অনেক সাধনার পরে পর্ব -৩৯+৪০+৪১

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৩৯]

বিকেলের শুরু মাত্রা। সূর্যের তীর্যক আলোকরশ্মি গুচ্ছ এখন কোমলায়ন। প্রবল প্রভঞ্জনে চারপাশ মোহনীয়। বারান্দায় লাগানো বাগানবিলাস গাছের ফুল গুলো ফুটে রঙ্গিন করে রেখেছে। মন ও প্রাণ দু-টোই ফুল্লিত হয়ে আছে। দাদীর কথামতো কালো লাল সংমিশ্রনের একটা শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিলো মিতালী। চুল গুলো বেনী করে একপাশে এনে রেখেছে। শেফালী চেয়েছিল চুল ছাড়া থাকতে। কিন্তু ফিরতে রাত হবে। আর রাতে মেয়েদের চুল খোলে বাহিরে থাকা ভালো না। এইসব বলে জুলেখা খোলা রাখতে দেয়নি। শেফালী চুপচাপ মুখ কালো করে ফেলেছে। তার নিজের চুলও বাধতে হয়েছে দাদীর কারণে। তবে যাইহোক, দুজনকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমেনা, মিতালী ও শেফালী দুইজনই তৈরি শপিংএ যাওয়ার জন্য। মেয়েদের কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি তারাই কিনুক। জুলফিকার অন্যান্য কাজ সামাল দিতে ব্যস্ত।
.

বাসার সামনে সাদা রঙ্গের গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অংকুর। দুই হাত পকেটে গুঁজানো। পরনে তার হুয়াইট কালার শার্টের উপর ব্ল্যাক কালার ব্লেজার। চুল গুলো আজ জেল দিয়ে সেট করা। একদম ফর্মাল গেটআপ। তাকিয়ে আছে বাসার গেইটের দিকে। ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা কাজ করছে তার। মেয়েটা এখনো আসছে না কেন? এতো দেড়ি করার মানেই হয় না। অধৈর্য হয়ে গেলো অংকুর। বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ওরা এখনো আসছে না কেন? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’

পাশেই রাকিব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ইনভেস্ট করতে ব্যস্ত। সে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিল, ‘আরে মেয়ে মানুষ। তৈরি হতে একটু সময় লাগবেই। আরেকটু ওয়েট কর চলে আসবে।’

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করতে লাগলো অংকুর। মূলত মিতালীকে দেখার অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না তার। অশান্ত হয়ে আছে মন। বিগত পাঁচটা দিন বাদে আজ ছয়দিন। মেয়েটার দেখা নেই। মন ব্যাকুল হয়ে আছে তার। হঠাৎ-ই চোখ গেলো তার বাসার গেইটের দিকে। আমেনার পিছনে কালো শাড়ি পরা একটি মেয়ের দিকে। চোখ আটকে গেলো তার। দৃষ্টি তার নউতো হলো না। পলক পরা বন্ধ হয়ে গেলো যেন। অপ্সরীর চাইতেও অধীক সৌন্দর্যের অধিকারিণী। মুগ্ধ হলো সে। অশান্ত মন শান্ত হলো। স্থির হয়ে প্রথমের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে রইলো মিতালীর দিকে। তার গুলুমুলু ‘ তুলতুল ‘ টার দিকে। মেয়েটা ভীষণ কিউট। যার থেকে চোখ সরানো কন্ঠসাধ্য হয়ে পরে।

আমেন সামনে এসে দাঁড়াতেই রাকিব সালাম দিলো। এতোক্ষণে ধ্যান ভাঙ্গলো অংকুরের। হকচকিয়ে গেলো কিছুটা। কিন্তু বুঝালো না। ভাজ্ঞিস চোখে সানগ্লাস ছিল নাহলে কি লজ্জায় পরতে হতো এখন। নিজেকে স্বাভাবিক নিজেও আমেনা কে সালাম দিলো। আমেনা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছো তাই না? বাসায় আসতে বললাম তাও আসলে না। আসলে ওইদিকে..”

রাকিব মৃদু হেসে বলে উঠলো, ‘না না আন্টি সমস্যা নেই।’

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো মিতালী ও শেফালী। একে অপরের সাথে কুষলবিনীময় করে নিলো।শেফালী অংকুরের সাথে হেসে হেসে কথা বললেও কথা বলেনি মিতালী। এই মুহূর্তে অংকুরের সাথে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। ব্যাপারটা খেয়াল করলো অংকুর। নিশ্চিত রইলো কেবল। অতঃপর গাড়ির পিছনের সিটে উঠে বসলো আমেনা, শেফালী ও মিতালী। সামনের সিটে অংকুর রাকিব। আজ রাকিব ড্রাইভ করবে।

অনেকটা পথ ড্রাইভ করার পর অংকুরদের বাসার কাছে গাড়ি থামালো রাকিব। অপেক্ষা করতে লাগলো সুপ্তি বেগমের। মিতালীদের বাসা যেহেতু তাদের বাসার পরে, সেহেতু আগে মিতালীদের নিয়ে আসা হয়েছে। এখন সুপ্তি বেগম কে নিয়ে শপিংমলে যাবে তারা। অংকুর তার ক্রেডিট কার্ড আনতে ভুলে গেছে। তাই সে গাড়ি থেকে নামলো। ক্রেডিট কার্ড ও মাকে নিয়ে একসাথে আসবে। কিছুসময় অপেক্ষার পরে অংকুর আর সুপ্তি বেগম আসলেন। সুপ্তি সাবলীল ভাবে ভাব বিনিময় করলেন আমেনার সাথে। সবই সুন্দর ভাবে আগালো। কিন্তু বিপাকে পরলো একটা জায়গায়। গাড়িতে সিট আছে পাঁচ জনের। কিন্তু এখানে উপস্থিত ছয়জন। আর একজন যাবে কিভাবে? অংকুর প্রথমে ভাবলো মিতালীকে নিয়ে সে আলাদা যাবে বলবে। কিন্তু এভাবে বলা কি ঠিক হবে? লজ্জার কারণে আর মুখ ফুটে বলে নি কিছু। রাকিব ড্রাইভিং সিটেই বসে রইলো। তাই সুপ্তি বলে উঠলেন, ‘তোর না বাইক আছে? তুই বাইকে চলে আয়।’

থমথমে খেলো অংকুর। বিস্ময় হলো প্রবল। মুখখানি তার কালো হয়ে এইকুটু হয়ে গেলো। তবে ঠোঁটে হাসি টেনে সম্মতি দিলো। মনে মনে প্রচুর বিরক্ত হলো। হচ্ছে টা কি ভাই? যেখানে সে নিজেই বর সেখানে তাকেই আলাদা যেতে বলছে? এটাকে কিসের তালিকায় ফেলা যায়? অবিচার? এটা গুরুতর অন্যায়! সবাই এক সাথে মজা করে যাবে। আর সে? পুরোটা রাস্তা একা একা। এটা মানা যায়? না! মুখ কালো করে বিড়বিড় করতে লাগল অংকুর।

রাকিব অন্য দিকে ঠোঁট টিপে হেসে ফেললো। ভাইটা তার আজিব। সবটা ব্যাপার খেয়াল করলো শেফালী। জিমির জন্য মায়া লাগলো তার। জিমি একা যাবে? পুরোটা রাস্তা মন খারাপ করে যাবে! সঙ্গ দেওয়া উচিত। তাকে আশ্বাস দেওয়া উচিত! যেই ভাবা সেই কাজ। গাড়ি থেকে নেমে বলে উঠলো, ‘জিমি বাইকে যাবে? তাহলে আমিও জিমির সাথে বাইকে যাবো।’

সুপ্তি বেগম গাড়ির সামনের সিটে বসার জন্য দরজা খুলেছি কেবল। শেফালীর কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরলো। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললে, ‘যাও না। সমস্যা নেই। তাহলে আমি পিছনেই মিতালীর পাশে বসি।’

এতোক্ষণে অংকুরের ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটে এলো। শেফালীকে বলল, ‘দাঁড়াও। আমি বাইক বের করছি।’

শেফালী বাচ্চাদের মতো মাথা দুলিয়ে ‘ ঠিক আছে ‘ জানালো। অংকুর বাসার ফিরতে গেলো। সুপ্তি বেগম মিতালীর পাশে বসলেন। রাকিব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালালো। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকার পরে অংকুর বাইক নিয়ে আসলো। একটা হেলমেড শেফালীর হাতে দিয়ে বলল, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মানুষটা হচ্ছে তোমার দুলাভাই। বুঝছো?’

শব্দ করে হেসে উঠলো শেফালী। দুই গালে টুল দুটো স্পষ্ট ভেসে উঠলো। হেলমেড হাতে নিয়ে মাথায় পরতে পরতে বলল, ‘ভাইটার উপর এতো অন্যায় সহ্য করা যায় না। রাজপথে নামতে হবে। আমাদের জোরদাবি মানতে হবে।’

বলেই আবারো হেসে উঠলো শেফালী। তবে হাসলো না অংকুর। বরঞ্চ মুখ কালো করে বাইকে বসে রইলো। শেফালী অংকুরের কাধে হাত রেখে বাইকে বসতে বসতে বলল, ‘ফিকার নট ব্রাদার। শেফালী আছে না? আসার সময় বুবুকে তোমার সাথে পাঠিয়ে দিব।’

খুশি হলো অংকুর। বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘পারবে? আম্মু তো মনে হয়না মিতালীকে ছাড়বে।’

‘পারবো না মানে? শেফালী পারে না এমন কোনো কাজ আছে নাকি? দেখে নিও কেমন কায়দা করে ওদের আগে পাঠিয়ে দি। তারপর তুমি বুবুকে নিয়ে লং ড্রাইভে চলে যাবে। ঘুরাঘুরি শেষে বাসায় পৌঁছে দিবে। ব্যাস।’

অংকুর হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’

‘কিন্তু বাকি কাজ করতে নেই জানেন তো? আমি আবার সদায় মাঙনা দেই না।’

এবার একটু বেশি জোড়ে হেসে উঠলো অংকুর। তার হাসিতে শেফালী নিজেও হেসে ফেললো।
.

কোলাহলপূর্ণ শপিংমল। যদিও অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ মানুষের ভীড় অনেক কম। শপিংমলে ঢুকার পর প্রথমেই পা রাখলো লেহেঙ্গার দোকানে। এতো এতো লেহেঙ্গার মাঝে একটা খয়েরী কালার লেহেঙ্গা পছন্দ করলো সবাই। তারপর মেচিং করে অংকুরের জন্য শেওরানি। তারপর আস্তে আস্তে যাবতীয় সরঞ্জাম কিনলো। অন্যদের জন্যই প্রয়োজনীয় জিনিস নিলো। ব্যাগ হয়ে গেলো এতো গুলো। শেফালী ও রাকিবের ড্রেস কিনা বাকি। কিন্তু এতো ব্যাগ সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে। এটাই মোক্ষম সুযোগ! এরই অপেক্ষায় ছিলো শেফালী। সময় মতো, সুযোগ বুঝে বলে উঠলো, ‘আম্মু আন্টি? আপনারা এই ব্যাগ গুলো নিয়ে চলে যান। যেহেতু আপনাদের সব কেনা শেষ। এখন আমাদের কেনাকাটা শেষ হলে চলে আসবো।’

সুপ্তি বেগম নিজেও সম্মতি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমাদের কাজ যেহেতু শেষ, চলেই যেতে পারি। তোমরা শপিং শেষ করে চলে এসে কেমন।’

আমেনা মেয়েদের ফেলে যেতে রাজি হচ্ছেন না। যতোই সময় লাগুক দুই মেয়েকে নিয়েই যাবেন। শেফালী ও সুপ্তি বুঝালেন। তারপরেও বললেন, ‘মিতালীর তো শেষ। তাহলে আমাদের সাথে চলে আয়।’

চোখ বড়বড় করে তাকালো শেফালী। যাকে রাখার এতো চেষ্টা সে চলে গেলে কিভাব্ব হবে? রাকিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে শেফালীর কাজকারবার দেখছে। অংকুর নিশ্চুপ। প্রফুল্লিত তার মন। এমন একটা শালী থাকা সাত কপালের ভাগ্য বটে। এমন শালী থাকলে প্রেম করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবে না।

শেফালী কিছুটা অস্থির হয়ে বলল, ‘আরে বুবু চলে গেলে আমার ড্রেস চয়েজ করবে কে? আশ্চর্য আম্মু। আমরা চলে আসবো। তোমরা যাও। আমি উবারে গাড়ি ডেকেছি। ওরা বাহিরেই আছে।’

অতঃপর সুপ্তি, আমেনা ও যাবতীয় জিনিসপাতি গাড়ি উঠিয়ে নিদিষ্ট গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলো। ওদের গাড়ি চোখের আড়াল হতেই শেফালী অংকুরের দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিলো একটা। মিতালী শেফালীর হাত ধরে শপিংমলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ড্রেস কিনতে তাড়াতাড়ি আয়। বাসায় ফিরতে হবে।’

দাঁড়িয়ে পরলো শেফালী। তারপর দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘বুবু? আমি আর তোমার দেবর মিলে কিনে নিবো। তোমরা এবার যাও।’

অবাক হলো মিতালী। বিস্মিত হয়ে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায়?’

অংকুর মিতালীর পাশে এসে বলল, ‘লং ড্রাইভে। শেফালী তোমাকে অনেক অনেক থ্যাঙ্কস।’

শেফালী জামার কলার ধরে টেনে একটু ভাব নিলো। হেসে উঠলো অংকুর। তারপর মিতালীর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলো। হতবাক হলো মিতালী। কাহিনী কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো।
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪০]

সাঁঝবেলা শেষে মিটমিট করে অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে ধরনী। রাস্তার দুই পাশে জ্বলে উঠেছে সোডিয়ামের কৃতিম আলো। সেই আলোতে পিচ ঢালা রাস্তা দৃশ্যমান। ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও খোলা আকাশের নিচে কৃতিম আলোর সাহায্যে রাত্রী বিলাস করছে মানুষ। রাজধানীতে দিনের চেয়ে রাতের পরিবেশ আরো মুগ্ধকর। টিএসসিতে গেলে দেখা যাবে কত রকমের মানুষের আগমন ঘটে রাতে। কেউ কেউ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ চা খাচ্ছে। কেউ গান গাইছে। কেউ বই পড়ছে। আবার কেউ টিএসসির মোড় ধরে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছে। বর্তমানে মিরপুরের রাস্তা ধরে অংকুরের গাড়ি চলছে আপন গতিতে। এক মনে ড্রাইভ করছে অংকুর। পাশে মিতালী চুপচাপ বসে আছে। চেহারায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ ভাস্যমান। গম্ভীর চোখেমুখে গাড়ির জালানার বাহিরে তাকিয়ে আছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। বড়দের অগোচরে এভাবে নিয়ে আসার কোনো মানে আছে? আর কয়েকদিন পরই তো দেখা হতো। এই বদলোকের সাথে কথা বলবে না সে। নিকুচি গেছে লং ড্রাইভের।

ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে মিতালীর দিকে তাকাচ্ছে অংকুর। সেই কখন থেকে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটা তাকে পাত্তা-ই দিচ্ছে না। জীবনের প্রথম বার লং ড্রাইভে যাচ্ছে দুজন। কোথায় কাধে মাথা রেখে প্রেম করবে। কিন্তু তা না; উলটো রেগে বোম্ব হয়ে বসে আছে। এই মেয়ে অনেক খারাপ। বিশাল মাপের খারাপের তালিকায় মিতালীকে ফেলা যায়। অন্যদের সাথে ঠিক-ই মিষ্টি মিষ্টি হেসে কথা বলে। কিন্তু তার সাথে? যতোবার দেখা হয়েছে ততোবারই রেগে ছিলো কোনো এক কারণে। তার সাথে এমন করার সায়েন্স অংকুরের মাথায় ধরে না। মনে মনে বিরক্ত হলো কিছুটা। কিন্তু বুঝালো না। বাঘিনীর সাথে বাঘার রাগ দেখাতে নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবে ঠোঁটে হাসি টেনে সামনে তাকিয়েই বলল, ‘এই রাস্তা টা চিনো?’

মিতালী ত্যাঁছড়া ভাবে ব্যঙ্গ্য করে বলল, ‘না চিনি না। আপনি আমাকে চিনিয়ে দিবেন প্লিজ?’

মুখ কালো করে ফেললো অংকুর। মলিন চোখে একবার মিতালীর দিকে তাকালো। তারপর সামনে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললো, ‘সমস্যা কি বলো তো মিলি? সবসময় আমার সাথে রেগে কথা বলো কেন? কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে। কোথায় একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে। প্রেম প্রেম ভাইভ আনবে। তা না করে ঝাঁঝ দেখাচ্ছো। এটা কি ঠিক করছো?’

ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে অংকুরের দিকে তাকালো মিতালী। বলে কি এই ছেলে? সবসময় কোথায় রেগে কথা বলে সে? ইমোশনাল ব্রে:ক:মে:ইল করলেও একটা রিজন থাকা লাগে। কিন্তু তার হবুবর উরফে অংকুর রিদওয়ান ছেলেটা রিজন ছাড়া ব্রে:ক:মে:ইল করে। নিজেই মিতালীকে এডাল্ট বলে, আবার নিজেই নিব্বাদের মতো বিহেভ করে। পুরো মানুষটাই আশ্চর্য। অংকুরের অগোচরে আনমনেই স্মিতি হেসে ফেললো মিতালী। কিন্তু রাগ বিন্দুমাত্র কমালো না। আগের মতোই রাগি রাগি চেহারা নিয়ে বসে রইলো।

মিতালীকে নিশ্চুপ দেখে অংকুর অসহায় ভাবে বলে উঠলো, ‘আমার মতো এতো শান্তশিষ্ট, নম্র-ভদ্র ছেলেটার উপর তোমার এমন অ:ন্যায় মানা যায় না মিলি। একে তো তোমার প্রেমে ফেলে গুরুতর অ:ন্যায় করেছো। তার উপর আবার এখন অ:ত্যা:চার করতেছো। নি’র্দয়, অসহায় ছেলেটাকে এভাবে তিলে তিলে হ:ত্যা করতে তোমার বিবেকে বাধে না?’

অংকুরের দিকে অবাক চোখে তাকালো মিতালী। বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেছে। অ:ন্যায়? অ:ত্যা:চার? সিরিয়াসলি? এমন বলার কারণ জানতে চেয়ে বলল, ‘কিভাবে অ:ত্যা:চার করলাম আমি?’

রাস্তার দুই পাশে বিশালাকৃতি অলিশিয়ান শেষে এখন নির্জন রাস্তা। দুপাশে কেবল গাছপালার পটভূমি। রাস্তাটাও অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনেক টা দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। বর্তমানে এমনি-ই নির্জন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। মিতালী কথাটা বলার সাথে সাথে তুমুল রুপে ব্রেক কষলো অংকুর। আকর্স্মিক গাড়ির ব্রেক কষায় হকচকিয়ে গেলো মিতালী। বিস্মিত হয়ে তাকালো অংকুরের দিকে। এভাবে, এখানে গাড়ি থামানোর কারণ টা খুঁজে পেলো না।

গাড়ি থামিয়েই আলতো করে বাঁকা হাসলো অংকুর। মিতালীর দিকে এগিয়ে এক হাত মিতালীর অপর পাশে রেখে ঝুকে আসলো। প্রগাঢ় চোখে তাকালো মিতালীর চোখের দিকে। অংকুরের এমন কাজে মিতালীর চোখ প্রায় চড়কগাছ। আশ্চর্য হলো বেশ। পিছিয়ে গাড়ির সিটের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নেওয়ার প্রয়াস করলো। মিতালীর এমন চাহনীতে মৃদু শব্দে হেসে উঠলো অংকুর। প্রেয়সীর মুখের পাশে অবাধ্য এলোমেলো চুল গুলো আলতো হাতে কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

‘সাধারন একটা ছেলের মতোই স্বাভাবিক ভাবে চলছিলাম। মাঝখানে দেখা দিলে তুমি। রাগি রাগি চাহনী, গুলুমুলু চেহারা, মিষ্টি হাসি দিয়ে তোমার প্রেমে আবব্ধ করে ফেললে। প্রতিটি ক্ষণে তোমাতে বিলীন ছিলাম। যার সঙ্গ সবসময় চাইতাম। যাকে একটুখানি দেখার আকাঙ্ক্ষায় সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকতাম। যার সাথে কথা বলতে না পারলে ভীষণ খারাপ লাগতো। তোমার ভালোবাসার অসুখে আক্রান্ত হয়ে প্রতিষেধকের সাহায্য নেই নি। তোমাকে ভালোবাসার পর এতো এতো অসুখে স্বীকার হচ্ছি আমি। এবার বলো এইগুলো কি অ:ত্যা:চার নয়?’

হতভম্ব হয়ে গেলো মিতালী। দৃষ্টি তার নউতো হলো না। এক দৃষ্টিতে অংকুরের গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো। অংকুর মিতালীর কপালে কপাল ঠেকালো। মিতালী চোখ বন্ধ করে ফেললো। অংকুর তার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়েই মৃদু কন্ঠে বলল,

‘তুমি আমার অদ্ভুত অসুখ। যার বেদনার অনুভূতি তীব্র। আর এই তীব্র অনুভূতির স্বীকার সারাজীবন হতে চাই।’
.

পুরো শপিংমল ঘুরে বেচারা রাকিবের পা দুটো অবশ হয়ে এসেছে। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে সে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। শেফালীকে মাথায় তুলে আ’ছা’ড় মারতে ইচ্ছে করছে তার। কান ধরেছে। এই জীবনে মেয়ে মানুষের সাথে শপিংএ আসবে না। না মানে না।

বহু কষ্টে ঘুরে ঘুরে একটা হিজাব কিনলো শেফালী। এই কালার টা সেই কখন থেকে খুঁজছে সে। এখন হাতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। পিছু ফিরে রাকিবের দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচেকা খেলো শেফালী। রাকিবের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কি হয়েছে? রাক্ষসের মতো তাকিয়ে আছেন কেন?’

রাগি রাগি চাহনীতে ধমকে উঠলো রাকিব, ‘এই একটা হিজাবের জন্য কতো গুলো দোকান ঘুরেছো বলো তো? দোকানদার কি বলবে? ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিলে।’

বিরক্ত হলো শেফালী। কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘তো কি করবো? ঘুরেছি তো অনেক দোকান। কিন্তু মন মতো পাচ্ছিলাম না।’

রাকিব দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘দোকানদার হাজারটা হিজাব দেখিয়েছে। এতো এতো হিজাবের মাঝে একটাও পছন্দ হয় নাই?’

শেফালী কপাট রাগ দেখিয়ে চোখমুখ শক্ত করে উত্তরে বলল, ‘হাজারটা দেখালে কি হবে? কালার ম্যাচিং হয় না, হলেও সফট না, আবার বেশি ছোট। তাহলে নিবো কিভাবে? আর আপনি এভাবে রেগে আছেন কেন?ঘুরে ঘুরে কিনেছি বলেই তো সুন্দর হিজাব পেয়েছি। আশ্চর্য!’

রাকিব পূর্বের ন্যায় রেগে বলল, ‘ভুল হইছে তোমার সাথে থাকা। ঘুরতে ঘুরতে আমার পা অকালে অজ্ঞান হয়েছে। এতো হাঁটতে পারো? দেখতে চিকনা হলে কি হবে। ভালোই হাঁটার শক্তি আছে। দোকানদার রা হিজাব বের করার পরেও নেও নি। তারা কি ভাব্বে বলো।’

শেফালী অপমানবোধ করলো। শরিরে রাগ তিরতির করে বেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘এমন করলে জীবনেও বউ পাবা না।’

দাঁড়ালো না এক মুহূর্তও। গটগট পায়ে বেড়িয়ে যেতে লাগলো শপিংমল থেকে। পিছন থেকে রাকিব গলার আওয়াজ একটু উঁচু করে বলে উঠলো, ‘এমন বউ আমার লাগবেও না।’
.

বুকে হাত গুঁজে অংকুরের কালো বাইকটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেফালী। এতোক্ষণে রাকিবের চৌদ্দ গোষ্টি ডিটারজেন্ট ছাড়া ধুয়ে ফেলেছে সে। রাকিবের চুল ছিঁ:ড়তে ইচ্ছে করছে তার। বাইকটা দেখে রাকিব ভাবলো। লা:থি দেওবার জন্য পা উঠিয়েও আবার থামিয়ে ফেললো। বাইকটা কার? জিমির নাকি রাক্ষসের? তখন অংকুর লং ড্রাইভে যাবে বিধায় গাড়ি নিয়ে বাইকের চাবি রাকিবের কাছে দিয়ে গেছে। আসলে কার বাইক, কার গাড়ি জানে না শেফালী। তাই পা টা শান্ত মেয়ের মতো নামিয়ে নিলো। কনফার্ম হয়ে নাহয় লা:থিটা দেওয়া যাবে।

একটু পরেই সেখানে হাজির হলো রাকিব। শেফালীর দিকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বাইকে উঠে বসলো। চাবি বাইকে লাগাতে লাগাতে বলল, ‘তোমার শপিং করা তাহলে শেষ?’

বাইক সার্ট দেবার পর শেফালী রাকিবের কাধ ধরে বাইকে উঠে বসে স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘না। আরো কিছু জিনিস বাকি আছে। সেগুলো কাল এসে কিনবো। আসবেন আমার সাথে?’

শেফালীর বলার সাথে সাথে রাকিব উত্তরে বলে উঠলো , ‘জীবনেও না। তোমার সাথে এই জন্মে শপিংমলে রাকিব আর নাই।’

দাঁত কটমট করে অন্যদিকে তাকালো শেফালী। বিড়বিড় করে বলল, ‘দেখিস এমন-ই একটা বউ জুটবে তোর কপালে।’

কথাটা বিড়বিড় করে বললেও কর্ণপাত হলো রাকিবের। নিঃশব্দে মৃদু হাসলো সে। মনে মনে বলল, ‘এমন-ই না। তুমি।’
.

বাসার কাছে বাইক থামানোর পরে নামলো শেফালী। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রাকিবের সামনে দাঁড়াল। শেফালীর টুল পরা হাসি দেখে মুগ্ধ হলো রাকিব। ভুলে গেলো যতো গ্লানি। মোহিত চোখে তাকিয়ে রইলো শেফালীর দিকে। শেফালী বলল, ‘ধন্যবাদ। এতোটা সময় দেওয়ার জন্য।’

স্মিতি হাসলো রাকিব। উড়ন্ত চুল গুলো হাত দিয়ে ঠেলে পিছে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ লাগবে না।’

‘আচ্ছা এই বাইকটা কার? আর ওই গাড়িটা?

‘এটা আমার। অংকুরের বাইকটা নীল কালার। আর গাড়িটা আমরা দুইজন মিলেই কিনেছি। যদিও আমি আরেকটা কেনার পরিকল্পনা করছি। ওটা অংকুরকে তার বার্থডেতে গিফট দিবো। পুরনো টা আমি নিয়ে নিবো। এমনিতেও মিলেমিশে চালাই আমরা।’

ঠোঁটে হাসি রেখেই মাথা দুলালো। দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘আপনার বাইকটাই চাইছিলাম।’

কথাটা ঠিক বুঝে আসলো না রাকিবের। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। বুঝার চেষ্টা করলো শেফালীর ভাবে হাসার কারণ। হঠাৎ-ই বাইকে ধামসে একটা লা:থি মারলো শেফালী। যদিও তার লাথি এই মজবুত বাইকের কাছে কিছুই না। তবুও যেন শেফালী তার আত্মায় শান্তি পেয়েছে। পরপর দুইটা লা:থি দিয়ে বলল, ‘কি ভেবেছেন? শপিংমলে আমাকে চিকনা বলে অপমান করবেন, ধমকাবেম আর আমি চুপ থাকবো? ইম্পসিবল! এই নেন আরেকটা লা:থি।’

শেফালীর এহেন কান্ডে বিস্মিত হলো না রাকিব। বরঞ্চ কপাল কুঁচকে ভ্রুঁ যুগল উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো শেফালীর দিকে। চোখ নামিয়ে শেফালীর পায়ের দিকে তাকালো একবার। তারপর শেফালীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘পা টা কি জীবিত আছে?’

রাকিব বলার সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উলটালো শেফালী। কাদুকাদু চেহারায় বলে উঠলো, ‘আপনার বাইকটা এতো শক্ত কেন? আমার পা আরেকটু হলে ভেঙ্গে যেতো।’

হাসি পেলো রাকিবের। কিন্তু হাসলো না। কারণ এখন হাসলে শেফালী দ্বিগুণ রেগে যাবে। আপাতত বিদায়ের ক্ষণে রাগাতে চায় না সে। তাই এক হাতের ইশারায় শেফালীকে কাছে ডাকলো। শেফালী একটু এগিয়ে আসলেই রাকিব গাল টেনে বলল, ‘মাঝে মাঝে একটু বেশি বাচ্চা বাচ্চা বিহেভ করো। যাইহোক, এখন বাসায় যাও। পরে রাগ দেখিও।’

শেফালী ঠোঁট উলটে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলালো। তারপর চুপচাপ বাসার ভিতরে চলে আসলো। শেফালী যেতেই স্মিতি হেসে উঠলো রাকিব। মেয়েটার গাল টেনে দিয়েছে সে। অথচ প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। ভাবা যায়?
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪১]

রাতের ঘড়ির কাটা প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই। চারপাশ একদম নিঝুম, নিস্তর। কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। ঢাকার বিভিন্ন অলিগলি ঘুরাঘুরি শেষে মিতালীদের এলাকার দিকে গাড়ি ঘুরালো অংকুর। কিছুসময় অতিবাহিত হবার পর নিদিষ্ট স্থানে অতি সাবধানে গাড়ি থামালো। অতঃপর চুপচাপ বসে রইলো দুজন। মিতালী অংকুরের দিকে তাকালো বিদায় নেওয়ার জন্য। দেখলো অংকুর সামনে তাকিয়ে আছে। মিতালী মোবাইলে সময় দেখলো। অনেক রাত হয়েছে। সবাই কি ভাববে? তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তপ্ত শ্বাস ফেললো একটা। অংকুরের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো মতালী, ‘আমি এখন আসি?’

রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিতালীর দিকে নিস্প্রভ চোখে তাকালো অংকুর। এই চাহনীতে মলিনতা প্রকাশ পেয়েছে। বুঝাতে চেয়েছে বিদায় নেওয়ায় সে বড্ড দুঃখি। অংকুরের বিবর্ণ মুখ দেখে বুক কেঁপে উঠলো মিতালীর। তাকিয়ে রইলো তার প্রেমিক পুরুষটির দিকে।

মিতালীর দিকে কিছুটা এগিয়ে আসলো অংকুর। কাছাকাছি এসে মিতালীর সিট বেল খুলতে খুলতে বলল, ‘আবার মনে হয় বিয়ের দিন দেখা হবে তাই না?’

মিতালী মাথা উপর নিচ দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বুঝালো। সিট বেল খুলে মিতালীর চোখের দিকে তাকালো অংকুর। মৃদু কন্ঠে বলল, ‘তাহলে আবার চারদিন পর।’

অংকুরের কণ্ঠস্বর শুনে বাকরুদ্ধ মিতালী। ভীষণ কষ্ট লাগলো তার। অংকুরের ডান গালে নিজের নরম হাতটা আলতো ভাবে রাখলো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো হাতের নরম মাংসে বিঁধে উঠলো। মিতালী আদুরে হাত খানি গালে রেখেই চোখে চোখ রেখে স্নান কন্ঠে বলল, ‘মাত্র তো চারদিন। তারপরেই সারাজীবনের জন্য এক হবো আমরা। তাহলে এতো মন খারাপের কারণ কি?’

অংকুর প্রভাশূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে বিষন্ন গলায় বলল, ‘জানি না। তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না।’

স্মিতি হাসলো মিতালী। বাম হাত তুললো এবার। দুই হাতে অংকুরের দুই গাল আলতোভাবে ধরলো। চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলল, ‘কিছু পেতে হলে কিছু সহ্য করতে হয়। থাক না চারটা দিন অদেখায়। বিয়ের দিন নাহয় বধূ রুপে দেখলেন আমায়।’

অংকুরের মলিন চাহনী এখন নেশাক্ত হলো। মিতালীর কথায় সন্তুষ্ট হয়ে কোমলায়ন ভাবে হাসলো। নিজের গালে মিতালীর নরম হাতের উপর এক হাত রাখলো। অপর হাত মিতালীর গালে রাখলো। আলতোভাবে হাত নামিয়ে মিতালীর কানের পিছে নিয়ে ঘাড়ের পাশে রাখলো। কপালে কপাল ঠেকালো। মিতালী চোখ বন্ধ করে নিলো। ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখে অনুভব করতে লাগলো অংকুরের আলতো স্পর্শ। অংকুর নিজের চোখ বন্ধ করে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।’

অল্প শব্দে মিষ্টি করে হেসে উঠলো মিতালী। ঘাড়ের পাশে অংকুরের হাতটা ধরে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতা।’

ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলো অংকুর। মিতালীর কপাল থেকে নিজের কপাল সরিয়ে মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকালো। তারপর নিজের সিটের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘বাহ্, কবিতা পড়া হয়?’

মিতালী কন্ঠস্বর প্রাণবন্ত করে উত্তরে বলল, ‘আমার কবিতা পড়তে ভীষণ ভালো লাগে।’

আলতোভাবে হাসি দিলো অংকুর। মিতালীর দিকে ঘুরে বসে এক দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘আর আমার কবিতা শুনাতে ভীষণ ভালোলাগে।’

মিতালী উল্লাসিত হয়ে বলল, ‘তাহলে আমাকে প্রতিদিন কবিতা শুনাতে হবে।’

ঘাড় হালকা কাত করে ‘ হ্যাঁ ‘ সম্মতি দিলো অংকুর। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিতালীর দিকে। তার এমন চাহনীতে মিতালী কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। লজ্জাভূতি হলো প্রবল। কোনো রকমে ‘আমি এখন আসি।’ বলে গাড়ির দরজা খুলে বের হলো। চলে যাবার আগে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে ‘ টাটা ‘ দিলো। অংকুর গাড়ির ভিতর থেকেই হাত ‘ টাটা ‘ দিলো। তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ মিতালীর চলে যাবার দিকে। চোখের আড়াল হতেই অংকুর ঠোঁট গোল করে বাঁশী বাজাতে বাজাতে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

.

মিতালী কলিংবেল বাজালে আমেনা দরজা খুললেন। মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে দরজা থেকে সরে এলেন। পিটপিট পায়ে বাসায় ঢুকলো মিতালী। ড্রয়িংরুমে জুলফিকার ও জুলেখা বেগমকে দেখে জড়সড় হয়ে গেলো। লজ্জাভূতি হলো অনেকটা। বিয়ের আগে হবুবরের সাথে এতো রাত্রী অব্ধি বাহিরে থাকাটা বেমানান। কিন্তু সে কি করবে? চলে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু অংকুর! এই লোকটাকে নিয়ে সে আর পারে না। এতো বুঝনোর পরেও বাসায় পৌঁছে দেয়নি তাকে। এখন বাবা দাদীর সামনে কি জবাব দিবে সে? এর থেকে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে?

জুলফিকার টিভিতে ‘ সময় ‘ চ্যানেলে নিউজ দেখছিলেন। মিতালী আসতে দেখে তার দিকে তাকালো। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘রাস্তায় কোনো অসুবিধে হয়নি তো?’

মিতালী বাধ্য মেয়ের মতো কণ্ঠস্বরে নম্রতা এনে বলল, ‘না।’

জুলফিকার কিছু বলার আগেই জুলেখা বলে উঠলেন, ‘নাতজামাই কই? বাসায় আনছ নাই?’

‘চলে গেছে।’

জুলেখার মাথায় যেন ডাব পরলো। চোখ বড়বড় করে মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো, ‘কস কি মাইয়া? মাথা কি গেছে তোর? নাতজামাই রে বাড়ির দরজা থেইকা তাড়াইয়া দিছোস? আক্কেল নাই তোর?’

মিতালী অসহায় দৃষ্টিতে দাদীর দিকে তাকালো। অর্থাৎ বাসায় আসার কথা বলতে ভুলে গেছে সে। জুলেখা বিবি আরো ক্ষেপলেন। কিছুক্ষণ আহাজারি করলেন। নাতজামাই বাসার নিচ থেকে চলে গেছে? এটা তিনি কিছুতেই মানতে পারলেন না। শেফালী টেবিলে বসে নোট করছিলো। দাদীর চেঁচামেচির শব্দ শুনে বিরক্ত হলো। বাহিরে আসল কাহিনী জানার জন্য। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকেই বুঝে গেলো কারণ। এবার যেন বিরক্ত আকাশ চুম্বী হলো। বলল,

‘দাদী? আপনার মাথা গেছে? বিয়ের আগে বর কনে একে অপরের বাড়িতে যায়? বুবুকে দুলাভাইয়ের বাসায় যেতে দিবেন আপনি? এটা বাজে দেখায় না? বিয়ে হওয়ার পরে এই কথা গুলো বলতে পারবেন। ভালো করেছে জিমি আসে নি। বিয়ের দিক একদম নায়কের এন্ট্রি নিয়ে আসবে হ্যাঁ।’

শেষের কথা গুলো উল্লাসিত হয়ে বললো। তারপর মিতালীর দিকে তাকিয়ে বললে উঠলো, ‘তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি। একটা ম্যাথ মিলাতে পারছি না। হেল্প লাগবে।’

‘হুম যাচ্ছি।’ বলে মিতালী নিজের রুমে চলে গেলো। জুলেখা চুপচাপ মুখ কালো করেই বসে রইলেন। ব্যাপারটা তিনি

.

আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে মিতালী। ঠোঁটে তার লাজুক হাসি। আজকের সন্ধ্যা থেকে রাত অব্ধি অংকুরের সাথে কাটানো মুহূর্তের অনুভূতি টা ছিলো স্বর্গীয়। অংকুরের ফাজলামো, দুষ্টি মিষ্টি কথা, বাঁকা দাঁতের হাসি, উড়ন্ত সিল্কি চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি; সব কিছুতেই ভালোলাগা রয়েছে। রয়েছে প্রবল অনুভূতি। বিশ্বাস ও ভালোবাসা। এইসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে লাজুক হাসছে মিতালী।

‘হবুবরের সাথে লং ড্রাইভ শেষে আয়নার সামনে বসে মুচকি মুচকি হাসার জন্য হলেও একটা বিয়ে করা দরকার।’

শেফালীর কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেলো মিতালী। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। দেখলো শেফালী কোমড়ে এক দিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্ত শরির নিয়ে যেভাবে দাঁড়ায় মানুষ, ঠিক সেই ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে শেফালী। তাকে দেখে মুখের লাজুকলতা মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেলো মিতালীর। মৌনতার সঙ্গে শেফালীকে উপেক্ষা করে আবারো চুল আঁচড়াতে লাগলো।

শেফালী আগ্রহভরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলো মিতালীর দিকে। পাশেই বিছানায় বসে প্রশ্ন করলো, ‘কোথায় গেলে তোমরা?’

মিতালী আয়নার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি।’

উত্তর টা পছন্দ হয়নি শেফালীর। তাই বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চাহ্’ জাতীয় উচ্চারণ করলো। বলল, ‘আমি জায়গাটার নাম জনতে চাইছি।’

‘মিরপুর।’

শেফালী দুষ্টু হেসে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলল, ‘কি এমন খেয়েছো যে বাসায় খেলে না? জিমি কিছু দিয়েছে নাকি?’

চোখ পাকিয়ে তাকালো মিতালী। কটমট করে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘তুই অনেক শ’য়’তা’ন হয়েছিস। এখানে কি তোর? নিজের রুমে যা।’

‘হাহ্, হাহ্, জানি। জানি। কিছুমিছু আদানপ্রদান করা হয়েছে। নাহলে পেট ভরা থাকে কিভাবে?’

ধমকে উঠলো মিতালী, ‘শেফালী?’

কিন্তু শেফালী তো শেফালীই। থামলো না। নন-স্টপ কথা চালিয়েই গেলো, ‘লং ড্রাইভে যাওয়ার কথা ছিলো শুধু। কিন্তু হলোটা কি? কিছুমিছু আদান প্রদান করে করা হয়েছে। তাও আবার বিয়ের আগে? ভাবা যায় এইগুলা?’

মিতালী তার হাতে থাকা চিরুনি তাক করে শেফালীর দিকে ছুঁড়ে মারলো। ‘ আহ্’ বলে লাফিয়ে উঠলো শেফালী। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

চলমান..
চলমান..
চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here