অনেক সাধনার পরে পর্ব -৪৯+৫০ ও শেষ

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪৯]

শেফালীর হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো রাকিব। থামার নাম নেই তার মাঝে। রাকিবের পায়ের গতির সাথে লেহেঙ্গা পরিহিত শেফালী তাল মেলাতে পারছে না। লেহেঙ্গায় পা পরছে বারবার। বিরক্ত হলো বেশ। বাহিরে আসার পর রাকিবের হাত ঝামটা মে’রে ছাড়িয়ে নিলো। দাঁড়িয়ে পরলো। তীক্ষ্ণ চোখে শেফালীর দিকে ফিরে তাকালো। রাকিব শক্ত করে হাত ধরায় হাতটা এখন জ্বলছে প্রচুর। ফরশা হাতে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পরে লাল হয়ে গেছে। লাল লাল আঙ্গুলের দাগ দেখে মহা বিরক্ত ও রাগ হলো শেফালী। অসন্তোষজনক চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি আপনার? এভাবে ধরে আনার মানে কি?’

রাকিব চোয়াল শক্ত করে রাগি গলায় বললো, ‘সমস্যা আমার না তোমার। ওই রায়াজের সাথে এতো কিসের তোমার হ্যাঁ? ওই ছেলে কেন তোমার হাত ধরবে? ভাই বলেই কি হাত ধরে হাহা হিহি করা লাগবে? আমারো তো অনেক মেয়ে কাজিন আছে। আমি তাদের হাত ধরেছি কখনো? তাহলে রায়াজ কেন ধরবে তোমাকে?’

রাকিবের কথা শুনে বোকা বনে গেলো শেফালী। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। রাকিবের এমন করার কারণ সম্পূর্ণ ভাবে বুঝে আসলো শেফালীর। জেলাস!

রাকিব আবারো রাগে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘শেফালি তোমাকে লাস্ট বারের মতো বলছি। ওই ছেলে যেন তোমার আশেপাশে না থাকে। নয়তো, নয়তো বড় ঝা’মে’লা পাকিয়ে ফেলবো।’

শেফালী ভ্রুঁ দুটো উচিয়ে রেগে তাকালো। কোমড়ে দুই হাত রেখে পালটা রাগ দেখিয়ে বললো, ‘রায়াজ আমার হাত ধরলে আপনার কি?’

‘শেফালী??’ দাঁতে দাঁত কটমট করে বললো রাকিব। শেফালীর রাগ আরো বাড়লো। রুক্ষভাষী কন্ঠে বলল, ‘জেলাস হবেন ভালো কথা। তাই বলে না জেনে ভুলবাল দেখে জেলাস হবেন? আশ্চর্য ভাই আপনি। রায়াজ আমার মামাতো ভাইই লাগে। তার একটা বউ আছে। আর তিন মাস পর সে বাবা হবে। বলি দুনিয়াতে এতো এতো ছেলে থাকতে আমার বিয়াইত্তা মামাতো ভাইরে দেখে জেলাস হলেন? আর একটু আগে কাহিনী টা কি করলেন? বড় ভাইয়ের সামনে আমার মান ইজ্জতের ফালুদা করে দিলেন। এখন উনি কি ভাব্বে বলেন।’

রাকিব বিস্মিত হলো। অবাক চোখে তাকালো শেফালীর দিকে। বিবর্ণ হলো তার মুখখানি। এক হাতে মাথার পিছনের চুল গুলো চুলকে বললো, ‘উনার বউ আছে?’

রাকিবের কথাটি ব্যঙ্গ্য করে শেফালী রিপিট করলো। রাগ দেখিয়ে বললো, ‘চুপ! আর একটাও কথা বলবেন না। কি বললেন তখন? ডোন্ট ট্রাই টু টাচ হার এগেইন। খুব তো বড় বড় করে বলে দিলেন। এখন রায়াজ ভাই যদি আব্বুকে বলে দেয়?’

ফ্যাকাশে হয়ে এলো রাকিবের মুখ খানি। আড়ষ্ট গলায় বললো, ‘এখন আমি কি করবো?’

শেফালী কটমট চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো, ‘আমার মাথাটা চিবিয়ে খান।’

চলে লেহেঙ্গা ধরে সামনে এগুতে লাগলো শেফালী। পিছন থেকে রাকিব ডাক দিলো আবারো। বললো, ‘এখন কি করবো কিছু তো বলে যাও।’

শেফালী পিছনে মাথা ঘুরিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো, ‘খবরদার! আমাকে ডাকবেন না। তখন বলার আগে মাথায় ছিলো না? স্টুপিড।’

দাঁড়ালো না শেফালী। দ্রুত পা চালিয়ে ভিতরে চলে গেলো। রাকিব আগের জায়গায় আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হলো। মনে মনে নিজেকে শ’খানেক গালি শুনিয়ে দিলো। বিড়বিড় করে বললো, ‘একেই বুঝি বলে নিজের পায়ে নিজে কু’ড়া’ল মা’রা।’
.

রিসিপশন শেষ! এবার মিতালীদের বাসায় যাওয়ার পালা। মিতালী অংকুরের ব্যাগ সহ নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। তার শাশুড়ির দেওয়া জলপাই রঙের একটা শাড়ি হাতে নিয়ে পরে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ রুপে তৈরি হয়ে নিলো। তখুনি রুমে আসলো অংকুর। তাকে দেখে মিতালী সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘আমি রেডি। এবার যাওয়া যাক?’

অংকুর মিতালীর পা থেকে মাথা অব্ধি দেখলো। সাজটা তার পছন্দ হলো না। চুপচাপ আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। অংকুরের এমন কাজে অবাক হলো মিতালী। কিছু বললো না কেন লোকটা? মন খারাপ? নাকি রেগে আছে? অংকুর চুপচাপ পুরো আলমারি ঘাটলো। মিতালীকে দেওয়া সব শাড়ি খুঁজে খুঁজে পছন্দ মতো হলুদ রঙের একটা শাড়ি বের করলো। শাড়িটা মিতালীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা পরে আসো।’

বিবর্ণ ধারণ করলো মিতালী মুখশ্রী। মাথা নিচু করে নিজের পরনের শাড়িটা দেখলো। এই জলপাই কালারের শাড়িটা তার শাশুড়ির দ্বিতীয় শাড়ি। এই শাড়ি পরেই নাকি উনি বিয়ের পর প্রথম তার বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাই সখ করে এই শাড়িটা মিতালীকে দিয়েছে পরার জন্য। এখন এই শাড়ি খুলে হলুদ শাড়িটা পরবে সে? শাশুড়ি মায়ের এইটুকু ইচ্ছেটা পূরণ করবে না সে? মিতালী অংকুরের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে বললো, ‘পরনের টাই থাক না। শাড়িটা মা দিয়েছে পরার জন্য। খুলে ফেললে কষ্ট পাবে।’

অংকুর তার কথায় অটুট থেকে বললো, ‘পাবে না। তুমি হলুদ শাড়িটা পরো। হলুদ শাড়িতে তোমাকে দারুণ লাগে। যাও বদলে আসো।’

‘হলুদ শাড়িটা নাহয় কাল পরি? আজ এটাই থাক।’

কিছুটা বিরক্ত হলো অংকুর। কন্ঠস্বর একটু বড় করে বললো, ‘বললাম তো কষ্ট পাবে না। তুমি হলুদটাই পরবে।’

মিতালী এগিয়ে অংকুরের কাছে এসে শাড়িটা হাতে নিয়ে বললো, ‘শাড়িটা ব্যাগে নিয়ে নিচ্ছি। কাল পরবো।’

হঠাৎ-ই রাগ হলো অংকুরের। মিতালীর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে আলমারি ঢিল দিয়ে ফেলে বললো, ‘পরতেই হবে না।’ বলেই গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। বিয়ের পর এই প্রথম কোনো ব্যাপারে অংকুর তার কাছে আবদার করলো। কিন্তু সেই আবদার মিতালী রাখতে পারলো না? কি হতো হলুদ শাড়ি টা পরলে? আম্মুকে বললে তো আম্মু বুঝতে পারতো। মুখের উপর বলে দিলো কাল পরবে? ইগোতে লাগলো অংকুরের। রাগ হলো প্রচুর। অভিমান জমলো মনে।

মিতালী অবাক চোখে দরজায় তাকিয়ে রইলো। রেগে গেলো লোকটা? ক্ষুন্ন হলো মিতালীর মন। অংকুরের ছোট আবদারটা পূরণ না করার জন্য মন খারাপ হলো। কিন্তু শাশুড়ির এই শাড়িটা না পরলে উনি মন খারাপ করতেন। এতোদিনের ইচ্ছেটা মিতালী আজ পূরণ করবে। আজ না পরলে হবেও না। ব্যাপারটা অংকুর বুঝলো না! লোকটা অনেক অদ্ভুত। মিতালী হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলুদ শাড়িটা ব্যাগে নিয়ে নিলো।
.

গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মেয়েদের দল আবিরের সাথে চলে গেছে। জুলফিকার ও তার ভাইয়েরা সুপ্তি বেগম ও অলীউর রাহমানের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রইলো শুধু রায়াজ, অংকুর, মিতালী ও জারা। মিতালী শাশুড়ি মায়ের কাছে বিদায় গাড়িতে উঠে বসলো। অংকুর সামনের সিটে বসায় জারা মিতালীর পাশে বসলো। মিতালী খেয়াল করলো অংকুর এখনো তার সাথে রেগে আছে। ক্ষুন্ন হলো তার মন। বিষন্ন মনে বসে রইলো নিরবে।

রায়াজ ড্রাইভ করবে। তাই চাবি হাতে নিয়ে গাড়িতে বসার জন্য দজরা খুলতেই ডাক দিলো রাকিব। দাঁড়িয়ে পরলো রায়াজ। গাড়ির দরজা বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়াল। রাকিব রায়াজের সামনে ইতস্তত করে বললো, ‘আসলে ভাইজান! তখনের ঘটনার জন্য আই’ম স্যরি। আসলে আমি জানতাম না আপনি ম্যারিড। তাছাড়া শেফালীর হাত ধরাতে রাগ উঠেছিলো আমার। তাই..!’

রাকিবের কথার পিঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো রায়াজ, ‘ম্যারিড না হলে কি করতে?’

রায়াজের চোখে চোখ রাখলো রাকিব। ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো প্রশ্নের, ‘সাধারন ভাবে যা করার দরকার তাই করতাম।’

রায়াজ মাথা দুলালো। রাকিব আবারো বললো, ‘তবে যাইহোক, তখনের জন্য আই’ম স্যরি।’

‘ইট’স ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।’

বলেই গাড়িতে উঠলো রায়াজ। রাকিব আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো গাড়ির দিকে। এখন স্যরি বললেও রাগ কমেনি তার। ভাই তোর বউ আছে। তাও কেন ফুফাতো বোনের হাত ধরবি তুই? বেশরম! মনে মনে রায়াজের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো রাকিব।
.

নতুন জামাই! প্রথম আগমন! আপ্যায়ন চলছে তুমুল রুপে। ব্যস্ত আমেনা। ব্যস্ত জুলেখা। মেহমান বলতে শুধু মিতালীর কয়েকজন কাজিনরা রয়েছে। তাদের সাথেই সোফায় বসে কথা বলছে অংকুর। মিতালী রান্না ঘরে আমেনা আর জুলেখা কে সাহায্য করতে ব্যস্ত। রাতের খাবারের সময় হলো। জামাই আপ্যায়নে কোনো কিছুর কমতি রাখলো না আমেনা। টেবিলে এতো এতো খাবার দেখে অবাক হলো অংকুর। খাবার খাওয়ার পরে তো যায় যায় অবস্থা। এতো খাবার কেউ খায়? একদিনে মনে হয় ১০ কেজি ওজন বেড়ে গেছে তার।

খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে অংকুরের দিকে আড় চোখে তাকিয়েছে মিতালী। এখন অব্ধি মিতালীর সাথে কথা বলেনি অংকুর। বিষণ্ণবদন হলো মিতালীর মন। কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে সে নিয়ে চিন্তিত হলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে জুলফিকার ও রায়াজের সাথে অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা করলো অংকুর। এক পর্যায়ে ঘড়িতে সময় দেখে রায়াজ আলোচনার সমাপ্তি ঘটালো। অংকুর বসার রুম ছেড়ে মিতালীর রুমে আসলো। দরজা বন্ধ করে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো মিতালী নেই। বুকশেলফের দিকে তাকালো একবার। মেয়েটা এতো বই পড়ে? বুকশেলফের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বই হাতে নিলো। বইটার কয়েকটা পৃষ্টা উলটে দেখলো অংকুর। তখুনি পিছন থেকে পরিচিত কেউ একজন জড়িয়ে ধরলো। কোমল হাত দুটো, শরিরের ঘ্রাণ, সংস্পর্শে আসা মানুষটা অংকুরের চেনা। স্পর্শ পেতেই চিনতে ভুল করলো না। মিতালী অংকুরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে মিষ্টি সুরে গান গায়লো একটা।

‘আজ এক নাম না জানা কোনো হাওয়া
চোখ বুজে ভাবছে বেয়াদব ধূলো
টুপটাপ বৃষ্টিফোঁটা গেলো থেমে
ভেজাভেজা খিড়কি দরজা তুমি খুলো

তুমি যাবে কি? বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে, ডাকলো কেউ
তুমি পাবে কি? পা-পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ।’

অংকুর মিতালীর হাত দুটো ছাড়িয়ে পিছু ফিরে তাকালো। তার বলা সেই হলুদ শাড়িটি পরেছে মিতালী। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। চুল গুলো উন্মুক্ত। লাজুক হাসিতে একদম মিষ্টি লাগছে। মিতালীর মুখের সামনে আঁচড়ে পরা অবাধ্য চুল গুলো আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে নিজেও পরের লাইন গুলো গায়লো..

‘ছুঁয়ে দিলে সোনাকাঠি খুঁজে পাই
যদি যাই ভেসে, এমনি ভেসে যাই।
ছুঁয়ে দিলে সোনাকাঠি খুঁজে পাই
যদি যাই ভেসে, এমনি ভেসে যাই।’

মিতালীর কপালে প্রগাঢ় চুমু একে দিলো অংকুর। আবেশে মিতালী নেত্রপল্লব বন্ধ করে ফেললো। চুমু দেওয়ার পর মিতালীর গাল দুটো আদুরে দুই হাতে ধরলো অংকুর। মিতালী অংকুরের চোখে চোখ রাখতেই অংকুর মৃদু গলায় বললো, ‘তোমার সাথে রেগে বড্ড মুশকিল। তোমার সংস্পর্শে আসলে রাগ, অভিমান কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়।’

মিতালী মিষ্টি করে হাসি দিলো একটা। অংকুরকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো। এইখানটা তার ভরশার জায়গা। এইখানেই রয়েছে যতো শান্তি। এইখানেই সারাজীবন থাকতে চায় মিতালী। এইখানের অধিকারী মানুষটা তার পাশে সারাজীবন থাকুক।
.
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

৫০ [অন্তিম পর্ব]

আজকের সকালটা শুরু হলো নতুন ভাবে। অন্যান্য দিনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। নিজেকে কারোর বাহুডোরের মাঝে আবদ্ধ পেলো মিতালী। পিটপিট করে চোখ খুলতেই অংকুরের ঘুমন্ত মায়াবী মুখশ্রী ভেসে উঠলো সামনে। এই মানুষটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এতো সুন্দর লাগে আগে জানতো না মিতালী। গতকাল সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর অংকুরকে পাশে পায়নি সে। তার ঘুম ভাঙ্গার আগেই অংকুর রুম থেকে চলে গিয়েছে। আজ অংকুরের আগেই ঘুম ভাঙ্গলো তার। তাই তো অন্যান্য দিনের তুলনায় নতুন ভাবে সূচনা হলো সম্পূর্ণ আলাদা এক সকাল। এক হাত উঠিয়ে আলতো ভাবে অংকুরের গাল স্পর্শ করলো মিতালী। তখুনি চোখ খুললো অংকুর। মিতালীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘গুড মর্নিং সুইটহার্ট।’

‘আপনি সজাগ ছিলেন? নাকি ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছি?’

মিতালীর মুখের সামনে পরে থাকা চুল গুলো অংকুর স্বযত্নে কানের পিছনে গুঁজে বললো, ‘অনেক আগেই উঠেছি।’

মিতালী আবারো বললো, ‘তাহলে উঠলেন না কেন?’

অংকুর মিতালীর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো, ‘বউ কে ছেড়ে এতো সকালে উঠতে মন চাইছে না। নেহাৎ কাল কাজ ছিলো তাই বাধ্য হয়ে উঠতে হয়েছে।’

আলতো শব্দে হেসে উঠলো মিতালী। অংকুরকে ঠেলে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বললো, ‘ফ্রেশ হয়ে আসেন। কফি নিয়ে আসছি আমি।’

‘উহুম! এখন না।’ বলেই মিতালীর বাহু টেনে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো। মিতালী হতবাক হয়ে গেলো অংকুরের এমন কাজে। কোনো রকমে আবারো নিজেকে অংকুরের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামলো। শাসনের ভঙ্গিতে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এখুনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি কফি নিয়ে আসছি।’

‘বাহ্! বিয়ের তৃতীয় দিনেই জ’ল্লা’দ সাজার চেষ্টা করছো। ভালোই। কফি খাবো না। তোমার হাতের চা নিয়ে আসো।’ মুখখানি কালো করে কথা গুলো বললো অংকুর। অসন্তুষ্ট হয়ে ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। মিতালী নিঃশব্দে হেসে ফেললো অংকুরের কথায়। লোকটার চেহারাটা এই মুহূর্তে দেখার মতো ছিলো।

বেশ কিছুসময় নিয়ে হাত মুখ ধোয়ার পর বেরুলো অংকুর। তারপর পা বাড়ালো মিতালীর বারান্দার দিকে। রেলিংয়ে দুই হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালো। তারপর তাকালো রাস্তাটার দিকে। এখানেই দাঁড়িয়ে রাতে ফোনালাপ করতো তারা। আজ সে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাবা যায়? কি সাত কপালের ভাগ্য তার। ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করা পাওয়া আসলেই সাত কপালের ভাগ্য। যা সবার থাকে না।

কাপে চা নিয়ে এসে রুম ফাঁকা দেখে বারান্দায় আসলো মিতালী। অংকুরের হাতে এক কাপ দিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। অংকুর কাপে চুমুক বসিয়ে তৃপ্তির সুর তুললো, ‘ওয়াহ্! কিয়া চিজ হে ইয়ার।’

হাসলো মিতালী। নিঃশব্দে সম্পূর্ণ কাপ খালি করলো দুজন। মিতালী কাপ দুটো নিয়ে রান্না ঘরে রেখে আবারো বারান্দায় আসলো। ভোরের আলো কিছুটা ফুটেছে। চারপাশ এখনো পরিপূর্ণ ভাবে আলোকিত হয়নি। মিতালীর বারান্দা থেকে এই ভোরের পরিবেশ মোহনীয় লাগছে বেশ। দুইজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। উপভোগ স্নিগ্ধ প্রভাত। দীর্ঘ নিরবতার পর অংকুর মিতালীর চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো, ‘ভালোবাসো?’

মিতালী অংকুরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উত্তর জানালো, ‘ভালো না বাসলে কি বিয়ে করেছি?’

উষ্ঠধয় প্রসারিত করে প্রাপ্তির হাসি দিলো অংকুর। স্পষ্ট বাঁকা দাঁতটা ভেসে উঠলো তার। মিতালীও লাজুক হাসলো। অংকুর মিতালীর দিকে একটু এগিয়ে একদম কাছাকাছি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আলতো শব্দে মৃদু গলায় সুর তুললো…

‘অনেক_সাধনার_পরে আমি
পেলাম তোমার মন
পেলাম খুঁজে এ ভুবনে
আমার আপনজন।’

এইটুকু বলে অংকুর থামতেই বাকি লাইন গুলো মিতালী বলে উঠলো.. .

তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয় আমাকে
আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি,
ভালোবাসি তোমাকে!’

‘ভালোবাসি তোমাকে’ অংকুরের দিকে তাকিয়ে গায়লো মিতালী। অংকুর উষ্ঠধয় প্রসারিত করে আমোদিত হয়ে হাসলো। মিতালীর দিকে এগিয়ে কপালে আলতো ভাবে চুমু খেলো একটা। তারপর মিতালীর মাথা বুকে চেপে ধরে বললো, ‘ভালোবাসি তোমাকে!’

.

অংকুর ও মিতালীর বিয়ের আজ সাতদিন। কেটে গেলো সকল প্রকার ব্যস্ততা। নিজেদের জীবনের কাজে পা বাড়ালো সবাই। সব কিছু স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হলো না শেফালী। রিসিপশনের দিন রায়াজের সাথে রাকিবের ওমন কাজে এখনো অসন্তুষ্ট শেফালী। তাই রাকিবকে ইগনোর করছে সে। রাকিব শত চেষ্টা করেও শেফালীর সাথে কথা বলতে পারছে না। আর না পারছে সরি বলতে।
.

কিছুদিন যাবত ভারী বর্ষণে মুখরিত ধরনী। আষাঢ়মাসের চতুর্থ দিন আজ। জৈষ্ঠমাসের অতিরিক্ত সূর্যালোকের তাপে গমগমে পরিবেশ এবার আষাঢ়মাসের বৃষ্টিতে ভিজে শীতল। রোদে শুকিয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট এখন ভিজে টুইটুম্বুর। বর্ষাকালের ফুল ফুটে ঋতুর সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে তুলেছে। সকালে ভারী বর্ষণ শেষে দুপুর থেকে সন্ধ্যে অব্ধি ঝিরঝির বৃষ্টি ছিলো। রাত বাড়তেই বৃষ্টির পরিমান বাড়লো। ঘড়ির কাটা এখন এগারোটা দশের ঘরে কেবল। সেকেন্ডের কাটা টিকটিক শব্দ তুলে ঘুরছে। রুমের জানালা খুলে বাহিরে এক হাত বের করে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছে শেফালী। চোখমুখ তার আমোদিত। গুনগুন করে আপন মনে গান গায়ছে।

‘এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকে না তো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।’

গানের তালে তালে যেন সত্যি সত্যি নিমন্ত্রণ পরলো শেফালীর। মোবাইলের রিংটোনের শব্দ কর্ণপাত হতেই ধ্যান ভাঙ্গলো তার। ঠিক এমন সময় কে কল দিতে পারে তা বুঝতে বাকি নেই। আলতো করে হাসলো শেফালী। প্রথমে ভেবেছিলো কল ধরবে না। চিন্তা অনুযায়ী তাই করলো। রায়াজের সাথে ঘটিত ঘটনার পর থেকে এখন অব্ধি রাকিবকে ইচ্ছে মতো পিছু ঘুরাচ্ছে শেফালী। কিছুতেই রেসপন্স করছে না। তাকে তো আর ছয়শো টাকার জন্য কম জ্বা’লি’য়েছে না। এবার নিজেও একটু বুঝুক মজা। মনে মনে হাসলো শেফালী।

কয়েকবার কল দেওয়ার পরেও যখন শেফালী কল ধরলো না। তখন রাকিব ছোট করে একটা ম্যাসেজ পাঠালো। ‘একটু বাহিরে আসবে?’

ম্যাসেজের টোন বাজতেই মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করলো শেফালী। ম্যাসেজ টা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো তাৎক্ষনাৎ। রিপ্লাই না করে পারলো না। চটজলদি কি-বোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে লিখে ফেললো, ‘মানে? কোথায় আপনি?’

‘তোমাদের বাসার সামনে।’

চোখ জোড়া এখন ছানাবড়া হয়ে গেলো শেফালীর। মোবাইল বিছানায় রেখেই বিলম্ব না করে দ্রুত পা চালিয়ে মিতালীর রুমে দৌড়ে আসলো। বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে বাসার গেইটের দিকে তাকাতেই রাকিবকে দেখতে পেলো শেফালী। প্রকাণ্ড রকমের অবাক হলো সে। এখানে কি করছে লোকটা? ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রাকিবকে স্পষ্ট দেখলো শেফালী। একদম কাকভেজা হয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি ভিজা একদমই অহেতুক লাগলো শেফালীর কাছে। দাঁতে দাঁত পিষলো নিরবে।

শেফালীকে বারান্দায় দেখে একটা হাত নাড়িয়ে ‘হাই’ জানালো রাকিব। শেফালী তারই দিকে তাকিয়ে রইলো। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ক্ষুন্ন হলো রাকিনের মন। ওইদিনের জন্য শেফালী এখনো তার উপর রেগে আছে। রায়াজকে সরি বলার পরেও এতো রাগ কেন এই মেয়ের? ধা’নি’ল’ঙ্কা নামটা তো আর এমনি এমনি দেওয়া হয়নি। জায়গা মতো পারফেক্ট হয়েছে নামটা। ফুঁশ করে হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো রাকিব। ডান হাত তুলে কান ধরলো। অর্থাৎ শেফালীকে ‘সরি’ বলছে সে। রাকিব কান ধরায় হাসি পেলো শেফালীর। রাগ উড়ে গেলো তাৎক্ষনাৎ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে হাসলো। চুপচাপ ভিতরে চলে গেলো।

কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া ছাড়া শেফালীকে ভিতরে চলে যেতে দেখে অসহায় হলো রাকিব। মন খারাপের শহর বড় হলো অনেক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে তাকালো। পায়ের কাছে পরে থাকা ইটের টুকরোতে কিঞ্চিৎ রাগের কারণে লা:থি দিলো একটা। পকেটে এক গুঁজে ধীর পায়ে সামনে এগুতে লাগলো। কয়েক কদম সামনে যাওয়ার পর পিছন থেকে কারোর অস্তিত্ব টের পেলো রাকিব। কাচের চুড়ির রিনরিন শব্দ আসলো কানে। পিছনে না ফিরেও কে আছে বুঝতে এক মুহূর্তও দেড়ি হলো না তার। ঠোঁটে ফুটে এলো মৃদু হাসি। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরলে শেফালীকে নজরে আসলো তার। পিংক কালারের ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে আসছে শেফালী।

রাকিবের কাছে এসে বিনা সংকোচে ছাতা টা এগিয়ে রাকিবের মাথার উপর রাখলো শেফালী। একদম কাছাকাছি দুজন। একই ছাতার ভিতরে। চোখে চোখ পরলো দুজনের। শেফালী পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে দেখলো রাকিবকে। ভিজে যাওয়া চুল গুলো থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পরছে। সাদা শার্টটা ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে একদম। এলোমেলো চুল গুলোতে ভীষণ কিউট লাগছে রাকিবকে। মুগ্ধ হলো বৃষ্টিতে ভেজা রাকিবকে দেখে। চোখেমুখে তার একরাশ মুগ্ধতা। রাকিবের দৃষ্টিতে বিভোর হয়ে নরম গলায় বললো শেফালী, ‘বৃষ্টি ভিজছেন কেন? জ্বর আসবে তো।’

রাকিব শেফালীর চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় উত্তর দিলো, ‘তোমার অভিমানে বৃষ্টি ঝরেছে। তোমার অভিমানে আমার চোখেও বৃষ্টি ঝরে। তাই আমি ভিজেছি। তুমি হাসলে রোদ আসে। তাই ভিজতে ক্ষতি কী!’

ধীর গতিতে আলতো ভাবে মাথা দুলালো শেফালী। মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরিয়ে পাশে ফেলে দিলো। মুহূর্তেই আকাশের বুক চিড়ে পরা বৃষ্টির ফোটা গুলো ভিজিতে দিতে লাগলো শেফালীকে। শীতল বাতাসে শরিরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে দুজনের। শেফালী এক হাত উঠিয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিতে লাগলো। আকাশের দিকে মুখ করে দুই হাত দুইদিকে মেলে আনন্দিত হয়ে বললো, ‘আমার কিন্তু বৃষ্টি ভালোলাগে।’

চেহারায় অসহায়ত্ব এলো রাকিবের। মলিন কন্ঠে বললো, ‘এখনো অভিমান করে বৃষ্টি ঝরাবে? একটুখানি রৌদ্দুর হয়ে হাসবে না?’

শেফালী গালে টুল পরা মিষ্টি হাসি দিলো একটা। তারপর বললো, ‘উম্ম! মেঘাচ্ছন্ন আকাশে এক চিলতে রোদ আসলে মন্দ হয় না।’

দুই কদম এগিয়ে শেফালীর একদম কাছে আসলো রাকিব। বৃষ্টির পানিতে ভিজে শেফালীর কুঁকড়ানো কিছু চুল মুখে লেপ্টে আছে। মাথা থেকে গাল, ঠোঁটে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে। কোমল গোলাপি ঠোঁট দুটো কাঁপছে শেফালীর। মাতোয়ারা হলো রাকিব। নেশা লাগলো মনে। শেফালীর সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় আরো বিমোহিত হলো। নিঃশব্দে শেফালীর নরম দুই হাত ধরলো। চকচকিয়ে তাকালো শেফালী। অবাক হলো কিছুটা। ভালোলাগা কাজ করলো মনে। রাকিব তার নরম দুটো হাত ধরেই চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বলে উঠলো, ‘বিয়ে করবে আমায়?’

দুজনে একে অপরের খুব কাছে। এতোটাই কাছে যে একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ সহজেই শুনতে পাচ্ছে। শেফালী ভিজে একাকার। বৃষ্টির পানি আকাশ চিড়ে এখনো মাটিতে আঁচড়ে পরছে। বড়বড় নেত্রপল্লব তুলে রাকিবের চোখের দিকে তাকালো শেফালী। মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মাঝে মাঝে বৃষ্টি ঝরাতে বিয়ে করা-ই যায়।’

এতোক্ষণে রাকিবের মনে জমে থাকা কালো মেঘ কাটলো। ঠোঁটে ফুটে এলো তার প্রাপ্তির হাসি। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হাসি দিলো একটা। আরেকটু এগিয়ে এসে শেফালীর কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। চোখ বন্ধ করলো দুজন। রাকিব এক হাত শেফালীর গালের কাছে কানের পিছে রেখে নেশাক্ত গলায় বললো, ‘ভালোবাসি প্রিয়!’

~সমাপ্ত~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here