অনূসুয়া পর্ব -১২+১৩

#অনূসুয়া
#পর্ব১২
#রাউফুন

(অতীত)

পঞ্চাশ গজ দূরে কাত হয়ে পড়ে আছে এক তরুণী। একটু আগে জঙ্গলের সামনে রাস্তার ধারে দেখে এসেছিলো সুসমা। মেয়েটির মৃ’ত লাশ পেছনে ফেলে এসে সুসমা সেই ধুলো মাখা জঙ্গলে-ঘেরা টিলার উপর দিয়ে হেঁটে সামনে এগোতে লাগলো। হঠাৎই সে থেমে গেলো। নিঃশব্দে মোটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পরলো সে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গলা চৌচির হয়ে মরুভূমির ন্যায় হয়ে গেছে একদম। তৃষ্ণায় ধুঁকছে সে। সে লক্ষ্য করলো ধুলোর ওপর বসে কুকাচ্ছে একটা বুড়ো। আর জঙ্গলের মাঝ বরাবরই যে মাটির রাস্তাটা, সেই রাস্তার ঠিক মাঝখানে কুড়ি একুশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটাকে ঘিরে রেখেছে তিনজন টগবগে জোয়ান। মেয়েটির হাত, পা রশিতে বাঁধা। চোখের অশ্রুতে টইটম্বুর আঁখিতে ছেয়ে আছে মুখের আদল খানি। এলোমেলো চুল ঘাম আর চোখের জলে ভিজে একাকার। হাত পা ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটি। প্রাণের ভয়ে তার চোখে আকুতি, কি নিদারুণ ভাবে তার প্রাণ ভিক্ষা চাইছে তার চোখ দুটো। সুসমা সহ্য না করতে পেরে শাড়ীর আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে নিলো। কোমড়ের কাছায় রাখা ধাঁ’রা’লো ছু’রি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে সেই ধুলো মাখামাখি হয়ে থাকা বুড়োটা তাকে টেনে ছেচড়ে একটা ছোট্ট কুঠুরিতে নিয়ে গেলো। ভারী জঙ্গলের আড়ালে সেই কুঠুরি এতোটা ছোট যে বসে বসে ভেতরে যেতে হলো সুসমা আর বুড়োকে। বুড়োটার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সুসমা আক্রোশে বললো,

‘আমাকে আপনি টেনে কেন আনলেন? ওঁরা ঐ মেয়েটির সঙ্গে কেমন করছে জানেন? ওঁকে মে’রে ফেলবে ওঁরা।’

বুড়োড়া খিটখিট করে হাসলেন। বুড়োর হলুদ লালচে দাঁত দেখে সুসমার শরীর শিরশির করে উঠলো। এই বুড়োটা আবার মানুষ খেকো নয় তো?তাকে এভাবে টেনে আনার কারণ কি? বুড়োর যা বয়েস তাকে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু সে, সে তো এভাবে বসে থাকতে পারবে না এখানে। তাকে বাঁচাতে হবে মেয়েটিকে। তার মেজাজ বিক্ষিপ্ত হলো। ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, ‘এখানে একটা নোং’রা’মি হচ্ছে আর আপনি হাসছেন? আমাকে যেতে দিন আমায় বাঁচাতে হবে মেয়েটিকে।’

আশ্চর্য জনক হলেও এই মুহুর্তে সুসমার নরম, স্নিগ্ধ, সুন্দর মুখ খানা কঠোর হয়ে গেছে। জেদ আর ক্ষোভে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অন্ধকারে থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেল বুড়োটা। একটু এগোল বুড়োটা। ভাঙা খড়খড়ে গলায় বললো, ‘এখানে এসব হয়। তুমি, এখানে যেচে মৃ’ত্যু’র দিকে কেন এগিয়ে যাচ্ছো? এখানে এলেই বা কি করে?’

সুসমা বিরক্ত হলেও বললো, ‘আমার স্বামীকে অনুসরণ করে এদিকে আসছিলাম। তাছাড়া আমার ননদকে পাওয়া যাচ্ছে না। একুশ বাইশ বছরের তরুণী। ঠিক ঐ মেয়েটির মতো। এদিকে আমরা সবাই আমার ননদকে খুঁজতে ব্যস্ত অথচ আমার স্বামী সন্ধ্যায় কোথায় যেনো বেরিয়ে আসছিলো। আমার কাছে তার হাবভাব স্বাভাবিক লাগেনি৷ বোনের হারিয়ে যাওয়ায় সে একটুও চমকালো না। তবে কেমন বিচলিত লাগছিলো তাকে। আমি এর আগে কখনোই বাড়ির বাইরে পা রাখিনি। আমার স্বামীকে সন্দেহ হলেও ধরতে পারিনি। আজকে বেরিয়েছি ননদকে খোঁজার বাহানায়৷ অতঃপর আমার স্বামীকে ঐ জঙ্গলের রাস্তায় আসতে দেখি। হঠাৎই সে গায়েব হয়ে যায় আমার সামনে থেকে আর তারপর আর পায়নি। কিন্তু এদিকে এমন সরু রাস্তা দেখে এগিয়ে আসছিলাম, তখনই একটা মেয়ের মৃ’ত দেহ দেখতে পেলাম। মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে আছে। গন্ডগোল আছে বুঝে আমি এগোচ্ছিলাম আর আপনাকে দেখলাম। এরপর তো জানেনই বাকিটা।’

বুড়ো সবটা শুনে আলতো, নিভে যাওয়া স্বরে বললো,

‘তুমি অপেক্ষা করো একটু৷’

বুড়ো একটা ঝুড়ির মতো ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করলো।এরপর আবারও নৈকট্যে এসে বললো,

‘এই নাও আমার হাতে বানানো নানা রকম পাতা দিয়ে বানানো স্প্রে, চাইলেই তুমি সাহায্য করতে পারো মেয়েটিকে। আমি বুড়ো মানুষ, ওঁদের মতো জোয়ান দের সঙ্গে পারবো না। ওঁরা যখনই আমাকে দেখতো, আমাকে আঘাত করার চেষ্টা চালাতো। তখনই স্প্রে করে পালিয়ে যেতাম। কিন্তু আজকে আশ্চর্যের বিষয় হলো আগে যত মেয়ে এনেছে, মেয়ে গুলোকে ওঁরা আজকের আগে জীবিত আনেনি। এই মেয়েটাই এখনো অব্দি জীবিত আছে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, সেজন্য মেয়েটির সঙ্গে এখনো কিছু করেনি। আমি নিশ্চিত কিছু করবেও না।’

সুসমার মাথা ঘুরতে লাগলো। এতো এতো খু’নের উৎস কি তবে এরাই? এই বিশ কুড়ি বছরের মেয়েরা হারিয়ে যাচ্ছিলো, এক মাত্র এই লোক গুলোর জন্যেই? এতো নিখুঁতভাবে ওঁরা কাজ করে যে, এদের শনাক্ত করা ইম্পসিবল হয়ে যাচ্ছিলো৷ এতো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে পুলিশের কাছে যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে সবকিছু৷ কেসের আগা মাথা ধরার চেষ্টা করেও পারেনি পুলিশ কর্মকর্তারা। সুসমা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,

‘আপনি আমাকে সাহায্য করছেন কেন? কি উদ্দেশ্য আপনার?’

‘কোনো উদ্দেশ্যে নেই।’ সুসমা বিশ্বাস করলো না। সে দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইলে লোকটি তার ভাঙা শক্ত খিটখিটে হাতে তার হাত চেপে ধরে স্প্রে এগিয়ে দিলো। আর বললো,

‘যদি দেখো, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই তবে সোজা এই খানে চলে আসবে। এই গুপ্ত কুঠুরির খোঁজ এই পর্যন্ত পায়নি, এতো বছর এখানে থাকছি!’

‘আপনি এখানে থাকেন কেন?’

‘আমার এই দিন দুনিয়ায় কেউ-ই নেই৷ আমাকে আমার আপন ছেলে এখানে, এই জঙ্গলের গহীনে ফেলে চলে গেছিলো, এরপর থেকেই এখানেই থাকা হয়।’

সুসমা যেনো কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। লোকটার একেকবার একেক রকম বিবরণ দেওয়া কথা। তাই সে বললো,
‘এই কারণ হতেই পারে না। আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনি তো চাইলেই এখান থেকে চলে যেতে পারেন! যান নি কেন?’

‘র’ক্তের স্বা’দ পেয়েছি। ওঁদের র’ক্ত চাই, র’ক্ত। ওঁরা আমার মেয়েকে খু’ন করেছিলো আমার চোখের সামনে। ওঁদের র’ক্ত চাই আমার। র’ক্ত চাই। এর আগেও অনেককে শেষ করেছি আমি এবারে আরও শেষ হবে। আমি ছাড়বো না ওঁদের কাউকেই!’ হঠাৎই অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠলো বুড়োটা।

সুসমা এবারে যেনো আরও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চাইলো লোকটার দিকে। মনে হচ্ছে বুড়োর কথা বানোয়াট। সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললো, ‘তাহলে প্রথম বার মিথ্যা বললেন কেন? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আপনাকে।’

‘আমি মিথ্যা বলি নাই। মেয়ের শোকে পা’গ’ল হয়ে যাওয়াই জঙ্গলে ছেড়ে গেছিলো আমার ছেলে। তবে আমার ছেলে জানতো না আমি এখানেই আসতে চাইতাম। মেয়েকে তো বাঁচাতে পারিনি। এঁদের কারণেই আমার মেয়ে আজ নেই। আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। বাবা হিসেবে অক্ষম আমি! অক্ষম! ওঁদের ছাড়বো না আমি কিছুতেই।’

বুড়ো হাউমাউ করে কাঁদছে। সুসমা ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে হাটু মুড়ে বেরোলো কুঠুরি থেকে। হাতের টর্চ সন্তর্পণে জ্বালাচ্ছিলো আর নেভাচ্ছিলো সে। ভয়ে সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হলো তার। শরীরের লোম কা’টা দিয়ে উঠছিলো তার। জীবনে প্রথমবার এমন লোহমর্ষক ঘটনার সম্মুখীন হতে চলেছে সে। অল্প এগিয়ে যেতেই সে শুনলো রিনরিনে মেয়েলি স্বর।

‘বলেছি তো যাব না আমি!’ চড়া সুরে বলল মেয়েটি। ভীষণ ভীত এবং অধৈর্য দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। সে আড়াল থেকে দেখলো মেয়েটির মুখ খুলে দেওয়া হয়েছে তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না মুখ টা৷

‘যাচ্ছো তুমি মেয়ে বসের হুকুম।’ শরীরের তুলনায় ঘাড় মোটা এমন একজন বলল। মোটা পোশাক পরনে, কোমরে সিক্সশূটার গুজে রাখা।

‘বসকে মেয়েটির কথা আগেই বলেছি কিন্তু এখনো কেন যে আসলো না।’ ঝাঁঝ লোকটার কণ্ঠে।

‘জানতাম, মেয়েটিকে জোর করেই নিয়ে যেতে হবে!’

দুই কদম এগোল লোকগুলো। মেয়েটি ভয়ে গুটি শুটি হয়ে পেছাচ্ছিলো। পিছিয়ে গেলোও। মেয়েটির সারা মুখে আতঙ্কিত ভাব বিরাজমান। চেঁচিয়ে বললো,

‘তোমরা সবাই কাপুরুষ, তোমাদের বস্-ও! একজন নিরীহ মেয়ের সাথে জোর করতে বাঁধছে না তোমাদের?’

মেয়েটির মুখ পুনরায় কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো। মেয়েটি আর কথা বলতে পারলো না। সুসমার কেন যেনো স্বর টা চেনা চেনা লাগলো। একটু অন্য রকমের কন্ঠঃ।

খরখর শব্দে হাসলো ঘাড়-মোটা লোকটা। হাসি থামিয়ে বললো, ‘কেউ যখন অবাধ্য হয়, তখন তাকে জোর করতেই হয়!’

হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কব্জি চেপে ধরল লোকটা। কিন্তু ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো মেয়েটি। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল এবার। বাঁধা হাত খানা গুটিয়েই দ্রুত হাত চালালো। ঘাড় মোটা লোকটার গালে লাগলো। কাত হয়ে পড়ে গেল লোকটা।

সেই সুযোগে সুসমা আওয়াজ না করে এগিয়ে গেলো। এখনও ওঁর উপস্থিতি টের পায়নি কেউই। সুসমা বুড়োর হাতে তৈরি করা স্প্রে খানা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে কাছে গেলো। নাকে শাড়ী চেপে স্প্রে করতেই সবাই লুটিয়ে পরলো। রাগে হিংস্রতায় সে ঘাড় মোটার হাত আর পে’টে ছু’ড়িঘা’ত করলো।
সুসমা একজনকে আঘাত করলেও বাকিদের পারলো না। তার হাতের টর্চ খানা পরে গেছিলো একটু দুরেই। সেই আলো এসে পরলো সুসমার মুখে৷ মেয়েটি সুসমাকে দেখতেই উম উম শব্দ শুরু করলো।

‘সরে এসো, বাছা!’ বুড়োটা এগিয়েই নিচু কণ্ঠে নির্দেশ দিলো।

তপ্ত লোহার ছ্যাকা খেয়েছে যেন, সেভাবে থমকে দাঁড়ালো সুসমা হঠাৎই কুজো বুড়োকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেখে। বুড়োর হাতে ধাঁ’রা’লো অ’স্র। তার মুখের চামড়া কুকড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। তার কোমরের কাছে চলে গেছে তার ডান হাত। বাম হাতে ধা’রা’লো অ’স্র। বিরক্তি আর ভর্ৎসনা দেখা গেলো বুড়োর নীলচে, ধুসর চোখে।

‘এই নর্দমার কীট গুলো কোত্থেকে উঠে এসেছে!এদেরকে মে’রে নিজের হাত নোংরা করো না মেয়ে। আমি দেখে নিচ্ছি!’ রাগে চেঁচাল বুড়োটা।

পরপর সব গুলো লোককে অনেক গুলো আ’ঘা’ত করে ঝাপ দিয়ে বুড়োটা হাউমাউ করে সেই রক্তের উপর হামলে পরলো। যেনো এতেই তৃপ্ত সেই বুড়ো। যেনো কতদিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম বুড়ো। সুসমার মনে পরলো বুড়োর কথা, “র’ক্ত চাই। র’ক্ত!” সুসমা সেই দৃশ্য সইতে না পেরে অন্যদিকে ফিরে বমি করে দিলো ঘেন্নায়। হাতের ছুড়ি কোমড়ের গাছিতে গুজে মেয়েটির কাছে গেলো। হাতের-পায়ের বাঁধন খুলতেই দেখলো রিয়া। অন্ধকার হলেও কাছ থেকে সে রিয়াকে চিনতে পারলো। রিয়া টর্চের আলোয় সুসমাকে দেখেছিলো।ভেঙে যাওয়া গলায় রিয়া বললো,

‘ভাবি, তুমি এখানে? কিভাবে?’

সুসমা পরিচিত মুখ দেখতেই জাপটে ধরলো নিজের ননদকে। রিয়া হাউমাউ করে কাঁদছিলো। বুড়োর র’ক্তের নেশা চেপে বসেছে শরীরে। ভয়ে শিটিয়ে গেলো সুসমা আর রিয়া। এখন বুড়ো যদি তাদেরকেও কিছু করে বসে? খু’ন চেপেছে তার মাথায়। শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তি না থাকা সত্ত্বেও দুইজন দুজনের হাত চেপে ধরে দৌঁড়ে ছুটে চললো। সুসমা জানে না জঙ্গলের কোন মাথায় আছে তারা। কিন্তু যে পথে এসেছে সেই পথ অনুসরণ করেই দৌঁড়াতে লাগলো। এক পর্যায়ে দৌড়াতে গিয়ে তারা কোনো নরম কিছুর সঙ্গে বাঁধা পেলো। পা আঁটকে যেতেই ধাম করে মুখ থুবড়ে পরলো তারা। সুসমা তখন আসার সময় টর্চ টা উঠিয়ে নিয়েছিলো। টর্চের আলো ফেলতেই ছিটকে সরে গেলো দুজনেই। যাওয়ার সময়কার মৃ’ত দেহখানা দেখলো। থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরে তারা আবার দৌঁড় শুরু করলো।

#চলবে#অনূসুয়া
#পর্ব১৩
#রাউফুন

(অতীত)

তখন সুসমা দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট। প্রথম বাচ্চা নষ্ট হওয়ার এক বছর পর আবার সুসমা কন্সিভ করে। সেবার রাশেদের আচরণ ছিলো ভিন্ন। সুসমা ভেবেছিলো এই বুঝি তার সংসারে সুখ নেমে এলো। সুসমাকে রানীর মতো করে রাখছিলো৷ কোনো রকম কাজে হাত লাগাতে দিতো না রাশেদ। তার হয়ে মায়ের সঙ্গে সেকি রাগারাগি, চেঁচামেচি করতো! সুসমা রাশেদের পরিবর্তন দেখে কত কেঁদেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে নামাজে বসে।

তবে এবার বাচ্চার যদি আবার ক্ষতি হয় তবে সুসমার লাইফ রিস্ক হবে। সুসমা ভেবেছিলো হইতো তার জীবন আশংকায় শুনেছে, সেজন্য হইতো রাশেদের এতোটা পরিবর্তন। শাশুড়ী মা ও ছেলের রাগারাগি দেখে আগের মতো ব্যবহার করে না৷ সে ভাবে সে পেরেছে, ভালোবাসায় সবাইকে বাঁধতে পেরেছে। তার দুঃখের দিন শেষ। আর দুঃখ তাকে ছুঁতে পারবে না৷ কিন্তু কে জানতো এরপরই তার জীবনের মোর বদলে যাবে ভয়ংকর ভাবে।

একদিন হঠাৎই রিয়া ভার্সিটি থেকে ফিরতে দেরি করে। বাসার সবাই চিন্তিত হয়ে পুরো এলাকা খুঁজেও পেলো না। মিথুন তার ছোট দেবর রিয়ার ভার্সিটিতে গিয়ে খোঁজ নিলো। সেখানের লোকজনের থেকে শুনতে পায় কোনো একজন মেয়েকে জোর করে কিছু ছেলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। মিথুন দৌঁড়ে এসে সবটা জানালে রাশেদের মুখ কালো হয়ে যায়৷ সে ঘামতে থাকে। এরপরই সে বেরিয়ে পরে বাড়ি থেকে। তাছাড়া বিগত কয়েকদিনের আচরণ সুসমার কাছে অদ্ভুত আর সন্দেহ জনক লেগেছে। হঠাৎই রাশেদের পরিবর্তন টা সে মানতে চেয়েও পারেনি। কেন যেনো তার মনে হতো রাশেদ অভিনয় করছে। ঐ যে কথায় আছে না, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ!” প্রথম দিকে সন্দেহ না করলেও পরবর্তীতে সুসমার মা ছেলের আচরণ সুবিধার ঠেকেনি। সুসমা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। দৌড়াতে দৌড়াতে সুসমা বললো, ‘মা তোমাকে না পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করছেন। আজকে ভার্সিটি থেকে ফিরতে দেরি কেন করেছো? দেরি না হলেই এতো বড় ঘটনা ঘটতো না।’

‘আমি দেরি করিনি ভাবি, আমি তো ভালো মনেই আসছিলাম, কিন্তু কোত্থেকে লোকগুলো এসে আমাকে তুলে নিলো সবার সামনে। লোকজন চেঁচালেও আটকাতে পারেনি ওঁদের গাড়িটা। আমি জানি না ওঁরা কেন আমাকে ধরেছিলো, তবে ওঁদের বসের নাম ফার্স্ট লেটার আর দিয়ে শুরু। আর,এস,কে নামে বার বার সম্বোধন করছিলো।’

সুসমার মাথায় তখন অন্য কিছু খেলা করছিলো। সেই কুঁজো বুড়োটা হঠাৎই সোজা কিভাবে হলো? সে লক্ষ্য করেছিলো, কুঠুরিতে বুড়ো যখন তার হাতে স্প্রে দিয়েছিলো তার হাতে কোনো দাগ ছিলো না কিন্তু পরবর্তীতে যে বুড়ো ছু’রি ধরেছিলো তার হাতের উপরি ভাগে দাগ আছে। টর্চের আলোয় সে স্পষ্ট দেখেছে। বেশ ভুষা এক হলেও দুজনকে আলাদা আলাদা মনে হচ্ছে তার কাছে। ভুল এখানেই ছিলো। তারা যখন বাড়ি ফিরলো রাত বারোটা। রাতের আঁধারে একদম বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরলো। এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও বাড়ি প্রবেশের পরই সুসমা জ্ঞান হারালো। এমনিতেই সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী তারপর সারা বিকেল থেকে রাত বারোটা অব্দি এতো ধকল। শরীর নিস্তেজ হয়ে পরলো তার। সবাই তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো।

মিথুনের বড় ভাইকে কেন যেনো সন্দেহ হতে লাগলো। এখনো বড় ভাই বাড়ি ফিরে আসেনি৷ অথচ সে ভাবির আগে বেরিয়েছে।
সবাই সুসমাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন মিথুন অন্য ভাবনায় পরেছে। রিয়া তার মাকে জাপ্টে ধরে সবটা খুলে বলতেই তড়তড় করে অপরাধ বোধ বাড়তে থাকে প্রজা বেগমের। সুসমার প্রতি এতো দিন করা সব গুলো অত্যাচার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কিভাবে দিনের পর দিন একটা মেয়ের উপর শারিরীক মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি। আর সেই মেয়েই কিনা নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তার সন্তানকে বাঁচালো। সে এই মুখ নিয়ে কি করে দাঁড়াবে মেয়েটির সামনে। সারা রাত সেই ঘরেই প্রজা, সুসমার শ্বশুর মশাই, রিয়া, মিথুন বসে বসে কাটিয়ে দিলো।

সুসমার ঘুম ভাঙলো সকাল পাঁচটার আগে প্রচন্ড প্র’স্রা’বে’র বেগে। সবাইকে তার ঘরের আনাচে কানাচে ঘুমাতে দেখে বুঝলো কারোরই গতকাল রাতে ঘুমানো হয়নি। কালকের বিমূর্ত, বিমর্ষ দিনের কথা মনে হতেই লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো। আবার ঐ লোকের র’ক্ত পান করার কথা মনে হলো। সে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে হড়বড়িয়ে বমি করে দিলো। শরীরে জোর পাচ্ছে না বিন্দু পরিমাণ। এতো কিছুর মধ্যে সে রাশেদকে একবারও দেখলো না। সবাই তখন বিভোর ঘুমে। কাউকে ডাকা ঠিক হবে ভেবে সুসমা খাওয়ার জন্য রান্না ঘরের দিকে গেলো। খিদেতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠছে তার। সুসমা সবে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছে, রাশেদ ফিরলো তখনই।

সুসমা ভালো করে লক্ষ্য করতে দেখলো, রাশেদের হাতে কি যেনো। র’ক্ত? সে ভয়ে শিউরে উঠলো। বললো, ‘আপনার হাতে র’ক্ত কেন রাশেদ?’

রাশেদ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, ‘কই না তো। ও তেমন কিছু না।’

‘আপনি জানেন আপনার গালে এখনো বুড়ো লোকের দাড়ি লেগে আছে?’ চালাকি করে বললো সুসমা। কারণ রাশেদকে তার সন্দেহ হচ্ছে। ঐযে বলে না, কলা চোরের মাথায় কলার পাতা!

সঙ্গে সঙ্গে রাশেদ মুখে হাত দিলো। বললো, ‘কি সব আবোল তাবোল বকছো? কোথায় দাড়ি?’

সুসমা অন্ধকারে তীর ছোড়ার মতো আন্দাজে রাশেদকে প্রশ্নটা করতেই তার ধারণা সত্যি হলো। বললো, ‘তার মানে আপনার হঠাৎই গায়েব হওয়ার কারণ টা বুড়োর ছদ্মবেশ তাই না? আর ফার্স্ট লেটার আর মানে আর তে রাশেদ। এস কে লাগানোটা যেনো আপনাকে না চেনা যায়!’

রাশেদ হাউমাউ করে কাঁদলো। বললো, ‘প্লিজ সুসমা বিশ্বাস করো, আমি এতো বছর থেকে এই কাজ করছি এমন ভুল হয়নি। ওঁরা যে আমার বোনকে তুলে নেবে ভাবতেও পারিনি। যেহেতু ওঁরা ভুল করেই ফেলেছিলো তাই ওঁদেরকে বলেছি মেয়েটাকে স্পেশালি আমার ডেরায় আন। যেনো ওঁকে আমি সেখান থেকে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু ওখানে সরাসরি গেলে আমাকে চিনে ফেলতো রিয়া। বোনের কাছে এই রূপ প্রকাশ করতে চাইনি বলেই বুড়োর ছদ্মবেশ নিলাম। কিন্তু দেখি তুমি এই পর্যন্ত পৌঁছে গেছো। তাই তোমাকে বিশ্বাস করাতে বানিয়ে আজে বাজে সব গল্প বলি, বলি স্প্রে আমি নিজেই বানিয়েছি।’

সুসমা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘এতো দিন মেয়েদের গায়েব হওয়ার কারণ তার মানে আপনি। এতো খারাপ আপনি? ছিঃ নিজের বোনকেও ছাড়লেন না? আর আপনি আপনার ভাড়ার লোক গুলোকেও মে’রে দিয়েছেন? কেন? ওহ বুঝেছি, আপনি মে’রে দিতেন বলেই খুনি অব্দি পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ। কারণ ঐ বুড়োটাই মানে আপনিই সবাইকে মে’রে ফেলন!’

‘আমি মা’রিনি! আমি মা’র’তে গিয়ে দেখি কেউ-ই আমার লোক গুলোকে মে’রে কু’চি কু’চি করে ফেলেছে। আমার বোনকে তুলে নেওয়াই আমার চরম রাগ হয় তাই ওঁদের মৃ’ত দেহকেই কু’পি’য়েছি।’

সুসমা হাটু ভেঙে পরে গেলো। কান্নায় ভেঙে পরে বললো,’এতো দিন তবে আমি একটা খু’নি, মেয়ে বাজ লোকের সঙ্গে সংসার করেছি? এতো দিন জানতাম আপনি ব’র্ব’র, জা’নো’য়া’র, কিন্তু এখন দেখছি আপনি তার থেকেও নিকৃষ্ট! নিজের বোন, বোন, অন্যের বোন বুঝি ফেলনা? আমি এক্ষুনি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সব বলে দিবো।’

‘কোথাও যাবে না তুমি। আর যদি তুমি বলে দাও তবে তোমার বাবা মায়ের আশা ছাড়তে হবে! নিশ্চয়ই তুমি বুঝে গেছো আমি ঠিক কি?’

সুসমার পিলে চমকে উঠে। সে অশ্রুসিক্ত লোচনে দেখলো মানুষ নামক জা’নো’য়া’র টাকে। এই দিনটাও দেখার ছিলো? রাশেদ এগিয়ে এসে সুসমাকে বললো, ‘ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিও। ডিভোর্স পেপার রেডি আছে!’

‘আমি তোকে ডিভোর্স দিলে তুই অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবি তা-তো হবে না। আমার জীবন যেভাবে নষ্ট করেছিস সেভাবে অন্য নারীকেও আঘাতে আঘাতে শেষ করবি ভেবেছিস? তোকে ডিভোর্স দিবো না আমি। যা করার করে নে।’

‘ভালোই তো, বুলি ফুটেছে মুখে। “পিপিলিকার পাখা গজায় ম’রি’বার তরে!” তোরও তাই হয়েছে। তুই কি ভেবেছিস আমি বিয়ে করিনি? এই দেখ এই মেয়েটা আমার মামাতো বোন। ওঁকে আমি বিয়ে করেছি। যদি-ও ওঁদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিন সম্পর্কে ছিলো না। তবে এখন আমি ওঁকে বিয়ে করে সম্পর্ক ঠিক করে নিয়েছি।’ রাশেদ একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে এই চরম সত্যিটা বললো।

সুসমা রাগে কাঁপতে থাকে। সর্বাঙ্গে আগুন ধরে যাচ্ছিলো। একটা মেয়েকে দিনের পর দিন টেনে টর্চার করার ফলে এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। একবার বহির্ভূত হলে বার বার সেটা বহির্ভূত হতে থাকে। রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সে প্রথম বারের মতো রাশেদকে আঘাত করতে থাকে।

পর পর থাপ্পড়ে জোর ছিলো অনেক। সুসমা রাগে কোমড়ের কাছ থেকে ছু’ড়ি নিয়ে আ’ঘা’ত করে। রাশেদের ডান হাতে লাগে। রাশেদ রেগে গিয়ে সুসমার কাছ থেকে ছুড়িটা কে’ড়ে নিলো। সুসমা আওয়াজ করতে গিয়েও পারলো না। সুযোগ পাওয়ার আগেই শাড়ীর আঁচলে তার মুখ বেঁধে দিলো রাশেদ। শ্বাস রোধ করে অজ্ঞান করে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো। শব্দ হচ্ছিলো বলে কোলে তুলে নিয়ে গেলো ছাদে। বাড়ির কেউ-ই তখন জেগে উঠেনি। ভোর পাঁচটাই শহরের কেউ-ই জেগে উঠে না। হাত বেঁধে, মুখও বেঁধে দিলো রাশেদ। ছাদের ট্যাংকে ফেলে ট্যাংকির ঢাকনা লাগিয়ে দিলো। তখন জলের ট্যাংক খালি। পানি শেষ হয়ে গেছে। রাশেদ সুসমাকে ফেলে নিচে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

এদিকে সুসমা হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরে রইলো ট্যাংকে। পানি যখন পরতে লাগলো সুসমার মুখে তখন তার জ্ঞান ফিরলো। সে অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে পরলো। তার বুঝতে সময় লেগেছিলো সে কোথায় আছে। জল পরতে দেখে সে বুঝলো জলের ট্যাংক এ আছে সে। তার হাইটের চেয়ে ট্যাংক বড়। জল নাক বরাবর উঠলেই সে শ্বাস রোধ করে মা’রা যাবে। দু চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পরছিলো তার। দম বন্ধ অবস্থা সে পরে রইলো। আর দু পা দিয়ে অক্লান্ত ভাবে শব্দ করতে লাগলো। থপথপ শব্দের সঙ্গে ছাদ ভরে গেলেও এখানে কেউ-ই ছিলো। এদিকে জল পরতে পরতে ভরে উঠতে শুরু করেছে ট্যাংক। নিশ্চয়ই রাশেদ যাওয়ার পথে মটরস অন করে গেছিলো। দশ মিনিটে প্রায় অনেক জল ভর্তি হয়েছে। দেখতে দেখতে গলা অব্দি জল আসলো। সে প্রাণপনে লাফিয়ে লাফিয়ে মাথা দিয়ে দিয়ে ঢাকনায় আওয়াজ করতে লাগলো। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরলো তার। সেই রক্তে রঞ্জিত হলো ট্যাংকের পানি। সে শেষবার চোখ বন্ধ করার ক্ষনকাল পর মনে হলো ট্যাংকের ঢাকনা খুলে গেলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here