#অনূসুয়া
#পর্ব১০
#রাউফুন
শেষ পর্যন্ত সুসমার জেদের কাছে হার মেনে মেরাজ চলে যেতে বাধ্য হয়৷ সব দিক দিয়েই তো তাকে ভাবতে হবে। তার কথা শুনে তার বাবা মা এসেছেন সুসমাকে দেখতে৷ কিন্তু তাই বলে তো এই না যে তাদেরকে কোনো রকম অসম্মান হতে দেবে। মেরাজ বাবা মায়ের কথা চিন্তা করেই গতদিন ফিরে গেছিলো৷
রোজকার মতো মেরাজ রাতে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেনি আর। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়াই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এটাই ভালোবাসা? মনে মনে তাচ্ছিল্য করলো সুসমা। অবশ্য এতে তার কি? সে-তো খুশি এখন থেকে, বেঁচে গেছে। অফিসের টুকটাক কাজ করে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলো সুসমা। কিন্তু বার বার সেই মেরাজের কথায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সম্পুর্ন ভাবে লোকটার কাজ কর্ম ভুলে থাকা যাচ্ছে না।
সুসমা অফিসে ঢুকতেই রিক্তা তাকে হাই দিলো৷ এগিয়ে আসলো তার দিকে। রিক্তার মুখ খানা শুকনো লাগছিলো খুব। সুসমা তার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। মুখের উজ্জ্বলতা হারিয়েছে কেমন! রিক্তা সব সময় হাসি খুশি থাকে তবে আজ কি হয়েছে?
‘গতকাল আসোনি যে!’ শুধালো রিক্তা।
‘আর বলো না সে অনেক কথা। আগে তোমার কথা বলো। মুখখানি ওমন শুকনো কেন?’
রিক্তার মুখ টা আরও শুকিয়ে গেলো। মন খারাপ করে বললো, ‘তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। আজকে একটু সময় হবে?’
‘হ্যাঁ হবে না কেন? আমি অপেক্ষা করবো তোমার! এখন কাজ করো! অফিসে গল্প করা উচিত না। রা’ক্ষ’স স্যার পছন্দ করেন না জানো তো!’
‘মিস সুসমা, রিক্তা এটা অফিস আপনাদের আড্ডা, হাসাহাসির জায়গা নয়! কাজের বাইরে কথা বলা আমার পছন্দ না।’
একটা কর্কশ কন্ঠে দুইজনেই মিইয়ে গেলো। রিক্তা সুরসুর করে তার জায়গায় গিয়ে বসলো৷ আলিফ শেইখ এরশাদ এগিয়ে এলেন। মোস্ট হ্যান্ডসাম এলিজিব্যাল ম্যান। তার গাম্ভীর্যের সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তার তেজ সকলকে কাঁপিয়ে দেই। তার প্রতিটি পদক্ষেপ , কাজ হবে একদম নির্ভূল। তীর্যক চাহনী, কথা বলার ধরণ এক কথায় নজর কাড়ার মতো। তার মুখের ফিচার এতোটাই নিখুঁত যে কেউ একবার তাকালে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাবে। সুসমা বসে কম্পিউটার ঘাটছিলো। তার দৃষ্টি কম্পিউটারে নিবদ্ধ! আলিফ তার ডেস্কে হাতের বারি দিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
‘মিস সুসমা আমি যে আপনাকে অবলোকন করছি দেখতে পাচ্ছেন না?’
সুসমা নিজের ডেস্কের বসার স্থান থেকে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রাখলো। বললো,
‘জ্বী স্যার বলুন, কিছু বলবেন?’
‘কাল অফিস আসেন নি কেন? আর আপনার গত কদিনের কাজ কর্ম ঠিক ঠাক হয়নি। এভাবে কাজ করলে আপনাকে ফায়ার্ড করতে বাধ্য হবো। রিমেম্বার মাই ওয়ার্ড! আর প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট হলে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।’
সুসমা শুকনো ঢুক গিলে মাথা নাড়লো। আলিফ তীব্র রাগে বললো, ‘মুখে কি খিল দিয়েছেন? কথা বের হয় না? আমি এতো গুলো কথা বললাম শুধু মাথা নাড়লেন! একে তো ভুলভাল প্রেজেন্টেশন প্রেজেন্ট করেছেন তারপর আবার নিয়মিত আসেন না অফিসে!’
‘স্যরি স্যার৷ আসলে আমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিলো তাই, গতকাল….!’
‘আমি আপনার বাড়ির কথা জানতে চাইনি। আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেবেন। কাজ কমপ্লিট করা চাই লাঞ্চ টাইমের আগে।’
আলিফের হুংকারে কেঁপে উঠলো সুসমা। ভেতরে ভেতরে ফুসছে সে। বসের হঠাৎই এমন রেগে যাওয়ার মানে ধরতে পারলো না সে। আলিফ তা অবলোকন করে দেখতেই বললো, ‘ফোস ফোস করে লাভ নেই।’
‘কই না তো স্যার! কোথায় ফোসফাস করছি?’
সুসমার এমন বোকা বোকা প্রশ্নে আলিফের হঠাৎই হাসি পেলো। কিন্তু সেটা হলে তার গম্ভীর্যের বাইরের রূপ সামনে আসবে। গম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,
‘ভেতরে ভেতরে ফোসফাস করলে আপনার নাকের পাটা ফুলে যায় জানেন? আর হ্যাঁ এখানে কাজ করতে হলে আপনাকে আমার দেওয়া রুলস রেগুলেশন মেনে চলেই কাজ করতে হবে। নতুবা…!’
সুসমা আলিফ কে কথা সম্পুর্ন করতে না দিয়ে বিক্ষিপ্ত গলায় উত্তর দিলো, ‘নতুবা, নতুবা চাকরিটা থাকবে না তাই তো? ওকে ফাইন করবো না আমি এই চাকরি!’
আলিফের চোয়াল শক্ত হলো। তার মুখের উপরে এই পর্যন্ত কেউ এভাবে কথা বলেনি। অথচ এই মেয়েটার সাহস দেখে সে অবাক হয়ে গেছে৷ যেখানে সে প্রায় সবার চোখে আটকায়, তাকে দেখে সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের দৃষ্টি আটকে থাকে সেখানে এই মেয়েটা তার দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত দেখে না৷ বরং সে নিজেই অনেক বার সুসমাকে দেখেছে। বোঝার চেষ্টা করেছে সুসমা তাকে আড়ালে আবডালে দেখে কি না। সে তীব্র আক্রোশে বললো,
‘ঠিক আছে। রেজিগনেশন লেটার টা সময় মতো পাঠাবেন এই মাসের শেষে। আপনার মতো ইম-পাংকচুয়াল স্টাফ আমার চাই না৷’
সুসমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আলিফের যাওয়ার পানে। রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সুসমা কড়া ভাবে বলে ফেলেছে। অনেক কষ্টে কাজ কমপ্লিট করে লাঞ্চের আগে সুসমা। রিক্তার সঙ্গে সুসমা এক সাথে ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো। রিক্তা মন খারাপ করে বললো, ‘তোমার কি দরকার ছিলো সুসমা, স্যারের মুখের উপর বলা যে চাকরি করবে না। এতো ভালো পজিশন আর এতো ভালো জব তুমি পাবে? জানোই তো স্যারের মেজাজ একটু চড়া। শান্ত ভাবে স্যরি বলে দিতে!’
‘একটা মানুষ এতোটা রেস্ট্রিকশন কিভাবে দিতে পারে? আমরা কি কাজ করি না? এমনি এমনি মাইনে দেন? সব সময় এতো কড়াকড়ি আমার ভালো লাগে না। সহ্য করতে না পেরে বলে ফেলেছি। তাছাড়া লোকটা একটা বে’য়া’দ’ব, একদম ম্যানার্সলেস। সদাচরণ নেই বললেই চলে। অসভ্য লোক!’
হঠাৎই রিক্তা দাঁড়িয়ে সুসমাকে ইশারায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সুসমা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো, ‘ হঠাৎই দাঁড়িয়ে পরলে যে? কি হয়েছে বলো তো? তুমি কি এখানেও ঐ লোকটার ভয় করছো? মানুষ রূপে আস্তো এক রাক্ষস লোকটা।’
‘আমি কি? আরেকবার রিপিট করুন মিস সুসমা!’
কন্ঠের মালিককে চিনতে পেরে জমে গেলো সুসমা। এখনই না আবার সিংহের ন্যায় গর্জে উঠে। তার মানে রিক্তা এতক্ষণ তাকে ইশারায় এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। সুসমা কাচুমাচু হয়ে ঘুরে মুখাবয়ব স্বাভাবিক করে বললো!
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার! কিছু বললেন স্যার?’
আলিফ গলার টাই টা ঢিলে করে শার্টের হাতা ফোল্ড করে এগিয়ে এলো আরও একটু। সুসমা ভয়ে জমে গেলো একদম। বললো, ‘আ-আপনি এগিয়ে আসছেন কেন?’
‘আমি বেয়াদব? অসভ্য? রা’ক্ষ’স আমি? আপনার লজ্জা করে না একজন সম্মানিত ব্যক্তির সম্পর্কে এভাবে আড়ালে কন্ডেম করতে?’
সুসমা চোখ উলটে বিরবির করলো, ‘উম সম্মানিত লোক না ছাই। ব্যবহার এর শ্রী দেখলে তো অসম্মান ছাড়া কিছুই আসে না।’
‘কিছু বললেন?’
‘নাহ স্যার, স্যরি স্যার!’
আলিফ গলার স্বর আবারও গম্ভীর করে বললো, ‘আপনার কাজ শেষ হয়েছে?’
‘ইয়েস স্যার!’
‘লাঞ্চ শেষ করে আমার ডেস্কে আসুন। কাজ বুঝিয়ে দেবেন!’
‘ওকে স্যার!’
আলিফ চলে যেতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সুসমা। রিক্তার অবস্থা এমন ছিলো যে সে পারলে এক লাফে আলিফ কে ক্রস করে পালিয়ে যেতো। সুসমা ঠিকই বলে যেনো আস্ত একটা রা’ক্ষ’স!
সুসমা শান্ত হয়ে বসলো শুধালো,’এবার তোমার কথা বলো রিক্তা। কি হয়েছে তোমার? চোখ মুখের কি হাল করেছো দেখেছো?’
রিক্তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি আমার হাসবেন্ড শান্তকে ডিভোর্স দিতে চাই!’
‘হোয়াট?’ চমকে উঠে সুসমা।
‘ঠিকই শুনেছো তুমি! আমি জানতে পেরেছি শান্ত অন্যত্র সম্পর্কে লিপ্ত। যা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করাই আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে!’
‘তুমি সত্যতা যাচাই করেছো?’
‘হ্যাঁ আমি ধরেছিলাম। ওঁর ফোনে খুবই নোংরা আর বাজে ম্যাসেজ ছিলো ঐ মেয়েটার সঙ্গে! আমি ভাবতেও পারছি না শান্ত আমাকে এভাবে ঠকাচ্ছিলো এতোদিন। যে মানুষটা আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না সে আমাকে ছাড়া….’
বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো রিক্তা। সুসমা রিক্তার হাত চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। সে এই সময় টা পার করে এসেছে তাই সে জানে এর ব্যথা কতটা। শান্ত কন্ঠে বললো, ‘রিক্তা, শান্ত হও। এখানে সবাই তোমাকে দেখছে। আমরা আলাদা ভাবে কথা বলবো এই বিষয়টা নিয়ে। রিল্যাক্স!’
রিক্তা চোখ মুছে বললো,’ আমার সঙ্গে এমন কেন করলো? দুনিয়ায় সব পুরুষ মানুষ এমন কেন হয়? ঘরে বউ রেখে পরকীয়া করে!’
‘ভুল বললে, সব পুরুষরা এক রকম হয় না। অনেক পুরুষ মানুষ আছে যারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন নারীতেই আবদ্ধ থেকে আজীবন কাটিয়ে দেই। এক নারীতে আসক্ত পুরুষ এখনো অহরহ। চরিত্রহীন পুরুষ আর শুদ্ধ পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখো।’
বলতে বলতেই সুসমার মেরাজের কথা মনে হলো। লোকটা অফিসের আশেপাশেও আসেনি আজ। রোজ যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানের জায়গাটা ফাঁকা৷ রিক্তা বললো, ‘আমি শান্তর সঙ্গে কথা বলেছি এই বিষয়ে। ওঁ আমাকে বলেছে থাকতে হলে এভাবেই থাকতে হবে! মানে ভেবেছো? ওঁ বাইরে মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করবে সেসব মেনে নিয়ে আমাকে ওঁর সঙ্গে থাকতে হবে!’
‘তোমার যদি শান্তর সঙ্গে কথা হয়ে থাকে তবে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেও। আমার মনে হয় না তোমার এখনো শান্তর সঙ্গে থাকা উচিত। জীবনে আর যায় হোক চরিত্রহীন পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করো না। না হলে জীবনটা আমার মতো হবে। আমার মতো আজীবন পস্তানোর মতো ভুল করো না!’
সুসমার সঙ্গে বিষয় টা শেয়ার করে রিক্তার কিছুটা হালকা লাগছে। লাঞ্চ টাইম শেষ হতেই ওঁরা উঠে পরলো। রিক্তার কথা শুনে সুসমার আর খেতে ইচ্ছে করেনি। তাই খাওয়া হলো না দুইজনের একজনেরও। ওঁরা দুইজনই উঠে গিয়ে কাজে লেগে পরলো। না-হলে কখন না জানি আবার রাক্ষস বস এসে শাসিয়ে যায়!
#অনূসুয়া
#পর্ব১১
#রাউফুন
রোজ রোজ আলিফের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ সুসমা ঠিক করলো এই জব টা সে সত্যিই ছেড়ে দেবে৷ ভেবে নিলো নতুন জব এপ্লাই করে তারপর ছাড়বে জবটা।
সুসমা অফিস গিয়ে নিজের কাজ করছিলো। হঠাৎই তার জানালার বাইরে রাস্তায় চোখ গেলো। কালো শার্ট পরিহিত আবছা আবছা একজনকে দেখা যাচ্ছে। চমকপ্রদ হয়ে সুসমা নিজের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে জানালা দিয়ে ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখলো সত্যিই মেরাজ দাঁড়িয়ে আছে। সুসমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠলো অজান্তেই। সে গিয়ে জানালার কাচ উপরে উঠিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো ঐটা আসলেই মেরাজ। মানুষটা কি এই ক-দিনে অনেক শুকিয়ে গেছে? কেমন জীর্ণ শীর্ণ শরীর। এলোমেলো চুল। অসুখ করেছিলো কি? তার কি উচিত ছিলো একবার খোঁজ নেওয়ার? সেদিনের পর মেরাজের ম্যাসেজ আসেনি।
‘মিস সুসমা কাজ বাদে আপনি জানালার বাইরে কি দেখছেন?’
সুসমা ভুলেই গেছিলো তার কড়া বসের কথা। সে পেছনে ফিরে বললো, ‘ আমার জামাই দেখি, দেখবেন?’
আলিফ ভ্রু কুচকে বললো,’হোয়াট? মশকারা করেন আমার সঙ্গে? ডোন্ট ফরগেট হাহ্ আ’ম ইউর বস!’
‘তো আমি কি জানালার কাছে যেতে পারি না?’
‘কাজ রেখে যেখানে সেখানে যাওয়া রুলসের বাহিরে! জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জামাই দেখা নয়৷’
‘আমি তো অপ্রয়োজনে যায়নি স্যার।’ জবাব দিলো সুসমা।
‘কাজ ফেলে জানালার কাছে কি প্রয়োজন আপনার?’
‘কফ্-থু থু ফেলছিলাম স্যার।’ যদিও বিন্দু মাত্র সত্যি নয় এই কথাটা। তবুও বললো সুসমা। তাছাড়া এই ঘাড় ত্যাড়া গম্ভীর বসের সঙ্গে এভাবেই কথা বলবে সুসমা এতে যা হবার হবে।
‘ছেহ্! মানে টা কি? এতোটা অপরিষ্কার কেন আপনি?’
‘স্যার, কফ্-থু থু কি আমি অফিস রুমেই ফেলতাম? তাহলে কি সেটা খুব পরিষ্কার এর মতো কাজ হতো?’
‘ইয়াক, কি কথা! আপনি এমন পঁচা? ছিঃ!’
‘এমন ভাবে বলছেন যেনো জীবনে আপনার নাক দিয়ে কফ্, স্বর্দি পড়েনি, স্বর্দি-জ্বর হয়নি। আশ্চর্য! নাকি আপনার নাকের ডগায় রাগে ভরা জন্য জ্বর স্বর্দি ভয়ে পালিয়ে যেতো লেজ গুটিয়ে?’
‘আমি আপনার মতো অপরিষ্কার না!’
আলিফ সুসমার দিকে তাকিয়ে থেকে ইয়াক ইয়াক করে নিজের ক্যাবিনে চলে গেলো। একটা মেয়ে এতোটা আন-হাইজেনিক কি করে হতে পারে?
অফিস শেষে ক্লান্ত শরীর খানা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো সুসমা। আজ রিক্তার ছুটি ছিলো। রিক্তার বাড়িতে অশান্তি চলছে। এমতা অবস্থায় অফিসে এসে খিটখিটে বসের পীড়া সহ্য হবে না। তাই সুসমাই বলেছিলো রিক্তাকে ছুটি নিতে। রিক্তা ডিভোর্স পেপারে সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে তার হাসবেন্ডের বাসায়। ভীষণ ঝুট ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে রিক্তাকে। সুসমা রুমালে ঘাম মুছে তাকিয়ে দেখলো মেরাজ তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে ত্রস্থ পায়ে এগিয়ে গিয়ে সরাসরি বললো, ‘আমি তো ভাবলাম আপনি আমার পিছু ছেড়ে দিয়েছেন। তা এতো দিন পর কোথা থেকে উদয় হলেন?’
সুসমা হাঁটছে, সাথে মেরাজও তার সঙ্গে পা মেলাচ্ছে। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে লিখলো, ‘আপনি কতটা নিষ্ঠুর মানবী জানেন?’
সুসমা ম্যাসেজ পড়ে বললো,’নিষ্ঠুরই আমি,আগে বুঝেন নি?’
‘নিষ্ঠুর হলে না বুঝবো। উপরে উপরে মিথ্যা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে থাকেন শুধু। নিষ্ঠুর শব্দটা আপনার জন্য আংশিক সত্যি, না না আংসিক নয় ক্ষনিকের জন্য সত্যি।’
‘হঠাৎ আপনি সম্বোধন?’
‘পরনারীকে তো আপনিই বলতে হবে। আগে মনে হতো আপনি আমার খুব কাছের একজন তাই তুমি বলতাম। এখন মনে হয় না। এখন মনে হয় আপনি আমার থেকে আলোকবর্ষ দূরে। ক্রমশ দূরে সরেই যাচ্ছেন।’
‘বাব্বাহ, অনেক কথা শিখেছেন দেখছি। অসুখ করেছিলো?’
‘হ্যাঁ, সেদিন রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে বেজায় জ্বর চেপে বসলো শরীরে। জ্বরে কাহিল আমি বিছানা ছাড়তে পারিনি। আপনি আমায় মিস করছিলেন?’
সুসমা হাঁটা থামিয়ে, কাষ্ঠ হেসে বললো, ‘নাহ! আপনাকে মিস করার মতো তো কিছু নেই।’
মেরাজ শুকনো হেসে মাথা নাড়লো। যার অর্থ ‘হ্যাঁ তাই তো কে আমি? কেন মিস করবে?’ সুসমাও বলতে চাইছিলো, ‘যাকে ভুলতেই পারলাম না এক মুহুর্তের জন্য তাকে কি মিস করতে হয়?’
দুজনেই নিরবে হাঁটছিলো। পাশা পাশি হেঁটে যেতে যেতে বললো,
‘জানেন মেরাজ, আমার প্রাক্তন আমাকে কি বলেছিলো? বলেছিলো, আমি যদি তাকে ডিভোর্স দিয়ে আমার প্রেমিককে বিয়ে করি তবে নাকি আমি এক বাপের প**দা না। খুব বাজে ভাবে বলছিলো, কলিজা ছিদ্র করা কথা খানা। আর রাশেদ প্রেমিক বলতে আপনাকেই বুঝিয়েছিলো।’
‘ওহ তার মানে এই কারণে তুমি আমায় রিজেক্ট করছো?’ লিখলো মেরাজ।
‘নাহ, আপনি কি আমার প্রেমিক? এই কলঙ্কিত জীবনে আপনার মতো শুদ্ধ পুরুষকে জড়াতে চাই না। আপনার উচিত এবার নিজেকে নিয়ে ভাবা। অনেক হয়েছে আর নয়। বাবা মায়ের পছন্দ মতো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিন! আমার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিজের গায়ে দাগ লাগাবেন না।’
‘তা সম্ভব না, আমি যদি তোমার কাছে শুদ্ধ পুরুষ হয়ে থাকি তবে জেনে নাও তোমার সঙ্গে নিজেকে জড়ালে যদি হাজারটা দাগ নিজের চরিত্রে লাগে তবে তাই সই।’
ম্যাসেজ পড়ে সুসমা বললো, ‘আপনি বৃথা জেদ করছেন।’
‘জেদ নয় ভালোবাসা বলো। এই ভালোবাসা মৃত্যুর আগ অব্দি থাকবে।’
‘আপনার এই কথাটি অভ্রান্ত সত্য, কিন্তু তবু কেন আপনার চৈতন্য হয় না?’
‘আমার চৈতন্যে শুধুই তুমি! তাই অন্য কোনো কথায় কিছু হয় না।’
‘তাহলে আপনি কি করবেন? বিয়ে করবেন না, এভাবে ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াবেন?’
‘অপেক্ষা করবো তোমার। আর বিয়ে করেই বা লাভ কি? যাকে বিয়ে করবো আমি তো সেই মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবো না। তাহলে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে কি লাভ বলো তো?’
‘আপনার অপেক্ষা যদি কোনো দিনই না শেষ হয় তখন কি করবেন?’
‘তোমায় ভালোবাসবো আমৃত্যু, আজীবন। আর এটাই হবে আমার স্বার্থকতা!’
সুসমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মেরাজকে সে কিভাবে বুঝাবে সে নিরূপায়। তার কোনো উপায় নেই। তাকে কোনো ভাবেই গ্রহণ করতে পারবে না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা ওঁদের বাড়ির কাছে চলে এলো। ভেতরে যাওয়ার আগে সুসমা এক পলক মেরাজকে দেখে বললো, ‘ওষুধ খাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, খেতে চাইনি, মা বোন, বৃদ্ধ বাবার দিকে তাকিয়ে হলেও আমাকে সুস্থ থাকতে হয়। এই মানুষ গুলোর যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার যেমন তুমি ছাড়া কেউই নেই তেমনই আমি ছাড়া ওঁরা নিঃস্ব, কেউ নেই। আমার কিছু হলে যে ওঁরা বাঁঁচবে না।’ শেষ ম্যাসেজ টা মেরাজ নিজের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে লিখেছিলো। সুসমা ভেবেছিলো এই প্রশ্নের সে উত্তর পাবে না। ম্যাসেজ পড়ে হতাশার শ্বাস ফেলে ঘরে গিয়ে ধাম করে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।
•
‘মেরাজ বাবা, আমাদের দিকে তাকিয়ে হলেও বিয়েটা করে নাও। আমরা তো তোমার বাবা মা, তোমাকে এভাবে দেখতে কি ভালো লাগে বলো? তাই আমরা ভাবছি তোমার জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখবো!’
‘আব্বা, তোমরা ভাইয়াকে প্লিজ এই বিষয়ে কিছু বলিও না। ভাইয়া সুসমা আপুকে ছাড়া আর কাউকে মানতে পারবে না।’
‘সুসমা, সুসমা, সুসমা! ঐ মেয়েটা তো ওঁর ভালোবাসার দাম দিচ্ছে না। তবে ওঁর পেছনে কেনো পরে আছে? আমাদের কি ইচ্ছে নেই নাতী নাতনীর মুখ দেখার? আমরা মরে যাবো, তবুও কি নাতী নাতনীর মুখ দেখে যেতে পারবো না?’
বাবা মায়ের কথা শুনে নির্বিকার স্বভাবে পা চালিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো মেরাজ। সর্বক্ষণ একটা বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।
‘এই জন্যই তো আমি আপনার ছেলের থেকে দূরে আছি আন্টি। উনি যদি আমাকে বিয়ে করেন তবে কখনোই আপনারা নাতি নাতনীর মুখ দেখতে পারবেন না। আমি কখনোই মা হতে পারবো না।’
‘সুসমা আপু তুমি এখানে?’ মেরাজের বোন এগিয়ে এসে শুধালো।
‘হ্যাঁ সেদিন বোধহয় তোমরা এই স্বর্ণের চেইন টা ফেলে এসেছিলে। এটাই দিতে এলাম।’
‘আমরা চেইন টা ফেলে আসিনি। তোমার সঙ্গে মেরাজের বিয়েটা পাকাপোক্ত করতেই নিয়ে গেছিলাম কিন্তু সেটা না হলেও আমার ছেলে ওটা তোমার জন্য রেখে এসেছিলো।’ মেরাজের মা বললেন।
‘উনি কি পা’গ’লা’মি করছেন উনি বলুন তো। এই নিন চেইন টা রাখুন। এতো দামী জিনিস কেউ রেখে আসে! আজ হঠাৎই মা বললো আপনারা এটা দিয়ে এসেছেন আমার জন্য। যেহেতু আমাদের বিয়েটা হওয়া সম্ভব নয় সেহেতু এটা ফিরিয়ে দিতে এলাম। আপনারা বরং নতুন বউকে দিয়ে দেবেন।’
সুসমার ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। মেরাজের ম্যাসেজ।
‘এই বাড়িতে অন্য কোনো মেয়ে বউ হয়ে আসবে না সুসমা। তুমি ছাড়া আমার বৌ অন্য কেউ-ই হতে পারে না৷ আর চেইনটা আমিই রেখে এসেছি, তুমি আমার না হও, কিন্তু আমার দেওয়া জিনিস টা তো নিতেই পারো।’
সুসমা তাকিয়ে দেখলো মেরাজ দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের দরজার সঙ্গে হেলান দিয়ে৷ তাকে দেখে হাত নেড়ে হাসলো। তার ঠোঁটে বিদ্যমান সুন্দর হাসিটি সুসমারে হৃদয়ে কিসের যেনো একটা দোলা দিলো। হঠাৎই মনে হলো তার হৃদয়ে নতুন কিছুর সঞ্চার হচ্ছে, নতুন কিছু অনুভূতির আবির্ভাব হচ্ছে। সেটা যে মেরাজকে ঘিরে তা বুঝতে সময় লাগলো না সুসমার। মনে হলো এই হাসি দেখার অধিকার একমাত্র তার। শুধুই তার, অন্য কারোর না। অন্য কোনো মেয়ের জন্য মেরাজ এভাবে হাসুক সে চাই না। তার খুব হিংসে হবে তাহলে। কেন হিংসে হবে? কোনো উত্তর পায় না সুসমা।
#চলবে
#চলবে