অনেক সাধনার পরে পর্ব -৪৪+৪৫+৩৬

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪৪+৪৫]

দুপুরের শেষভাগের সময়। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পরেছে। বাহিরের পরিবেশ গমগমে হলেও কমিনিটি সেন্টারের ভীতর টা বেশ শীতল। পুরো জায়গা মেহমানদের ভরপুর। রয়েছে খাওয়া দাওয়ার বেপক আয়োজন। কাঁচা ফুলের সৌরভে মু-মু করছে পরিবেশ। দুটো থালায় গোলাপ ফুলের পাপড়ি, তিনটে থালায় গাঁদাফুলের পাপড়ি সাজিয়ে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েদের দল। উল্লাসিত সবাই। বরপক্ষ এসেছে খবর আসার পর থেকেই তারা দাঁড়িয়ে আছে। সকলে প্রস্তুত যার যার লাভের আশায়।
.

অংকুরদের গাড়ি গুলো কমিনিটি সেন্টারের বাহিরে এসে থামলো। প্রথম গাড়িতে অংকুর, রাকিব, ওবাইদুর ও অংকুরের অন্য দুইজন কাজিন। গাড়ি থামার পর এক এক করে সবাই নেমে পরলো। শুধু অংকুর ও ওবাইদুর অবশিষ্ট রইলো। রাকিব দরজা খুলে গাড়ির ভিতরে কিছুটা ঝুকে বলল, ‘ব্রো? আসবা নাকি কোলে তুলে নিতে হবে?’

বিরক্তিকর চোখে রাকিবের দিকে তাকালো অংকুর। কপাল কুঁচকালো নিরবে। তার পাশে ওবাইদুর বসে ছিলো। সে অংকুরের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের করতে করতে বলল, ‘ভাই তাড়াতাড়ি বের হ। ক্ষিদা লাগছে প্রচুর। আগে খাইতে হবে।’

অংকুর গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলল, ‘যতোসব রা’ক্ষ’স আমার বং’শেই পরতে হয়েছে।’

অংকুরের বিড়বিড় করে বলা কথাটা রাকিব ও ওবাইদুরের কর্ণপাত হলো। তারা অল্প শব্দে হেসে উঠলো। অতঃপর অংকুর গাড়ি থেকে নামলো। জুলফিকার, রায়াজ ও অন্যরা এসে বরপক্ষ কে আন্তরিকতার সঙ্গে ভিতরে নিয়ে গেলো।

গেইটের কাছে আসার পর মেয়েদের দল ফুল ছিটিয়ে স্বাগতম করলো তাদের। জুলেখা ও আমেনার হাতে মিষ্টির থালা। তারা দুইজন অংকুরকে বরণ করতে লাগলেন। আমেনা শেফালীর হাতে মিষ্টির থালাটা দিয়ে কাটা চামচ দিয়ে মিষ্টি নিলেন। তারপর অংকুরের মুখে তুলে দিয়ে পানি খাইয়ে দিলেন। এভাবে জুলেখাও খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমেনার পাশে মিষ্টির থালা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো লাল লেহেঙ্গা পরিহিত শেফালীকে দেখে রাকিবের চোখ আটকে গেলো। খোলা কুঁকড়ানো চুল, বড়বড় কানের দুল, কপালে সুন্দর একটা টিকলি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাত ভর্তি চুড়ি ; সব মিলিয়ে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। শেফালীর চোখেমুখে প্রশান্তিময় হাসি। খুবই আনন্দিত সে। কেউ একজন যে তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিনে বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই তার।

অংকুরকে বরণ করার পর আমেনা আর জুলেখা চলে গেলেন। কিন্তু বরপক্ষ আর গেইটের ভিতরে যেতে পারলো না। ঘিরে ধরেছে পাত্রীপক্ষ। নতুন করে লাগলো আরেক ভয়ংকর বিপত্তি। অর্থাৎ পাত্রীপক্ষের পকেটে কিছু চালান দিয়ে ভিতরে যেতে হবে। নাহলে বউ ছাড়া বাড়ি ফিরতে হবে। শুরু হলো তর্কাতর্কি। এক পর্যায়ে বরপক্ষ ফাইনালি বলে দিলো, ‘আমরা কিছুতেই টাকা দিবো না।’

মুনিয়া বুকে হাত গুঁজে বলে বলল, ‘তাহলে আমরাও বউ দিচ্ছি না।’

রাকিব প্রতিত্তুরে বলল, ‘বিয়েতে যখন এসেছি তখন বউ নিয়ে যাবোই।’

শেফালী রাকিবের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমরা বউ না দিলে হাওয়ার উপরে বউ নিবেন নাকি?’

অংকুরের এক ছেলে কাজিন বললো, ‘কোন সংবিধানে লিখা আছে যে জামাই বউ নিতে আসলে টাকা দিয়ে নিতে হবে?’

জারা বললো, ‘আপনি বোধহয় আয়ীন বিভাগে পড়েন নি তাই জানেন না। আগে শালীকাদের বাগে নিয়ে তারপর বউ নিতে হবে।’

ওবাইদুর মেয়েদের দিকে একটু ঝুকে বলল, ‘ভদ্র মেয়েরা এভাবে তর্ক করে না।’

মুনিয়া কড়া চোখে তাকালো। তখন তাহমিনাহ ওবাইদুরের কথার প্রতিত্তুর মুচকি হেসে বললো, ‘এক হাতে তালি বাজে না।’

হেসে উঠলো সবাই। ওবাইদুর এমন উত্তর শুনে থমথমে খেলো। তবুও স্বাভাবিক রইলো। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘সুন্দরী বেয়াইনদের কাছ থেকে এমন আশা করছি না আমরা।’

তখুনি পিছন থেকে মনিরা ওবাইদুরের বাহুতে জোড়ে চিমটি কাটলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো ওবাইদুর। কিন্তু আর্তনাদ করলো না। মনিরা তার কানে ফিশফিশ করে বলল, ‘সুন্দরী বেয়াইন? আজকে রুমে আসিস তুই।’

অন্ধকার নেমে এলো ওবাইদুরের মুখে। আড় চোখে অংকুরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ঠোঁট চেপে হাসছে। অংকুর দুজনের পাশাপাশি থাকায় সম্পূর্ণ কথায় শুনেছে। ওবাইদুর নিচু কন্ঠে অভিশাপের ন্যায় বলল, ‘বিয়ে করছিস তো? তারপর দেখিস মজা কেমন।’

অংকুর প্রতিত্তুরে নিরবে হাসলো শুধু। চুপচাপ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। দুই পক্ষের মাঝে তু’মুল রুপে ঝ’গ’ড়া চলছে। তাহমিনাহ এবার অংকুর কে বলে উঠলো, ‘টাকা দিবা না তাহলে বউ নিতে এসেছো কেন?’

অংকুর জড়তাহীন কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘আমার বউ আমি নিবো, টাকা কেন দিবো?’

তাহমিনাহ বললো, ‘দেখুন দুলাভাই। শালী মানে আধা ঘারওয়ালী। যদি শালীদের খুশি করেন তাহলে এতো এতো শালীদের আদরযত্ন পাবেন। নাহলে শালী তো পাবেন-ই না, সাথে বউ টাও কপালে জুটবে না।’

শেফালী কন্ঠে কিছুটা ক্ষুব্ধ করে বললো, ‘জিমি? এতো কিপটামি করছো কেন? টাকা দিয়ে দাও।’

শেফালীর কথার প্রতিত্তুরে রাকিব বলে উঠলো, ‘এতো দেখছি ডিজিটাল ফকি… মানে কিছু না।’

শেফালীর কড়া চোখের চাহনী দেখে বলতে গিয়েও বললো না রাকিব। মেয়েটাকে এতো কিউট লাগছে। আজ মেয়েটার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তাকিয়ে থেকেই দিন পাস করা যাবে। রাকিবকে চুপ হয়ে যেতে দেখে হাসি পেলো শেফালীর। মুগ্ধকর চোখে রাকিবের দিকে তাকালো। লোকটা অনেক অদ্ভুত। কাল থেকে এখন অব্ধি নতুন নতুন অনুভূতির স্বীকার হচ্ছে শেফালী। এই অনুভূতির নামকরণ করতে পারছে না সে। হয়তো ভালোলাগা! রাকিবের চোখে চোখ পরতেই ভ্যাবাচেকা খেলো শেফালী। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। অস্বস্তি আঁকড়ে ধরলো আবারো। শেফালীর বিব্রতভাব দেখে মৃদু হাসলো রাকিব।

তর্কাতর্কি চলতেই লাগলো। মেয়েরা যা ডিমান্ড করছে, তার থেকেও কম দিচ্ছে ছেলেরা। কিন্তু কেউ টাকা হাতে নিচ্ছে না। সময় অনেক পার হয়ে গেছে। বরপক্ষ কে তারা এখনো ছাড়ছে না দেখে রায়াজ সেখানে উপস্থিত হলো। সবার হাল-বেহাল দেখে বিরক্ত হলো কিছুটা। বরপক্ষ কে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখাটা পছন্দ হলো না তার। তাহমিনাহ কে ধমকে উঠলো, ‘হচ্ছে টা কি তাহমিনাহ? ওদের ভিতরে যেতে দিচ্ছিস না কেন?’

জড়সড় হলো সবাই। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ। কেঁপে উঠলো সবাই। তাহমিনাহ ধমক খেয়ে মিহিয়ে গেলো। আওয়াজ নিচু করে উত্তর দিলো, ‘ওরা কম দিছে তাই।’

তাহমিনার এমন মিহিয়ে যাওয়া দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রায়াজ। এক হাতের ইশারায় শেফালীকে ডাকলো। শেফালী প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও মৌনতার সাথে রায়াজের দিকে এগিয়ে গেলো। শেফালী পাশে এসে দাঁড়াতেই রায়াজ শেফালীর কানের দিকে কিছুটা ঝুকে ফিশফিশ করে বললো, ‘বোকা, এখন এতো টাকা নিয়ে কি করবি? যতোই নিবি তার ১৪ ভাগ হবে। তাহলে তোর ভাগে পরবে কত? মাত্র এক ভাগ। লাভ হবে? তার থেকে বরং এখন কমিয়েই নিয়ে নে। পরে সবাই চলে গেলে কৌশলে তুই একা হাতিয়ে নিস। লাভ হবে। বুঝছিস?’

চোখ দুটো চড়কগাছে উঠে গেলো শেফালীর। ঠোঁটে ফুটে এলো আনন্দোৎসব হাসি। মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। নিজেও ফিশফিশ করে বললো, ‘ভাইইইই তোমার মতো হাজারটা ভাই ঘরে ঘরে হোক।’

মৃদু হাসলো রায়াজ। তারপর স্বাভাবিক হয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এখন যতো দিচ্ছে ততো নিয়ে নে। কথা বাড়াবি না কেউ। ওদের ভিতরে আসতে দে।’

তাহমিনাহ, জারা ও মুনিয়ার মুখখানি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। মুখ অন্ধকার করে টাকা হাতে নিয়ে ওদের ভিতরে আসতে দিলো। রায়াজ ব্যস্ত হয়ে তাদের খেয়াল রাখছে। স্টেজে বসে আছে অংকুর। তার-ই পাশে অন্যরা। রাকিব স্টেজের নিচে এক পাশে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে রায়াজের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা দেখতে স্মার্ট বটে। কথাবার্তা, ব্যবহার সাবলীল। কিন্তু শেফালীর সাথে একটু বেশি ক্লোজ। যার ধরণ রায়াজকে একদম পছন্দ হচ্ছে না তার। বরঞ্চ রাগ উঠছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। রায়াজের থেকে চোখ সরিয়ে শেফালীর দিকে তাকালো। দেখলো শেফালী তার অন্য কাজিনের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাহ্! এখন তদূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রায়াজের সাথে এতো ক্লোজ হবার মানে কি? জেলাসি আঁকড়ে ধরলো রাকিবকে। শেফালীকে অন্য কারোর সাথে দেখে সহ্য হয় না তার।
.

একা রুমে আয়নার সামনে বসে আছে মিতালী। চোখে তার গাঢ় কাজল দেওয়া। ঘন কালো চোখের পাপড়ি তুলে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। বধূ সাজে বসে আছে সে। আজ তার বিয়ে! অবাক করার বিষয়। সমাজে এতো এতো অপমান সহ্য করা মোটা মেয়েটার বিয়ে। উঠতে বসতে যেই মেয়েটাকে মানুষ কথা শুনাতো ; সেই মোটা মেয়েটাকে কেউ একজন ভালোবেসে বিয়ে করছে। অদ্ভুত না ব্যাপার টা? সে কি আসলেই এতো ভালোবাসা ডিজার্ভ করে? অংকুর অনেক সুদর্শন। চাইলেই মিতালীর থেকে দ্বিগুণ সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু তাকে কেন বেছে নিল? ভালোবাসা বুঝি এতোই সুন্দর? আপন মনে ভাবছে মিতালী। চোখেমুখে তার সন্তুষ্টকরণ হাসি। একটু পর লিখিত ভাবে অংকুরের স্ত্রীর মর্যাদা পাবে। সারাজীবনের জন্য পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে। বুক ফুলিয়ে প্রাপ্তির নিশ্বাস নিলো একটা।
.

মানুষ অনেক অদ্ভুত। সমাজে বসবাস করে কিছু নিম্নমানের মানুষ। যাদের অন্যের ভালো দেখলে গা জ্বলে। কারোর সুখ সহ্য করতে পারে না। ঠিক তেমনি হলো আজ। কারণ টা অন্য কিছু না। মিতালী নামের মোটা মেয়েটার জামাই দেখে। এতো সুদর্শন একটা পুরুষ বলে কথা। সবাই যার-পর-নাই অবাক। ভেবেছিলো হয়তো ষাট বছর বয়সের কোনো বুড়ুর সাথে বিয়ে হচ্ছে। কিংবা বিবাহিত কোনো ছেলে। তা নাহলে প্রতিবন্ধী তো হবেই। এমন ভাবনা নিয়েই বিয়ে খেতে এসেছিলো তারা। কিন্তু আজ্ঞত জামাইকে দেখে যেন সবাই আকাশ থেকে পরেছে। এটা কিভাবে সম্ভব? চোখ জোড়া সবার বিস্ময়ের কৌটায়। তবুও তারা তাদের কটূকথা থামায় নি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কানে কানে ফিশফিশ চলছে মহিলাদের।

‘এতো সুন্দর ছেলে এই মেয়েকে বিয়ে করছে কিভাবে?’
‘দেখো গিয়ে ছেলের কোনো দোষ আছে কিনা।’

নানান প্রকার কথাবার্তা চলছে তাদের মাঝে। নিন্দুকরা সারাজীবন সমালোচনা করবেই। তাদের কথার গুরুত্ব দিলে জীবনে সামনে এগিয়ে চলা কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে। সবাইকে সমান ভাবে গুরুত্ব দিতে নেই। তাইতো সেদিকে কারোর বিন্দুমাত্র পাত্তা নেই। মিতালীর অতি কাছের আত্মীয়স্বজন, কাজিনরা মিলে সব কিছু সামলাতে ব্যস্ত।
.

রুমের দরজা খুলার শব্দ শুনে পিছু ফিরে তাকালো মিতালী। লাল সিল্কি শাড়ি পরিহিত ছিমছাম গড়নের উজ্জ্বল ফরসা তিথী কে দেখে স্মিতি হাসলো মিতালী। প্রতিত্তুরে তিথীও হাসলো। আশেপাশে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মিতালীর পাশে চেয়ারে বসলো। আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বললো, ‘কেমন আছো?’

আলতোভাবে মুচকি হাসি দিলো মিতালী। সাবলীল ভাবে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন ভাবি?’

‘এইতো ভালো।’

লম্বা দম নিলো মিতালী। কথা বললো না আর। হাতের সোনালি চুড়ি গুলোর দিকে তাকালো। দাদীর দেওয়া স্বর্ণের বালা টা ধরে ঘুরাতে লাগলো। তখুনি কানে হাসলো তিথী কথা গুলো।

‘তোমার বর কে দেখলাম। মাশাআল্লাহ অনেক হ্যান্ডসাম। ভেবেছিলাম বুড়া হবে কিন্তু হলো অল্পবয়সী। তবে আমি অনেক অবাক হচ্ছি একটা ব্যাপারে। সেটা হলো ছেলেটা বিয়েতে রাজি হলো কিভাবে?’

ফুঁশ করে হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো মিতালী। তার ধারনা-ই ঠিক। তিথী উরফে আজিম খন্দকারের স্ত্রী। তাদের বাড়ির তৃতীয় তলার ভাড়াটে। মেয়েটি যখুনি পারে মিতালীকে কথা শুনিয়ে দেবার চেষ্টা করে। নিজে দেখতে মারাক্তক সুন্দরী বলেই অন্যকে ছোট ভাবে দেখে। রূপ নিয়ে তিথী অহংকার করে বেশি। মেয়েটিকে মিতালীর একদম ভালো লাগে না। সামনা সামনিও কিছু বলতে পারে না। বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো একটা।

তিথী আবারো বলতে লাগলো, ‘ছেলেটা অনেক স্মার্ট। আমার মতো সুন্দর মেয়ে ডিজার্ভ করতো। কিন্তু তোমাকে? তুমি তো অনেক মোটা।’ বলে মুখ দিয়ে ‘ চাহ্’ জাতীয় উচ্চারণ করে বললো, ‘তোমাদের পাশাপাশি মানাবে না।’

প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এবার কষ্ট লাগলো মিতালীর। চোখ ঝাপসা হলো। অংকুরের সাথে তাকে মানাবে না। কথাটি সত্ত্য। অংকুর অনেক সুদর্শন। তার সাথে সুন্দর ফিগারের মেয়ে পারফেক্ট। মিতালীর মতো মোটা মেয়ে যায় না। কিন্তু অংকুর তাকে ভালোবাসে। সে মোটা হওয়ার পরেও অংকুর তাকেই বিয়ে করছে। ভালোবাসে বলেই তো। মন খারাপ কেটে গেলো মুহূর্তেই। যেখানে অংকুর তাকে ভালোবাসে সেখানে অন্যদের কথার গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।

তিথী আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই কানে আসলো শেফালীর কন্ঠ, ‘আসলে কি বলেন তো ভাবি। যাদের নজর ত্যাড়াব্যাকা। জামাই থাকা শত্বেও অন্যের জামাইয়ের দিকে নজর দেয় তারা।’

মিতালী ও তিথী ঘার ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। শেফালীকে দরজার এক পাশে বুকে হাত গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মিতালী বুঝলো এবার তিথী কে আচ্ছা মতো ধুলাই দিবে।

শেফালীর কাধে এক হাত রেখে আরেক হাতে কিছু চুল আঙ্গুলে প্যাচাতে প্যাচাতে জারা বললো, ‘জামাই রেখে পরপুরুষের দিকে তাকানো পরকীয়ার শামিল। হায় আল্লাহ। কি নোংরা একটা ব্যাপার।’

কথাগুলো ঠিক কাকে এবং কিসের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে সেটা বুঝতে বাকি নেই তিথীর। রাগে দাঁতে দাঁত পিষলো সে। চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুনিয়া দরজার অপর পাশে হেলান দিয়ে বললো, ‘রূপবতী মেয়েদের একটা দিয়ে হয় না। তাইতো ঘরে জামাই থাকতে অন্যের জামাই নিয়ে গবেষণা করে।’

জারা হাই তুলতে তুলতে বললো, ‘একদম বারোভাতারি।’

মিতালী হতবাক হয়ে গেলো বোনদের এমন কথা শুনে। চোখ তার বিস্মিত। তিথীর দিকে তাকিয়ে দেখলো রেগে নাক লাল করে ফেলেছে একদম। হাসি পেল তার। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো মিতালী। তার হাসি তিথীর নজর এড়ালো না। এতো অপমান সহ্য হলো না আর। গটগট পায়ে দরজার সামনে আসলো। কড়া চোখে একবার তিনজনকে দেখে চলে গেলো।

তিথী যেতেই শেফালী, জারা ও মুনিরা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে তাদের জান যায় যায় অবস্থা। একজন আরেকজনকে ধরে হাসছে। মুনিয়া হাসিতে মুখ খিঁচে বললো, ‘মেয়েটার চেহারা দেখার মতো ছিলো।’

মিতালী হতাশার নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। কন্ঠ কিছুটা মলিন করে বললো, ‘এভাবে না বললেও পারতি।’

জারা কথার ভঙ্গির সাথে হাত নাড়িয়ে বললো, ‘এতো ভালো মানুষিকতা দেখিয়ো না তো আপু। মুখের উপর উচিত কথা বলতে শিখো।’

শেফালী মিতালীর পাশে বসে বললো, ‘বুবুর সব কিছুই ঠিক আছে। তবে প্রতিবাদ করতে পারে না।’

মুনিয়ে মিতালীর মাথায় দোপাট্টা পরিয়ে দিলো। তারপর খুব সূক্ষ্ম ভাবে তাতে ক্লিপ লাগিয়ে দিতে লাগলো। জারা মিতালীর উদ্দেশ্যে বললো, ‘তোমার এই অতিরিক্ত ভালো ব্যবহার ধুয়ে পানি খাবে? শুনো আপু, মানুষ যেমন কটুকথা শুনাতে পারে। তেমনি তুমিও তাদের মুখের উপর জবাব দিতে পারবে। এতে দোষের কিছু নেই। একটা প্রবাদ আছে ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুইজন সমান অপরাধী। বুঝলা?’

মিতালী জারার ফোলা ফোলা গাল দুটো টেনে আহ্লাদিত কন্ঠে বললো, ‘ওকে মেরি জান। বুঝেছি।’

জারা আমোদিত হাসি দিয়ে মিতালীকে জড়িয়ে ধরলো। মিতালী হাতের ইশারায় মুনিয়া, শেফালীকে কাছে ডাকলো। উল্লাসিত হলো দুজন। ঝাঁপিয়ে এসে ধরলো মিতালীকে।

দোপাট্টা মাথায় ভালো ভাবে লাগিয়ে দেওয়ার কিছুসময় পর সেখানে আমেনা উপস্থিত হলেন। মেয়েকে বধূ সাজে দেখে বুক ভার হয়ে এলো তার। চোখে জমে এলো জলের বিন্দু কণা। আমেনা কে দেখা চার বোন সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমেনা শাড়ির আচল টেনে মেয়ের কাছে আসলেন। এক হাত মিতালীর গালে রেখে আদর করলেন।

‘মাশাআল্লাহ!’

মিতালীর মন খারাপ হয়ে গেলো। কান্না পেলো ভীষণ। মাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন আমেনা। শেফালীও ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর প্রয়াস করতে লাগলো। জারা এক হাত শেফালীর কাধে রেখে ইশারায় শান্ত্বনা দিলো। রুমে উপস্থিত সকলের চোখে পানি। মুনিয়া কাঁদছে, জারা কাঁদছে, কাঁদছে শেফালী। আমেনা নিজেকে শান্ত করে মেয়েকে সরালেন। মিতালীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, ‘সারাজীবন সুখে থেকো।’

কান্নায় খিচঁকি উঠছে মিতালীর। মায়ের চোখ সরিয়ে দরজায় তাকালে বাবাকে দেখতে পেলো। জুলফিকার নিরবে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সব। কষ্ট হচ্ছে তার। মেয়েটা আজ চলে যাবে। ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়ি। মেয়েকে ছাড়া বড্ড একা একা লাগবে নিজেকে।

মিতালী এক হাতে বাবাকে কাছে ডাকলো। জুলফিকার ধীর পায়ে এগিয়ে আসলে মিতালীও তার দিকে এগিয়ে গেলো। অতঃপর জুলফিকার কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মিতালী। জুলফিকার পরম আদরে মেয়েকে ধরলেন। এক হাত মাথায় রেখে হাত বুলালেন। জুলফিকার কাঁদছে না। তবে চোখ জোড়া লাল হয়ে এসেছে তার। তার লাল চোখ দেখে শেফালীও কেঁদে ফেললো। এগিয়ে এসে মিতালীকে সহ জুলফিকার কে জড়িয়ে ধরলো। কিছুসময় পর জারা, মুনিয়া দুইজনও এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাদের। জুলফিকার নিজের দুই বাহুতে চার মেয়েকে আগলে রাখলেন।

তাহমিনাহ এসেছিলো মিতালীর খোঁজ নিতে। রুমে এসে এমন করুণ দৃশ্যপট দেখে বাকশূন্য হয়ে গেলো। সবাইকে একইসাথে জড়িয়ে ধরতে দেখে খুশিতে চোখ লাল হলো তার। লেহেঙ্গা হালকা উঠিয়ে নিজেও এসে জড়িয়ে ধরলো তাদের।

এমন একটা সুন্দর মুহূর্ত ফ্রেমে বন্দি করে নিলো রায়াজ। বেশ কয়েকটা শাটারের শব্দে দরজায় তাকালো সবাই। রায়াজ কে ছবি তুলতে দেখে হেসে উঠলো সবাই।

চলামান….#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪৬]

দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটির পর বিষন্ন মন কাটিয়ে আনন্দিত হলো সবাই। মিতালীকে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য রায়াজ তাড়া দিলো সবাইকে। তাহমিনাহ, শেফালী, জারা ও মুনিয়া মিলে মিতালীকে নিয়ে স্টেজের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হলো। মিতালীর বুক অজানা কারণে ধুকধুক করছে। হৃদকম্পন ক্রমাগত বেড়ে চলছে। স্টেজ সাজানো বিশালবহুল হলরুম টায় আসার পর মিতালীর ভাইরা বড় একটা লাল চাদর এনে তার মাথার উপর টান টান ভাবে ধরলে। তাকে দেখে সবাই তার দিকে ফিরে দাঁড়ালো। মিতালী চোখ তুলে স্টেজের দিকে তাকালো। অংকুর কে দেখে লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিলো একটা।

স্টেজে ওবাইদুরের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিলো অংকুর। হঠাৎ-ই কোলাহলের শব্দ শুনে দরজায় তাকালো। স্থির হলো তার দৃষ্টি। বধূ বেশে মিতালী এই প্রথম দেখলো। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো মিতালীর দিকে। মিতালী লাল শাড়ি পরে বউ সেজেছে তার জন্য। ভাবতেই মনে অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। শপিংয়ের দিন মিতালীর সাথে দেখা। তার চারদিন পর আজ দেখা। এতোদিন ঠিক ভাবে কিটিয়েছে তা এক মাত্র অংকুর ভালো জানে। মেয়েটাকে না দেখার যতো তৃষ্ণা ছিলো, তা আজ এক নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। পরিতৃপ্তি আসছে মনে। অদ্ভুত প্রশান্তচিত্ত নাচ করছে হৃদয়ে।

বিয়ের বেনারসির কুচি গুলো আলতো হাতে ধরে ধীর পায়ে সামনে স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো মিতালী। ঠোঁটে তার প্রাণবন্ত মিষ্টি হাসি। চোখে গাঢ় কাজল। অংকুরের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। স্টেজের একদম সামনে আসলে অংকুর সিড়ির কাছে আসলো। এক হাত বাড়িয়ে দিলো মিতালীর দিকে। মিতালী মুচকি হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে অংকুরের হাত ধরতে যাবে এমন সময় শেফালী থামিয়ে দিলো, ‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। কি করছো তোমরা।’

কপাল কুঁচকালো অংকুর। হাত ফিরিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি করেছি?’

‘বউ কে স্টেজে তুলার আগে শালীকে টাকা দিতে হয়। আর সেটা না করেই তুমি স্টেজে তুলে নিচ্ছো? এটা কি ঠিক হচ্ছে?’

শেফালীর কথা শুনে বিহ্বল হলো অংকুর। কন্ঠস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, ‘গেইটে না টাকা দেওয়া হলো? তাহলে আবার এখানে কেন?’

শেফালী ফিচেল গলায় উত্তর দিলো, ‘এটাই সাইন্স।’

অংকুরের পিছনে সিঙ্গেল সোফায় রাকিব বসে ছিলো। সেখান থেকেই সে বলে উঠলো, ‘দুলাভাইয়ের পকেট যেভাবে গ্রাস করছে, না জানি বিয়ের পর নিজের জামাইয়ের অবস্থা কি করে।’

শেফালী এক হাত দেখিয়ে রাকিবকে থামিয়ে বললো, ‘ওহ হ্যালো মিঃ? আমি এতোটাও বেকুব মেয়ে না যে জামাইকে পতনের কারণ হবো। ভুলে যাবেন না ‘সংসার সুখি হয় রমনীর গুনে’ আমার গুণেও আমার সংসার সুখি হবে।’

শেষের কথা গুলো চুল নাচিয়ে বললো শেফালী। রাকিব গালে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, ‘আপনার মাঝে ভালো গুণ-ও আছে?’

রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে গেলো। শেফালী ক্ষুব্ধ হলো। রাকিবের সাথে কথা বলে ঝগড়া বাড়াতে চাইলো না। তাই ঝাঁঝ মেশালো গলায় অংকুকে ঝাড়ি মেরে বলে উঠলো, ‘জিমি? আমি তোমার সাথে কথা বলছি। মাঝ খানে যেন থার্ড পারসন না আসে।’

রাকিব দুই হাতে ব্লেজার ঠিক করে সোফায় হেলান দিয়ে বললো, ‘ঠ্যাকা পরে নাই আমার।’

অতঃপর আবারো কিছুসময় কথা কাটাকাটি করে আরো কিছু টাকা হাতিয়ে নিলো মেয়েরা। হতাশ হলো অংকুর। আগে যদি জানতো বউ আনতে এতো টাকা যাবে শালীদের দিয়ে, তাহলে আগে থেকেই মাটির ব্যাঙ্কে টাকা জমাতো যদিও এই আফসোস ক্ষণিকের জন্য। মিতালীর মায়াবী মুখশ্রী দেখে ভুলে গেলো সব। আবারো নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো। মিতালী অংকুরের হাত শক্ত করে ধরে স্টেজে উঠলো। সবাই ফুল ছিটিয়ে দিলো দুজনকে। অতিথিরা এক এক করে দেখা করতে লাগলো।

এতো এতো অতিথির মাঝে আলাদা কথা বলার চান্স পাচ্ছে না অংকুর। পাবে কি করে? আজ তো তারই বিয়ে। আসর ফেলে তো আর চিপায় গিয়ে কথা বলা যায় না। কি আর করার। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে। তবে একটু আধটু কথা তো বলতেই পারে। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলো অংকুর। মিতালীর দিকে একটু ঝুকে ফিশফিশ করে বললো, ‘কি ব্যবহার করেছো?’

হঠাৎ অংকুরের এমন উদ্ভট কথায় অবাক হলো মিতালী। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না। ভ্রুঁ কুঁচকে ঠোঁটে হাসি রেখে সামনে তাকিয়েই কন্ঠ নিচু করে জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে? কি ব্যবহারের কথা বলছেন আপনি?’

‘না মানে, হঠাৎ এতো সুন্দরী হলে কিভাবে? আজকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে।’

মিতালী হাসি হাসি ভাব রেখেই দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘এতো কথা বলেন কেন? চুপ থাকেন।’

‘আশ্চর্য। আমার বউ, আমি কথা বলবো না? তোমার শুনতে ইচ্ছে না করলে কানে তুলা দিয়ে রাখো না। কে বলেছে আমার কথা শুনতে?’

মিতালী সকলের অগোচরে চোখ পাকিয়ে অংকুরের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত কটমট করে বললো, ‘আপনার বউটা কে?’

অংকুর দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘তুমি ছাড়া আর কে হবে? আমি তো তোমাকেই বিয়ে করছি। আমার গুলুমুলু তুলতুল টাকে।’

বিরক্তি আর নিতে পারলো না মিতালী। হতাশ হয়ে বললো, ‘আমি যেহেতু বউ, সেহেতু আমি-ই শুনবো তাই না? আর বিয়ের দিন অত্যন্ত মুখটা বন্ধ রাখেন।’

অংকুর ত্যাড়া ভাবে বললো, ‘আমার বিয়ে, আমি মুখ খোলা রাখবো। বন্ধ রাখতে যাবো কেন?’

মিতালী রুক্ষভাষী কন্ঠে আওয়াজ নামিয়ে বললো, ‘আর একটা ফালতু কথা বললে স্টেজ থেকে চলে যাবো।’

অংকুর ভাবলেশহীন ভাবে প্রতিত্তুর করলো, ‘যাও না। কোলে তুলে আবার নিয়ে আসবো।’

সত্যি সত্যি হতাশ হলো মিতালী। এই ছেলের সাথে কথায় পারা যায় না। ছেলে মানুষ এতো কথা বলতে পারে। নিরবে ফুঁশ করে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল একটা।
.

চুপিচুপি পায়ে হাঁটছে রাকিব। সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে চারপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এতো এতো মানুষের ভিড়ের মাঝে শেফালীকে খুঁজছে তার চোখ। কিন্তু পাচ্ছে না। সেই কখন থেকে শেফালীর দেখা নেই। মেয়েটা গেলো কোথায়? কিছুটা চিন্তিত হলো। অস্থির হলো মন। কমিনিটি সেন্টারের তৃতীয় তলার চারপাশ খুঁজতে লাগলো তার প্রেয়সী কে। স্টেজের আশেপাশে কোথাও নজরে এলো না। কিছুটা রাগ হলো রাকিবের। হুট করে কোথায় উধাও হয়ে গেছে এই মেয়ে। বিরক্তি ভাব নিয়ে অন্য দিকে পা বাড়ালো। শেফালীকে খুঁজতে খুঁজতে কিছুটা ভিতরে নির্জন জায়গায় আসলো। তখুনি নিজের থেকে একটু দূরে শেফালীকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো। শেফালী রাকিবকে এখানে দেখে কিছুটা অবাক হলো। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এখানে?’

রাকিব পালটা প্রশ্ন করলো, ‘এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? কখন থেকে খুঁজছি তোমায়।’

শেফালী স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘কেন? কোনো প্রয়োজন?’

রাকিব পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে তাকালো শেফালীর দিকে। ধীর পায়ে শেফালীর একদম কাছে এসে দাঁড়াল। ভড়কালো না শেফালী। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে রাকিবের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাকিব শেফালীর দিকে একটু ঝুকে এসে চোখে চোখ রাখলো। মৃদু গলায় বললো, ‘তোমাকে প্রয়োজন।’

আলতো হাসলো শেফালী। দুই গালের টুল দুটো ভেসে উঠলো তাৎক্ষনাৎ। চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। রাকিব তার টুল পরা গালের হাসি দেখে বলল, ‘ট্রাস্ট মি শেফালী। তোমার টুল দুটো এতো কিউট। বিয়ের পর এখানে লবণ মরিচ রেখে কাচা ফল খাবো।’

রাকিবের প্রথম কথা গুলোতে লাজুক হাসলেও শেষের কথাটা শুনে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। তার এমন চাহনী দেখে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো রাকিব। রাগে শরির রিনরিনিয়ে উঠলো শেফালীর। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘আপনি আস্তো একটা অসভ্য।’

লেহেঙ্গা ধরে গটগট পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে। রাকিব ঠোঁটে হাসি রেখে আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে শেফালীর চলে যাওয়া দেখলো। এক মাথা মাথার পিছনের চুল গুলো চুলকে নিজেও পা বাড়ালো।
.

অবশেষে আসলো কাঙ্ক্ষিত সময়! উপস্থিত হলো নিকটাত্মীয় সবাই। কাজি সাহেব আসলেন। কাবিননামা খুলে দুজনের সামনে বসলেন। এক এক করে পুরো কাবিননামা পড়তে লাগলেন। অংকুর ও মিতালী পাশাপাশি বসে আছে। মিতালীর হৃদপিন্ড দ্রুত চলছে। ভয়ে শরির অসাড় হয়ে এসেছে এমন। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। চোখে জমে এলো বিন্দু বিন্দু জলের কণা। মিতালীর এই বেহাল অংকুর খেয়াল করলো। তাই হাত বাড়িয়ে মিতালীর হাতটা শক্ত করে ধরলো। ভিজে যাওয়া কাজল কালো চোখ তুলে অংকুরের দিকে তাকালো মিতালী। অংকুর চোখের ইশারায় তাকে আশ্বাস দিলো। কিছুটা শান্ত হলো মিতালী। তবুও যেন ভয় কাটেনি। বিয়ের ঠিক এই মুহূর্তে প্রত্যেক মেয়েকেই এমন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়। কারণ টা নাহয় অজানা-ই থাক।

মিতালীর ভয়ের মুহূর্তে অংকুরকে তার হাত ধরে শান্ত্বনা দেওয়া দেখলো জুলফিকার। খুশি হলেন তিনি। খুশি হলেন এই ভেবে যে মেয়েকে তিনি ভুল কারোর হাতে তুলে দেননি। যথাযথ যোগ্য ব্যক্তিটির কাছে তার বড় রাজকন্যা কে তুলে দিচ্ছেন। মন ভরে দোয়া করলেন মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের জন্য।

মিতালীর অপর পাশে শেফালী বসে আছে। এক হাতে মিতালীর কাধ ধরে রেখেছে। কষ্ট লাগছে তার। তবুও শান্ত সে।

কাজি সাহেব প্রয়োজনীয় সব তথ্যাদি পড়ে অংকুর কে কবুল বলতে বললেন। অংকুর স্বাভাবিক ভাবে কবুল বললো। তারপর মিতালীর সম্মতি চাইলেন। মিতালীর গলা শুকিয়ে এসেছে প্রায়। বুক কাঁপছে তার। চোখ লাল হয়ে এলো। জুলফিকারের দিকে তাকালে জুলফিকার চোখের ইশারায় বলতে বললেন। শেফালী মিতালীকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘বুবু? চুপ আছো কেন? কবুল বলো।’

বেশ কিছুসময় নিরব রইলো মিতালী। অংকুর মিতালীর হাতটা শক্ত করে ধরে কন্ঠ নিচু করে বললো, ‘বিশ্বাস করো না আমাকে?’

মিতালী মাথা উপর নিচ দুলালো। অংকুর আবারো বললো, ‘ভরশা রাখতে পারো। এইযে হাতটা ধরলাম। মৃ’ত্যু’র আগ পর্যন্ত আর ছাড়বো না ইনশাআল্লাহ। সারাজীবন পাশে থাকবো তোমাকে ভালোবেসে।’

অদ্ভুত রকমের শান্তি পেলো মিতালীর মন। দীর্ঘক্ষণ নিরবতার পরে সম্মতি দিয়ে কবুল বললো মিতালী। চারপাশ থেকে সবাই খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললো। কাজি সাহেব কাবিননামা এগিয়ে দিলে দুইজন নাম লিখলো। ইমাম দোয়া পড়ালেন। একে অপরের মুখে মিষ্টি তুলে দিলেন সবাই।

অতঃপর কাবিননামায় নিজেদের নাম লিখে, ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে, লিখিত ও বৈধ ভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেলো অংকুর ও মিতালী।

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here