#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
হাতে সময় খুবই স্বল্প। এরমাঝে সবাইকে দাওয়াত করা, বিয়ের কেনাকাটা সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন তরীর বাবা। সাথে মামাও আছেন। মামি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিয়ের দুদিন আগেই একেবারে আসবেন। এখন সবার স্কুল খোলা, তাই মাঝেমাঝে আসা-যাওয়া করছেন।
যত দিন যাচ্ছে ততই তরী লজ্জায় সংকুচিত হচ্ছে। হুট করে তার ভেতরে ভয় ঢুকলো! সে চলে গেলে সবার কী হবে? বাবা একা হাতে বাহির, বাড়ি সবটা কিভাবে সামলাবেন? অরুকে কে দেখবে?
তরী ফোন হাতে হুট করেই মাহমুদকে কল দিলো। রিসিভ হওয়ার পরই হড়বড়িয়ে বলল,
-“আমি বিয়ে করবো না।”
মাহমুদের রগঢ় কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
-“বেশ তো, করোনা। আমি না করেছি না-কি?”
তরী শক্ত হয়ে বলল,
-“আমি সিরিয়াস!”
মাহমুদ এবার বোধহয় একটু নড়েচড়ে উঠলো। রসিকতা ছেড়ে সেও যথেষ্ট মনযোগ দিলো তরীর উপর। খানিক চিন্তিত স্বরে শুধালো,
-“তুমি ঠিক আছো, তরী?”
-“না আমি ঠিক নেই।”
তরীর শরীর থরথর করে কাঁপছে। সবটা ভাবতে গেলেই কেমন মাথা ভার লাগছে। উত্তেজনা বশত মাহমুদকে এভাবে কল দেওয়া ঠিক হয়নি তার। বোধদয় হতেই স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
মাহমুদ বলল,
-“আগে শান্ত হও। তারপর বলো কী হয়েছে? আমি শুনছি।”
তরীর চোখের পাতা মুদে এলো। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে গোল করে প্রশ্বাস ছাড়লো। মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে শান্ত হয়ে বসলো। বলল,
-“আমরা বিয়ে করে নিলে বাবা, অরু, মিঠু ওদের কী হবে?”
মাহমুদের স্বর শোনা গেল না। ওপাশ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। তরী প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে মুখিয়ে আছে জবাবের আশায়।
মাহমুদ নরম স্বরে বলল,
-“সবাইকে দেখবো আমরা। তুমি চিন্তা করো না। আমরা দুজন সবটা সামলে নেবো। তুমি নাহয় আগে তোমার পরিবারকে সময় দিলে।”
তরী স্বস্তি পেলো মাহমুদের কথা শুনে। সে নিজেও কোমল হয়ে এলো। বলল,
-“তাহলে বলুন, আমি বিয়ের পর এখানেই থাকবো।”
-“থাকবে, সেটা সমস্যা না। সবাইকে দেখার জন্য হলেও তোমাকে থাকতে হবে। পরে অন্য একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।”
তরী শঙ্কা নিয়ে বলল,
-“কিন্তু আন্টি কি আমার বাবার বাসায় থাকা এলাউ করবেন?”
-“মা নিশ্চয়ই বুঝবেন। আমি কথা বলবো।”
-“সরি!”
তরীর নিচু স্বর।
মাহমুদ মৃদু শব্দে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“সেটা কেন?”
-“একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছি।”
-“আমি কিন্তু রেগে আছি, তরী।”
মাহমুদের স্বর ক্রমশই গম্ভীর হয়ে এলো। তরী ভয়কাতুরে গলায় বলল,
-“কেন? আমি তো সরি বলেছি।”
মাহমুদ আরেকটু গমগমে গলায় বলল,
-“সরি দিয়ে আমি কী করবো?”
-“তাহলে?”
-“ভীষণ ভালোবাসতে হবে।”
ক্ষণিকেই গাম্ভীর্যে ভরপর স্বর পালটে গেল। গলায় ভর করলো একরাশ ব্যাকুলতা, তীব্র অনুরাগ।
তরীর গালে লজ্জালু আভা ফোটে উঠলো। লজ্জা ঢাকতে চোখ বুজে নিলো সে। মনে হলো মানুষটা তার সমানেই দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করেই তাকে কঠিন লজ্জায় ফেলতে চাইছে।
তরীর জবাব না পেয়ে মাহমুদ বলল,
-“কী হলো? জবাব চাই আমার। বাসবে তো?”
টুক করেই লাইন ডিসকানেক্ট করে দিল তরী। ফোন হাতে নিয়ে অজান্তেই হেসে ফেললো। এখন অনেকটা হালকা লাগছে।
★★★
বিয়ের কেনাকাটা করতে তরীকে সাথে নিয়েই বের হলেন আয়েশা সুলতানা। মাহমুদ সহ তাদের পরিবারের সকলেই আছে। তরীর সাথে অরুও আছে।
শাড়ি দেখছিল সবাই। দোকানে আরো কয়েকজন মহিলা ছিলেন। রামির ঘড়িতে টা*ন পড়ে দাদুর বয়সি একজন ভদ্রমহিলার মাথার কাপড় ঝরঝর করে পড়ে যায়। মিঠুর চোখ আটকালো বৃদ্ধার মাথায়। তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে ভ্যাবাচ্যাক খেয়েছে।
বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি কতবার হজ্জ করেছেন? তাছাড়া হজ্জে পুরুষের মাথা ন্যাড়া করা হয় জানতাম। নারীদেরও ন্যাড়া করা হয় জানতাম না।”
বৃদ্ধা তেতে উঠলেন। কেননা, উনার মাথায় একটা চুলও নেই। দ্রুত মাথায় আঁচল টে*নে কর্কশ কন্ঠে বললেন,
-“এই ছেলে অ*স*ভ্য*তা করছো কেন? মহিলা মানুষ দেখলে তোমাদের বখাটেপনা জেগে উঠে, তাইনা?”
রামি তব্দা খেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-“ঘড়ি গিয়ে এই এই কর্কশ গলার বুড়ির শাড়ির সাথেই আটকাতে হলো? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়লো না-কি?”
পরক্ষণেই কৌতুহলের বশে বৃদ্ধাকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“বলুন না, হজ্জে কি মহিলাদের ও ন্যাড়া করা হয়?”
বৃদ্ধা এমন তেতে উঠছে কেন জানা নেই রামির। পাশের সবাই মিটিমিটি হাসছে। বৃদ্ধার সাথের একজন ইশারায় রামিকে চুপ থাকতে বললো। সেও চুপ করে গেল। যিনি চুপ থাকতে বলেছেন, সেই ভদ্র মহিলাই পরক্ষণে বললেন,
-“আমার শাশুড়ি ঔষধকে চিড়ামুড়ির মতো গেলেন। ভুলভাল ঔষধ খেয়ে সব চুল পড়ে টাক হয়ে গিয়েছেন। হজ্জে ন্যাড়া করা হয়নি।”
মহিলার ফিসফিসানো কন্ঠে এহেন জবাব শুনে রামি বিটকেলের মতো হেসে উঠলো। বারবার বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। বৃদ্ধা আড়চোখে তাকাচ্ছেন আর রাগে ফেটে পড়ছেন। রামিকে চোখ রাঙাতেই সে মৃদু শব্দে বলল,
-“দাদু আপনার কদবেলটা বেশ আকর্ষণীয়। একটু বেলের শরবত খাওয়াবেন?”
বৃদ্ধা রাগতে গিয়েও রাগলেন না। রামির কথায় তিনি নিজেও হেসে ফেললেন। বললেন,
-“আমার বাড়ি এসো। তোমায় কদবেলের শরবত খাওয়াবো।”
কেনাকাটা শেষ করে বৃদ্ধা পুত্রবধূ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তারাও কয়েকটা শাড়ি পছন্দ করে অন্যপাশে চলে গেল। তরীর পছন্দমতো তারজন্য প্রসাধনী থেকে শুরু করে সবটা কেনা হলো।
★★★
দু’পক্ষের হলুদের অনুষ্ঠান একইসাথে কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হলো। তরীকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। অরু ঠিক তরীর মতোই তৈরি হলো। বসলো মাহমুদ, তরীর মাঝখানে। মাহমুদের বড়ো ভাইয়া এসে মাহমুদকে উঠিয়ে অরুর পাশে বসে পড়লেন ধপ করে। ছোট্ট অরুর নরম গাল দু-খানা টে*নে দিয়ে বললেন,
-“আমার বউকে দেখি মারাত্মক সুন্দরী লাগছে।”
অরু ক্ষেপে উঠলো। তার মিষ্টি চেহারায় রাগের আভা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। গাল দুটো ঘঁষে চললো অনবরত। নাকমুখ কুঁচকে বাজখাঁই গলায় বলল,
-“আমি হলাম স্মার্ট মেয়ে। এমন একটা বুড়ো লোককে আমি কখনোই বিয়ে করবোনা। আর আমার গাল ধরার সাহস করবেন না। হাত ভেঙে দেবো।”
বড়ো ভাইয়া অরুর দিকে আরেকটু চেপে বসলেন। ঘাড়ের উপর হাত দিয়ে বললেন,
-“রাগ করাতে বউকে আরো সুন্দরী দেখাচ্ছে। আজই বিয়ে করে নিয়ে যাবো।”
অরু ঘাড়ের উপর থেকে ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে দিল। তার রাগের মাত্রা বাড়ছে। নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো মেয়েটা। আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।”
-“আজ তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
অরু জেদ করে উঠে যেতে চাইলো। বড়ো ভাইয়া অরুর রাগ দেখে শব্দ করে হেসে ফেললেন। বললেন,
-“থাক, বিয়েটা আগামীকালই করবো।”
তিনি উঠে গেলেও অরু রক্তচক্ষু নিয়ে উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলেও তিয়াসের পরিবার থেকে কেউ এলেনা। হলুদের সাজ ছাড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই তরীর ফোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে “তিয়াস ভাইয়া” নামটা জ্বলজ্বল করছে। তরী ধরবেনা বলে ঠিক করলো। পরপর তিনবার রিং হওয়ার পরই সিদ্ধান্ত বদলে কল রিসিভ করলো। মুঠোফোন কানে তুলে চুপ করে রইলো। ওপাশ থেকে তিয়াসের স্বর শোনা গেল।
-“কেমন আছো, তরী?”
-“ভালো।”
ছোটো করে জবাব দিলেও ফিরতি তিয়াসকে কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা সে।
তিয়াস চুপ থেকে নিজেই আবার বলল,
-“শুনলাম বিয়েটা তোমার পছন্দেই হচ্ছে!”
-“হ্যাঁ।”
এবারও অল্পকথায় জবাব দিলো তরী। তিয়াস বোধহয় ছোটোখাটো একটা ধাক্কা খেলো। ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,
-“তুমি আমায় সবটা বলতে পারতে, তরী।”
তরী রাগ দেখালোনা। শান্তভাবেই জবাব দিলো,
-“বলিনি বলছো? আমি তোমাকে বলে দিয়েছি তোমাকে আমি নিজের বড়োভাই মানি। আমাদের মাঝে বিয়ের মতো সম্পর্ক আসতে পারেনা।”
-“তুমি নিজের পছন্দের ব্যাপারে আমাকে জানাতে পারতে।”
তরী নরম হলো খানিকটা। বলল,
-“তখন এতটা সাহসে কুলায়নি আমার। তাছাড়া পরবর্তীতে মায়ের মৃ*ত্যু*তে পরিস্থিতি ঘেঁটে গিয়েছে। তাই আর জানানোর সুযোগ হয়নি।”
-“তোমার জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো। দোয়া করি ভালো থেকো।”
তিয়াস আর কথা বাড়ালোনা। কেমন করুণ স্বরে বাক্য শেষ করেই বিনাবার্তায় বিদায় নিলো। তরীর হুঁশ ফিরলো কল কাটার শব্দে।
ফোন রেখে চোখের পাতা এক করতেই রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ভীড় জমালো।
★★★
মিঠু আর রামি দুজনই ম্যাচিং ড্রেস পরে ছোটাছুটি করছে। তাদের কাজ হলো বিয়ে বাড়িতে আনন্দ করা। তরীর বাবাকে অনেকক্ষণ হলো দেখতে না পেয়েই মামা উনার তালাশ করলেন। তরীও বাবার খবর জানেনা। কল দিলেও তিনি ফোন তুললেন না।
এদিকে বিয়ের সময়টা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। তরীকে পার্লারে যাওয়ার জন্য তাড়া দেওয়া হলো। ইরা এসে বসে আছে তাকে নিয়ে পার্লারে যেতে।
পার্লার থেকে সোজা সেন্টারে চলে গেল ইরা আর তরী। সবাই উপস্থিত। বাবাকে মাত্রই আসতে দেখা গেল। শেষবার নিজ থেকেই ভাইকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিয়াসের বাবা আসবেন না মানে না। তরীর বাবা রিং ফেরত দিয়ে শেষমেশ ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।
বিয়ের কাজ কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। সবাই জানলো মাত্রই একজোড়া কপোত-কপোতী বন্ধনে আবদ্ধ হলো। তাদের পুরনো বিবাহের কথা চাপা রইলো নিজেদের মাঝেই। বিদায় বেলা ছিল তরী আর তার বাবার জন্য সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত। তরীর মায়ের কথা মনে পড়তেই বাবাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ক্রমাগত হেঁচকি তুলে কেঁদেই যাচ্ছে। বাবার চোখের অশ্রুও আজ বাঁধা মানছেনা। ২৪ বছর ধরে ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করা মেয়েটা চোখের পলকেই পরের অধীন হয়ে গেল। এই কয়েকটা মাস মায়ের অনুপস্থিতিতে বাবার সবরকম দেখাশোনা করেছে, সংসার সামলেছে তরী। বাবার কলিজা ফেটে এলেও তিনি খুব একটা প্রকাশ করতে পারলেন না। কেবল অশ্রুমাখা চোখে মেয়েকে বিদায় জানালেন। অরু অনবরত কেঁদেই চলেছে। মিঠুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তরী অরুকে বুকে জড়িয়ে মিঠুকে খুঁজে বেড়ালো। তরীর সাথে সাথে বাকিরাও মিঠুকে খুঁজলো।
মিঠু এককোনায় থম ধরে বসে আছে। রামি ব্যাপারটা জানাতেই অরুকে বাবার কাছে দিয়ে তরী এগিয়ে গেল। মিঠুর ঘাড়ে হাত রাখতেই সে হাসার চেষ্টা করে।
-“যাও অকর্মার ঢেঁকি। তেমাকে দিয়ে তো আমার কোন উপকার হলোনা। এবার তুমি ভালোয় ভালোয় বিদায় নিলেই তোমার ফোনটা আমি দখল করবো।”
বলতে বলতেই ঠোঁট ভেঙিয়ে কেঁদে ফেললো মিঠু। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করলো। তরী মিঠুকে বুকে চেপে ধরলো। মিঠু মায়ের মৃ*ত্যু*র সময় যেভাবে কেঁদেছিল, আজও তেমনটাই কাঁদছে।
-“তুমিও আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছো? মা তো অনেক আগেই পর করে দিয়েছে। তুমি আমাদের পর করে দিও না আপু।”
তিন ভাই-বোনই সমান তালে হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। অরু কিছুতেই তরীকে যেতে দিতে চাইছেনা। ঝাপটে ধরে রেখেছে। আজ তার বড্ড একা একা লাগছে। ছোটো মানুষ বলে কাউকেই বোঝাতে পারছেনা। তরীও অরুকে রেখে এগোচ্ছে না। মাহমুদ নিজেই অরুকে কোলে তুলে বলল,
-“অরু আর মিঠু আমাদের সাথেই যাচ্ছে, তরী। তুমি প্লিজ আর কেঁদো না!”
#চলবে……..#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বিষাদময় হয়ে উঠলো তরীদের বাড়ি। বাবা সবার আড়ালে ঘরে ঢুকলেন। দরজার খিল দিয়ে স্ত্রীর ব্যবহৃত জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে কথা বলছেন। পুরুষ মানুষ যতটাই শক্ত থাকুক না কেন? একটা পর্যায়ে এসে তারা আবেগী হয়ে ওঠে। সেই পর্যায়টা কন্যা বিদায় দেওয়ার মুহুর্তেই হুট করে আসে। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঝড় নামে।
অরু আর মিঠুকে তরী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। একা হয়ে পড়েছেন বাবা। আজ নিজেকে সত্যিকার অর্থেই একা লাগছে। ভীষণ একা। যতটা একা হলে আর পৃথিবীর স্বাদ গ্রহন করার ইচ্ছে থাকেনা!
তবুও পরিস্থিতি আমাদের বাঁচতে বাধ্য করে। আমরা বাঁচি কারো টা*নে। কিসের যেন একটা দায়বদ্ধতা থাকে আমাদের। পরক্ষণেই কিছু একটা অনুভব করি। হয়তো উপলব্ধি করি জীবন নামক রেলগাড়ীটি সত্যিই বৃথা অথবা জীবন এত সুন্দর কেন? আমি তাকে আরো কাছ থেকে জানতে চাই। পৃথক পৃথক মানুষের ক্ষেত্রে ধারণাটা ভিন্ন।
বিভীষিকাময় জীবন পার করে মাহমুদ-তরীর জীবনে নামলো আষাঢ়ের ঝুমঝুমি বৃষ্টি। এই আষাঢ়ে তরী সদ্য ফোটে ওঠা এগুচ্ছ কদম ফুলের মতোই সুন্দর মাহমুদের কাছে। আলোকসজ্জায় জমজমাট ফ্ল্যাটের একটা ঘরেই তরী বসেছিল। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বারান্দাটা তাকে খুব করে টা*ন*লো। মেহেদী রাঙানো হাত দুটো শক্তপোক্ত গ্রিল ছুঁয়ে দাঁড়ালো। জীবনের প্রতি অদ্ভুত এক টা*ন কাজ করে তার। স্বপ্নগুলো রঙিন হয়ে ওঠে। যখনই অরু, মিঠু আর বাবার কথা ভাবে, নিমিষেই ফিকে হয়ে যায় সবকিছু। সব সুখ, উল্লাস ঝরঝর করে ভেঙে পড়ে।
তরীর ভীষণ দুঃখ হয়। মন খা*রা*পে*র মাঝেই তার সিঁদুর রাঙা নরম হাত দুটোতে আলতো হাতের ছোঁয়া পড়ে। তরীর পুরনো ভাবনা কে*টে নতুন ভাবনায় ডুব দেয়। আবছা আলোয় বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে ওই হাতের মাঝে। মাহমুদ শব্দ করলোনা। শব্দহীন পেছনে দাঁড়ালো। আজ আর বাঁধা নেই। নিজ থেকে প্রথম তরীর খুব নিকটে এলো। তরীর হাত ছেড়ে মাহমুদের হাত দুটো তরীর কোমর স্পর্শ করলো। পেছন দিক থেকেই জড়িয়ে ধরলো তাকে। আবেগঘন মুহূর্ত সৃষ্টি হলো। দুদিক থেকেই কোন বাঁধা নেই। চোখ বুজে নিলো তরী। ঠোঁটে ক্লান্তির মাঝেও একটুখানি প্রশান্তির ছাপ। বুকের ভেতর দুরুদুরু ভয় আজ ঠেলে বেরিয়ে গেছে। এখন কেবল আছে ভালোবাসা। মাহমুদের কন্ঠস্বর প্রসক্ত।
-“সৃষ্টিকর্তা আমায় একটুকরো সুখ দিয়েছেন, তরী। আমি তার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবোনা। তিনি আমার আর্জি শুনেছেন। তোমায় আমার করে দিয়েছে, তরী। তার কাছে কতটা আকুতি করে তোমায় চেয়েছি, তরী তুমি জানো না।”
তরী অবাক হয়। এই মানুষটা তাকে এতটা চেয়েছে? অনিমন্ত্রিতভাবে আসা প্রেম তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে বহুদূর। তরী শুধায়,
-“আপনি আমায় ঠিক কবে থেকে মুনাজাতে রেখেছেন?”
মাহমুদ আলতো হাসে। হিসহিসে হাসির শব্দে কান ধাঁধিয়ে যায় তরীর। উষ্ণ শ্বাস গলার কাছটাতে পড়তেই একটুখানি মিইয়ে যায়।
মাহমুদ বলল,
-“তোমাকে আল্লাহর কাছে চাইবো, আমি কখনোই ভাবিনি। প্রথম দেখাতেও আমার চোখে তোমার জন্য কোন ভালোলাগা ছিলোনা। কেবল একরাশ স্তব্ধতা ছিলো। পরপরই তোমাকে নিয়ে কৌতুহল হতো। তারও অবশ্য কারণ আছে। তুমি আমাকে দেখলেই পালাতে৷ পরে যখন পালানোর কারণটা উপলব্ধি করলাম তখন আমার ইন্টারেস্টিং লাগলো। ভাবলাম একটু বিভ্রান্ত করা যাক তোমায়। কিন্তু দিন দিন তুমি আমার চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়েছো। আমাকে জড়িয়ে ফেলেছো তোমার মাঝে। তবুও আমি প্রথমদিকে ভাবতাম এটা কেবলই মুগ্ধতা। ধীরেধীরে বোধদয় হলো আমার। অজান্তেই তোমাকে চেয়ে বসলাম মুনাজাতে। সেদিন নিজেই অনেকটা বিস্মিত হলাম নিজের কাজে। আহবান ছাড়াই আমার জীবনে প্রেমের বৃষ্টি নামলো। খাঁ খাঁ করা রোদ্দুরে এক পশলা বৃষ্টি ঝরালে আমার হৃদয়ে। তারপর থেকে রোজ নিয়ম করে চাইলাম। তোমার কাছে তোমাকে নয়, খোদার কাছে আমার সুখকে।”
তরীর চোখেমুখে বিস্ময়, ভালোলাগা, মুগ্ধতা, ভালোবাসা সবকিছুই জায়গা করে নিয়েছে। তার চোখজোড়া ব্যাকুল ভঙ্গিতে মাহমুদকে দেখতে চাইলো। মাহমুদের হাত ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেহেদি রাঙানো নরম হাত দুটো মাহমুদের গালে জায়গা করে নিলো। ঘোর নিয়ে খুঁটিয়ে মাহমুদকে দেখলো। মাহমুদও মুগ্ধতার চোখে স্নিগ্ধ এক মানবীকে অবলোকন করলো। যার উপর একমাত্র তারই হক রয়েছে৷ আজ মেয়েটা ভয়ঙ্করভাবে তাকে টানছে। উষ্ণ ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো তরীর প্রশস্ত ললাটে। আবেশিত হলো তরী। চোখজোড়া তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
★★★
কাক ডাকা ভোর, অথচ একরত্তি ঘুম নেই চোখে। সারারাত নিষুপ্তিহীন কেটেছে তরীর। মাহমুদ উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। বালিশে হেলান দিয়ে তার খালি পিঠে হাত ছুঁইয়ে দিলো তরী। লজ্জায় রাঙা হলো গাল দুটো। অল্প ভেজা চুল মেলে দিয়েই মাহমুদের পিঠে মাথা রেখে এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো। উপুড় হয়ে থাকা মাহমুদের ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। সেও তরীর মতোই জেগে আছে। তবে প্রকাশ করলোনা। কিছু ভালোলাগা নিরব হয়, একান্তই ব্যক্তিগত। তরীর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সে নিজেকে মাহমুদের বাহুডোরে আবিষ্কার করলো। তার চুলের ভাঁজে চিকন আঙ্গুল চালিয়ে দিল। হুট করেই সময়ের কথা মনে পড়তেই সে সময় দেখলো। নয়টার চেয়ে একটু বেশি সময় হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাদের ডাকতেও এলোনা! তরী ঝটপট নিজেকে ছাড়িয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। মাথায় লম্বা ঘোমটা টে*নে পরিচত মুখ খুঁজতে ব্যস্ত। ইরার সাথে দেখা হতেই সে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-“কাউকে খুঁজছো তরী? অরু আর মিঠুকে? তারা নাস্তা করে বেরিয়েছে রামির সাথে। তুমি মাহমুদকে ডেকে তুলে দুজনে নাস্তা করে নাও।”
তরী ভাবলো হয়তো ইরা ভাবি লজ্জাজনক কোন কথা বলবেন। সে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিতেই ইরার স্বাভাবিকতায় অবাক হলো। ভালোলাগলো তার। তরী মাহমুদকে ডেকে দিয়ে ফের বেরিয়ে এলো।
দুজনে নাস্তা করতে বসেছে একসাথে। অনেকেই ঠোঁট চেপে হাসছেন। তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অস্বস্তিতে তার খাওয়া থেমে গেল। মাহমুদ খেয়াল করতেই জিজ্ঞেস করলো,
-“খাচ্ছো না কেন?”
ইরা সবটা তদারকি করছিল। সে বেশ শব্দ করেই বলল,
-“বিয়ে, সংসার সবটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে হাসাহাসি করে একজন নতুন মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলা উচিত না।”
যাদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, তাদের মাঝেই একজন বলল,
-“এটা সব নতুন বউদেরই বুঝতে হয়। যারা মজা বুঝেনা, তাদের সাথে কথা বলাই বৃথা।”
ইরা রাগ করলোনা। মৃদু হেসে বলল,
-“অবশ্যই মজা করবেন। তবে সে এখন এখানে সম্পূর্ণ নতুন। নিজেকে সবটার সাথে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। এভাবে করলে সবারই খা*রা*প লাগা কাজ করে। যখন সবার সাথে মিশে যাবে, তখন এই মজাটা সেও উপভোগ করবে।”
মাহমুদ আর কথা বললোনা। তরীর দিকে খাবার এগিয়ে ইশারায় খেতে বললো। ভাবি নিজেই সবটা সমাধান করে দিলেন। তরী কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো। সত্যিই তার এতক্ষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। ইরা বিনিময়ে হাসি উপহার দিলো।
তরীর বাসা থেকে মেহমান আসলো। আশ্চর্য হলো সাথে চাচাকে দেখে। তিনি এগিয়ে এসে তরীর মাথায় হাত রাখলেন। তরীর নম্রতা দেখে তিনি মন থেকেই চাইতেন ভাইয়ের মেয়েটা নিজেদের কাছেই থাকুক। মেয়েটা তাদের নিজ হাতে গড়া মানুষ। অন্তত তাকে নিয়ে কোন আতঙ্ক থাকবেনা। ইচ্ছেমতো চালানো যাবে। তিয়াসের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন তরীকে নিয়ে তার আপত্তি নেই। হুট করেই ভাইকে বিয়ের কথা বলে বসলেন। তাদের সুসম্পর্কের কারণে তরীর বাবাও আর না করলেন না। সবটা ঠিকঠাকই ছিলো। মাঝখান থেকে মেয়েটার মতামতের তোয়াক্কা করলেন না কেউই। নিজেরাই নিজেদের অপ*মান ডেকে এনে মনমালিন্য করলেন। অহমিকায় অন্ধ হয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরাট দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। দুঃসময়ে আপনজন হয়েও পাশে থাকার প্রয়োজন মনে করেন নি। সবসময় কাজের বাহানায় দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছেন। এখন অবশ্য তিনি লজ্জিত। ভাইয়ের বারবার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। আজ আবারও তরীর বাবা ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসে রইলেন। ক্ষো*ভে*র বশে দুজনই দুজনকে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন। তবে আজ ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব ভুলে একে অপরকে বুকে টে*নে নিলেন। পুরুষরা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের মাঝের দূরত্ব ঘুচাতে পারে, নারী তত তাড়াতাড়ি পারেনা। তাদের মনে ভালোবাসার মতোই ঘৃণাটাও তীব্র। আজ তরীর বাবা আর চাচার মাঝে তার মা আর চাচি থাকলে এতটা দ্রুত সবটা ঠিক হতো না। তারা নিজেদের ইগো ধরে রাখতে হলেও দূরত্ব বৃদ্ধি করতেন আরো কিছুকাল।
তিয়াসের বাবা বললেন,
-“সুখে থাকিস, মা। তোদের দুঃসময়ে পাশে থাকিনি। তবে আজ আর নিজেকে একা মনে করবিনা। চাচা-চাচি তোদের পাশে আছি।”
তরীর ভীষণ ভালোলাগলো সবটা ঠিক হয়ে যাওয়াতে। সৃষ্টিকর্তা চাইলে কি-না করতে পারেন? কিছুই তার ক্ষমতার বাইরে নয়। তরী বলল,
-“বেয়া*দবি করার জন্য আমাকেও ক্ষমা করবেন চাচ্চু। সেদিন আমিও আপনাদের সাথে খা*রা*প ব্যবহার করেছি। আর মিঠুর কথায় মনে কষ্ট ধরে রাখবেন না। ছোটো মানুষ মুখে যা এসেছে বলে ফেলেছে।”
তিয়াসের বাবা হেসে বললেন,
-“আমার মনে আর কারো জন্যই রাগ অবশিষ্ট নেই।”
একবুক প্রশান্তি নিয়ে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলো তরী। সকলের যাওয়ার মুহূর্তে তরীর বাবা তাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা তুললেন। মাহমুদ সকলের কাছে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইলো, বিশেষ করে মায়ের কাছে।
-“আমি কিছু কথা বলতে চাই মা।”
আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“বল।”
মাহমুদ বিনয়ের সাথে নরম সুরে বলল,
-“তরী আপাতত তার বাবা আর ভাই-বোনের সাথেই থাকুক। তাদের দেখার জন্য এখন তরীকে দরকার। পরে নাহয় কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তরী এখানে সবার সাথে থাকবে।”
আয়েশা সুলতানা চুপ করে আছেন। কিছুই বলছেন না। সকলেই উনার জবাবের প্রতিক্ষায় বসে আছেন। তিয়াসের বাবা তরীর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তিনতলা তো এখনো খালিই পড়ে আছে। এতটা ঝামেলা করার দরকার কী? জামাই তার পরিবার নিয়ে সেখানে উঠলেই সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।”
তরীর বাবার ব্যাপারটা মনে ধরলো। বললেন,
-“মন্দ বলো নি ভাইয়া। আমি আসলে ভেবে দেখিনি।”
অতঃপর মাহমুদ আর আয়েশা সুলতানার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“আমাদের বাসায় উঠলে ভালো হতো। ভালোলাগতো আমার।”
মাহমুদ কিছু বলার আগেই আয়েশা সুলতানা জবাব দিলেন।
-“আপনাদের বাসায় উঠতে আমাদের সমস্যা নেই। তবে আমরা ঠিক তেমনটাই থাকবো, যেমনটা পূর্বে ভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম।”
তরীর বাবা বললেন,
-“ছিঃ! ছিঃ! এখন আপনারা আমার আত্মীয়।”
আয়েশা সুলতানা বাঁধা দিলেন।
-“তবে আমরা থাকতো পারবোনা আপনার বাসায়। আমাদের সম্পর্ক সব জায়গায় ঠিক থাকলেও বাড়িতে থাকাকালীন বাড়ির মালিক আর ভাড়াটিয়ার মতোই সম্পর্ক থাকবে। এখানে যেমন ভাড়া দিয়ে থাকি, ওখানেও তেমন ভাড়া দিয়েই থাকবো। আপনি যেমন আত্মসম্মানের জোর ধরে রাখতে চাইছেন, তেমনই আমিও চাই আমার ছেলের সম্মান বজায় থাকুক।”
আয়েশা সুলতানার উপর আর কথা বলার মতো ভাষা পেলেন না তরীর বাবা। সকলেরই আয়েশা সুলতানার সিদ্ধান্ত পছন্দ হলো। তবে এ বাসা ছাড়তে ছাড়তে আপাতত তরী তার বাবার কাছেই থাকবে।
#চলবে…….