অন্তরালের কথা পর্ব ৩৪

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৩৪
.
.
“হ্যাঁ মা, আপনার কিসের এতো চিন্তা? আমি আছি না? রান্নাবান্না সবইতো শেষ এখন শুধু ঘর গুছানো বাকি। আর ঘর গুছাতে যে বেশি একটা সময়ের প্রয়োজন হয়না সেটাতো আমার থেকে আপনি ভালো জানবেন তাই না? ”
” তারপরও টেনশন যে হয় মা। সে তোমরা বুঝবে না যখন তোমরা নিজেরা বাবা-মা হবে ঠিক সেদিন বুঝবে এই মায়ের চিন্তার কারণ। ”
কথাটি বলে ড্রয়িং রুমের দিকে তাকাতেই মরিয়ম বেগমের মেজাজ চরম পর্যায় বিগড়ে যায়। ড্রয়িং রুমের কাছে যেতে যেতে উত্তেজিত গলায় বলল,
” এসব কী তিহান? আমাদের কী তোর কাছে মানুষ মনে হয় না? হাতের পুতুল মনে হয়? ”
” কেন কী হয়েছে? আমি আবার কী করলাম? ”
” তুই জানিস না তুই কী করেছিস? ”
” জানলে বোধহয় তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম না মা। ”
” ঘড়িতে দেখেছিস ক’টা বাজে? বিকেল হতে চলল বলে! কিছুক্ষণ বাদেই যে মেয়ের বাড়ি থেকে লোক চলে আসবে সে খেয়াল আছে? ”
” আসলে আসবে তাতে আমি কী করবো? ”
” তোকে তো কিছু করতে বলিনি আর না কোন পাহাড় সমান কাজ দিয়েছি। তোকে শুধু বলেছিলাম নিজেকে তৈরি করে রাখতে। করেছিস কী সেটা? ”
” বলেছ যখন অবশ্যই করবো। সেটা নিয়ে ভেবো না আর এমনিতেও তারা তো চলে আসেনি। তাই না? ”
” চলে আসেনি কিন্তু আসতে কতক্ষণ? সবকিছুতে এরকম হেয়ালীপনা একেবারেই ঠিক নয় তিহান। ”
” হেয়ালীপনা কখন আবার করলাম? আমিতো বলেছি সময় হলে সবকিছুই করে ফেলব। ”
” এখন করলে কী বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে? হবে না তোরে বাবা। যা না রেডি হয়ে মা’কে একটু শান্তি দেয় না বাবা। ”
মরিয়ম বেগমের কথার সাথে কথা মিলিয়ে অতলও বলল,
” তিহান! ভাই আমার এরকম করিস না। দেখছিস তো মায়ের অবস্থা, এই মুহূর্তে মা’কে টেনশনের মাঝে না রাখলেই কী নয়? পরে দেখা যাবে অতিরিক্ত টেনশনের ফলে প্রেশারই হাই হয়ে যাবে। তখন কী একটা অবস্থা হবে বুঝতে পারছিস? ”
” আমি বুঝতে পারছি না ভাইয়া আমি কি এমন করেছি যার জন্য তোমরা সকলে এমন করছ? আমি কী একবারও বলেছি যে রেডি হবো না? নাকি এটা বলেছি যে বিয়ে করবো না? বলেছি কী? বলিনি তো। যখন যেটার সময় হবে সবই করব বলেছি। তাহলে…তাহলে কেন তোমরা এরকম করছ?
” আসলে ভাই ব্যাপারটা এরকম পজিশনে গিয়ে ঠেকেছে, না আছে এখানে তোর দোষ আর না আছে আমাদের দোষ। পুরোটাই পরিস্থিতির কিংবা আমাদের নিয়তির খেলা। ”
” পরিস্থিতি হোক কিংবা নিয়তি এ দুটোর একটিও আমায় নিয়ে খেলার সুযোগ পেতো না, যদি না তোমরা সুযোগ করে দিতে। ”
এক মুহূর্তও তিহান দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা নিজ ঘরের দিকে চলে গেল। পেছনে কে কী ভাবল কোন কিছুরই সে তোয়াক্কা করল না। এদিকে বাড়ির উঠোনে উপস্থিত সকলেই যেন তিহানের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। কারো মুখে কোন কথা নেই একেবারেই হা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
.
” কী ব্যাপার ভাই ফিরোজ! তুমি তো দেখছি কিছুই মুখে দিচ্ছ না। মেয়ে বিয়ে দেয়ার নিয়ত নেই নাকি? ”
” কী যে বলেন না ভাই! মেয়ে দেয়ার নিয়ত না থাকলে কী আর কাল আসতে বলায় আজই চলে আসি? ”
” তাহলে খাচ্ছো না যে? আর তোমার বউও তো ওই এক কাপ চা খেয়েই বসে আছে।
মরিয়ম বেগম ফাঁক তালে বলে উঠলেন,
” এই তুমি কি হ্যাঁ? কুটুমের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? আর তোমার বউ তোমার বউ করছ কেন? ভাবী কিংবা বেয়াইন বলতে পারো না? ”
” তুমি সেসব নিয়ে ভেবো না তো মরিয়ম। ”
আইরিন বেগমও ডিশ থেকে নিমক পাড়ার কয়েক পিস হাতে নিয়ে হেসে বলল,
” হ্যাঁ ভাবী, আপনি এসব একদমই মাথায় নিবেন না। এ কথাগুলো একেবারেই স্বাভাবিক আমাদের জন্য। কেননা নিদ্রার আব্বুর সাথে ভাইয়ের পরিচয় হওয়ার পরই আমাদের বিয়ে হয়। তখন ছিলাম আমি নতুন বউ। তাই তখন থেকেই ভাইয়া দুষ্টুমি করে নিদ্রার আব্বুকে বলতো তোমার বউ। আমার যে কথাটি খারাপ লাগতো তা নয়, বেশ ইনজয় করতাম ভাইয়ের এই কথাটিতে। সেই থেকেই ভাইয়া মুখে এ কথাটিতে আমরা অভ্যস্ত। তাই বলছি কী ভাবী আপনি ইতস্ততবোধ করবেন না আমরা কেউ কিছু মনে করছি না। ”
” বাঁচালেন ভাবী! আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ”
” না না, এটা কোন বিষয় না। ”
কথায় কথায় ফিরোজ আলম হাসতে হাসতে আনিস খন্দকারকে বললেন,
” তো ভাই! তিহান কোথায়? সেই যে আসার পর কয়েকটা কথা হয়েছিল আর তো দেখতে পেলাম না।”
আনিস খন্দকার এ পর্যায়ে কিছুটা আমতা আমতা করে বলল,
” ছেলেটা আমার এরকমই রে ভাই। ভীষণ একঘরে টাইপের। কিছুতেই ঠিক করতে পারলাম না। ”
” কিন্তু ভাই এই একঘরে টাইপের ছেলেরাই যে সংসারী মনমানসিকতার হয়। তাই আমার মতে একঘরে থাকাই হয়তো ভালো হা হা… ”
” হুম। তো ফিরোজ আসল কথায় আসি আমরা? ”
” সেতো অবশ্যই। এ কথার জন্যই যে আশা। ”
” তোমাদের মেয়েকে আমাদের ভীষণ ভালো লেগেছে বলেই আজ এ বিষয় নিয়ে তোমাদের ডেকে আনা। তো আমাদের ছেলেকে তোমাদের কেমন লাগলো? মেয়ের জামাই হিসেবে কী চলে?”
” কী যে বলেন না ভাই! চলবে কী সাথে যে দৌড়বে। হা হা… ”
পাশ থেকে আইরিন বেগম হাসি মুখ করে বললেন,
” এতো সুদর্শন পাত্রকে কি না ভাই বলছেন আমাদের চলবে নাকি? এ যে আমাদের ভাগ্য। আজকাল তো একূল পেলে ও কূল পায় না, ও কূল পেলে এ কূল পায় না। আর আমার মেয়েতো তার ভাগ্যের জোরে আলহামদুলিল্লাহ দুকূলই পেল। ক’জন এরকম পাত্রের সন্ধান পায় বলুন? যারাই পায় তারাই যে একেবারে লুফে নেয়। আর আপনি বলছেন চলবে নাকি? ”
” তারমানে আমরা কী বিয়েটা পাকা ধরে নেব ফিরোজ? ”
” ইনশাআল্লাহ ভাই। আমার এবং আমাদের পক্ষ থেকে এ বিয়ে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভাই, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে কীভাবে কী করতে চাইছ তোমরা? ”
” ভাই, আপনি আমার বড়। আপনাকে সর্বদা বড় ভাই হিসেবেই সম্মান করে এসেছি। তাই এ ব্যাপারে বড় ভাই হিসেবে আপনি সিদ্ধান্ত নিন আমি আপনার সাথে আছি। ”
” সব ব্যাপারে বড় ছোট হিসেব করলে হয় না ফিরোজ। এর সঙ্গে মানসিক এবং আর্থিক বিষয় জড়িত। আমি যেসময় দিন তারিখ রাখতে পারি সেসময় তোমার সমস্যা থাকতেও পারে। তাই আমি মনে করি দুজনের মতামত বিনিময়ের মাঝেই এ কাজটি করা শ্রেয়। ”
” আপনি যা ভালো মনে করেন? তাহলে কবের দিকে হলে ভালো হয় ভাই? ”
” তুমি বলো তুমি কবের দিকে ফ্রি থাকতে পারবে? আমিতো আর জব করি না সারাদিন বাসায় থাকি। তাই আমি যেকোন সময় ফ্রি থাকব। কিন্তু তুমিতো জব করো তাই তোমার পক্ষে আমার দেয়া সময় মেইনটেইন করা টাফ হয়ে যাবে। তারচেয়ে ভালো তুমি একটা তারিখ বলো যখন তুমি ফ্রি থাকবে। যদি আমাদের কোন সমস্যা না’হয় তাহলে সেদিনই ফিক্সড করা হবে। আর সমস্যা হলেতো ডেট চেঞ্জ কর‍তেই হবে। ”
” তাহলে ভাই আজকে তো মাসের শেষ সপ্তাহ, বিয়ের ডেট যদি আমরা আগামী মাসের প্রথম শুক্রবারে কিংবা দ্বিতীয় শুক্রবারে রাখি কেমন হয়? ”
” হ্যাঁ, বেশ হয়তো। এখন ফিরোজ তুমি কী চাচ্ছো ১ম সপ্তাহে হোক নাকি ২য় সপ্তাহে? ”
” আমারতো ভাই কোনোটা তেই সমস্যা নেই। আর আমার ছেলেপেলেও নেই যে সমস্যা হবে। তাই আপনি বলুন কোনটা হলে বেশি ভালো হয়! ”
” আমার মতামত যদি শুনতে চাও ফিরোজ তাহলে আমি বলব আগামী মাসের ১ম শুক্রবারে ডেট ফেললেই ভালো হয়। গুরুজনদের কাছে শুনেছি শুভ কাজে কখনো দেরি করতে নেই। এখন তুমি বিবেচনা করে দেখো কী করলে ভালো হয়। ”
” সত্যি বলতে ভাই আমারও এই একই ইচ্ছে ছিল কিন্তু মুখ ফুটে বলে উঠতে পারি নিই। যদি আপনাদের সমস্যা হয় সেই কথা ভেবে। ”
” না না, কিসের সমস্যা? এটাতো আরও ভালো হয়। যে কাজ করতেই হবে সেই কাজে বিলম্ব করে কী লাভ? যত দ্রুত সম্ভব করে ফেলাই ভালো। ”
” তাহলে ভাই আমরা কী আগামী শুক্রবারেই বিয়ের ডেট পাকা ধরে নেব? ”
” পাকা না ধরে কী উপায় আছে? মেয়ের বাবা যে তুমি, মাথার উপর পাহাড় সমান কাজ রয়েছে। আর ডেট পাকা না ধরলে কী বরযাত্রী নিয়ে গিয়ে খালি মুখে বউ নিয়ে আসব নাকি হা হা….. ”
” হা হা… ভাই আপনিও না…”
.
বিছানার কোণে বসে বিষন্ন মন নিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিছানায় মেলা শতশত ছবির দিকে তিহান। বুকটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কেন এতো কষ্ট হচ্ছে তার! এই কষ্টের সমাপ্তি প্রায় ৫ বছর আগেই ঘটে যাওয়া উচিৎ ছিল। তাহলে আজও কেন বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা হয়! প্রশ্নটি হাজারো বার মনে আসলেও উত্তর খুঁজে পায় না তিহান।
বিছানার উপর মেলে রাখা ছবিগুলো থেকে একটি ছবি নিয়ে চোখের জল ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
” পৃথিবীতে এসে কী এমন অপরাধ করেছিলাম আমি? কারো কাছে সামান্যটুকু সহানুভূতি পেলাম না! হ্যাঁ, বাবা-মা যা করছে তাদের হিসেব অনুযায়ী আমার ভালোর জন্য করছে। কিন্তু তানহা…তুমিতো জানো এ হিসেব আমার গড়া হিসেবের সাথে মিলবে না। তাহলে কেন শায় দিচ্ছো সবার তালে? কেন মেতে উঠছ বিয়ের আনন্দে? কষ্ট হচ্ছে না তোমার? বুক ফেটে কান্না আসছে না? অবশ্য কান্না আসবেই কী করে! তুমি যে আগের তানহা নেই। নিজেকে বদলে ফেলেছ সময়ের কাটা ধরে। তবে কী জানো, তোমার বদলানোটা একেবারে জায়েজ আমার কাছে! আমাদের বিচ্ছেদের জন্য তো তুমি দায়ী নও সর্বদাইতো আমার ডাকের আশায় প্রস্তুত ছিলে। তাহলে কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিবে, দোষারোপ করবে! এ কাজ তো আমার। আমার অক্ষমতার জন্যই তো আজ আমরা আলাদা। তাই নিজেকে কষ্ট দেয়া, দোষারোপ করা কেবল আমায় মানায় তোমায় নয়। কিন্তু এ কষ্টগুলোও কষ্ট মনে হতো না যখন দিনের কর্মব্যস্ততার শেষে রাতে তোমার ছবির মেলা বসাতাম। যেমনটা আজ বসিয়েছি। কিন্তু কাল…কাল থেকে কী পারবো এ সুখের মেলা বসাতে আমার? পারবো না। নতুন অধিকারীনী আসবে যে আমার ঘরে! তাহলে আমার মনের গহীনে গাঁথা কষ্টগুলো কীভাবে দূর করবো বলতে পারো? এই দূর্বিষহ মনের নতুন করে বিধ্বস্ত হওয়ার পথে ধাবিত হওয়াটা কী করে আটকাতে পারবো জানা আছে কী তোমার? জানো তানহা, খুব ইচ্ছে ছিল তোমার স্মৃতিগুলো নিয়েই জীবন পার করে দেবার। কিন্তু আমার সুখ যে কারো সইছে না তাইতো আমার জীবনে নতুন চ্যাপ্টারের হাঁড়ি খুলে দিয়েছে। ”
এমন সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে তিহান চুপসে গেল। যদি কেউ তানহার ছবিগুলো দেখে ফেলে সেই ভয়ে! তাড়াহুড়ো করে ছবিগুলো আলমারির ড্রয়ারে রাখতেই একটা ছবি হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে যায়। তিহান সেদিকে লক্ষ না করে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলতেই হা হয়ে যায়! দরজার অপর পাশের মানুষটিকে যে তিহান একেবারেই আশা করেনি এই নির্জন রাতে। তাইতো মানুষটিকে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে নিজেই দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে হা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এদিকে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তানহা হাঁপাতে হাঁপাতে তিহানকে বলল,
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here