অনূসুয়া পর্ব -১৪

#অনূসুয়া
#পর্ব১৪
#রাউফুন

(বর্তমান)

‘সবাই জানে আমি দশ বছর সংসার করে সংসার ত্যাগ করেছি কিন্তু না আমি পাঁচ বছরের মাথাতেই রাশেদের সঙ্গে সংসার ভেঙেছি। জানেন আলিফ আমি কখনোই এই ব্যাপারটা কাউকে জানাইনি?’

‘ হঠাৎ আমাকে জানানোর কারণ?’

সুসমা রহস্যের হাসি হাসলো। বললো, ‘কারণ ঐ দিন যে বুড়োর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিলো তার একজনের খোঁজ পেয়েছি।’

আলিফ ঘামতে ঘামতে বললো, ‘সেই বুড়োটা কে?’

‘আপনি ঘামছেন? কেন?ফুল পাওয়ারে এসি চলছে তবুও?’

‘না না ঘামছি না তো।’

‘আপনার ডান হাত খানা দেখি!’

‘কেন?’

‘দেখান না!’

আলিফ তার কম্পনরত হাত টেবিলের সামনে রাখলো। সুসমা আলগোছে হাত দেখলো। সে যা প্রত্যাশা করেছিলো তা নেই। সে মুচকি হেসে আলিফের হাতের উপর জোরে জোরে ঘষা দিলে আলিফ বাধ সেধে বললো, ‘মিস সুসমা, আপনি কিন্তু বারাবাড়ি করছেন!’

‘উঁহু বারাবাড়ি না তো। এই তো দাগ দেখা যাচ্ছে। আমি যদি কোনো ভুল না করে থাকি আপনিই সেই বুড়ো লোক। যত গুলো দাগী ধর্ষণ কারী ছিলো তাদের প্রত্যেককে আপনি হ’ত্যা করেছেন। এবং সেদিনের হত্যার দায় আপনি আমার উপর চাপিয়েছিলেন আড়াল থেকে ভিডিও করে। সেই ভিডিও ক্লিপে আমার মুখ স্পষ্ট না হলেও একবার টর্চের আলোই মাত্র দুই সেকেন্ড আমার মুখ দেখা গেছে। এতেই পুলিশ আমাকে চিনে ফেলেছে। সেদিন যেমন আপনি আমার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তেমনি একই সঙ্গে অপকারিও ছিলেন। তারপর, তারপর আমার জীবন বদলে গেলো। পুলিশকে তো আপনি পাঠিয়েছেন আমার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানায়। আপনি পুলিশ পাঠিয়েছেন আমাকে ধরার জন্য কিন্তু আমাকে ধরার জন্য গেলেও পায়নি বাসায়। খুঁজে খুঁজে ছাদে গিয়ে জলের ট্যাংক থেকে পেলো। পুলিশ সময় মতো আমায় উদ্ধার না করলে মা’রা যেতাম। এরপর সুস্থ হলে আমি আমার শ্বশুর বাড়ির সবার নামেই মামলা করলাম। বঁধু নি’র্যা’ত’নের মা’ম’লা। স্বামীকে জেল থেকেই ডিভোর্স করলাম। খু’নের দায়ে আর সব কিছু বিবেচনা করে আমার জেল হলো চার বছর। তার আগে বলে রাখা ভালো, আমার খুব কাছের একজন আমার প্রতিনিয়ত খোঁজ নিতো। তার সেই লোককে আমি বলে দিয়েছিলাম, যেনো আমার জেলে যাওয়ার খবর খানা কাউকে না দেই। শুধু যেনো বলে আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি।’

‘আপনি এতো সব কি করে জানলেন? আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় আপনি এতোটা বিচক্ষণ! আপনার সেন্স অব হিউমার এতোটা স্ট্রং।’

‘মিষ্টার আলিফ আপনি আমাকে অফিস জয়েনিং এর প্রথম দিনেই চিনে ফেলেছিলেন। আপনি অনেক ভালো মানুষ না হলেও ভালো মানুষ তো বটেই। আমাকে চিনতে পেরে আপনি অনুতপ্ত হোন। কিন্তু আমি আপনাকে সেদিন চিনেছি যেদিন আপনি মেক-আপ করতে ভুলে গেছিলেন। আর ডেস্কের সামনে আপনার ডান হাত খানা নাড়িয়ে কথা বলছিলেন।’

‘আপনি আমার হাতের দাগটা সেদিন কিভাবে দেখলেন? আর এরকম দাগ তো অনেকেরই হতে পারে।’

সুসমা আবারও হাসলো। হেসে বললো, ‘অনেকের দাগ আর আপনারটার পার্থক্য হলো সবার টা কালো হয় আপনার বার্থ সাইন টা লালচে।’

‘আমি কেন এমন করেছি জানতে চাইবেন না?’

‘হু জানি, আপনার সম্পর্কে সব খবরই আমার জানা আছে। তাছাড়া আপনার কেবিনে আমি একটা মেয়ের ছবি দেখেছিলাম। দুইদিন দেখেছি। এরপর আপনি সেটা সরিয়ে দিয়েছেন। তবে কি জানেন? আমি মেয়েটাকে চিনি। মেয়েটি আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত ছিলো। সে আপনার ওয়াইফ নিশি রাইট? আর তার খু’নের প্রতিশোধ নিতেই আপনি এতো সব করেছেন। তার নির্মম মৃ’ত্যুটা আপনি মানতে পারেন নি। তাই খোঁজ খবর নিয়ে সমস্ত কিছুর উপর একটা প্ল্যান বানান। এবং আপনি আপনার কাজে সফলও হোন। আপনি ভেবেছেন, আপনার থেকে আমার স্বামী আপনার ভালোবাসা কে’ড়ে নিয়েছে আপনিও সেটাই করে প্রতিশোধ নিবেন। আপনি যে পরিস্থিতিতে গেছেন আপনার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগবে এটা স্বাভাবিক। আপনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে খু’নের দায়ে ফাসালেন। কিন্তু জানেন কি? আমার ভাগ্যে কখনোই স্বামীর ভালোবাসা জোটেনি। তবে ভালোবাসা জুটেছিলো এক অভাগা প্রেমিকের। যাকে আমি কখনোই গ্রহণ করতে পারিনি, সব সময় তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি আমার কলঙ্কের জন্য।’

‘আপনি কি তাকে ভালোবাসেন?’ সন্তর্পণে শুধালো আলিফ।

সুসমা জবাব দিতে সময় নিলো। অকপটে বললো, ‘জানি না। তবে আমার মতো জেল খা’টা আসামির কি কারোর পবিত্র ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে?’

আলিফ অপরাধবোধ থেকে বললো, ‘আমি তিন বছর স্বাভাবিক ছিলাম না আপনার উপর দোষ চাপিয়ে। অনেক কষ্টে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছি। তবে আগের মতো হাসি খুশি থাকতে চাইলেও পারি না। গম্ভীরতার ভীরে আমি আমাকে ভুলে থাকি। সেদিন ভিডিও টা করা আমার উচিত হয়নি। না জেনে অন্য একজনের শান্তি আপনাকে দিয়েছি, যেখানে আপনি সম্পুর্ন নির্দোষ ছিলেন। আমাকে আপনি যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন। আমি মাথা পেতে নেবো।’

‘শাস্তি দিলে কি আমার চারটি বছর ফিরে পাবো? আমার সেই তিক্ত অতীত থেকে নিজেকে বের করতে পারবো? আপনি জানেন, আমি এমন ট্রমায় ছিলাম যে আমি চাইতাম আমার গর্ভের বাচ্চাটা ম’রে যাক। আমি অতি শোকে পাথর হয়ে গেছিলাম। পাগল প্রায় আমি বার বার নিজের পে’টে আঘাত করতাম। জেলে গর্ভবতী মহিলাদের রোজ চেক-আপ আর আল্ট্রা করা হয়। আমি জানতে পারি আমার মেয়ে হবে। এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় কোনো মেয়ের জন্ম আমি দিতে চাইনি। কারণ মেয়ে মানেই জন্মাবে নতুন আরেক সুসমা। যাকে শাস্তি পেতে হবে প্রতিনিয়ত। অধিক নির্যাতনের ফলে তাকে জলের ট্যাংকে ভরে মে’রে ফেলা হবে। তারপর, তারপর সব শেষ। আমি তখন আমার জায়গায় আমার মেয়েকে দেখছিলাম। ওঁকে কেউ একজন জলের ট্যাংক এ ফেলে দিয়েছে। ওঁ হাউমাউ করে কাঁদছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেউ নেই। এক সময় অনেক গুলো পানি খেয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবে। তার কান্না থেমে যাবে। আমি চাইনি আমার সন্তানের সঙ্গেও এমন হোক। তাই তাকে জন্মের পরেই মে’রে দিয়েছিলাম নিজের হাতে। ওঁকে সমস্ত কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম এক লহমায়।’

বলতে বলতে সুসমার গলা কাঁপছিলো। সে থেমে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। শান্ত কন্ঠে বললো, ‘সুসমা ক্ষমা করতে জানে। সেদিন ভুল করে হলেও আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন তাই আমি সেদিনই আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম! আপনি যা শাস্তি পাওয়ার তা তো পেয়েই গেছেন! জানেন, আমি আমার শাশুড়ী মাকেও ক্ষমা করেছিলাম, প্রকৃতি উনাকে উনার যোগ্য জবাব দিয়েছেন। উনি এখন আরোগ্যের রোগী। একজন অসুস্থ মানুষের প্রতি রাগ রাখা আমি সুসমার শিক্ষার মধ্যে পরে না। আর আমার প্রাক্তন সেও শাস্তি পেয়েছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্য একজনের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। সে এখনো পুলিশের হেফাজতে। যাবৎ জীবন কারাগারে থাকবে।’

কথা শেষ করেই সুসমা উঠলো। উঠতে উঠতেই অদ্ভুত এক প্রশ্ন করে বসলো আলিফকে, ‘চেয়ারের বাংলা কি জানেন?’

আলিফ ভ্রু কুচকে বললো, ‘কেদারা!’

‘আর টেবিলের বাংলা?’

আলিফ ভেবে বললো, ‘না, জানি না।’

‘এতো বড় বস আর এটা জানেন না? চেয়ারের বাংলা কেদারা এটা সবাই বলতে পারলেও টেবিলের বাংলা কেউ-ই বলতে পারে না৷ কিন্তু আমার ফ্রেন্ড রিক্তা পেরেছিলো। টেবিলের বাংলা মেজ্! ম একার মে জ্ – মেজ্ মনে রাখবেন, হ্যাঁ !’

চলে এলো সুসমা। আলিফকে পূর্বের ঘটনা বলতে বলতে তার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। চিবুকের পাশ দিয়ে শিরশির করে সে ব্যথা মাথায় চড়ে বসছে। পেছনে ফেলে এলো আলিফের হতভম্ব হয়ে যাওয়া মুখ। সুসমা সামনে তাকিয়েও বুঝলো আলিফ তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই সুসমার এমন প্রশ্নের মানে নিশ্চয়ই সে বুঝতে পারেনি। সুসমা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই তাকে একটু লজ্জা দিয়েছে! সব সময় গুমোট পরিস্থিতি ভালো লাগে কার? আজকেও রিক্তা অফিসে আসেনি। তার সাংসারিক ঝামেলা মেটেনি। ডিভোর্স দিয়েছে কিন্তু রিক্তার স্বামী শান্ত এখন মানছে না। কান্নাকাটি করে রিক্তার হাতে পায়ে ধরছে আবার ফিরে আসার জন্য। কিন্তু রিক্তার মন গলছে না।

সুসমা বের হলো অফিস থেকে। বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা একটা ভাব এসেছে। সেদিন বিয়ে ভাঙতে সুসমা মেরাজের কাছে চিঠির ব্যাপারটা এমনিতেই বলেছে। হ্যাঁ সে চিঠি পেতো তবে সেটা চার বছর অব্দি। এরপর আর পায়নি। পাবে কি করে পাঁচ বছরের পর তো সে জেলেই ছিলো চার বছর। সেখানেই চার বছর কা’টিয়ে নিজ গৃহে ফিরেছিলো। বাবা মাকে সত্যিই জানাতেই তারা হাহাকার করেন। বাবা সেই মুহুর্তেই স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। মেয়ের প্রতি এতো অন্যায় করেছেন বুঝতে পেরে সইতে পারেননি। সুসমা ধরেই নিলো তার জন্যই বাবার এই অবস্থা। তার অপরাধের বোঝা বাড়লো। মায়ের ইমোশনাল কথায় বিয়ের জন্য পাত্রের সামনে তো যেতো তবে সে আড়ালে গিয়ে পাত্রকে মুখের উপর রিজেকশন লেটার ধরিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাতো। কিন্তু মেরাজের প্রতি সে কঠোর হতে চেয়েও পারে না। উপরে উপরে কঠিন কথা শোনালেও ভেতরটা ছারখার হয়ে যায় তার। মানুষটা এতোটা চড়া ব্যবহার তার থেকে প্রাপ্য না।

হঠাৎই রাস্তায় একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দেখলো সে। বাচ্চাটি খুব সুন্দর। লাল টুকটুকে ফ্রকের সঙ্গে ছোট কালো রঙ এর একটা পালাজো পরানো। সুসমা ভেবে পেলো না, এই এতটুকু বাচ্চা, যে সবে হাঁটতে শিখেছে তাকে কেন পালাজোর মতো এমন ড্রেস পরাবে। বাচ্চাটি যদি পালাজো তে পা বেজে এখনি মুখ থুবড়ে পরে তখন? সে যেনো বাচ্চাটির মধ্যে তার সেই সদ্য জন্ম নেওয়া ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে দেখতে পেলো। মনে হচ্ছে তার দিকে মা মা করে বাচ্চা মেয়েটি ছুটে আসছে। হাত বাড়িয়ে কোলে উঠার জন্য বায়না করছে আর বলছে, ‘মা তুমি এমন কেন? দেখছো তো আমি হাঁটতে পারছি না। কোলে নাও! কত নিষ্ঠুর তুমি!’

সুসমার দু চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে না চাইতেও সেই ফুটফুটে বাচ্চাটিকে ধরে কোলে উঠিয়ে নিলো। মেয়েটি টুকুর টুকুর করে তার দিকে সুন্দর মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে। তম্বন্ধে কোনো এক মহিলা এসে বাচ্চাকে তার কোল থেকে নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য তাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলো বাচ্চাকে ধরার জন্য।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here