অনুতাপ পর্ব -৩৯ ও শেষ

#অনুতাপ
#শেষ_প্রহর #Yasira_Abisha (#Fatha)

বিয়ের পরে প্রথম বাবাকে দেখে রুহির খুশির সীমানা থাকে না আর এদিকে ইরাদের মনে হচ্ছে এই বুঝি ওর রুহিকে আজকের এই পরিস্থিতি ওর থেকে আলাদা করে ফেলবে। কেননা, যতই হোক মেঘা রুহির বড় বোন। বড় বোনের প্রক্তন স্বামী নিজের বর্তমান স্বামী জিনিসটা কি মেনে নেওয়া এতোই সহজ? আর ইরাদ যদিও বিয়ের পরে ব্যাপারটা জেনেছে তবুও রুহির আগে জেনেছে এই কঠিন সত্য গুলো কি রুহি আসলেও নিতে পারবে?
ইরাদ নিজের চিন্তা করে না, তবে রুহির জন্য চিন্তা করে। কারণ রুহি যে ইরাদকে ছেড়ে থাকতে পারবে না? রুহি যে ইরাদ ছাড়া অপূর্ণ। আজকে যদি পরিস্থিতির চাপে পরে রুহি ইরাদকে ছেড়েও দেয় তবে কি ইরাদ বিহীন রুহি ঠিক থাকতে পারবে? পারবে না।

.

.

.

রুহির বাবা ভেতরে এলেন,
রুহি- বাবা এসেছেন, ভেতরে আসুন।
ইরাদ সামনে আসার পরে রুহি খুশি হয়ে বললো আবার ও বললো,
– বাবা উনি ডক্টর ইরাদ আহসান
– হুম জানি
ইরাদ কাছে গিয়ে রুহির বাবাকে সালাম করলেন৷ রুহির বাবা ইরাদের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-সুখে থাকো।
রুহি- বাবা বসো। তুমি এলে যে? আমি না বললাম আমরাই আসবো।
– হ্যাঁ মা আসলে আমার কিছু জরুরি কথা আছে তোমার সাথে তাই ভাবলাম বেশি দেরি না করে এখনই আসা উচিত।
– হুম বাবা আগে কফি অর্ডার করি খেতে খেতে কথা বলি।
– মা আমার কথা তোমার সাথে ছিলো।
বাবার কথার মানে রুহি বুঝতে পারে, তখন মনটা খারাপ ও হয়ে যায়। কিন্তু ইরাদ তো এখন রুহির স্বামী। তাহলে কেনো ইরাদের সামনে কথা বলা যাবে না? তাই রুহি বাবার কথার মানে বুঝেও বাবাকে বলে,
– হুম বাবা বলো শুনছি আমি।
ইরাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে রুহির বাবা বললো
– এখন কি বাবাকে আলাদা দুই মিনিট সময় ও দেওয়া যাবে না?
– রুহি তখন বাবার পাশে এসে বসে বাবার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো,
– কেনো যাবে না বাবা? তুমি না থাকলে আমি এই দুনিয়ায় আসতে পারতাম না। তোমাকে অবশ্যই সময় দেওয়া যাবে। তবে উনি আমার স্বামী আর আমার মনে হয় স্বামী স্ত্রী তো একই তাই না? আমি তোমার মেয়ে হলে উনি তোমার মেয়ের জামাই। আর উনার সামনে কথা তো বলাই যায় তাই না??
ইরাদ একদম চুপ করে বসে আছে, কোনো কথাই বলছে না
-ঠিক আছে আমি তবে বলছি
– বলো বাবা
– তুমি কোনো ধরনের প্রেশারে পরে বিয়েটা করেছো?
– প্রেশার কিসের বাবা?
-তুমি ভেবে করেছো মা?
– বাবা আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না তুমি কি বলতে চাচ্ছো?
-উনার একটা অতীত আছে। এসব সম্পর্কে তুমি জানো? আজকে তোমার হয়তো সব ঠিক লাগছে, কাল নাও লাগতে পারে। বিয়ে তো কোনো ছেলেখেলা না। এসব নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তোমাদের বয়সের ব্যাবধানটাও ১৩-১৪ বছর,, সবটা কি ভেবেছো?

– বাবা আমি একটা এডাল্ট মেয়ে। আমি ভেবে চিন্তা করেই বিয়েটা করেছি। আর কিসের প্রেশার হবে বাবা? উনার অতীতের ওপরে উনার হাত নেই তবে বর্তমানে আছে। আর আমি আমাদের বর্তমানটা সুন্দর করতে চাই। অতীত সম্পর্কে জানি, উনার বিয়ে হয়েছিলো আগে একটা তবে দুর্ভাগ্য ক্রমে সেটা টিকে নি। আমি একে অবশ্য দুর্ভাগ্য বললো না, কারণ তাহলে আজকের দিনটা আমার জীবনে আসতো না। রুহি ইরাদকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, বাবা আমি ইরাদকে ছাড়া নিজের জীবন কল্পনাও করতে পারি না। আমি জানি সবটা হয়তো ওত সহজ না। এই জিনিসটা ভেবে উনি আমাকে পুরো তিনটা বছর দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন বাবা। আমি ইরাদকে পেয়েছি অনেক সাধনার পরে। আর জীবনে উনি জীবনে সুখ পান নি বাবা, আমি চাই আমাদের বাকি জীবনটা একসাথেই কাটুক। আর বয়স বাবা? এটা কিছুই না মনের মিল থাকাই বড় কথা। উনি এতো ভালো একটা মানুষ যাকে যে কেউ ভালোবাসতে বাধ্য হবেন। উনাকে ছাড়া আমি যে এখন একদম নিঃস্ব, এই মানুষটাকে ছাড়া আমি একটা মুহুর্ত ও নিজেকে ভাবতে পারি না বাবা। আর উনার আগের স্ত্রী? মেয়েটার ভাগ্য খারাপ তাই উনাকে পায় নি আমি এতোটুকু সিউর হয়ে বলতে পারি।

এমন সময়ই বাবার ফোনের স্ক্রিনটা জ্বলে উঠে, কল এসেছে নামটা লিখা মেঘা,
– বাবা আপুর কল
– পরে কথা বলি,
– এখনই রিসিভ করো লাউডস্পিকার দিয়ে।
রুহির কথা বাবা ফেলতে পারলেন না.।
– হ্যালো পাপা
– হুম বলো মা?
– রুহির সাথে কথা হয়েছে?
– হুম
– ও কি ডিভোর্স দিতে রাজি? আমি সব কাগজ করে ফেলেছি। পাঠাবো?
কথা গুলো শুনে রুহির মাথায় আকাশ ভেঙে পরে, ডিভোর্স পর্যন্ত কেনো যাবে ব্যাপারটা? আপু কি বলছে এইসব?
কথা গুলো ধীরে শুনে রুহির বাবা বললেন,
– রুহি ইরাদকে অনেক ভালোবাসে।
– পাপা এটা কি করে হয়? সবটা আপনি জানেন তাই না? রুহিকে বুঝান আর সবচেয়ে বড় কথা ওদের বয়সের ও তো অনেক বেশি পার্থক্য। এটা কি আদও সম্ভব?
এমন সময় সাহারা বেগম ফোনটা নিজে নিয়ে বলেন,
– ভাই রুহিকে বলেন ও যদি এই সংসার করে তাহলে সারাজীবনের জন্য আমাকে আর মেঘাকে হারিয়ে ফেলবে। আমি মরে গেলেও আর আমার চেহারা দেখতে পারবে না।
– মেঘা মা তুমি কি বলো?
– পাপা আমার ডিসিশন ও একই।

এমন কথা শুনে রুহির চোখ গুলো টলমল করছে, কলিজার ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। নিজের মাকে রুহি দেখেনি কোনোদিন, এই খালাকেই নিজের আপন মায়ের মতো ভালোবাসে এসেছে রুহি আর সাহারাও কোনোদিন রুহিকে মেঘার থেকে আলাদা করে দেখেনি। তবে আজকে কেনো এতো বড় শাস্তি দিতে চাইছে মা? রুহি কি ভালোবেসে বিয়ে করার এতো বড় শাস্তি পাওয়ার যোগ্য?

এদিকে রুহির বাবার মুখে কোনো কথাই আসছে না। একজন এমপি হয়ে কতো মানুষের বিচারক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন, কত বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছেন উনি। তবে আজকে একজন অসহায় পিতা উনি, একদিকে মেঘার কথা ভাবলে ইচ্ছে করছে রুহিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে আর অন্যদিকে রুহির সুখের কথা ভেবে আজকে স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। আর একজন মানুষ হিসেবে ইরাদ কেমন তার প্রমাণ আজকেও উনি পেয়েছেন। আজকের দিনে ইরাদ একজন যোগ্য ডক্টর হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করেছেন এই কথাটা রুহির বাবার কান পর্যন্ত ঠিকি এসেছে। ইরাদকে কোনোদিন দিয়েই কেউ নিজের বাড়ির জামাই হিসেবে অযোগ্য বলতে পারবে না, একটা সময় তার কাছে টাকা পয়সার অভাব ছিলো আজকে তাও নেই তবে আছে একটা অতীত যার কারনেই সবকিছু জেনেও ইরাদকে আপন করতে পারছেন না একজন পিতা। এই মুহুর্তে অধীর আগ্রহ নিয়ে মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। কারণ সর্বশেষ ডিসিশন রুহিরই হবে। পুরোটা পরিবেশ যেনো দম ধরে আছে, ওই মুহুর্তে রুহির একটা কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।

রুহি কান্নাভরা চোখ নিয়ে পেছন দিকে গিয়ে ইরাদের হাতটা ধরে ইশারায় বাবাকে জানালো সে ইরাদকে ছাড়তে পারবে না।
– মেঘা রুহির জবাব না। ও বিয়েটা ভেঙে দিতে চাচ্ছে না।
– তাহলে এটাও ওকে জানিয়ে দিও পাপা আমরা আজ থেকে ওর জন্য মরে গেসি।

রুহির বুকটা ফেটে যাচ্ছে বোনের জন্য মায়ের জন্য তবে আর যাই হোক নিজের স্বামীকে রুহি ফেলে যাবে না। রুহি বিশ্বাস করে ইরাদকে ওরা একদিন ঠিকি মেনে নিবে হোক দেরি রুহি নাহয় অপেক্ষাই করবে।

.

আমি রুহির বোনের প্রাক্তন স্বামী এটা এখনই ওকে জানিয়ে দিবো নাহয় সামনে জানতে পারলে রুহির মনটা একদম ভেঙে যাবে। যদিও আমার রুহিকে হারানোর একটা ভয় লাগছে
ইরাদ- রুহি কিছু বলার আছে আমার। সবটা শুনে আমার মনে হয় আপনার ডিসিশন নেওয়া উচিত।
– কি কথা?
– কোনো কথা আমার মনে হয় না আর বলার অপেক্ষা আছে, রুহি ওর ডিসিশন নিয়েছে আর আমার মেয়ে ভালো থাকলে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমি চাই বাবা আপনি আমার মেয়েকে আজীবন সুখে রাখবেন, ও যে ত্যাগ করেছে এর মূল্য আপনি দিবেন।
ইরাদ রুহির বাবার কথা শুনে অনেক বেশি অবাক হয়, এই কথা গুলো ও আশা করেনি।
ইরাদ- বাবা?
– হুম বিগত জীবনে কি হয়েছিল না হয়েছিলো ওগুলো তো শেষ এখন আর ওসব ভেবে কোনো লাভ হবেনা। আমার মনে হয় এখন সব ভুলে সবকিছু নতুন করে শুরু করাই ঠিক হবে।

রুহির এই ডিসিশনটা পিতা হয়ে এখন সাপোর্ট করছেন রুহির বাবা। মেঘার সাথে ডিভোর্স হয়েছে ইরাদের পরিবেশ, আর্থিক সমস্যার করণে কিন্তু ইরাদের তো দোষ ছিলো না। আর একজন স্বামী হিসেবে রুহিকে ইরাদ আগলে রাখবে তা ভালোভাবেই ইরাদের অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে বুঝতে পারছেন উনি। তাই মেয়েকে আজকে কোনো বাধা দিবেন না উনি, বরং নতুন জীবনের জন্য মেয়েকে দোয়া দিয়ে দিবেন, আর সবচেয়ে বড় কথা ইরাদের ও মেঘার বিগত জীবন সম্পর্কেও জানতে দিবেন না নিজের রুহিকে কারণ মেয়েটা ইরাদকে ছাড়া থাকতেই পারবে না তো কেনই বা আর এসব সম্পর্কে জানাবেন মেয়েকে?

.

ফোনটা রাখার পরের থেকে মেঘা কোনোভাবেই আর শান্তি পাচ্ছিলো না। ইরাদ কি তাহলে ঠিকি বলেছিলো? আমিই কি আমার বোনকে বুঝিনি? কেনো একটাবারের জন্য বুঝতে পারিনি রুহি ইরাদকে ভালোবাসে? এতো বেশি খারাপ লাগছে কেনো আমার? দম বন্ধ হয়ে আসছে খুব। দিন যেতে থাকে মেঘার পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে পড়তে থাকে। একে তো ইরাদ সুখে আছে, যাকে ভালোবাসে তাকে সে পেয়েছে একটা সুখী সংসার পেয়েছে ইরাদ আর অন্য দিকে সেই মেয়েটা রুহি। নিজ চোখে মেঘা দেখেছে রুহি কতটা ভালোবাসে ইরাদকে। পরিশেষে ইরাদ তাহলে ভালো আছে এটা মেঘা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু নিজে কি আছে মেঘা? ও তো ভালো নেই। কেনো ভালো নেই আজকে এই প্রশ্নের উত্তরটাও নিজের কাছে নেই। আগে জীবনটা নিয়ে কোনো ধরনের অনুতাপ কাজ করতো না, ইদানীং সব কিছুই বিষাদময় লাগে মেঘার। যে সুখের খোঁজ মেঘা করছিলো, তা হয়তো জীবনে আর দেখা মিলবে না। তবে মনের কোণে একটা আশা আছে রুহিও বুঝে ফিরে আসবে একদিন, ইরাদের সাথে না থেকে মেঘা কোনো ভুল করে নি বরং ওর আর রুহির তো একই রকম লালনপালন হয়েছে তবে মেঘা থাকতে না পারলে রুহি কি পারবে? নাহ রুহিও তো পারার কথা না। এইসব ভেবেই নিজের মনকে প্রবোধ দিচ্ছে মেঘা।

দেশে ৭দিনের মধ্যে কাজ সবকিছু শেষ করে ফেললো ইরাদ। এরই মাঝে রুহি কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিলো না। বোন মাকে হারিয়ে এই বিচ্ছেদ কোনোরকমেই সহ্য করতে পারছিলো না রুহি। তাই ইরাদ ৮দিনের সময় রুহিকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যায়। নিজের অতীতের জন্য বর্তমানটা নষ্ট করতে চায় না ইরাদ।
নতুন পরিবেশ নতুন জায়গায় নিশ্চয়ই রুহি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, এই বিশ্বাস নিয়েই ওরা চলে আসে এখানে। ঠিক বিয়ের ২৯দিনের মাথায় রুহি সম্পুর্ণ স্বভাবিক হয়ে ওঠে দিবার সাথে কথা বলে। সেদিন দিবা রুহিকে বুঝায় যা হয়েছে তা তো হয়েই গেছে, আল্লাহর বিধানে কেউ পরিবর্তন আনতে পারবে না। তাই এসব ভাবলে সবটা সময় নষ্ট হয়ে যাবে। আর ইরাদের সাথে বিয়ের পরের এই মুহুর্ত গুলো আর কোনোদিন ও ফিরে আসবে না তাই তো এসব না ভেবে এখন সবটা ঠিক করে ইরাদকে নিজের করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

রুহি বুঝতে পারে ও ইরাদের সাথে অন্যায় করে ফেলছে, নিজের কথা ভাবতে গিয়ে পরিবারের কথা ভাবতে গিয়ে কখন নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এতো দূরের করে দিয়েছে রুহি তা কোনোদিন ও ভাবতে পারেনি ও।
কাল রুহি আর ইরাদের বিয়ের ৩০দিন অর্থাৎ এক মাস পূর্ণ হবে। সেদিনই রুহি ইরাদকে নিজের করে নিবে তা ভেবে নেয়।
সেদিনটা ছিলো শীতের সময়, বাইরে কণকণে ঠান্ডা ছিলো এবং বাতাস বইছিলো খুব। ইরাদ কাজে যাওয়ার পর থেকে রুহি খুব সুন্দর করে ওদের বেডরুমটা সাজায় মোমবাতি দিয়ে কাজ করতে করতে কখন যে সকাল থেকে বিকেল থেকে রাত হয়ে যায় তার খেয়াল রুহির ছিলো না।
ইরাদ বাড়ি ফিরে দেখে রুহি দরজা বন্ধ করে রেখেছে তাই আর রুহিকে নক না করে ইরাদ পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পরে। কারণ আজ প্রথম না রুহির মন খারাপ থাকলে প্রায় ও দরজা বন্ধ করে রাখে তাই ইরাদ ওকে আর ডাকে না আর নিজেও কিছুটা ক্লান্ত থাকার কারনে ইরাদ ফ্রেশ হয়ে গিয়ে শুয়ে পরে।
রাত যখন ১২টা বাজে রুহি তখন রেডি হয়ে ঘর থেকে বেড় হয়, সুন্দর একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পরেছে রুহি। ওকে দেখে যেনো কেউই চোখ ফেরাতে ইরাদ ফিরেছে কি না তা জানার জন্য যখন
ইরাদকে কল দিতে যাবে তখনই খেয়াল করে পাশের রুমে ইরাদ শুয়ে আছে। সাদা পাঞ্জাবিতে ইরাদকে বেশ দেখাচ্ছে, টানা চোখ মুখে একটা অজানা মায়া আর রূপের কথা তো বলার মতই না। রুহি ধীর পায়ে ইরাদের পাশে গিয়ে বসে বিছানায়, কতটা দিন ধরে ও নিজের ইরাদকে নিজের থেকে দূর করে রেখেছে, যেই মানুষটাকে পাওয়ার জন্য রুহি ব্যাকুল ছিলো আজ সে রুহির পাশে শুয়ে আছে পূর্ণ অধিকার নিয়ে। যাকে রুহি ভালোবাসে সে আজ রুহির, কোনোরকম কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই আজ ইরাদ রুহি এক হয়ে যেতে পারে চাইলেই। রুহি আলতো করে ইরাদের চোখে চুমু দিলো, ইরাদের চাহনি রুহিকে যেমন পাগল করে তেমনি লজ্জাও লাগায়। তাই ইরাদের বন্ধ চোখেই রুহি ভালোবাসা একে দিলো। ইরাদের এতো আরামের ঘুম রুহির ভেঙে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই, তাই রুহি আস্তে করে উঠে যাচ্ছিলো বিছানা ছেড়ে ঠিক তখনই ইরাদ রুহির হাতটা আলতো করে ধরে মুখে বিস্তৃত হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আমার পরীটা কোথায় যাচ্ছে?
ইরাদের কথায় রুহি লজ্জা পেয়ে যায়,
রুহির সাজসজ্জা দেখে ইরাদ বুঝতে পারে রুহি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে,
-হ্যাপি ওয়ান মান্থ এনিভ্যার্সারি।
– হ্যাপি ওয়ান মান্থ এনিভ্যার্সারি মায়াবতী
এই বলে ইরাদ উঠে রুহির হাতে একটা সুন্দর ডায়মন্ড এর রিং পরিয়ে দেয়।
– এই কয়দিন আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? আমাকে মাফ করে দিবেন প্লিজ?
– তুমি আমার জান। তুমি কেনোই বা মাফ চাইছো বলো তো? আমি সরি আমার কারণে আজকে তুমি এতোটা কষ্ট পেয়েছো আমার যদি এমন অতীত না থাকতো তাহলে হয়তো বা তুমি এমন কষ্ট কোনোদিন পেতেই না।
– অতীত কেউ ইচ্ছে করে বানায় না, সবটাই ভাগ্যের বিধান। আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাবো না। আমরা এখন থেকে নতুন জীবনের দিকেই ইনশাআল্লাহ মন দিবো।
রুহির কথায় ইরাদ রুহিকে জড়িয়ে ধরে, আজ নেই কোনো বাধা, নেই কোনো সমস্যা, আছে শুধু পূর্ণ অধিকারের সাথে ভালোবাসা। বিয়ের পরে এই প্রথম রুহিকে ইরাদ আপন করে নেয়, রুহির সম্মতির সাথে। প্রেম ভালোবাসা সবকিছু মিলে রুহির আর ইরাদের জীবনটা রঙিন হয়ে গেছে, পুরোনো কোনো কথা আর রুহির জানা হলো না। ইরাদ সে রাত্রে চেয়েছিলো মেঘা আর ইরাদের বিয়ের কথাটা রুহিকে জানিয়ে দিতে কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় রুহির বাবা। যে সময়টা আর জীবনে নেই তাহলে কেনই বা ওই সময়টার কথা মনে করে রুহিকে জানিয়ে কষ্ট দিবে? রুহির আজকে যখন পছন্দ ইরাদ এই সত্যি জানার পরেও ইরাদই হবে তবে একটা কষ্ট মনের মধ্যে থেকে যাবে সারাজীবন আর বাবা হয়ে এই জিনিসটা কোনোদিন উনি চান না নিজের কোনো মেয়ের জন্যই।

.

.

.

.

দীর্ঘ ৭ বছর পরে রুহি আর ইরাদ ফিরে আসে বাংলাদেশে, এই সাত বছরে রুহির প্রতিটি দিন কাটতো নববিবাহিতা বধুর মতো। ইরাদ রুহিকে এতোটাই ভালোবাসে যা রুহির কল্পনাও করতে পারে নি রুহি। ওদের ছোট একটা মেয়েও আছে নাম ইরা। ৬ বছরের ইরা সবসময় বাংলাদেশ সম্পর্কে শুনেছে কোনোদিন দেখা হয় নি তাই বাবা মায়ের কাছে তার বায়না এবারের জন্মদিনে তাকে বাংলাদেশ দেখাতে হবে। যে কথা সেই কাজ রুহি ইরাদ বাংলাদেশে ফিরেছে মেয়েকে নিয়ে। রুহি মেয়ের জন্মদিনে সবাইকে দাওয়াত করার পাশাপাশি মেঘা ও তার পরিবারকে দাওয়াত করতে ভুলে নি।
রুহি এতো বছর পর ফিরেছে জেনে মেঘা রুহিকে না দেখে থাকতে পারছিলো না, তাই অনিচ্ছা স্বত্তেও মেঘা দাওয়াত গ্রহণ করে রুহির বাসায় যায়। বাড়িটা কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, ইরাদ যে অনেক ধনী তা ইরাদের বাড়িঘর দেখেই বুঝা যাচ্ছে। মেঘা যখন ঢুকছিলো তখন রুহির কোমড় জড়িয়ে ইরাদ দাড়িয়েছিলো আর কথা বলছিলো একটা দম্পত্তির সাথে
রুহি তাদেরকে গর্ব করে বলছিলো “আমি অনেক ভাগ্যবতী এমন একজন স্বামী পেয়েছি আর জীবনে কোনো কিছুই চাওয়ার নেই আল্লাহর কাছে। দুয়া করবেন আমাদের জন্য। ”

মেঘা পেছন থেকে রুহিকে ডাক দেয় তখন মেঘাকে দেখে রুহি জড়িয়ে ধরে আর কান্না করে দেয়, মেঘাও রুহিকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়, শত কিছু হলেও তো নিজের বোন হয় রুহি। মেঘাকে পেয়ে এতোদিন পরে রুহি অনেক কিছুই বলছিলো, তবে মেঘা সেদিকে খেয়াল না করে, ভালো করে তাকিয়ে দেখে রুহিকে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে যেনো বিয়ের পরে ওর রূপ আরো বেড়ে গেছে, হয়তো সুখে থাকার কারণেই আজ রুহিকে আরো বেশি রূপবতী দেখাচ্ছে। রুহি ইরাদের সাথে মেঘাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। মেঘা কিছুই বলে না। শুধু হ্যালো বলা পর্যন্তই। এমন সময় ইরা মা মা বলে ডাকায় রুহি বাচ্চার কাছে যায় এবং সে সময়, এতো বছর পরে ইরাদ ও মেঘা মুখোমুখি দাঁড়ায়। ইরাদ মেঘাকে নিজের প্রাক্তন ভেবে কিছুই বলে না,বরং নিজের বাড়ির অতিথি ও শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে বলে,
ইরাদ- বসুন প্লিজ
মেঘা- রুহি কি ভালো আছে?
– দেখে হয়তো বুঝতে পারছেন, আমার স্ত্রী আমার সাথে ভালো আছে কি না?
– আপনি কেমন আছেন?
– আমি ভালো আছি, আমি আমার বোনকে আর বোনের মেয়েকে দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়েছে আজ আসছি।
এই বলেই মেঘা গিফটটা ওর ড্রাইভারকে দিয়ে রাখিয়ে বেড়িয়ে পরে, যাই হোক রুহির প্রতি মায়া মেঘা ছাড়তে পারবে না তাই বোনের খোঁজ হয়তো মাঝে মধ্যে ও নিবে।
তবে রুহি ও ইরাদের ভালো থাকা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ মেঘার নেই। আগে একটা আশা ছিলো হয়তো রুহি ইরাদকে ছেড়ে আসবে কিন্তু আজ লাগছে না আর কোনোদিন রুহি ফিরবে না। কারণ ইরাদ ওকে ভালোবাসে। রুহি ইরাদ এক সাথে ভালো আছে। আজ অনুতপ্ত মেঘা, ইরাদের সাথে রুহি ভালো আছে, তাহলে কি মেঘা একটু সময় দিলে আজকে এই ভালো থাকাটা ওর হতে পারতো? আজ মেঘা ভালো থাকার অভিনয় নয় বরং সত্যিকারের ভালোই থাকতে পারতো? কেউ তো জানেও না আজ ২বছর ধরে সাহিল মালয়েশিয়া গিয়ে আছে আর এর মধ্যে মেঘার সাথে তার কোনো ধরনের টাকা পয়সা বাচ্চার ব্যাপার ছাড়া কথা হয় না। কেউ তো জানেও না মেঘা একজন বিবাহিত নারী ঠিকি কিন্তু বিবাহিতার সুখটা এখন আর তার জীবনে একদমই নেই। সবাই জানে মেঘা সুখী, সে ভালো আছে তাই সারাজীবন ধরে সে অভিনয় করে যাবে। আজ মেঘা বুঝতে পারছে সে ভুল করেছিলো, অনেক বড় ভুল করেছিলো। যেই ভুলের কোনোমতে আর শুধ্রানোর রাস্তা নেই, হয়তো বাকি জীবনটাও এভাবেই কেটে যাবে অনুতাপ আর অভিনয় করেই।

তবে মেঘা এখন একদমই ভালো নেই এটা আর কেউ না বুঝলেও ইরাদ বুঝেছে। হাজার হলেও একটা সময় মেঘাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো ইরাদ। মেঘার কথা বলার ভংগিমা দেখে ইরাদ বুঝেছে মেঘা আসলেই ভালো নেই। তবে এই ভালো না থাকাটা ইরাদকে ব্যাথিত করে না এখন আর, ইরাদ এখনো অনুতপ্ত হয় মেঘার আর ওর বিয়ে নিয়ে হয়তো জীবনে এই ব্যাপারটা ছাড়া আর কোনোকিছু নিয়েই আক্ষেপ নেই ইরাদের কারণ, ইরাদ ভালো আছে এখন, নিজের রুহিকে নিয়ে নিজের মেয়ে ইরাকে নিয়ে।
ইরাদের প্রেমের অদৃশ্য বাধন রুহিকে এমন ভাবে আকঁড়ে রেখেছে যা রুহি চাইলেও কোনোদিন ভেঙে দিতে পারবে না, ইরাদ সবসময় আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া করতো আল্লাহ পাক ওকে যেমন রেখেছেন ভালো রেখেছেন। তবে এখন ইরাদ যতই শুকরিয়া করবে মনে হয় কম পড়বে। কারণ একটা সময় সে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলো কিন্তু এখন এতই পেয়েছে যে আল্লাহ কে শুকরিয়া করাটা যেন জীবনের একটা সবচেয়ে বড় কাজ হয়ে গেছে ইরাদের।

(সমাপ্ত)

(

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here