অনুভব পর্ব ৩

অনুভব
৩য় পর্ব
মারিয়া আফরিন নুপুর

অর্ণবের হাঁটুর উপরে হাসনাহেনা বানু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন। অবাক হয়ে ও হাসনাহেনা বানুর দিকে তাকাতেই উনি ফিসফিসিয়ে বলল,
___ ” কি রে নাত বউ কেমন?”
___ ” ঠিক তোমার মতন “।
পাউরুটি চাবাতে চাবাতে উওর দিল অর্ণব। কিন্তু হাসনাহেনা বানু খেঁকিয়ে উঠলেন বেশ জোরেই,
___ ” তোর সাহস তো কম না আমার নাত বউরে তুই জামার মতন বলিস।”
___ ” ওরে দিদুন জামার মতন বলি নি বলেছি তোমার মতন…. ”
এবার অর্ণবও বেশ জোরেই বলে উঠলো, দাদি নাতনীর এই অবস্থা দেখে মেহুল হাসতে লাগল মুখ চেপে চেপে। হাসনাহেনা বানু এবার রেগে বলেন,
___ ” তুই এত জোরে কথা কেন বলতেছিস? আমি কি কালা নাকি যে কানে শুনি না ”
এবার সোহেলি হাসতে হাসতে বলল,
___ ” লও ঠেলা, চালুনি জিজ্ঞেস করে সুইরে তার পিছনে কত ফুটা। নানুমনি জিজ্ঞেস করে সে কালা নাকি? ”
এমন হাসি মজার মধ্যেই শেষ হয় ওদের নাস্তা। খাওয়ার শেষে অর্ণব চলল ওর রুমে। মেহুল বসে সবার সাথে গল্প করতে লাগল। বড় ভাবি চোখের ইশারায় মেহুলকে উপরে যেতে বলল, কিন্তু মেহুল মাথা নেড়ে মানা করল। এবার বড় ভাবি ফিসফিস করে বলল,
___ ” আমার দেবরটা কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করতেছে আর তুমি কি না এখানে আড্ডাবাজি করতেছ। যাও বলছি তাড়াতাড়ি উপরে যাও।”
___ ” শোনো ভাবি তোমার দেবর আমারে দেখলেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে যেন আমি মায়ানমারের বর্ডার গার্ড। আমারে দেখলেই কেমন কেমন জানি করে।”
মেহুল ঠোঁট উল্টিয়ে বিচারের মতন করে বলল। বড় ভাবি এবার হাসি আটকে বলল,
___ ” দুই দেশের বর্ডার গার্ডদের মধ্যে সন্ধি চুক্তি সাক্ষর করার ব্যবস্থা করো যাও।”
অগ্যত উপায় না পেয়ে মেহুল চলল অর্ণবের কাছে।

___ ” অর্ণবকে আমি না পেলে আর কারোই হতে দেব না।”
প্রচন্ড আক্রোশের সাথে ঝিলমিল ফুলদানিটা ভেঙ্গে ফেলল টেবিলের উপর থেকে নিয়ে। আতিক সাহেব এবার নিরুপায় হয়ে গেলেন, মেয়েকে শান্ত করার জন্য বললেন,
___ ” ঝিলমিল প্লীজ থামবি তুই, এমন করার কোন মানেই হয় না। অর্ণব অনেক ট্রাই করেছিল তোকে মানানোর কিন্তু তোর জিদে তুই অনড় ছিলি।”
___ ” হ্যাঁ ছিলাম কিন্তু আমি শুধু এটাই জানি অর্ণব শুধু আমার।”
চিৎকার করে বলল ঝিলমিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল আতিক সাহেবের। মেয়ের এই বেপরোয়া হওয়ার পিছনে সম্পূর্ণ দায়ভার যে শুধুই তার। একমাত্র মেয়ে বলে ঝিলমিলকে কখনও সে কিছুতেই বাধা দেয় নি। যা করেছে মেয়ে তাতেই সে সায় দিয়ে গেছে, কিন্তু আজ খুব আফসোস হচ্ছে। যদি একটু শাসন করত তাহলে মেয়েটা হয়ত উচ্ছনে যেত না। ঝিলমিল পাগলের মতন কাঁদছে, আজকে মনে হচ্ছে আসলেই ওর লাইফ থেকে ভালবাসার মানুষটা হারিয়ে ফেলেছে ও। খুব মনে পড়ছে ওর শেষের দিনটার কথা যেদিন অর্ণব ঝিলমিলের হাত ধরে বারেবার অনুরোধ করেছি, ও যেন ফিরে আসে অর্ণবের লাইফে। কিন্তু সেদিন ওর কাছে সাদামাটা অর্ণবকে মোটেও যোগ্য মনে হয় নি। চার বছরের রিলেশন এক মূহুর্তে ছেটে ফেলেছিল ও। সামনে ছিল রঙ্গিন দুনিয়ার হাতছানি। আজ যে আবার ওর মনে হচ্ছে অর্ণব ছাড়া এই জীবনে ওর কাউকে প্রয়োজন নেই শুধু অর্ণবকেই দরকার ওর। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো ঝিলমিল, অর্ণবকে ওর চাইই চাই। যে করেই হোক অর্ণবে ওর পেতেই হবে। ফোন হাতে নিয়ে ও ঘুরে দাঁড়ালো আতিক সাহেবের দিকে,
___ ” বাবা অর্ণবকে না পেলে আমি মরে যাব, এখন তুমি সিদ্ধান্ত নিবে মেয়েকে চাও কি না।”
এটুকু বলেই ঝিলমিল গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

মেহুল দরজা একটু খানি ফাঁকা করে মাথা ঢুকিয়ে দিল রুমের মধ্যে। খাটের উপরে বিশাল এক কম্বল, অর্ণবকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মেহুল পা টিপে টিপে রুমে ঢুকতেই হঠাৎ শাড়ির কুঁচিগুলো কি ভাবে যেন কলার খোসার মতন ওর পায়ের নিচে চলে এলো৷ কুঁচিতে টান পড়ায় কোমর আপনা ইচ্ছাতেই বাঁকা হয়ে এলো। মেহুল দেখল ফ্লোরের টাইল গুলো যেন ওর কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে হাত সামনের দিকে এগিয়ে আসতেই টের পেল হাতের নিচে শক্ত আরেকটা হাত। চোখ খুলতেই দেখল অর্ণব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে। মেহুলকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বেশ রাগি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেহুল অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
___ ” আসলে হইছে কি পড়ে যাওয়াটা আমার একটা বিশাল ঐতিহ্য আর কি। আমি সব খানে গেলেই পড়ি। একবার অফিসে সবার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম মিটিং রুমে। ”
অর্ণব আবার অবাক হয়ে তাকালো মেহুলের দিকে, এই মেয়ের সাথে কি করে সংসার করবে ও। অর্ণবের কাছে যেন ব্যাপারটা মিশন ইমপসিবলের মতন মনে হচ্ছে। মেহুলের শাড়ি অর্ধেক খুলে গেছে শাড়িকে অনেকটা দলামুচি করে ধরে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ও। অর্ণব যেয়ে আবার বারান্দাতে দাঁড়ালো, মেহুল পা টিপে টিপে ক্লজিটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল পরবে কি সালোয়ার কামিজ নাকি টিশার্ট আর ট্রাউজার। ভাবল বেশ কিছুক্ষন তো আছে দুপুরের গোসলের পরেই সালোয়ার কামিজ পরে নেবে এখন টিশার্ট পরুক। অর্ণবকে ডাকতে যেয়েও থেমে গেল মেহুল, ওর কাছে টিশার্ট চাইলে যে হারে চোখ বড় করে কখন জানি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে টুপ করে খুলে নিচে পড়ে যায়। কালকে রাতে অর্ণব যে ক্লজিট থেকে বের করেছিল টিশার্ট ও সেই পাল্লাটা ধরে টান দিতেই দেখল থরে থরে টিশার্ট ভাজ করে রাখা। অফ হোয়াইট কালারের একটা টিশার্ট নিচ থেকে টান দিতেই মেহুলের সামনের ফ্লোরে একটা ছবি উড়ে যেয়ে পড়ল। মেহুল শাড়ি হাতেই নিচু হয়ে ফ্লোর থেকে ছবিটা তুলে নিল। একটা পুতুলের মতন মেয়ের সাথে অর্ণবের হাসোজ্জল ছবি। মেহুল বেশ অবাক হল অর্ণব এত সুন্দর করে হাসতেও পারে। আচ্ছা সাথের মেয়েটা কে, বন্ধু হবে হয়ত। এসব ভাবনার মধ্যে থাকতে থাকতে মেহুল চোখের কোনা দিয়ে দেখল অর্ণব আসছে, তাড়াতাড়ি ছবিটা যেখানে ছিল সেখানে ঢুকিয়ে রেখে টিশার্ট হাতে ক্লজিট থেকে বেরিয়ে এলো।
___ ” তুমি এখানে কি করো ”
অর্ণব অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
___ ” মানুষ ক্লজিটে কি কি করে? মাছ তো আর ধরে না কাপড় বের করছিলাম। ”
___ ” কথার সোজা উওর একটাও দিতে পারো না তাই না?”
___ ” জন্মই হয়েছিল উল্টা তাই এই অবস্থা।”
এই বলেই মেহুল বাঁ চোখ টিপ দিল। অর্ণব বিড়বিড় করে বলল,
____ ” বোঝাই যায় যে উল্টা পয়দা হইছিল। নতুন করে বলার কি দরকার।”
মেহুল কথা না বাড়িয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে চলে, আর অর্ণব বসল বই নিয়ে। মাথাটা ঠান্ডা করতে হবে ওর, এই মেয়ের সাথে কি করে যে বাকি জীবন কাটাবে সেটা ও নিজেও জানে না। তবে মেহুলের একটা জিনিস ওকে খুব আকর্ষণ করছে সেটা হল মেহুলের ছেলেমানুষী। মেয়েটা আসলেই প্রকৃতির মত উচ্ছল। অর্ণব বই খুলে গভীর চিন্তায় ডুব দিল আবার, মেহুলকে এত এত ভাল লাগছে কেন ওর, মাত্র এক রাতের পরিচয়ে মনে হচ্ছে মেয়েটাকে কতদিনের পরিচিত কত আপন। কিন্তু এমন কি হওয়ার কথা ছিল, ওর জীবনের ভালবাসার তলানিটুকুও তো অবশিষ্ট নেই। সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছিল একজনকে, কিন্তু সেই ভালবাসার মূল্য সে পায় নি। যদি এখনও আবার সেরকম কিছু হয়ে যায়। চিন্তার ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে অর্ণব দেখল, মেহুল গরুর মতন চার হাত পায়ে সারা ফ্লোর ময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাথা একবার এদিক দোলাচ্ছে আরেকবার ওদিক দোলাচ্ছে। এবার যেন অর্ণবের হার্টবিট মিস হবার যোগাড়। মেহুলের ঢোলা টিশার্টের উপর থেকে বুকের উপরের অনেকখানিই চোখে পড়ছে। অর্ণবের চোখ যেন আটকে আছে সেই উন্মুক্ত বুকের দিকে। নিজেকে যেন ফেরাতেই পারছে না ঠিক এমন সময়……

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here