অনুভূতি,পর্ব-৪৩+৪৪

অনুভূতি
পর্ব ৪৩
মিশু মনি
.
৬৭
খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লো সবাই। বিকেল গড়িয়ে এসেছে। এখন হেলিপ্যাডে যাওয়া হবে। বিকেলটা ওখানে কাটিয়ে দিয়ে সূর্যাস্ত দেখে তারপর কটেজে ফিরবে। মিশুর চেহারায় একটা লাজুক রাঙা আভা চলে এসেছে। দেখলেই ওর গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মেঘালয় বারবার ড্যাবড্যাব চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। আজীবন দেখলেও বোধহয় দেখার সাধ মিটবে না। চোখ দুটো শতবার দেখেও তৃপ্ত হতে চায়না। কি মায়া ছড়িয়ে আছে মেয়েটার পবিত্র মুখে! কত বিশুদ্ধ চাহনি।
মিশু মেঘালয়েকে একটা খোঁচা মেরে বলল, “কি হলো? এভাবে দেখছো কি?”
– “এবারের মধুচন্দ্রিমা একেবারে সার্থক তাইনা?”
– “কেন?”
– “মধুর মিষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে।”
মিশু ক্ষেপে বললো, “বড্ড দুষ্টু তুমি। এসব দুষ্টুমি ফেলে এখন বলো আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
– “হ্যালিপ্যাডে যাচ্ছি। সূর্যাস্ত দেখতে।”
– “আর মেঘ?”
– “মেঘ আজকে তোমাকে একেবারে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে,তবুও সাধ মেটেনি?”
মিশু এগিয়ে এসে দুটো কিল বসালো মেঘালয়ের বুকে। ছেলেটা বড্ড দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে। এভাবে বললে লজ্জা লাগেনা? বুঝেও এরকম করে বলে। যেন মিশুর লাজ রাঙা চেহারাটা দেখতেই ওর সুখ হয়।
সবাই মিলে পৌছে গেলো হ্যালিপ্যাডের কাছে। যাওয়ার আগেই রুনময় রিসোর্ট দেখতে পেয়ে মিশু মুখটা বাচ্চাদের মতন ছোট্ট একটু করে বললো, “এখানে কি শুধু আর্মিরা থাকে?”
– “না তো। এটা একটা রিসোর্ট।”
– “আমরা কেন এখানে থাকলাম না?”
প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলোনা মেঘালয়। হেসে বললো, “এখানে থাকতে চাও? আচ্ছা এর পরেরবার এসে তোমাকে নিয়ে এখানে আসবো।”
– “সত্যি তো?”
– “হুম।”
হেলিপ্যাডে ঢোকার আগেই একটা ছোট্ট পার্ক সামনে পড়ে। পার্কের ভেতরে একটা দোলনা আছে। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সামনে বিশাল আকাশ। পাহাড়,আকাশ, সবুজের মিশ্রণে এক অপূর্ব শোভা তৈরী হয়েছে। দোলনা দেখেই মিশু আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। ছুটে গিয়ে দোলনায় বসে পা দোলাতে লাগলো। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। কি যে অপরূপ লাগছে প্রকৃতিটাকে! দূর থেকে রূনময় রিসোর্ট দেখতেও ভালো লাগছে। রিসোর্টের সামনে যে রাস্তা দিয়ে আসা হলো,সেটাও অসম্ভব সুন্দর। রাস্তাগুলোও এত সুন্দর হতে হয় বুঝি! সবকিছুই ছবির মত সুন্দর। মানুষ কেন যে নিজের দেশ ছেড়ে অন্যকোথাও ঘুরতে যায়?
মেঘালয় এসে মিশুর পাশে বসল। বাকিরা সবাই হেলিপ্যাডের দিকে যাচ্ছে। ওরা দুজন এখানে বসে দোল খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।
পূর্ব ও রোদ একসাথে হাঁটছে। নিখিল ও দুপুর ওদেরকে ছেড়ে সামনে চলে গিয়েছে। সায়ান ও আরাফ পুরো হেলিপ্যাড ছোটাছুটি করছে আর দুজনে তর্ক করছে মজার মজার সব ব্যাপার নিয়ে।
রোদ পূর্বকে বললো, “এতবড় আকাশ আমি কখনো দেখিনি। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়ের চুড়া আর আকাশ। আমরা সব পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছি তাইনা?”
– “এখানে তিনবেলা এলে তিনরকম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সকালে সূর্যোদয় একরকম লাগে, বিকেলবেলা অন্যরকম আর সূর্যাস্তের ভিউ আবার অন্যরকম।”
– “আপনি এখানে আগেও এসেছেন তাইনা?”
পূর্ব বললো, “হুম। মেঘালয় আর সায়ান দুজনেই প্রচুর ঘুরাঘুরি করে। ওদের সাথে আমিও বেড়িয়ে পড়ি। আমার সবসময় সময় হয়ে উঠেনা। তারপরও চেষ্টা করি।”
রোদ বলল, “আমার ও খুব এভাবে দূর বহুদূর ঘুরতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার কখনো যাওয়া হয়না কোথাও। আগে বাবা যেতে দিতো না, কিংবা নানান কারণে যেতে পারতাম না। ভেবেছিলাম বিয়ের পর বরের সাথে ঘুরবো। সেটাও ভাগ্যে নেই। আসলে মেয়েদের সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়না।”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রোদ। পূর্ব ওর মুখের দিকে তাকালো। বড্ড করুণ দেখাচ্ছে মুখটা। মেয়েটার চেহারায় একটা মায়া আছে। এই বিকেলের রঙিন আলোয় কত রাঙা লাগছে সে মায়াবী মুখটা, অথচ অরণ্য এরকম একটা মেয়েকে ওভাবে কষ্ট দিলো! মায়াবতী জিনিসটা কি সেটা বোঝার ক্ষমতা অরণ্য’র ছিলোনা। পূর্বকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে রোদ বললো, “আচ্ছা, আপনার গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসেন নি কেন?”
পূর্ব মুচকি হেসে বললো, “থাকলে তো নিয়ে আসবো। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
– “আমি ভেবেছিলাম আছে। প্রায়ই আপনাকে অনেক্ষণ ফোনে কথা বলতে দেখি।”
– “ওহ, বাসায় কথা বলি। আমার আম্মু আমাকে মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে দেয়না। আম্মুর সাথেই অনেক্ষণ কথা বলতে হয়।”
– “আপনাকে খুব ভালোবাসেন উনি তাইনা?”
-“হুম প্রচুর ভালোবাসে।”
– “সব মায়েরাই তার ছেলেমেয়েকে অনেক ভালোবাসে। মায়েরা এমনই হয়।”
পূর্ব বললো, “সব মায়েরা এমন হয়না। সায়ানের ভাগ্যটা খুব খারাপ। ওর মা সারাবছর বিজনেস, মিটিং এসব নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই কখনো সময় পায়নি মায়ের কাছ থেকে। মায়ের আদর কি সেটা বলতেই পারেনা ও। আর যে মেয়ের সাথেই রিলেশন হয়,সবার ধান্ধা থাকে ওর টাকা পয়সার প্রতি। কেউ ওকে সত্যিকার ভাবে ভালোই বাসলো না।”
কথাটা শুনে সায়ানের প্রতি একটু মায়া লাগলো রোদের। কত ভালো একটা ছেলে,অথচ কত একা! বিধাতা কিছু কিছু মানুষকে খুব নিঃসঙ্গ করে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। সায়ান তার একজন, রোদ নিজেও তার একজন। আজীবন নিঃসঙ্গ থাকতে হবে হয়ত।
আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস!
হেলিপ্যাডের সূর্যাস্ত একদম অনন্য। বিশাল প্রান্তরে সূর্য ধীরেধীরে ডুবে যায়। মাথার উপর শুধুই মহাশূন্য। সামনে পাহাড়,আর গাঢ় সবুজ। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। সামনে ছোটছোট ঘর চোখে পড়ে। লাল সবুজ ঘরের চালা। প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে রূপের ডালা সাজিয়ে রেখেছে এখানে। দূরে দোলনায় মেঘালয় ও মিশু বসে আছে। মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখেছে। মেঘালয় মিশুর হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে চঞ্চলতার ঝুড়ি খুলে বসেছে। ওদেরকে দেখলেই মনেহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী কাপল। এত সুখী কেন ওরা!
রোদকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূর্ব জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো?”
– “মিশুর ভাগ্যটা খুব ভালো। কয়টা মেয়ের ভাগ্যে এমন একটা মেঘালয় জোটে?”
– “হুম। মেয়েটাও কিন্তু অনেক ভালো। কয়টা ছেলেই বা এরকম একটা মিশু পায়? মিশু একটু অনন্য বলেই কিন্তু ওরকম একটা ছেলে পেয়েছে।”
রোদ একটু বাঁকা চোখে তাকালো পূর্ব’র দিকে। যদিও কথাটা সত্য, ও ভালোভাবেই জানে। তবুও তার সামনে একটা মেয়ের প্রশংসা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না। রাগ লাগছে। ও ক্ষেপে গেলেও সেটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেড়িয়ে আসলো।
পূর্ব নিজেও ক্ষেপে গেছে। ওর ইচ্ছে করছে রোদের হাত টেনে ধরে একদম কাছে টেনে নিয়ে ওর মুখটা দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরতে। তারপর চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমাকে কি মেঘালয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম মনেহয়? আমাকে ভালো লাগেনা?”
কিন্তু পারছে না সেটা বলতে। কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে। আর কেনই বা বলবে এ কথা? রোদ ওর কে?
রোদ বললো, “কি দেখছেন এভাবে?”
পূর্ব থতমত খেয়ে অন্যদিকে তাকালো। গোধূলি বিকেল দেখতে খুবই আনন্দ হচ্ছে। কেন যেন ইচ্ছে করছে রোদকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখতে। সেই যে প্রথম দেখা হলো, তারপর আর কখনো ওকে শাড়ি পড়তে দেখেনি। শাড়িতে মেয়েদেরকে কতটা সুন্দর লাগে এটা কি মেয়েরা জানেনা? সবসময় শাড়ি পড়ে থাকতে কি হয়? মিশু শাড়ি পড়লে একটা সতেজতা চলে আসে ওর চেহারায়। চঞ্চলতা আরো গভীর হয়ে ওঠে। মনেহয় উচ্ছল কিশোরী। রোদ শাড়ি পড়লে ওকে ও কোনো অংশে কম লাগবে না। একবার কি বলবে শাড়ি পড়তে?
পূর্ব আনমনে এসব ভাবছে আর চেয়ে আছে আকাশের দিকে। মিশু মেঘালয় হেলিপ্যাডে এসে সূর্যাস্ত দেখছে। গাঢ় সবুজ ঘাসের উপর বসে খুনসুটি করছে আর খিলখিল করে হাসছে মিশু। পূর্ব’র ও ইচ্ছে করছে এভাবেই খুনসুটি করতে। কিন্তু কার সাথে? কোনো উত্তর খুঁজে পায়না ও। রোদের প্রতি একটু একটু ভালোলাগা কাজ করছে ওর। তবে কি রোদকেই….?
৬৮.
সন্ধ্যার পর কটেজে ফিরে এলো ওরা। রাতের খাবার খেয়ে এসে যে যার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। রোদ বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। মেঘ উড়ে উড়ে আসছে, সাদা তুলোর মত মেঘ। এক পাহাড়ের উপর দিয়ে আরেক পাহাড়ে চলে যাচ্ছে। ওর মনে পড়ছে সকালের কথা। হাজাছড়া ঝরনায় স্নানের সময় মেঘালয় কত গভীর আবেশে মিশুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। মিশু লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ লুকালো ওর বুকে। সবাই অন্যদিকে চেয়ে ছিলো তখন। মেঘালয় আগেই সবাইকে বলেছিলো যেন কেউ ওদের দিকে না তাকায়। তবুও চুপিচুপি রোদ ওদের প্রেম দেখে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। ওদেরকে দেখলে রোদের খুবই কষ্ট হয়। তিনদিন পরপর মেঘালয় আসে মিশুর কাছে, মিশু সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে ওর জন্য। খুব যত্ন করে সাজুগুজু করে, বসে থাকে কখন মেঘ আসবে? মেঘালয় আসার পর মিশু বারবার শব্দ করে হাসে। রোদের রুম থেকে ওদের হাসির শব্দ শোনা যায়। ও বের হয়না রুম থেকে। মেঘালয় মিশুকে কোলে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, রান্নাঘরে মিশুকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে থাকে। সুইমিংপুলে একসাথে দুষ্টুমি করতে করতে গোসল করে। এসব না চাইলেও রোদের চোখে পড়ে। কিংবা রোদ ইচ্ছে করেই কখনো জানালার ফাঁক দিয়ে তাকায় পুলের দিকে। মিশু মেঘালয়ের দুই কাঁধের উপর নিজের দুইপা তুলে দিয়ে পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে, দেখলে বুকটা ফেটে কান্না আসে রোদের। ঝাপসা হয়ে আসে সবকিছু। ও তবুও তাকায় ওদের দিকে। সারারাত কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। ওরও ইচ্ছে করে কারো এমন ভালোবাসা পেতে। কিন্তু পায়না সেটা। সবার ভাগ্যে সবকিছু থাকেনা। কেন এরকম একটা মেঘালয় ও পেলোনা?
আজকেও কান্না পেয়ে যাচ্ছে রোদের। এমন একটা মেঘালয় কেন ও পেলোনা? এই একটা প্রশ্ন নিজেই নিজেকে বারবার করতে লাগলো। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। কারো ভালোবাসা, স্পর্শ, একটু যত্ন পেতে ইচ্ছে করছে। কেউ হাত ধরে পাহাড়ে উঠবে, ঝরনায় যাওয়ার সময় হাত ধরে নিয়ে যাবে, খুব করে আগলে রাখবে। কেন এই সুখটুকু ওর ভাগ্যে হলোনা? শুধু কালো বলে? শ্যামলা রঙের মেয়েরা কি মেয়ে নয়? ও কি দেখতে খুব খারাপ?
রোদের খুব কান্না পাচ্ছে। ও বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে যত্ন করে পড়লো। কপালে টিপ দিলো,চোখে কাজল আঁকলো। ভ্রু দুটো আরেকটু কালো করলো, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিলো। এখন পাক্কা মায়াবতী লাগছে ওকে। আয়নায় তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা রৌদ্রময়ী, তুই দেখতে কি খারাপ? তোকে কেন আমার চোখে এত ভালো লাগে? আর কারো চোখে কি তোকে ভালো লাগবে না?”
এমন সময় কে যেন দরজায় নক করলো। রোদ দরজা খুলে দিয়ে দেখলো মিশু। মিশু বললো, “আপু বারান্দায় আসো। সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে আকাশের তারা গুনবো। জানো আকাশটা কত সুন্দর দেখাচ্ছে বারান্দা থেকে?”
কথাটা বলার পরপর ই মিশু অবাক হয়ে তাকালো। চোখে মুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বললো, “একি রোদ আপু! তোমাকে একদম পরির মত লাগছে গো। এত মিষ্টি লাগছে উফফ!”
রোদ মুচকি হেসে বললো, “তাই না?”
– “হুম। আসো আসো। আজকে আমাদের তিনজন ব্যাচেলর ভাইয়ের মধ্যে একজনের মাথা ঠিকই ঘুরে যাবে দেখো।”
– “মানে!”
– “পূর্ব, সায়ান আর আরাফের মধ্যে একজন আজকে তোমার প্রেমে পড়ে যাবে শিওর।”
– “কি যে বলোনা।”
– “দেখে নিও তুমি। এবার আসো তো আমার সাথে।”
মিশু রোদের হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। রোদের চুলগুলো সুন্দর করে আচড়ে দিলো। খোলাচুলে মারাত্মক সুন্দর লাগছে রোদকে। মিশু বারবার ওর রূপের প্রশংসা করতে লাগলো। রোদ খুবই লজ্জা পাচ্ছে ওর কথা শুনে।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সবাইকে একবার অবাক হয়ে তাকাতেই হলো ওর দিকে। পূর্ব’র বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে উঠলো। আজকে বিকেলেই ওর ইচ্ছে হয়েছিলো রোদকে শাড়ি পঢ়া অবস্থায় দেখতে। সত্যি সত্যি দেখবে সেটা ও কল্পনাও করেনি। কিন্তু রোদকে শাড়িতে আর হালকা সাজে এত বেশি সুন্দর লাগবে ও ভাবতেও পারেনি। মুখে মেকাপ ও তো করেনি। তবুও অপ্সরী অপ্সরী লাগছে।
সায়ান ও আরাফ ও একবার চমকালো ওকে দেখে। সবাই বসে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো একসাথে। এভাবে একসাথে থাকলে খুব কোলাহল হবে। তাই যে যার মত আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। যার যার রুমের কাছে বারান্দায় বসে সবাই আকাশ দেখবে। আর যেহেতু এখানে দুজন কাপল আছে, কাজেই এটা তো করতেই হবে। মেঘালয় ও মিশু সবার আগেই উঠে চলে গেলো। নিখিল ও দুপুর ও চলে গেলো নিজেদের রুমে। পূর্ব সায়ানকে কানেকানে কি যেন বলতেই ও হেসে বললো, “আচ্ছা।”
রোদ একাই বসে আছে ওদের সাথে। ও উঠে দাঁড়ালো নিজের রুমে যাওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে হেঁটে রুমের দিকে পা বাড়ালো। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। সৌরবিদ্যুতের আলোয় এই কাঠ ও বাঁশের বারান্দা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বারান্দা থেকে দূরের পাহাড়্গুলো স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ ধাধিয়ে যায়। রাত্রিবেলা দূরের কিছু দেখাও যায়না। আকাশের তারাগুলো যেন খুব কাছে চলে এসেছে। রোদ নিজের রুমের দরজার কাছে এসেছে,এমন সময় পূর্ব’র গলা শুনতে পেলো, “এখুনি ঘুমোবে?”
রোদ চমকে উঠে বললো, “না। এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না।”
– “কিছুক্ষণ গল্প করি বসে? বারান্দা থেকে আকাশ দেখি একসাথে?”
– “হুম আচ্ছা।”
পূর্ব যেদিকে যাচ্ছে রোদ ওর পিছুপিছু চলে এলো। রুমের পিছনের দিকের বারান্দায় এসে বসে পড়লো। এখানকার অধিকাংশ রিসোর্ট ও কটেজ বাঁশ ও কাঠের তৈরী। ঘরে শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে মেঘের উড়ে আসা দেখা যায়। বারান্দায় বসে সুন্দর আকাশ দেখা যায়। রাতের অন্ধকারে আকাশের রূপ বদলায়। নক্ষত্রগুলো খুব কাছে নেমে আসে। আর অন্ধকারেও চারিদিকে মেঘের দলের ছুটে আসার উপস্থিতি অনুভব করে শিউরে উঠতে হয়।
পূর্ব ও রোদ বারান্দায় পাশাপাশি বসলো। পূর্ব প্রথমেই বললো, “সবসময় শাড়ি পড়ে থাকতে পারো না?”
রোদ চমকে উঠে বললো, “কেন?”
– “বাঙালী মেয়েদের শাড়িতেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। আর তোমাকে যা লাগছে! সাজেকের মেঘের মতন সুন্দর।”
রোদ হেসে বললো, “কালো মেঘ!”
পূর্ব কিছু বললো না। এখানে সোলারের আলো নেই। অন্ধকার বারান্দায় পাশাপাশি বসে কেমন কেমন যেন ফিল হচ্ছে দুজনের ভেতরেই। চারিদিক খুব বেশি নিস্তব্ধ। এই কটেজে বেশি রুম নেই। যে কয়টা রুম আছে,বলতে গেলে সবগুলোই ওরাই বুক করে ফেলেছে। ওদের মধ্যে চেঁচামেচি করার কেউ নেই। সবাই নিজ নিজ বউ নিয়ে ব্যস্ত। দুই অভাগা সায়ান ও আরাফ নিশ্চয়ই গলা জড়াজড়ি করে বসে আছে। বাকি থাকলো পূর্ব ও রোদ। ওরা কি চাইলেই একটু ভালো থাকতে পারেনা? পূর্ব মনেমনে এসবই ভাবছে। রোদের কথা শুনে সম্বিৎ ফিরে পেলো, “আচ্ছা, তারাগুলো এত কাছে চলে এসেছে কেন?”
– “আমরা যে তারাদের কাছে চলে এসেছি, তাই।”
– “আমরা কালকে কোথায় যাবো? এখনো তো মেঘ ছুঁয়ে দেখাই হলোনা।”
– “কাল খুব ভোরে উঠতে হবে। ভাগ্য ভালো হলে এখানে বাইরেই মেঘ ধরতে পারবো। নয়ত ভোরবেলা উঠেই আমাদের কংলাক পাড়ায় যেতে হবে।”
– “ওহ আচ্ছা। সেখানে কি কি আছে?”
– “ওটা মূলত লুসাইদের গ্রাম। লুসাইরা থাকে, আর পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। ওখানে গেলে মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে।”
-“আমাকেও?”
পূর্ব হেসে বললো,”আজব কথা বললে। মেঘ সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলে তোমাকে বাকি রাখবে কেন?”
– “আমি কালো তো। তাই সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে রাখে।”
– “তুমি কালো? হা হা হা। তোমার মত একটা মেয়ে এটা বলছে আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা।”
– “আগে আমার ও বিশ্বাস হতোনা। আজকাল হয়। যা ঘটে গেছে আমার লাইফে, তারপর এটা বিশ্বাস করতেই হয়।”
পূর্ব একটু ঝাঁঝালো গলায় বললো, “এসব কথা প্লিজ মনে করোনা তো। তুমি কতটা সুন্দর তোমার বোধহয় জানা নেই।”
– “তাই নাকি? আপনার জানা আছে?”
– “এই ফালতু টপিক বাদ দিবা? আকাশের তারা দেখো। একটা তারা আরেকটা তারার সাথে কথা বলছে। দেখেছো?”
রোদ আকাশের দিকে তাকালো। তারপর নিশ্চুপ হয়ে গেলো একদম। এত কাছ থেকে তারাদের কখনো দেখেনি ও। এত সুন্দর লাগছে উফফ! মনেহচ্ছে সব তারা মিটিমিটি করে একে অপরকে ভালোবাসার কথা জানান দিচ্ছে। আনন্দে ছেয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। উত্তেজনায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো রোদ। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো পূর্ব’র কাছাকাছি। পূর্ব ও একটু কাছে এগিয়ে এসেছে। এখন চাইলেই রোদকে নিবিড়ভাবে ছোঁয়া যায়। ওর ভেতরে কাঁপন ধরে গেছে।
রাত বাড়ছে। আর পাহাড়ের মাঝে কঠিন নির্জনতায় রাত আরো বেশি গভীর মনেহচ্ছে। মেঘেদের আনাগোনা টের পাওয়া না গেলেও খুব কাছেই মেঘ এসে উড়ে বেড়াচ্ছে, ভাবলেই শরীরে একটা অন্যরকম স্পন্দন হয়। কি যে ভালো লাগে!
পূর্ব বললো, “একবার আমার কাঁধে মাথা রাখবে রোদ?”
রোদ চমকে উঠলো। অজান্তেই পানি এসে গেলো ওর চোখে। এত সুখকর কথা বোধহয় কক্ষনো শোনেনি ও।
চলবে..’

অনুভূতি
পর্ব ৪৪
মিশু মনি
.
৬৯.
রোদের চোখে পানি এসে গেলো। ও আস্তে করে মাথাটা রাখলো পূর্ব’র কাঁধের উপর। পূর্বকে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ বলা যায়। ও কখনোই শুধুমাত্র মজা নেয়ার জন্য কাঁধে মাথা রাখতে বলবে না। বললে একদম আপন ভেবেই বলবে। এসব কিছু ভেবে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো রোদের।
পূর্ব বললো, “বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে তাইনা?”
রোদ কোনো কথা বললো না। ঢিপঢিপ আওয়াজ ওরও হচ্ছে। কিন্তু মুখে কিছু বলা যাচ্ছেনা। খুব লজ্জা করছে ওর। লাজুক ভঙ্গিতে বললো, “আপনি কি কখনো কারো এই ঢিপঢিপ শব্দের কারণ হয়েছিলেন?”
– “খুব সম্ভবত হইনি কখনো।”
– “আজকে হয়েছেন। আমি তাহলে ভাগ্যবতী বলতে হবে।”
পূর্ব আর কোনো কথা বললো না। ওর ও ইচ্ছে করছে রোদের নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হওয়ার কারণ হতে। ওর ইচ্ছে করছে রোদের সমস্ত দুঃখ,সমস্ত যন্ত্রণা ঘুচিয়ে দিতে। রোদ মেয়েটা অনেক দুঃখী। একবার ওকে আপন করে নেয়া যায়না?
পূর্ব রোদের হাত ধরে ফেললো। কেঁপে উঠলো রোদ। ওর হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল রাখলো পূর্ব। আস্তে আস্তে একজনের হাতের মাঝে আরেকজনের হাত একদম জড়াজড়ি হয়ে গেলো। কেউই কোনো কথা বলছে না। কিন্তু একজনের বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় হচ্ছে আরেকজন সেটা ঠিকই ধরতে পারছে।
এভাবেই দুজনে চেয়ে রইলো নক্ষত্রভরা আকাশের দিকে। হাতে হাত, একইসাথে দুজনের নিশ্বাস পড়ছে। দুজনের মনে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, “আমি কি ওকে ভালোবাসি?”
পূর্ব ধীরেধীরে মুখটা একটু কাছে এগিয়ে আনলো। রোদও মাথাটা কাঁধ থেকে সরিয়ে আস্তে করে পূর্বর বুকে ঢলে পড়লো। এই প্রথম কোনো ছেলের এত কাছে চলে এসেছে ও। পূর্ব’র বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে কেমন যেন মাতাল হয়ে যাচ্ছে রোদ। এত সুখ কখনো হয়নি ওর। পূর্ব দুহাতের নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ফেললো রোদকে। রোদের মাথাটা বুকে চেপে ধরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। পুর্ব’র নিজের ও খুব সুখ সুখ লাগছে। রোদের ভারি হয়ে আসা নিশ্বাস বুকের উপর পড়ছে। দুজনের নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। পূর্ব কি বলবে বুঝতে পারছে না,খেই হারিয়ে ফেলেছে। কেউই কোনো কথা না বলে চুপচাপ জড়াজড়ি করে বসে রইলো।
রাত অনেক বেড়ে গেছে। রোদ ঘুমিয়ে পড়েছে পূর্ব’র বুকের উপর ঢলে পড়ে। ওর মাথাটা কোলের উপর নিয়ে বারান্দায় শান্ত হয়ে বসে আছে পূর্ব। এভাবেই থাকবে নাকি উঠে রুমে যাবে বুঝতে পারছে না কিছুতেই। নড়লেই তো রোদের ঘুম ভেঙে যাবে। কিন্তু এভাবেও তো থাকা যায়না। রাত বেড়ে যাচ্ছে। যদিও পুরো কটেজটাই এখন ওদের দখলে তারপরও সারারাত এভাবে বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয়না। কালকে আবার সারাদিন ঘুরতে হবে।
পূর্ব মৃদু স্বরে ওকে ডাকলো, “রোদ। এই রোদ।”
রোদের কনো সাড়া শব্দই নেই। কত শান্তিতে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। পূর্ব আবারো ডাকলো- “এই রোদ। পাগলি মেয়েটা..”
রোদ উম বলে ওর গলাটা ভালোমতো পেঁচিয়ে ধরলো। শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো পূর্ব’র। এভাবেই তো একেবারে খুন করে ফেলবে মেয়েটা। একদণ্ড শান্তি দিচ্ছেনা আবার যদি এভাবে আগলে রাখতে চায়,তাহলে তো মরণ ই। কি যে করবে ও!
রোদকে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো পূর্ব। এবার ঘুম ভেঙে গেলো ওর। পূর্ব কোলে নেয়া মাত্রই চোখটা আবারো ভিজে উঠতে শুরু করেছে। রোদের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো। পূর্ব ওকে কোলে তুলে নিয়ে রোদের রুমে চলে এলো। বিছানায় শুইয়ে দেয়ামাত্রই রোদ চোখে মেলে তাকালো। ঘরে সৌরবিদ্যুতের আলো জ্বলছে। হালকা আলোয় পূর্ব’র চোখে চোখ রেখে কেঁপে উঠলো রোদ। পূর্ব দেখলো মেয়েটির চোখে জল। এ জল হয়ত সুখের! কিন্তু তবুও ওর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অন্যরকম একটা যন্ত্রণা আঁচ করতে পারছে ও। সত্যি সত্যিই রোদকে ভালবেসে ফেলেছে বুঝতে পেরেছে পূর্ব।
রোদ অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে পূর্ব’র দিকে। ওর চোখে মায়া,এক অলৌকিক মায়া। এই মায়ায় নিমেষেই গ্রাস করে ফেলা সম্ভব। এখানে থাকলে সত্যিই ভূলভাল কিছু ঘটে যাবে আজ। পূর্ব আর কিছু না বলে রোদের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। আবেশে চোখ বুজে ফেললো রোদ। পূর্ব নিচু হয়ে এসে ওর একদম চোখের কাছে চোখ রেখে বললো, “শাড়িতে তোমাকে কি যে মায়াবী লাগে,বলে বোঝাতে পারবো না। সবসময় শাড়ি পড়ে থাকার অভ্যেস করে নিও কেমন? আর নিজের একটু খেয়াল কি রাখা যায়না? চুলগুলো এত অগোছালো করে রাখো কেন হুম? একটু আছড়ানো যায়না? এখন লক্ষীমেয়ের মতন ঘুমিয়ে পড়ো তো। মেঘ ছুতে চাইলে খুব ভোরেই উঠতে হবে কিন্তু।”
আরেকবার হাত বুলিয়ে দিলো কপালে। রোদের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সুখেই মনেহয় মরে যাবে ও। এত সুখ জীবনে কখনো বোধহয় পায়নি ও।কেউ কক্ষনো ওকে এভাবে বলেনি,এভাবে একটু ভালোবাসেনি। ও কেঁদেই চললো। সোলারের টিমটিমে আলোয় সে জল চোখ এড়ালো না পূর্ব’র। আস্তে করে চোখটা মুছে দিয়ে বললো, “আর কান্না নয় রোদ,তোমার সমস্ত যন্ত্রণা আজকের এই জলেই ধুয়ে মুছে চলে যাক। যত জমানো কষ্ট সব নির্বাসন দিয়ে যাও। এই পূর্ব আর কক্ষনো কাঁদতে দেবেনা তোমায়,মাথায় থাকে যেন।”
রোদের ইচ্ছে করছে পূর্বকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। পূর্ব’র ও ইচ্ছে করছে ঠিক একই কাজটা করতে। কিন্তু এখন ওকে একবার স্পর্শ করলে কোথ থেকে কি হয়ে যাবে কিছুই বুঝতে পারবে না। আবেগের বশে কোনো ভূল করতে রাজি নয় পূর্ব। ও আর কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। দরজাটা যাওয়ার সময় লাগিয়ে দিয়ে গেলো। রোদ বালিশ জাপটে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। কেন কাঁদছে ও নিজেও জানেনা। অরণ্য’র দেয়া অপমানের সমস্ত যন্ত্রণা আজকের চোখের জলে বেড়িয়ে এসেছে। সব কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পূর্ব বলেছে আজকের কান্নাই শেষ কান্না হোক, আজই সব যন্ত্রণা নির্বাসন দিয়ে দিতে। এত সুখ কি কপালে সইবে ওর?
বাকি রাতটা নির্ঘুম কেটে গেলো। অনেক্ষণ কাঁদার পর নানান রঙিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়লো রোদ। এদিকে পূর্ব’র ও বাকি রাতটা খুব ছটফটানির মধ্য দিয়ে কেটে গেলো। এত অস্থিরতা কিসের বুঝতে পারেনা ওরা।
৭০.
ভোরবেলা মেঘালয়ের ডাকে চোখ মেলে তাকালো মিশু। মেঘালয় ওর ডান দিকে শুয়ে আছে আর বারবার সেদিক থেকে ডাকছে। মিশু চোখ না মেলেই বললো, “সারারাত জ্বালিয়েছো। এখন একটু ঘুমুতে দিবা প্লিজ?”
মেঘালয় কোনো বারণ শুনলো না। মিশুকে জোর করেই বিছানার উপর তুলে বসালো। মিশু বিরক্তমুখে চোখ কচলে যেই ওর দিকে তাকাতে গেছে,অমনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ গেলো। সাদা সাদা অজস্র মেঘের ভেলা পালা করে ছুটে আসছে, চারদিকে শুধু মেঘ আর মেঘ। জানালা থেকে একটু দূরে ঘরের নিচে শুধু মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। মনেহচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। কিন্তু জানালা থেকে অনেক নিচে মেঘগুলো। ছোঁয়া যাচ্ছেনা। এত কাছ থেকে মেঘ দেখতে পারবে সেটা কল্পনাও করেনি মিশু। সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে এমন মেঘের খেলা দেখলে মনটা কেমন যেন করে ওঠে। মিশু বিস্ময়ে কথাই বলতে পারলো না।
মেঘালয় তাড়া দিয়ে বললো, “সারপ্রাইজড?”
মিশু বললো, “হুম। সত্যিই অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে পুরো পাহাড় জুরে।”
– “মাত্র সকাল হলো। সূর্য উঠবে একটু বাদেই। মেঘ ছুতে চাইলে এক্ষুনি আমাদের বেড়িয়ে পড়া দরকার মিশু। আমি সবাইকে ডেকে এসেছি, তুমি একটু রোদকে ডেকে দাও দ্রুত। ওর বোধহয় ঘুম ভাঙেনি।”
মিশু তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নামলো। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ছুটলো রোদের ঘরের দিকে। দরজা খোলাই ছিলো। এসে রোদকে ডেকে তুললো ঘুম থেকে। রোদ আড়মোড়া ভেঙে বললো, “এত সকালে ডাকছো কেন মিশমিশি?”
মেঘালয় মিশুকে যেভাবে চমকে দিয়েছে মিশু ঠিক সেভাবেই রোদকে চমকে দিলো। বিছানায় বসে এত কাছে মেঘ দেখতে পেয়ে রোদ বেশ চমকালো। খুশি হয়ে বলল, “ইস কি সুন্দর মেঘ!”
মিশু একটু হেসে বললো, “রাতে ঘুম হয়েছে বলে তো মনেহয় না। তাইনা?”
রোদের সবকিছু মনে পড়ে গেলো। ও লাজুক ভঙ্গিতে বললো, “উম।”
– “মেঘ বললো পূর্বকে রাত দুটার দিকে তোমার রুম থেকে বেরোতে দেখেছে। তো, কতদূর এগোলো? ঠোঁটে ঠোঁটে কথা হলো? নাকি আরো বেশি?”
রোদ লজ্জায় লাল হয়ে বললো, “উহু সেরকম কিছুই না। পূর্ব খুব ভালো, খুবই ভালো।”
– “হু,এবার ওঠো। বাকিটা পরে শুনবো। এখন না গেলে আর মেঘ ছোঁয়া হবেনা।”
– “আচ্ছা উঠছি। মিশু,তোমার আকাশী রঙের শাড়িটা আমায় দেবে পড়তে?”
মিশু ভেবেছিলো আজকে আকাশী রঙের শাড়িটা পড়বে। কিন্তু রোদের সদ্য ভালোবাসাবাসি শুরু হচ্ছে ভেবে ও বললো, “আচ্ছা আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। ভাইয়া বুঝি শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে বলেছে?”
– “হুম।”
– “যাক। দুজনের একটা গতি হলো। বলেছিলাম না, একজনের মাথা ঠিকই ঘুরে যাবে? গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে।”
রোদ হাসলো। সেই সিলেটে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই তো ওদের মধ্যে একটু একটু অনুভূতি জন্মাচ্ছিলো। এখন সেটা দুজনেই ফিল করতে শুরু করেছে। লাজে রাঙা হয়ে উঠলো মুখটা।
মিশু ওর শাড়িটা রোদকে দিয়ে এসে জামা পড়ে নিলো। পাহাড়ে ট্রেকিং করতে হবে। শাড়ি পড়ে কিভাবে রোদ ট্রেকিং করবে সেই ভালো জানে। তবে পড়তে চেয়েছে যখন বাধা তো দেয়া যায়না। মিশু নিজের রুমে এসে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো।
কটেজের বাইরে এসে সবাই একত্রিত হলো। পূর্ব’র চোখে মুখে এখনো ঘুম লেগে আছে। ছেলেটা যে সারারাত ঘুমায়নি,সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রোদের সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনের হার্টবিট দুম করেই বেড়ে গেলো। রোদ কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো বারবার। প্রেমে পড়ার প্রথম অনুভূতি বুঝি এমনই হয়!
সবাই বেড়িয়ে পড়লো কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। ওদের কটেজ থেকে পাহাড় বেশি দূরে নয়। তবুও লেগুনায় বেশ খানিকটা পথ যেতে হলো। তারপর শুরু হলো ট্রেইল। রোদ শাড়ি তুলে ধরে পাহাড়ে উঠছে। পাহাড়ের দুদিকে দুটো পথ চলে গেছে। সায়ান ও আরাফ সবার আগে আগে হাঁটছিলো। ওরা বামদিকে যাচ্ছে দেখে মেঘালয় বললো, “আগে ডানদিকে চল। এদিকে ভিড় কম থাকবে। আর মেঘ ও দেখা যাবে ভালোমতো।”
ওরা আবার ফিরে আসলো। দুজনকে খুবই ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে। সবাই কাপল হয়ে গেছে আর ওরা দুজন শ্যাওলার মত ঝুলে আছে ওদের পিছনে। ভালো দেখায় কি? আরাফ তো সবার সামনে বলেই ফেললো, “নেক্সট টাইম থেকে বউ ছাড়া ট্যুরে যাবোনা।”
সবাই হেসে ফেললো ওর কথা শুনে। মেঘালয় মিশুর হাত ধরে ফেলছে বারবার, মিশুকে নিয়ে ওর বড্ড দুশ্চিন্তা হয়। কিছুক্ষণ ট্রেকিং করেই পৌছে গেলো কংলাক পাহাড়ের চূড়ায়!
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে লাগলো সবাই। এখানে দাঁড়িয়ে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনেহচ্ছে পুরো পৃথিবীটাই দেখছে ওরা। এত বিশাল প্রান্তর সামনে। বিশাল মহাশূন্য আর রাশি রাশি মেঘ। আসার পথেই কুয়াশার মত মেঘেরা গা ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। মিশু কেবলই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে।
মেঘালয় খেয়াল করে দেখলো এক রাশি তুলোর মত মেঘ উড়ে আসছে। ও ছুটে এসে মিশুর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে সেখানে গিয়ে দাড় করালো। মিশু মুগ্ধতার চোটে কথাই বলতে পারছে না। এমন সাদা মেঘ ও কক্ষনো দেখেনি। মেঘেরা উড়ে আসছে ওদের দিকে। মিশু উত্তেজনায় কাঁপছে। মেঘালয় ওর পিছনে দাঁড়িয়ে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। মিশু মেঘালয়ের বুকে পিঠ ঠেকে দাঁড়ালো। মেঘালয় ওর পিছনে দাঁড়িয়ে হাত দুটো মিশুর হাতে তুলে নিয়ে সামনে বাড়িয়ে দিলো। মিশু উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মেঘালয়ের বুকের উপর সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশাল আকাশ আর এই মহাশূন্যের মাঝে উড়ে আসা মেঘ দেখে ওর মনেহচ্ছে নিজেই বোধহয় আকাশে উড়ছে। মেঘালয়ের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে আবেশে চোখ বুজে ফেললো মিশু। গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ এসে শরীর ফুঁড়ে ঢুকে যেতে লাগলো। দুজনকে একসাথে আলিঙ্গন করছে মেঘ। মেঘ স্পর্শ করার অনুভূতি এত সুন্দর হতে পারে মিশু কখনো কল্পনাও করেনি। অজান্তেই ওর দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে। বহু প্রতিক্ষীত সেই অনুভূতি!
মেঘের স্পর্শে চোখ বুজে ফেলেছে ও। চোখ মেলেই আবার মিটমিট করে বন্ধ করে ফেললো। মনেহচ্ছে একটু গাঢ় কুয়াশা। শীতল এক অনুভূতি! ভেতরে কাঁপন ধরে গেছে একেবারে। মেঘেদের দল উড়ে চলে যাওয়ার পর মিশু পিছন ফিরে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। সায়ান ওদের মেঘের ভেতরের ছবি তুলে নিয়েছে। কখনো এরকম মেঘ ও দেখেনি। আজ মিশুর জন্যই বোধহয় মেঘেরা তার পথ ভূলে এ পথে এসেছে এভাবে। রাজকন্যাকে দেখতেই এসেছে ওরা। নয়ত মেঘগুলো কত নীচে, এত উপড়ে সবসময় আসেনা ওরা।তবে উপরে সব জায়গায় কুয়াশার মতন মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মিশু এখনো কাঁপছে। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে ওকে ধরে আছে। মেঘালয় এই আনন্দটুকু দেয়ার জন্যই এত আয়োজন করে মিশুকে নিয়ে এসেছে এখানে। একেই বলে ভালোবাসা!
মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে মেঘালয় বললো, “ভালোবাসি মিশু,প্রচণ্ড ভালোবাসি।”
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here