আছে ভীষণ যত্নে গড়া ভালোবাসা। তরীর ভালোলাগছে আবার কেমন লজ্জাও লাগছে। মাহমুদের সাথেই সিএনজিতে উঠলো। মাঝে মাহমুদ তাকে সাবধান করে দিল,
-“শাড়ি টে*নে বসো। চাকায় লেগে দু*র্ঘ*ট*না হতে পারে!”

তরী আঁচল গুটিয়ে বসলো। মাথা রাখলো মাহমুদের ঘাড়ে। আজ কেমন নির্লজ্জ হয়ে উঠলো তরী। বন্দী খাঁচার পাখি যেমন মুক্ত হয়ে গেলে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়! ঠিক তেমন। নিজের ইচ্ছেকে আজ প্রাধান্য দিল। জলে যাক জড়তা, লজ্জা। তাদের আজ ছুটি দেওয়া হলো। মাহমুদ একবার তাকালো। সামনে দৃষ্টি রেখে হাত নিয়ে রাখলো তরীর পিঠ ছুঁইয়ে বাহুতে। আগলে রাখলো নিজের সাথে। নরম স্বরে ডাকলো,
-“তরী।”

-“হু।”

-“ভয় করছে না?”

-“উঁহু।”

তরীর এই সরল জবাব টুকু যেন প্রশান্তি দিল মাহমুদকে। বুক ভরে শ্বাস নিলো। এই মেয়েটাকে আর দূরে দূরে রাখা যাচ্ছে না। দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। কেন এত আদুরে আদুরে লাগছে তাকে?
তরী ঘাড়ে মাথা রেখেই প্রশ্ন করলো,
-“আমরা বাস থেকে কেন নামলাম? আর বললেন না তো কোথায় যাচ্ছি?”

-“নতুন বাসায়।”

দ্বিরুক্তি করলোনা তরী। মাহমুদের সাথে ওভাবেই মিশে রইলো। পূর্ব স্টপেজ এ নেমে পড়ার কারণ আছে অবশ্য। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা মাহমুদের বাসায় গিয়ে নামতে পারবে। কেউ দেখবেনা। কিন্তু তরীদের এলাকায় এসে নামলে দুজনকে একইসাথে তরীর বাবা হয়তো দেখে ফেলতে পারেন। আগে ভয় ছিলনা। কিন্তু এখন তিনি মাহমুদের ব্যাপারটা জানেন। দুজন এসে নামলো মাহমুদের নতুন বাসার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল। মাহমুদ সামনে, তরী তার পেছনে। দুতলায় এসে বেল দিল মাহমুদ। তরী মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের বাহুতে হাত রেখে ভয়কাতুরে চেহারায় জিজ্ঞেস করলো,
-“আন্টি কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবো?”

মাহমুদ চাপা হেসে বলল,
-“সেটা আমি কী জানি?”

ততক্ষণে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন আয়েশা সুলতানা। তরী ঝট করে মাহমুদের বাহু থেকে হাত ছাড়িয়ে মিষ্টি হেসে সালাম দিল আয়েশা সুলতানাকে। তিনি অবাক হয়েছেন তরীকে দেখে। হেসে সালামের জবাব দিয়ে তাকে টে*নে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মাহমুদ ধীরেসুস্থে ভেতরে ঢুকলো। সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে পড়লো। নতুন বাসায় চোখ বুলিয়ে দেখছে তরী। আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন,
-“তুমি যে এখনাে এসেছো, বাসায় সমস্যা হবে না?”

তরী মাথানিচু করে বলল,
-“বাসায় কেউ জানেনা।”

চমকালেন আয়েশা সুলতানা। আতঙ্কিত স্বরে বললেন
-“তোমার বাবা জানলে সমস্যা হয়ে যাবে। কেন আসতে গেলে এভাবে?”

নিচু স্বরে জবাব দিল তরী,
-“আপনাদের দেখতে ইচ্ছে করছিল।”

-“মাহমুদের দেখা কোথায় পেলে?”

-“উনিই আমাকে ভার্সিটির সামনে থেকে নিয়ে এসেছেন।”
বলেই থতমত খেয়ে গেল তরী।
আয়েশা সুলতানা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। উনার খানিকটা সন্দেহ হলো।
-“তোমার বাবা আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। তাহলে তুমি মাহমুদের সাথেই বা কেন এলে? তুমি ও কি মাহমুদকে পছন্দ কর?”

আয়েশা সুলতানার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কবলে পড়ে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। ঢোক গিললো তরী। ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। তবুও তার গরম লাগছে। কেমন হাঁসফাঁস করে উঠছে। তরীর অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে আয়েশা সুলতানার সন্দেহ গাঢ় হলো। তিনি আরেকটু চেপে বসলেন৷ ফের জিজ্ঞেস করলেন,
-“বলো, তুমিও কি পছন্দ করো?”

তরী হ্যাঁ, না কি বলবে বুঝতে পারছেনা। হুট করেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,
-“আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।”

আয়েশা সুলতানা বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। অস্ফুট স্বরে শুধালেন,
-“কী?”
এভাবে বিয়ে করাকে তিনি কিছুতেই সমর্থন করেন না। আয়েশা সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়ে তরীর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল। গলা কাঁপছে তার। ঢোক গিলে বলল,
-“আন্টি প্লিজ আপনি

কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলোনা তরী। হাত উঠিয়ে বাঁধা দিলেন আয়েশা সুলতানা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি প্রচুর অসন্তুষ্ট। হাঁক ছেড়ে মাহমুদকে ডাকলেন। সে মাত্রই গায়ের ঘর্মাক্ত শার্ট ঝেড়ে ওয়াশরুমে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মায়ের ডাক পড়ায় তার কাজে বাঁধা পড়লো। দ্বিতীয়বার গলা চড়িয়ে ডাকলেন মা। মাহমুদ লম্বা কদম ফেলে বেরিয়ে এলো। রামি স্কুল থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিল। সেও চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। তরীকে দেখে ঈষৎ চমকালো। মাহমুদ নিচু গলায় শুধালো,
-“কী হয়েছে মা?”

আয়েশা সুলতানা চোয়াল শক্ত করে নিলেন। কঠিন গলায় বললেন,
-“তরী এসব কী বলছে? বিয়ে করেছিস তোরা?”

মাহমুদ একবার তরীর দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে আছে সে। বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মায়ের দিকে ফিরে শান্ত গলায় জবাব দিলো মাহমুদ,
-“হ্যাঁ।”

মাহমুদের স্বীকারোক্তি যথেষ্ট ছিল রামিকে চমকে দেওয়ার জন্য। চমকালেও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে বলা চলে। আয়েশা সুলতানা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কবে বিয়ে করলি? আজই? কে কে জানে?”

মাহমুদ একইভাবে শান্ত গলায় জবাব দিল,
-“তরীর বাসায় থাকাকালীন বিয়ে করেছি। যেদিন ওকে রিং পরিয়ে গিয়েছিল, সেদিন। বিয়ের ব্যাপারে আমার কয়েকজন বন্ধু জানে।”

আয়েশা সুলতানা কঠিন হয়ে বললেন,
-“তরীকে বাসায় দিয়ে আয়।”

-“কিছুক্ষণ থাকুক। তারপর দিয়ে আসছি।”

-“এক্ষুণি দিয়ে আসবি। আর তরীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবিনা।”

তরীর ভেতরটা তড়াক করে উঠলো। মাথা তুলে টলমল চোখে তাকালো। কপোল ঘেঁষে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাহমুদের চোখমুখ শক্ত। কন্ঠের ভীত দৃঢ়। অনড় গলায় বলল,
-“তরী আমার স্ত্রী, মা।”

-“তো? কেউ তো জানেনা। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের মেয়েকে এভাবে বিয়ে করার মতো বে*হা*য়া*প*না*র শিক্ষা তো আমি তোকে দেইনি!”

-“আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক।”

-“আমি এতকিছু শুনতে চাইনা। এক্ষুণি তরীকে বাসায় দিয়ে আসবি।”

মাহমুদ গটগট পা ফেলে একটা শার্ট জড়িয়ে বোতাম আটকাতে আটকাতে বেরিয়ে এলো। শার্টের হাতা গুটিয়ে তরীর হাত চেপে ধরে বলল,
-“চল।”

রামি মায়ের হাত ধরে অনুনয় করলো,
-“মা প্লিজ এমন করো না! তুমি তো তরী আপুকে পছন্দ কর।”

আয়েশা সুলতানা নির্লিপ্ত রইলেন।
তরীর হাত চেপে ধরায় সে মাহমুদের দিকে আশাহত চোখে তাকালো। মানুষটা কি সত্যিই তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে? এটাই বুঝি বিশ্বাস? এই ঠু*ন*কো বিশ্বাসের বলে মানুষটার হাত ধরেছিলো? অঝোর ধারায় জল গড়ালো দু-চোখ ভরে। মাহমুদ তরীর অশ্রুমাখা চোখে তাকালো। মজবুত কন্ঠে বলল,
-“যত ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন! আমি তোমার হাত ছাড়ছিনা, তরী। এই হাত ধরেছি ছাড়ার জন্য নয়।”

#চলবে…..#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বিষন্নতায় নিস্তেজ হয়ে আসা তরীর চোখ জোড়া আশার আলো দেখলো। টলমলে চোখ সতেজ হলো। মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখের পাতা বন্ধ করে ভরসার দৃষ্টিতে তাকালো।
আয়েশা সুলতানা সামনে ঘোর বি*প*দে*র আশঙ্কা করছেন। অন্যকিছুকে ভয় পান না তিনি। ভয় শুধু সম্মান নিয়ে। কেউ যেন তার, তার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলতে না পারে। এসব তার অন্তরে সহ্য হবেনা। তিনি এবার খানিকটা নরম হলেন। দরজার দিকে আগত তরী আর মাহমুদকে থামিয়ে বললেন,
-“তোমরা যা করেছো, তাতে আমার যেমন খা*রা*প লাগছে! তেমন তরীর মা-বাবার ও খা*রা*প লাগবে। এটা স্বাভাবিক। কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার মতো অসম্মান আর কিছুতে নেই। তরীর বাবা ভাইয়ের কাছে অসম্মানিত হয়ে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। তরী বাবা-মা থেকে দূরে সরে যাবে।”

তরীর ভেতরটা অজানা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা-মা তাকে দূরে ঠে*লে দিলে সে সইতে পারবেনা। বাবা সত্যটা জানার পর তাকে মা*রু*ক, কা*টু*ক সে কিচ্ছুটি বলবেনা। তবে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পারবেনা। তার সবাইকে চাই। কেন সবার মতের এত অমিল? বাবা তার মতামত না নিয়ে চাচাকে কথা না দিলে কি খুব ক্ষ*তি হয়ে যেত? অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো তরী। মাথার ভেতর বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীর আর এগোতে চাইছেনা। মাহমুদের হাত ছাড়িয়ে ধপ করেই নিচে বসে পড়লো। চমকে উঠে দ্রুত তরীকে ধরলো মাহমুদ। রামি আর আয়েশা সুলতানাও এগিয়ে এলেন। তরীকে ধরে বসিয়ে দিলেন। পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরে বললেন
-“পানি খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”

ঢকঢক করে সবটা পানি গিলে নিলো তরী। গলাটা যেন শুকনো মরুভূমি হয়ে ছিল। মাহমুদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“বেশি খা*রা*প লাগছে, তরী?”

তরী এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে জানালো সে ঠিক আছে। তেজহীন গলায় বলল,
-“আমি বাসায় যেতে চাই।”

ঘন্টাখানেক আগের হাসিহাসি মেয়েটা কেমন দুঃখের সাগরে হারিয়ে গেল। ক্ষণিকেই জীবন হয়ে উঠলো দুর্বিষহ। মাহমুদ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
-“তুমি আগে ঠিক হও। তারপর বাসায় যাবে।”

তরীর একরোখা শান্ত জবাব।
-“এক্ষুণি বাসায় যাবো আমি।”

আয়েশা সুলতানা বাঁধ সাধলেন।
-“তোমাকে ঠিক লাগছেনা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। তারপর বাসায় যেও।”

তরী মলিন ঠোঁটে হাসলো। চোখ জোড়া নিভু নিভু। ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-“আমি ঠিক আছি। এখন বাসায় না গেলে দেরি হয়ে যাবে। সাধারণত ক্লাসের পর আমি বেশিক্ষণ বাইরে থাকিনা।”

এবার কন্ঠে জোর দিলেন আয়েশা সুলতানা।
-“আসার আগে এসব ভাবা উচিত ছিল। খেয়ে একটু আরাম করে তারপর যাবে। নয়তো মাহমুদ তোমায় দিয়ে আসবেনা।”

তরীর এই বিষন্নতার মাঝেও বড্ড হাসি পেল। তবে চেপে রাখলো সে হাসি। যেন সে ছোট্ট অরু। বাসায় না দিয়ে আসলে সে যেতে পারবেনা।
তরীকে রেখে দিলেন আয়েশা সুলতানা। খাবার খেয়ে একেবারে বের হলো। দালানের বাইরে বেরিয়ে মাহমুদ আলতো হাসলো। তার ঠোঁটের ওই নিটোল হাসি তরীকে একবুক প্রশান্তি এনে দেয়। বরাবরের মতো এবারও মুগ্ধ হলো সে। মাহমুদ কোমল স্বরে বলল,
-“দেখলে তো, মা কেমন গলে গেল। ঠিক এভাবেই তোমার বাবাকে মানিয়ে নেব।”

তরী বিদ্রুপ হেসে বলল,
-“এত সহজ না। বাবা কঠিন মানুষ।”

চোখে চোখ রাখলো মাহমুদ। অপলক তাকিয়ে রইলো শান্ত চোখে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-“যদি গলাতে পারি? কী দেবে আমায়, তরী?”

তরীও একইভাবে জবাব দিল,
-“আপনি কী চান?”

মাহমুদ মৃদু হাসলো। চোখজোড়া ক্ষীণ করে বলল,
-“সেটা নাহয় সময়ই বলবে।”

তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তবে কিছু বললো না। মাহমুদ তাকে নিয়ে সিএনজিতে চড়লো। তরীর হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিলো। বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে দিলো তরীর হাতের তালুতে। ভুরু কুঁচকে শুধালো,
-“মেয়েদের সবার হাতই কি এমন তুলতুলে থাকে? মিতুর হাতও যতবার ধরেছি, ততবারই এমন লেগেছে।”

তরীর চোখে প্রশ্নের মেলা। বুকের ভেতর অজানা আতঙ্কের ঢেউ। ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে রোধ হয়ে আসা গলায় শুধালো,
-“মিতু কে?”

মাহমুদ নিঃশব্দে হাসলো। তরীর এই ভয়কাতুরে চেহারা তাকে বড্ড আনন্দ দিচ্ছে। মেয়েটা তাকে নিয়ে জেলাস ফিল করে। ব্যাপারটা তার ভালোলাগলো।
জবাব না পেয়ে তরীর ভেতরটা তড়পাচ্ছে। কোথা থেকে এক আকাশসম অভিমান এসে জড়ো হলো। মুখ ঘুরিয়ে চলন্ত গাড়ির বাইরে তাকালো। গালদুটোর ফোলা ভাব ক্রমশ বাড়ছে। মাহমুদ মিটিমিটি হাসলো। আর অভিমান বাড়তে দেওয়া যায়না। অনুরাগী স্বরে ডাকলো,

-“তরী!”

লাভ হলোনা, তাকালোনা তরী। বরং তার হাতের মুঠোয় থাকা নিজের চিকন হাত ছাড়িয়ে নিলো। মাহমুদ আরেকটু কোমল হল।

-“তাকাও না,তরী!”

এবারও তরীর অবস্থার পরিবর্তন হলোনা। অভিমানে চোখজোড়া পানিতে চিকচিক করছে। মাহমুদ জোর করে তার দিকে ফেরালো। গোলগাল মুখশ্রী আঁজলা করে দু-হাতের ভাঁজে তুলে ধরলো। যত্ন করে মুছে দিল ওই নোনাজল। মাহমুদ বলল,
-“আমার অভিমানিনী, এত অভিমান কেন কর? মিতু আমার বোন। তোমার জায়গা শুধুই তোমার।”

তরী নাক টা*ন*লো। অভিমানের বরফ গলে পড়লো। নিজের কাজে এবার ভীষণ লজ্জা হলো। তার চোখে অল্পতেই পানি এসে যায়। সে চাইলেও কিছুতেই আটকাতে পারেনা। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে ফেললো। মাহমুদ বুঝতে পেরে হাসলো। বলল,
-“তোমার রাগ, অভিমান, পাগলামি সব তো আমার জন্যই।”

তরীর নাক টে*নে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো মাহমুদ। সামনের পথেই সে নেমে যাবে। সিএনজি তরীকে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। সামনেই নেমে পড়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল মাহমুদ। তাকে পেছনে ফেলে সিএনজি এগিয়ে গেল। তরী মাথা বের করে পেছনে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ না মাহমুদ দৃষ্টি সীমানার বাইরে যায়। মাহমুদ অদূরে মিলিয়ে যেতেই তরী সামনে দৃষ্টি ফেরালো। স্মৃতি রোমন্থন করে হাসলো মেয়েটা। আগে মাহমুদকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াতে চাইতো। আর এখন তার পরিবর্তন ঘটেছে। মন সারাক্ষণ মানুষটার কাছাকাছি থাকতে চায়।
বাসায় ফিরেই দেখলো মায়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তরী জামাকাপড় পাল্টে বাবাকে ফোন করলো। মিঠু বিকেলে খেলতে বেরিয়েছে, এখনো আসেনি। মা তরীকে বাঁধা দিলেন। দুর্বল গলায় বললেন,
-“আমি ঔষধ নিয়েছি। তুই এত অস্থির হবিনা।”

কয়েকদিন ধরেই জ্বর আসছে যাচ্ছে। তরীর মা কাউকেই জানায়নি। এখনও ভালোভাবে জ্বর এসেছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। তরী দুটো কম্বল নামিয়ে মায়ের শরীরে দিল। তবুও কাঁপুনি কমছেনা। পাশে অরু মুখ ছোটো করে দাঁড়িয়ে আছে। তরী আর মায়ের বাঁধা মানলোনা। বাবাকে বারকয়েক কল দেওয়ার পর তিনি ব্যাক করলেন। তরীর চোখে পানি, গলা ধরে আসছে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
-“বাবা, মায়ের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। শরীর কাঁপছে। কাঁথা, দুটো কম্বলেও কাঁপুনি কমছেনা।”

তরীর বাবা চিন্তিত হলেন। বললেন,
-“একটু অপেক্ষা কর। আমি এক্ষুণি এসে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”

কান থেকে ফোন নামিয়ে মায়ের পাশে বসলো তরী। কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মিঠু হেলেদুলে বাসায় ফিরলো। স্বভাবসুলভ মা মা বলে কয়েকবার হাঁক ছাড়লো। মায়ের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে মায়ের ঘরে আসলো। অরু ভীত চোখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। তরী আপু মায়ের কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মায়ের চোখমুখ ফ্যাকাশে, কেমন শুকনো হয়ে আছে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো মিঠু। জিজ্ঞেস করলো,
-“মায়ের কী হয়েছে আপু?”

তরী চোখমুখ অন্ধকার করে জবাব দিলো,
-“জ্বর এসেছে। কমছেই না।”

অরু দাঁড়ানো থেকে মায়ের পাশে খাটে উঠে বসলো। মায়ের শরীরের উপর উঠে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা দিয়ে নিস্তেজ হয়ে রইল। তরী আস্তে করে বলল,
-“নেমে পড়, অরু। মা ব্যথা পাবে।”

অরু নামলোনা। মাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। যেন ছেড়ে দিলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।
বাবা এসেই মাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। বাসায় অরু আছে বিধায় তরীকে রেখে গেলেন। মিঠুকে মানানো গেল না। পাগল হয়ে ছুটে চললো মায়ের সাথে। সে যতই পাগলামি করুক। দিন শেষে মায়ের কাছে এসেই শেষ দম ফেলে। তরীর মুঠোফোনে মাহমুদের দেওয়া কল, মেসেজের ভীড়। সেদিকে খেয়াল রইলো না তার।

★★★

রাত্রি দশটা। রাস্তার মোড়ে দানবীয় ল্যাম্পপোস্ট গুলো হরিদ্রাভ আলো ছড়িয়েছে। যানবাহনের শব্দে মাথা টনটন করে উঠছে। মাথা ধরে সিটে হেলে রইলেন তরীর মা। জ্বর এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাই ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা। তরীর বাবা চিন্তিত গলায় শুধালেন,

-“খুব কি কষ্ট হচ্ছে, রুবিনা?”

তরীর মা মাথা দুলিয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় জানালেন,
-“একটু খা*রা*প লাগছে।”

তরীর বাবা একহাতে আগলে রাখলেন স্ত্রীকে। ড্রাইভারকে তাড়া দিলেন দ্রুত গাড়ি টা*ন*তে।
একরোখা স্বভাবের মানুষ হলেও তরীর বাবা স্ত্রী, সন্তানের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। দো*ষ একটাই, তিনি একরোখা। নিজের সিদ্ধান্তকেই সঠিক মনে করেন।

বাসার সামনে এসে একহাতে স্ত্রীর বাহু চেপে ধরলেন। অন্যহাত হাতের মুঠোয় নিলো মিঠু। চারতলা পর্যন্ত এসে বেল দেওয়ার পরপরই দরজা খুলে গেল। যেন তরী বাবা মায়ের অপেক্ষাতেই ছিল। মাকে ধরে ঘরে পৌঁছে দিল। অরুকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছে।

খাবার শেষ করে ঘরে ঢুকেছে সবাই। তরী মাত্র ফোন হাতে নিতেই মাহমুদের অনেকগুলো কল, মেসেজ পেলো। সে কল ব্যাক করলো। মাহমুদ রিসিভ করেই চিন্তিত গলায় শুধালো,
-“বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে, তরী? এতবার কল দিলাম, মেসেজ দিলাম, রিপ্লাই করলেনা?”

তরী লম্বা শ্বাস নিলো। মায়ের অসুস্থতার কথা জানালো। মাহমুদ কী বলল শোনা গেল না। বাবার ডাক পড়তে ‘পরে ফোন করছি’ বলে তরী তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।

#চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here