অনুভব
৪র্থ পর্ব
মারিয়া আফরিন নুপুর
ঠিক এমন সময় মেহুল সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল অর্ণবের দিকে, ওকে এমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও পরে বেশ দুষ্টোমির এক হাসির ঝিলিক দিলো ওর ঠোঁটের কোণে৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
___ ” মেজর সাহেব শো শেষ , এখন তো অন্তত মুখটা বন্ধ করুন।”
___ ” তুমি গরুর মত অমন চার হাত পায়ে ভর দিয়ে কি করছিলে?”
অর্ণব বেশ কড়া স্বরেই প্রশ্ন করল। মেহুল বিছানায় উঠতে উঠতে বলল,
___ ” গরু গরু খেলছিলাম, কিন্তু আফসোস আমি গরু সেজে ছিলাম ঠিকই কিন্তু আপনি আমার পিঠে উঠলেন না”।
এটুকু বলেই মেহুল দুলে দুলে হাসতে লাগল। মেয়েটা আসলেই একটু তার ছিঁড়া কিসমের কিন্তু অর্ণব পুরোই উল্টো। ওর কাছে লাইফ মানেই সিরিয়াস কিছু। আবেগের প্রশ্রয় একদমই নেই সেখানে। একবার আবেগের টানে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছিল, কিন্তু সেই একই ভুল আর করতে চায় না অর্ণব। জীবনের অনেকটা দিন একাকী পার করা অর্ণবকে যেন মেহুল এক রাতেই নাড়িয়ে দিয়েছে অনেক অনেক বার। কিন্তু নিজেকে আরো শক্ত করতে হবে অর্ণবকে। আগের বারের ভুল যেন আর না হয় এ জীবনে। অর্ণব এবার আরো কড়া গলায় মেহুলকে বলল,
___ ” এখন বিছানায় যেও না ব্যাগ প্যাক করো আজকে রাতের গাড়ি । সন্ধ্যাতেই বের হতে হবে মনে আছে সে কথা?”
___ ” আচ্ছা যাওয়াটা কি খুব জরুরি ”
মেহুল ডাগর চোখগুলো পুরো মেলে প্রশ্ন করল অর্ণবকে।
___ ” দেখো মেহুল আমরা সামাজিক জীব, যতই অস্বীকার করি না কেন সমাজের রীতিনীতি আমাদের মানতেই হবে। এখন যদি আমরা হানিমুনে না যাই অনেক কানাঘুষা চলবে। আর আমি চাই না আমাদের নিয়ে কেউ কানাঘুষা করুক।”
___ ” সমাজের কথায় যদি নিজের মনটাকেই মেরে ফেলতে হয়, তাহলে সেই মন বা সমাজের মূল্য কোথায়?”
___ ” আচ্ছা তুমি তো বিয়ের আগেই জেনেছিলে আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হই নি, তারপর বেশ চাপে পড়েই তোমাকে বিয়ে করেছি। এটা জানতে নিশ্চয়ই? ”
মেহুল মাথা দোলালো। অর্ণব তার কথা চালিয়ে যেতেই লাগল,
___ ” তুমি শিক্ষিত স্মার্ট স্বাবলম্বী মেয়ে তাহলে তুমি এত কিছু জানার পরে আমাকে কেন বিয়ে করলে। না করে দিতে পারতে।”
___ ” আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারি নি।”
মেহুল এবার বেশ গম্ভীর স্বরে উওর দিল। অর্ণব চাপা এক হাসির সাথে বলল,
___ ” একদম ঠিক পয়েন্টটা ধরেছ। দিদুন অনেক দিন ধরে আমার হানিমুনের প্লান করেছে। অন্তত দিদুনের জন্য হলেও আমাদের যাওয়া উচিত।”
___ ” আচ্ছা আমি ব্যাগ প্যাক করে নিচ্ছি। আর হ্যাঁ শোনেন অবশ্যই টিশার্ট বেশি করে নেবেন আপনার। ”
___ ” হঠাৎ এমন কথা কেন?”
___ ” বারে আমি টিশার্ট ছাড়া ঘুমাতে পারি না।”
মেহুল আবার সেই মুগ্ধ এক রাশ হাসি ছড়িয়ে উওর দিল৷ অর্ণব কিছু না বলে বই খুলে তাকিয়ে রইল। মনের মধ্যে যেন হাজারো হিসেব মেলানোর বাকি কিন্তু যে হিসাবের আগা মাথাই নেই সেই হিসাব মেলানো যে বড় কঠিন।
___ ” আম্মা আপনার কি মনে হয় অর্ণব মেহুলকে মেনে নেবে?”
লিপি বেগম চিন্তিত স্বরে বললেন হাসনাহেনা বানুকে।
___ ” আচ্ছা তুমি কেমন মা বলো তো লিপি, তোমার ছেলে তার বউকে কোলে নেবে না কি করবে সেটা জেনে তোমার কি প্রয়োজন। লজ্জাশরম কি সব বাপের বাড়ি রেখে এসেছ নাকি।”
চাপা স্বরে উত্তপ্ত গলায় বলল হাসনাহেনা বানু। লিপি বেগম দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
___ আম্মা লজ্জা শরম বাপের বাড়ি রাখি নাই নিজের বুদ্ধি রেখে আসছি বাপের বাড়ি। না হলে আপনার সাথে একত্রে থাকতাম কি করে। কালা বুড়ি একটা।”
শেষের কথাটা বেশ নিচু স্বরেই বলল লিপি বেগম। হাসনাহেনা বানু তাড়াতাড়ি বলল,
___ ” এই তুমি শেষের কথাটা কি বললে আবার বলো তো তাড়াতাড়ি বলো।”
___ ” আমি কিছুই বলি নাই আম্মা। আপনি পান খান পান।”
লিপি বেগম হাতের পানের বাটাটা শাশুড়ীর সামনে নামিয়ে রাখল। হাসনাহেনা বানু আয়েশ করে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল,
___ ” তা বউ মা গান তো আমি গাইতেই পারি, এখন তো আমার গলাটা বুড়ো হয়ে গেছে আগে তোমার শশুর যখন ছিল তখন তাকে প্রায়ই গান শোনাতাম। ”
লিপি বেগমের মনে চাচ্ছিল দুচোখ যেদিক যায় সেদিন চলে যেতে কিন্তু নিজেকে সংবরন করে চূপ করে উঠে চলে গেলেন নিজের রুমের দিকে। আর মনে মনে প্রার্থনা করলেন বুড়ো বয়সে দরকার হলে তার চোখ নিয়ে যাক উপরওয়ালা কিন্তু কানে যেন কিছু না করেন।
বিকালের দিকে বের যখন হল তখন ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। অর্নব ওর মাকে জড়িয়ে ধরেই কানে কানে বলল,
___ ” দিদুনের সাথে একদমই ঝামেলা করবে না।”
___ ” ঝামেলা আমি না তোর দিদুনই করে, পান খেতে বললে গান গাইতে বসে।”
লিপি বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন। ওদিকে মেহুল হাসনাহেনা বানুকে সালাম করতে করতে বলল,
___ ” বলো দিদুন তোমার জন্য কি নিয়ে আসব? ”
___ ” যেখানে যাচ্ছ সেখানে ঘি পাওয়া যায়। তাহলে তো ভালই ঘি নিয়ে এসো আমার জন্য।”
মেহুল কিছু বলের আগে সোহেলী বলল,
___ ” নানুমনি ওখানকার বিষও কিন্তু সেই রকমের টেষ্টি নিয়ে আসবে নাকি তোমার জন্য?”
___ ” এই মুখপুড়ি কি… কি বললি তুই? আমার জন্য বিষ আনবে, তবে রে আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।”
তেলেবেগুনে ক্ষেপে যেয়ে বলল হাসনাহেনা বানু৷ সোহেলী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
___ ” বাহ রে বাহ খুব তো কালা সেজে থাকো, কিন্তু আসল কথাগুলো ঠিকই পর্দায় চলে যায়৷
অর্ণব সবার কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলল,
___ ” অনেক হইছে এমন করতে থাকলে অফ হয়ে যাবে যাওয়া।”
ওরা গাড়িতে বসতেই হাত নেড়ে সবাই বিদায় জানালো। গাড়ি যখন রাতের আলোকিত রাস্তা ধরে ছুটে চলছে তখন মেহুল চোখ বন্ধ করে বলল,
___ ” জানেন মেজর সাহেব আপনি না খুব লাকি, এত এত সুন্দর একটা পরিবার আছে আপনার। আর আপনার চেয়ে বেশি লাকি তো আমি। যে আপনার এই পরিবারটা আমিও পেয়েছি।”
ওরা যখন কলাবাগান শ্যামলী কাউন্টারে পৌঁছালো তখন অলরেডি ছয়টা বেজে গেছে। গাড়ি কাউন্টারে সামনেই দাঁড়ানো, দেরি না করে ওরা গাড়িতে উঠে বসল। অর্ণব সিটে বসে বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
___ ” এখানেই এত ঠান্ডা ওখানে না জানি কি একটা অবস্থা হয়। মেহুল ভারি গরম পোষাক হাতের কাছে রেখো”।
কিছু না বলে মেহুল চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। অর্ণবের মনে হল এই মেয়েটার সাথেভার যাই হোক গাম্ভীর্য একদমই মানানসই না। গাড়ি ছেড়ে দিতেই অর্নব হেড ফোন কানে গুজে চোখ বন্ধ করে রইল। মেহুল চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। বাসের দুলুনিতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল মেহুলের টেরই পায় নি। ঘুম ভাঙল উষ্ণ এক কোমল হাতের স্পর্শে। চোখ খুলেই দেখে বাস দাঁড়িয়ে আছে। আর অর্ণব ওকে ডাকছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বাস থেকে নিচে নামতেই মেহুল আর অর্ণবের মনে হল ঠান্ডা একটা দেয়ালে কঠিন ধাক্কা খেল৷ ফোনের দিকে তাকিয়ে অর্ণব দেখল রাত সাড়ে এগারো বেজে গেছে৷ মেহুল তাড়াতাড়ি অর্ণবের ফোন হাতে নিয়ে দেখল তাপমাত্রা ১৫ °ডিগ্রী সেলসিয়াস শো করছে। বিশাল এক ঢোক গিলে মেহুল অর্ণবকে বলল,
___ ” আচ্ছা আমার চোখ গেছে না আপনার ফোন গেছে। এত টেম্পারেচার কমলো কি করে?”
মেহুলের কথার ধরন দেখে অর্ণব হেসেই ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
___ ” চোখ আর ফোন কেউ কোথাও যায় নাই উত্তরবঙ্গে এমনিতেই প্রচুর ঠান্ডা পড়ে।আর আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে তো মাইনাসে চলে তাপমাত্রা। এখন টাইম নষ্ট না করে চলো ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নি।
ওদের গাড়ি এসে থেমেছিল বগুড়ার ফুড ভিলেজে। ওরা হাত মুখ ধুয়ে এসে গরম ধোঁয়া উড়া চা অর্ডার করল। অর্ণব ফোনে কার কার সাথে কথা বলতে লাগল। আর মেহুল…মনোযোগ দিয়ে অর্ণবকে দেখতে লাগল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গজিয়েছে, ক্লিন সেভ করা অর্ণবের চাইতে এই খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতেই যেন বেশি মানিয়েছে। চুল গুলো পেছন থেকে একদম ছোট করা আর সামনে দিয়ে একটু বড়। কথা বলার সময় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলাটাও বেশ লাগে মেহুলে। অর্ণব কথা শেষ করে মেহুলের দিকে তাকাতেই বেশ অবাক হল৷ মেহুল অপলক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে, এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও বলল,
____ ” আচ্ছা দিন ক্ষন ঠিক করে একদিন তুমি আমাকে দেখো এভাবে, কিন্তু এখন তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নেও গাড়ি ছেড়ে দেবে।”
লজ্জায় মেহুলের গালে রক্ত জমল। ওদের গাড়ি যখন বাংলাবান্ধা পৌঁছালো তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা আর কুয়াশা। প্রকৃতি যেন শীতে জুবুথুবু, মেহুল বাইরে বের হতেই অনুভব করল প্রকৃতি যেন এক স্নিগ্ধ কোমল পরশ ছড়িয়ে রেখেছে সারা জায়গায়। এখানে যেন বারবার হারিয়ে যাওয়া যায়। অর্ণব মেহুলে বলল,
___ ” বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন আটটার দিকে খুলবে, এখন একটু হাত মুখ ধুয়ে চা খাবো চলো।”
মেহুল আর অর্ণব ঘুরতেই যেন আচমকা থেমে গেল দুজনে, চোখের সামনেই…..
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর
(