#অনুতাপ
#সপ্তম_প্রহর
#Yasira_Abisha (#Fatha)
ছয়টা মাস ও পুরোপুরি সংসার করা হয়নি আমার, তার আগেই স্বামীকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিলাম আর কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স ও হয়ে গিয়েছিলো।
তার বাড়িতে আমি ৫ মাস ২৭ দিন ছিলাম, সময়টা আমার খুব কষ্টে কেটেছিলো ; সেখান থেকে ফিরে আসার পরে আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই কিন্তু কেনো যেনো খারাপ লাগতো, সব গুলো স্মৃতি মনে বারবার উকিঁ দিতো, এসবের জন্য ডিভোর্সের পর আর ঢাকায় ফিরলাম না। আর পুরোনো সব বন্ধু-বান্ধবীদের থেকেও সব ধরনের কন্টাক্ট বন্ধ করে দিলাম। সিলেটেই একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলাম, আমার বিয়ের কথা শুধুমাত্র জানতো মা আর পাপা। আমি ৬ মাস দেশে কাটানোর পরে ও কেনো যেনো সব কিছুর সাথে আর মিলাতে পারছিলাম না নিজেকে। তাই বাবা আমাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে আমি পড়াশোনা করতে থাকি। সেখানে বছর দু’এক পরে সাহিলের সাথে আমার পরিচয় হয় ও আমার মায়ের বন্ধুর ছেলে। ওর পরিবার আমাকে দেখে পছন্দ করে এবং বিয়ের জন্য বলে, তখন আমি আমার জীবনের ঘটে যাওয়া বিয়ে ডিভোর্স সবকিছু সম্পর্কে সাহিলকে জানাই। সে তখন বলে,
” মানুষের পাস্ট থাকতেই পারে, আমার অনেক গুলো রিলেশনশিপ ছিলো আগে। তাই বিয়ে হইসে এটা বড় ব্যাপার না” আমাদের বিয়ে হলো। সাহিল আমাদের থেকে আরো বেশি ধনী ছিলো।
তখন খুব খুশি হয়েছিলাম ভেবেছিলাম সাহিল বোধহয় খুব ভালো একজন মানুষ সে আমার অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলে নি কিন্তু তার সাথে থাকতে থাকতে আমি বুঝতে পারলাম সে আসলে কেয়ারলেস। সে কোনো কিছুই খুব একটা গায়ে লাগায় না, তাকে কিছু করতে বললে সে শুনে না।
টাকা আছে আমাদের, কিন্তু কেনো যেনো একটা শান্তি পাই না আমি তার সাথে, মাঝে মাঝে মনে হয় সাহিল আমার সাথে থেকেও সে আমার সাথে নেই। বিয়ের পরে আমরা মালয়েশিয়াতেই ছিলাম কিন্তু হঠাৎ একদিন সাহিলের বাবা স্ট্রক করেন, তার অনেক বড় ব্যাবসা বাংলাদেশে সেটা ধরে রাখার জন্য সাহিলের এখন প্রয়োজন কারণ সে তার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আর ছোট একটা বোন আছে তার। সব কিছু মিলে আমি আর সাহিল বাংলাদেশে ফিরতে বাধ্য হই। বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমি কোনোদিন ঢাকা আর পা দেইনি। বিয়ের ৩ বছর পরেও আমাদের কোনো সন্তান হচ্ছিলোনা, এই নিয়ে আমি তিলে তিলে মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলাম। সাহিলের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না এই ব্যাপারেও বাচ্চা হলে হবে নাহলে নাই। সে সব দিকে খামখেয়ালি ভাবের ছিলো, ব্যাবসার দিকেই তার মন ছিলো এ ছাড়া আর কিছুতেই তার মন ছিলো না। সারাদিন পর যখন যে বাড়ি ফিরতো আমার ইচ্ছে করতো স্বামীর সাথে বসে কথা বলি, সারাদিন সে কি করলো আমি কি করলাম সব ভাব বিনিময় করবো, আমি যখন বাবার বাড়ি যেতাম আমি চাইতাম সে আমাকে ফোন করে খবর নিবে, আমাকে বলবে ” তুমি যেও না, বা জলদি ফিরে এসো” আমাদের বিশেষ দিন গুলোতে আমাকে জড়িয়ে ধরে উইশ করবে, কিন্তু না এসব কিছুই সে কোনোদিন করে নি। সে আমাকে উপহার ও দিতো না কোনো দিন। সবসময় ক্রেডিট কার্ড দিতো, হাতে টাকা দিতো আর বলতো
” তোমার যা ইচ্ছা কিনে নিও। ”
আস্তে আস্তে সব কিছুতে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিলাম। মা বলতো স্বামীদের মধ্যে এটা কমন জিনিস, এসহ নিয়ে মন খারাপ করতে না, কিন্তু আমি মন খারাপ করতাম। সত্যি বলতে ইচ্ছে করে করতাম না, মন খারাপ হয়েই যেতো। অনেক চেষ্টা করার পরে আমার মেয়ে হিমা জন্ম হয়। ও আসার পরে আমার জীবনে খুশি ফিরে আসে, মনে হয় অনেক বছর পর আমি সুখের এক চিলতে আলো দেখি। মানসিক অশান্তি সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয়, এর কোনো তুলনা হয় না। সব কোনো মতে চলছিলো জীবনের সাথে একপ্রকার সমঝোতা করে নিয়ে ছিলাম এরই মাঝে সাহিলের অসুখ ধরা পরে। কিছুদিনের মধ্যেই তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, কত ডাক্তার দেখিয়েছি, কত কিছু করলাম কিছুতেই কিছু না তখন রুহি আমাকে বলে,
– আমাদের হসপিটালে টপ কার্ডিয়াক সার্জন আসছেন কিছুদিনের মধ্যেই, আপু তুমি উনাকে দেখাও জিজুর অপারেশন উনিই করবেন ইনশাআল্লাহ এবং অভয় দিয়েছিলো
আমি আর ডাক্তারের নাম ও জিজ্ঞেস করিনি, এপয়েনমেন্ট থেকে শুরু করে সব কিছু রুহিই করেছিলো আর সাথে দিবাও ছিলো।। কিন্তু যেদিন আমি চেম্বারে আসি সেদিনই নামটা দেখে বুকের ভেতরটা ধুক করে ওঠে। মেডিকেল কলেজের নাম দেখে সিউর হলাম যে হ্যাঁ এটা আমার প্রাক্তন স্বামী ইরাদ। আজকে কত বড় একজন ডাক্তার হয়ে গেছে।
মেঘা হসপিটালে বসে আনমনে এসব কিছুই ভাবছিলো, সময় আজকে ইরাদকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে আর মেঘা হয়তো পেছনে পরে আছে। আচ্ছা মেঘা তো যা চেয়েছে তাই পেয়েছে তাহলে কেনো ইরাদকে দেখলে একটা হতাশা কাজ করে? এই হতাশা কিসের জন্য?
.
বেলা দুপুর আড়াইটা বাজে, দিবা আর রুহি চলে এসেছে ক্লাস শেষ করে মেঘের কাছে।
দিবা- ভাবি চলো আজকে আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি
-তোর ভাইয়ারে অবস্থা এখন ঘুরতে যাবো?
রুহি- হুম, কারন জিজু ইনশাআল্লাহ আর কয়েক দিনের ভিতরেই সুস্থ হয়ে যাবে।
মেঘা- আমি তোমাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।
দিবা- আরে ভাবি আজকে ইরাদ স্যার ভাইয়াকে দেখে সব কিছু চেক করে বললেন, ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ সম্পূর্ণ রূপে আউট অফ ডেঞ্জার।কিছুক্ষণের ভিতরেই ভাইয়াকে কেবিনে দিয়ে দেওয়া হবে এবং কিছুদিনের ভিতর ভাইয়াকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো।
রুহি- হুম আর এজন্যই আপু ও বলতেছে আমরা ঘুরে আসি।
– কিন্তু সাহিল কেবিনে এলে ওর যদি কিছু দরকার হয়?-
– জিজুকে ইনজেকশন দিয়েছে ঘুমের উনি ঘুমাবে অন্তত ৭-৮ ঘন্টা
মেঘা- কিন্তু ঘুরতে কোথায় যাবে? এরচেয়ে চল আমরা বাইরে কোথাও থেকে লাঞ্চ করে আসি?
রুহি- গুড আইডিয়া।
মেঘা- আচ্ছা ঠিক আছে চল।
রুহি মেঘা আর দিবা ওরা সবাই মিলে লাঞ্চ শেষ করলো। কিছুদূর থেকে একটা মহিলাকে মেঘার বেশ পরিচিত একটা মুখ মনে হচ্ছে কিন্তু ও ঠিক মেলাতে পারছে না এটা কে?
কিছুক্ষণ পরে মহিলাটাই হেঁটে মেঘা সামনে এলো।
– মেঘা কেমন আছিস?
-হ্যাঁ, আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না তবে চেহারাটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।
-আমি শম্পা তোর ছোটবেলার স্কুল ফ্রেন্ড।
-আরে হ্যাঁ শম্পা কেমন আছিস?
-আই এম রিয়েলি সরি তোকে তো একদমই চেনা যাচ্ছে না, তোর এই অবস্থা কেন? একদম বুড়ো মানুষের মত দেখা যায়।
– প্রতিমুহূর্তে জীবনের সাথে সমঝোতা করতে করতে আজ আমার এই অবস্থা।
-আর লিখন কেমন আছে?
-ভালো আছে
বাচ্চা কয়জন লাভ বার্ডসদের?
-আমার আলহামদুলিল্লাহ ছেলে এক মেয়ে।
আর তোর?
-আমার এক মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ।
তারপর শম্পা ঢাকা আসলি কবে?
-আর বলিস না আমাদের তো সেই স্কুল লাইফ থেকে প্রেম তারপর ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে বিয়ে। সে বিয়ের পর প্রথম থেকে চাকরির জন্য খুব সমস্যা হচ্ছিল। না লিখনের চাকরি হচ্ছিলো না আমার চাকরি হচ্ছিলো,
তার ওপরে বিয়ে করে ফেলেছিলাম।
পরিবারের সবাই অমত করেছিলো সেইম এইজের কারণে।
এরপর আমাদের এই দায়িত্বের জীবন শুরু হয়, তখন থেকে খুব কষ্ট ছিলো আমাদের জীবনে।
তারপর অনেক বছরের স্ট্রাগল ছিলো দু’জনের এখন আমরা জীবনে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। পাঁচ বছর ধরে আমরা ঢাকায় সেটেল নিজেদের ফ্ল্যাট কিনেছি গাড়ি আছে আলহামদুলিল্লাহ, লিখনের একটা ভালো চাকরি আছে আমিও চাকরি করছি। এই আর কি জীবন চলছে।
কথা গুলো হেসে বলতে বলতে কেমন যেনো ম্লান হয়ে গেলো শম্পার চেহারা। এরপর সে আমার বলতে শুরু করলো,
-হয়তো এখন বলতে পারি আলহামদুলিল্লাহ কিন্তু আমি মানসিক দিক থেকে অশান্তিতে আছি।
খুব মনে হয় জীবনটা আমি নিজের হাতে নিজেই নষ্ট করেছি এভাবে বিয়েটা করা ঠিক হয়নি। যদি মা বাবার পছন্দে বিয়ে করতাম হয়তো একটা সমস্যায় মা-বাবা না হয় শ্বশুর শ্বাশুড়ি এগিয়ে আসত কিন্তু নিজের পছন্দে বিয়ে করার পর থেকে আমাদের দায় বদ্ধতা, আমাদের দায়িত্ব, আমাদের সবকিছু নিজেদের সামলাতে হয়েছে।
পারিবারিক কোন সাপোর্ট আমরা পাইনি এখন কেন যেন আমার আর লিখনের মতামত মিলেনা? জানিস? বিয়ের আগে মা এটাই বলেছিলো আমার একদম স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন তাদের কথার কোনো তোয়াক্কা করিনি। আজ তা নিজ চোখে দেখছি, সহ্য করতে হয় অনেক কিছুই।
-হ্যাঁ, এটা সত্যি শম্পা যে সেম এজ এ বিয়ে করলে সমস্যা হয়। কয়েক বছর পরে নাকি তাদের মতামত আর মিলেনা, মানসিক শান্তি নষ্ট হয়। তবে একটা কথা কি যদি শান্তি না থাকার থাকে সেটা তোর বয়সে ডিসটেন্স হলেও হয় না অনেক সময়। সুখ শান্তি আসলে আল্লাহর হাতে।
-হ্যাঁ,
তো তুই কবে আসলি ঢাকা? আর এই সুন্দরী দুইটা মেয়ে তোর সাথে ওরা কারা?
-এটা আমাদের ছোট্ট রুহিয আর ও হচ্ছে আমার ননদ দিবা। দুজনে সমবয়সী, মেডিকেলে পড়াশোনা করছে,
– পিচ্চিগুলো বড় হয়ে গেছে এখন।
আর আমাদের রুহি, তুমি এতো বড় হয়ে গেছো? আমি প্রথমে চিনি নাই, ছোটবেলা থেকে মাশাল্লাহ খুব সুন্দরী ছিলে এখন তো আরো সুন্দর হয়ে গেছো।
রুহি লজ্জা পাচ্ছে শম্পা আপুর কথা তে।
– মেঘা, তারপর সুন্দরীকে বিয়ে কবে দিবি?
-আরে এত তাড়াতাড়ি না আগে, ওর পড়াশোনা শেষ করুক, ওরা অনেক ছোট।
-হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছিস আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।উচিত তারপর বিয়ে।
আচ্ছা, মেঘা আজকে আমি আসি কাজ আছে রে।
-ঠিক আছে।
মেঘার এখন মনে হচ্ছে না সেদিন ইরাদকে রেখে আসার ডিসিশন যে সে নিয়েছিলো সেটা সে ভুল,।নাহ সে ভুল করেনি। আজকে যদি ইরাদ ও সে একসাথে থাকতো তাহলে হয়তোবা তাদের মাঝে এরকম অশান্তি হতো, ঝগড়াঝাটি ঝামেলা হতো, এরচেয়ে দূরে এসে দুইজন দুই রকম জীবন বেছে নিয়েছে সেটাই বোধহয় সঠিক।
আর রুহি? ও ভাবছে সেইম এইজে ঝামেলা হয় কিন্তু ইরাদ তো ওর থেকে বয়সে অনেক বড় এখানে তো ঝামেলা হওয়ার চান্স নেই। এসব ভেবে একাই ও লজ্জা পাচ্ছে, ইরাদ তো বোধহয় ওকে তেমন একটা খেয়াল ও করেনি তবুও ইরাদকে ঘিরেই ওর সব চিন্তা ভাবনা কাজ করে।
(চলবে,, কাল থেকে ইরাদ রুহির স্টোরি শুরু হবে আর হ্যাঁ সামনে আরো বড় কিছু টুইস্ট আসা বাকি)